আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাতারগুল - জল সবুজের ছায়া ।

অবারিত বাঙলার রূপ দেখে অনেক কবি পাতার পর পাতা কবিতা লিখেছেন, উপন্যাসিকেরা লিখেছেন গল্প, উপন্যাস। আমি এদের মাঝে কোনটি নই। বাংলার রূপ , রস, সুধা পানের জন্য মাঝে মাঝে পা চিড়বিড় করে, ২ বা ৩ মাস অন্তর পাহাড়, সাগর, জঙ্গল না দেখলে পেটের ভাত হজম হয়না । এরই পরিক্রমায় গেল ঈদের পর পরই সেন্ট মার্টিন, কক্স বাজার, সুনামগঞ্জ- টাঙ্গুয়ার হাওড় ঘুরে সপ্তাহ তিনেক আগে ঘুরে এলাম শ্রীমঙ্গল- মাধবপুর লেক, লাউয়াছড়া উদ্যান ; এরপর আমার জন্য পুরো নতুন জায়গা- রাতারগুল বন, সিলেট । দৈনিক প্রথম আলোতে , রাতারগুলের ব্যাপারে মোটামুটি জানতে পারলেও ছাপার কালি আর কিছু রঙ্গিন ছবি দেখে তো আর মন ভরেনা।

যাই হোক, সঙ্গী খুঁজতে লাগলাম, পেয়ে গেলাম দুই চিকিৎসক বন্ধু কে- শফিক আর মাজেদ । তো যাওয়া যাক, রাতারগুল ( RATARGUL SWAMP FOREST ) । ঢাকার উত্তরা, এনা পরিবহনের বাস কাউন্টার থেকে কোন এক বৃহস্পতিবার রাত ১১:৩০ মিঃ এর টিকেট কেটে ফেললাম, এরপর সময় মত বাসে উঠে রওয়ানা সিলেটের পথে, মনে তখন নতুন আবিষ্কারের উত্তেজনা ! সময়, ভোর পাঁচ টা, শুক্রবার; আমরা সিলেট বাস টার্মিনাল এ। পার্শ্ববর্তী কোন এক হোটেলে ঢুকে কিছুটা ঘসা মাজা হয়ে , নাস্তা করে বেড়িয়ে পরলাম খাঁচার উদ্দেশ্যে ( সি এন জি ), একটা ঠিক করলাম গোয়াইন ঘাট বাজার পর্যন্ত, পথে পরল হযরত শাহ- পরান ( রাঃ ) এর মাজার, সেখান থেকে আমাদের সাথে যোগ দিলেন মাজেদের দুলাভাই, বড়ই অমায়িক আর মজার মানুষ, সঙ্গে এলেন সুক্কুর ভাই- যিনি প্রায় দেড় যুগ কাজ করেছেন বিট এ। মাজার হতে জাফ্লং এর রাস্তায় চলতে লাগল আমাদের তিন চাকার বাহন।

পথের এক পাশে পড়ল ছোট বড় ধান ক্ষেত, আর সবুজ। আরেক পাঁশে সারি নদীর শাখা- লালাখাল; শ্যাওলা সবুজ পানির ধারা, চা বাগানের টিলা, আর দূরবর্তী মেঘালয়ের ছায়া। সময়, সকাল সাড়ে ৯ টা ( আনুমানিক ), আমরা গোওয়াইন ঘাট বাজারে, মাঝে সি এন জি নষ্ট হওয়াতে ৩০ মিনিট নষ্ট। বাজার হতে রিক্সা নিয়ে ঘাটে পৌছলাম, সেখান দাম দর করে একটা ট্রলার ভাড়া করে আমরা ৫ জন ও এক মাঝি সহ - এক নতুনের সন্ধানে যাত্রা শুরু করলাম। প্রায় দেড় ঘণ্টা সারি নদীর বুকে অসাধারণ একটা ভ্রমণ হল।

পুরো ছবির মত দু ধারের দৃশ্যপট কল্পনার রাজ্যেই বোধহয় দেখা যায়। এর মাঝে মেঘলা আকাশ যেন আমাদের দেখে দিল ফিক করে হেসে, যদিও ছাতা নিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু চাইনি আকাশের হাসি দূর করতে। ছই ওলা ট্রলারের উপর আয়েস করে বসে, ঝাপসা বৃষ্টিতে, উদাসী মনে; দু ধারের মাঝিদের জাল দিয়ে মাছ ধরা, দস্যি ছেলেদের জলকেলি, গ্রাম্য বউ এর ছাগল গরু নিয়ে ত্রস্ত ঘরে ফেরার তাড়া, আর পানিতে বৃষ্টির ঝুপুর ঝুপুর শব্দ- অসাধারন, অসাধারন। একটা সর্বাধুনিক ডিজিটাল ক্যামেরা দিয়েও এই সৌন্দর্য যেন তোলার নয়। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক পর আমরা পৌঁছলাম রাতারগুল বিট অফিসে, যদিও অফিস টা কোথায় খুঁজে পেলাম না, প্রয়োজনও ছিলনা।

আমাদের ট্রলার টা ভিড়ল বনের কিনারে একটা আইলের মত জায়গায়। ঠিক ছিল আমরা না আসা পর্যন্ত ট্রলার আমাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। আমরা ৫ জন মিলে আইল পার হয়ে , দরদাম করে একটা ছোট ডিঙ্গি নৌকা ঠিক করে তাতে চেপে বসলাম। পলকা নৌকা , মাঝি দু জন। বড় জনের নাম মনে নেই, ছোট জনের নাম শাহাদত।

এদিকে আরও দু এক টা ভ্রমণ পিয়াসি ট্রলার ধারী মানব কুলের দেখা পেয়াছি, বুঝলাম বন্ধের দিন বলে আস্তে আস্তে ভীর বাড়তে থাকবে। আমাদের ডিঙ্গি চলতে লাগল বনের উদ্দেশ্যে, এবার কল্পনা করুন আপনি যেন চলছেন একাকী আমাজনের গভীর বনে, আশে পাঁশে ঝি ঝির তীব্র ডাক, চিলের চইই চিই, আর মাঝে মাঝে বানরের হুপ হাঁপ শব্দ। দূরবর্তী কোন অজানা পাখির কিন্নরী আওয়াজ। চলেছেন আপনি এক যেন ভাসমান বনের মাঝ দিয়ে, চারপাশে মাঝে মাঝে শাপলা সালুক আবার মাঝে মাঝে কোন নাম না জানা জংলা লতার মাঝ দিয়ে। এবার আরেকটু গভীরে, আপনার ডিঙ্গির চারপাশে বড় বড় শত শত নাম না জানা উঁচু বৃক্ষরাজি, একটু নীরব পরিবেশ, কিংবা হটাত করে কোন এক নাম না জানা পাখির হুসস করে উড়ে গিয়ে চমক ভাঙ্গানোর প্রক্রিয়া ! হটাত সুরু হল আবার বৃষ্টি - ঝুপ ঝুপ অবিরাম, যদি ভাগ্যে থাকে , হয়ত দেখবেন খয়েরি বা সবুজ সর্প বাবাজি গাছের ডালে লটকে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছে ! এর মাঝে পাবেন বুনো মাকড়শার উৎপাত, এগুলো বেশ সুড়সুড়ি দিবে আপনাকে, বনের এক ডাল হতে আরেক ডালে এদের বিস্তৃত জাল ভেঙ্গে আপনি এগিয়ে গেলে তারা তো তাই করবে ! উঁচু সব গাছের পানিতে পড়ন্ত ছায়া আর তাদের সবুজ রঙ আপনার চোখে ধান্দা লাগাবে নিশ্চিত।

প্রায় দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা ঘুরাঘুরির পর যখন আবার ট্রলারের কাছে ফিরে এলাম তখন যেন এক কল্পনার রাজ্য থেকে কেও টেনে নিয়ে এল। ততক্ষণে একটু একটু করে ভিড় বাড়ছে পর্যটকদের । ডিঙ্গিওলার ভাড়া বুঝিয়ে দিয়ে আবার ট্রলার যাত্রা। এবার যাত্রা সালুটিকর ঘাটের উদ্দ্যেশে, প্রায় ৩০ মিনিট পর পৌওছালাম ঘাটে; এখান থেকে অম্বরখানা পার হয়ে মাজেদের বোনের বাসায় দুপুরের খাওয়া। পথে পড়ল এয়ারপোর্ট, বাংলাদেশের প্রথম চা বাগান মালনিছড়া টি এস্টেট।

বিকেলের দিকে হযরত শাহ পরান ( রাঃ) ও হযরত শাহ জালাল ( রাঃ) এর মাজার জিয়ারত করে , সিলেটের ঐতিহ্যবাহী সাতকড়া কিনে রাতের খাবার উদ্দেশে আবার মাজেদের বোনের বাড়ি, যাই হোক আমরা জ্বালিয়েছি আচ্ছামত আপাকে। এরপর পূর্বেই বুকিং দেয়া রাত ১১ টার এনা পরিবহনের বাস কাউন্টারের দিকে যাত্রা। তারপর আরকি ঢাকা, ঢাকা, ঢাকা। কিভাবে যাবেন রাতারগুল - ট্রেনে করে গেলে কমপক্ষে ৩ দিন আগে টিকেট কেটে রাখবেন, ঢাকার কমলাপুর বা এয়ারপোর্ট স্টেশন থেকে কাটলে ভাল হয়। আর বাসে গেলে ঢাকার সায়েদাবাদ ( শ্যামলী, হানিফ, এনা, আল বারাকা পরিবহন ) বা মহাখালী/ উত্তরার এনা পরিবহনের টিকেট কাটবেন ( রাতের বাস ধরবেন ১১ টা বা ১২ টার ) ; ঢাকা টু সিলেট, সময়- ৫ ঘণ্টা, ভাড়া- বাসে ৪৫০ থেকে ৭৫০ ( এ সি ), ট্রেনে ২০০ থেকে আনুমানিক ১০০০ টাকা।

বাসে বা ট্রেনে যেটাতেই যান পরদিন রাতের ফিরতি টিকেট বুক করে বা কেটে রাখলে সুবিধে। ভোরে সিলেট রেল স্টেশন বা বাস টার্মিনাল নেমে ফ্রেশ হয়ে সি এন জি ঠিক করবেন গোয়াইন ঘাট বাজার পর্যন্ত, সময়- ২ থেকে ২ ঘণ্টা ৩০ মি । ভাড়া- ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। বাজার থেকে ১০ টাকা রিক্সা ভাড়া দিয়ে ১৫ মি পর পৌঁছলেন ঘাটে। ভাল ভাবে দর কষা কষি করে একটা ট্রলার ঠিক করবেন রাতারগুল হয়ে সালুটিকর ঘাট পর্যন্ত।

ভাড়া- ৮৫০ থেকে ৯০০ টাকা। সময়- ১.৩০ - ১.৪৫ ঘণ্টা ( রাতারগুল পর্যন্ত )। রাতারগুল বিটে নেমে একটা ডিঙ্গি নৌকা ঠিক করবেন বন ঘুরে দেখার জন্য। সময় - ২ থেকে ৩ ঘণ্টা ( মর্জির উপর ), ভাড়া- ৩০০- ৩৫০ টাকা। আবার ডিঙ্গি করে ট্রলারের কাছে ফিরে এলে , এতে করে পথ ধরবেন শালুটিকর ঘাটের পানে।

শালুটিকর ঘাট থেকে একটা সি এন জি নিয়ে চলে যাবেন সিলেট শহরে । সময় - ১.৩০ ঘণ্টা। ভাড়া- ২৫০- ৩০০ টাকা। ( আপনি চাইলে ট্রলারে করে শালুটিকর ঘাটে না এসে পুনরায় গোয়াইন ঘাট নামতে পারেন ও আগের মত ফিরতি পথ ধরবেন। ) বিকেলে সিলেটে এসে ফ্রেশ হয়ে, চাইলে মাজার জিয়ারত করতে পারেন বা সিলেটের কিছু দর্শনীয় স্থানের খোজ করতে পারেন।

......... এরপর রাতের বাস বা ট্রেন ধরে ঢাকা । রাতারগুল যাবার উপযুক্ত সময় হল মধ্য জুন থেকে সেপ্টেম্বর, কিন্তু অক্টোবরে , বনে পানি আছে কিনা বা সিলেটে বৃষ্টি বাদলের কি অবস্থা খোজ নিয়ে যাত্রা করা ভাল। যা যা সঙ্গে নিতে ভুলবেন না : ১। যাবার জন্য প্লান। ২।

কয়েক জন ভাল বন্ধু। ৩। ছাতা, সানগ্লাস, সান স্ক্রিম, ক্যাপ, হাফ প্যান্ট বা থ্রি কোয়ার্টার,হাল্কা নাস্তা বা প্যাকেট লাঞ্চ, খাবার পানি। ৪। প্রচুর পরিমানে প্রানশক্তি আর মজা করার মান্সিকতা।

সবাইকে ধন্যবাদ। .................. আদনান .................. ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.