আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আস্থার সঙ্কটে পাবলিক সার্ভিস কমিশন

আস্থার সঙ্কটে পাবলিক সার্ভিস কমিশন এম মামুন হোসেন আস্থা সঙ্কটে পড়েছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। বারবার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সর্বশেষ ৩৩তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস এবং তড়িঘড়ি পরীক্ষা স্থগিত করা নিয়ে নতুন সঙ্কট তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. সা'দত হুসাইন 'পিএসসি নখদন্তহীন' প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, রাষ্ট্র পরিচালনায় কর্মকর্তা নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ায় প্রশাসনে মেধাহীনদের প্রবেশের সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে।

সংবিধানের ১৩৭ ধারা অনুযায়ী সরকারি কর্ম কমিশন গঠন করা হয়। প্রতিষ্ঠানটি সাংবিধানিকভাবে দেশের প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড কর্মকর্তা নিয়োগসহ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা নিয়োগদানে পরীক্ষা গ্রহণ, নিয়োগ সুপারিশ ও পদোন্নতি-সংক্রান্ত সব কর্মকা- পরিচালনা করে। বর্তমান পিএসসির চেয়ারম্যান আহমেদুল হক চৌধুরীর আমলে বেশ কয়েকটি প্রতিযোগিতামূলক নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। এরমধ্যে থানা শিক্ষা কর্মকর্তা, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও সাব-রেজিস্ট্রার পদের নিয়োগ পরীক্ষা। প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ নিয়েই চলতি বছরের ২১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয় সহকারী থানা শিক্ষা কর্মকর্তা (এটিইও) নিয়োগ পরীক্ষা।

তবে প্রতিবার পিএসসি কর্তৃপক্ষ জোর দিয়ে এই অভিযোগ অস্বীকার করে। সর্বশেষ ৩৩তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষার প্রশ্ন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে পিএসসি পরীক্ষার্থীদের 'গুজবে কান দেবেন না' বলে সর্তক করে দেয়। শেষ পর্যন্ত কমিশন নিজেই 'গুজবে কান দিয়ে' একদিন আগে ছুটির দিন হঠাৎ বৈঠক করে পরীক্ষা স্থগিতের ঘোষণা দেয়। ৩৩তম বিসিএসের আবশ্যিক ৯টি বিষয়ের সবগুলো সেট ফাঁস হয়ে যায়। সব সেটের প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ায় বিকল্প সেটের মাধ্যমেও পরীক্ষা নেয়ার কোনো সুযোগ ছিল না।

৪ হাজার ২০৬টি শূন্যপদে নিয়োগের জন্য গত ২৯ ফেব্রুয়ারি ৩৩তম বিসিএসের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। গত ১ জুন প্রাথমিক বাছাই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পৌনে ২ লাখের বেশি পরীক্ষার্থী এতে অংশ নেন। গত ২৮ জুন প্রাথমিক বাছাই পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। এতে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ২৮ হাজার ১৬২।

মোট পরীক্ষাকেন্দ্র ২৬টি। পিএসসি বিভিন্ন সময় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ অস্বীকার করে এবং দায় এড়াতে বিভিন্ন যুক্তি দেখায়। তবে ঘটনা তদন্তে তেমন কোনো তোড়জোড় দেখায় না। এক সময় বিষয়টি চেপে যেতে কর্তৃপক্ষ যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যায়। অতীতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে সব সময় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নাম জড়িত ছিল।

এবারো অভিযোগের তীর ছাত্রলীগ, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নেতাদের দিকে। বিভিন্ন সরকারের সময় কমিশনকে রাজনীতিকরণের অভিযোগ ওঠেছে। বর্তমান কমিশনও রাজনীতিকরণের দোষে দুষ্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষার্থী জানান, ৩৩তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষায় যারা অংশ নেবেন, তাদের বলা হয়, ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা দিলে পরীক্ষার দুই-এক দিন আগে সব প্রশ্নপত্র পাওয়া যাবে। বাস্তবেও ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা দিলেই মিলেছে ৯টি বিষয়ের প্রশ্নপত্র।

প্রতিটি বিষয়ের ৪-৫ সেট প্রশ্নপত্র পরীক্ষার্থীকে দেয়ার কথা শোনা যায়। তবে কোন প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা হবে, তা পরীক্ষার আগের রাতে নিশ্চিত করার আশ্বাসও দেয়া হয়। এ প্রসঙ্গে ৩৩তম বিসিএস পরীক্ষার এক প্রার্থী জানান, যত মেধাবীই হোক আগে প্রশ্ন পাওয়া পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অন্যদের টিকে থাকা সম্ভব নয়। পিএসসি সূত্রে জানা গেছে, জুন মাসে ৩৩তম বিসিএসের প্রাথমিক বাছাই পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়। এরপর জুলাই মাসে লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরির কাজ শুরু হয়।

৯টি আবশ্যিক বিষয়ের প্রশ্নপত্রসহ মোট ৪৬টি বিষয়ের প্রশ্নপত্র তৈরি করে। একেকটি বিষয়ের জন্য ৮ জন প্রশ্নকারক ৮টি প্রশ্ন তৈরি করেন। এরপর ওই প্রশ্নপত্র তারা খামে ঢুকিয়ে সিলগালা করে চারপাশে তাদের স্বাক্ষর করে গেছেন। এরপর ৪ জন নিরীক্ষক এসে সেই খাম খুলেছেন। একেকজন নিরীক্ষককে দুইটি করে প্রশ্নপত্র দেয়া হয়েছে।

তারা সেই দুইটি প্রশ্নপত্র সমন্বয় করে একটি প্রশ্নপত্র তৈরি করেছেন। নিরীক্ষকরাও একইভাবে খাম সিলগালা করে স্বাক্ষর করেছেন। পিএসসির কর্মকর্তারা বলছেন, এভাবে একেকটি বিষয়ের জন্য ৪ সেট প্রশ্নপত্র চূড়ান্ত করে হাতে লেখা প্রশ্নপত্র মুদ্রণ ও ছাপার জন্য পাঠানো হয়েছে বিজি প্রেসে। বিজি প্রেসে প্রশ্নপত্র মুদ্রণ ও ছাপা শেষে আবার সিলগালা করে পাঠানো হয়েছে পিএসসিতে। এখনো সিলগালা অবস্থায়ই এই প্রশ্নপত্র পিএসসিতে আছে।

এ প্রসঙ্গে পিএসসির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ক্যাডার) আ, ই, নেছার উদ্দিন যায়যায়দিনকে বলেন, তারা এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সবাইর সহযোগিতা কামনা করছেন। আশা করেন, এখান থেকে তারা সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারবেন। প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনার পুনরাবৃত্তি আবারো হতে পারে কি না_এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সময় বলে দেবে। তবে তারা সবাইর কাছে প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ চেয়েছেন। তবে এখনো কেউ কোনো প্রমাণপত্র নিয়ে আসেননি।

কেউ চাইলে ডাকযোগে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পাঠাতে পারেন। প্রসঙ্গত বিসিএস ছাড়াও অন্তত শতাধিকবার বিভিন্ন নিয়োগ, ভর্তি পরীক্ষা ও পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। এরমধ্যে মাধ্যমিকের শিক্ষক নিয়োগ, খাদ্য অধিদপ্তরের সহকারী খাদ্য উপ-পরিদর্শক, ঢাকা ওয়াসার সহকারী প্রকৌশলী, খাদ্য বিভাগের তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক, সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও অগ্রণী ব্যাংকসহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেও মূল হোতারা সব সময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকেছেন। দেশে প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রথম আলোচিত ঘটনা ঘটে ১৯৭৯ সালের এসএসসি পরীক্ষায়। এরপরও এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাসের ঘটনা ঘটে ১৯৯১ ও ১৯৯৭ সালে।

কিন্তু তখনো কারো কোনো শাস্তি হয়নি। ১৯৯৯ সালের এসএসসি পরীক্ষার আগে ভোলার একটি কেন্দ্র থেকে ইংরেজি দ্বিতীয়পত্র পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় পরীক্ষা বাতিল করে গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। কিন্তু কারো শাস্তি হয়নি। দেশের নিয়োগ পরীক্ষার বিভিন্ন প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা শুরু হয় ২০০৩ সাল থেকে।

ওই বছর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা, ডিগ্রি পরীক্ষা, সমবায় অধিদপ্তরের পরিদর্শক নিয়োগ পরীক্ষা, সাব-রেজিস্ট্রার পদে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা এবং পুলিশের এসআই নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটে। ২০০৪ সালে এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র, ২০০৫ সালে ২৫তম বিসিএসের লিখিত এবং ২৭তম বিসিএসের প্রাথমিক বাছাই পরীক্ষার প্রশ্নপত্রসহ একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে থাকে। ২০১০ সালের জুলাইয়ে মাধ্যমিকের প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার পর সারা দেশে আলোচনার ঝড় ওঠে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। এর আগে গত ২৯ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের নার্সিং ইউনিটের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে।

সূত্র: যায়যায়দিন (Click This Link) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.