আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্মৃতির জানালায় ১৯৯৭ ও একটি আষাঢ়ে গল্প

!! এ শিকল ছিড়ব আমি কেমন করে!! পড়াশুনা শেষ করে দেশের আর আট দশজন ছেলে-মেয়ের মত যুদ্ধ করেই আমার জীবন কেটেছে। চাকুরীর আবেদন, প্রিপারেশন, ইন্টার্ভিউ এভাবেই কেটেছে দিনের পর দিন। যে চাকুরীর জন্য আবেদন করি প্রায় চাকুরীর জন্যই ঘুষ চাই। আমার কাছে তেমন কোন টাকা নেই যে ঘুষ দিয়ে একটি চাকুরী নিব। তাছাড়া পরিবারের বাঁধন হারা হয়েছি সেই কবে।

তাই এখন সেই রাস্তাটাও বন্ধ। আমার জীবনের অনেক সীমাহীন যন্ত্রণার মাঝেও ভাল ভাবে বাঁচার হাল ছেড়ে দিইনি। আমি সব সময়ই খুব আশাবাদী, স্বপ্ন-বাদী মানুষ। অল্পতেই যুদ্ধে হেরে যেতে রাজি নই। তাই ভাবলাম চাকুরী হওয়ার আগ পর্যন্ত তো কিছু তো একটা করতে হবে।

জীবন সাঁজাতে না পারি জীবন বাঁচাতে তো হবে। আর যেনতেন করে তো জীবন বাঁচানো যাবে না। একদিন গুলশানে ধানসিঁড়ি রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাবার খাচ্ছি। এমন সময় আমার এক বন্ধু বলল, আমাদের বসের বাসায় একটি ল্যান্ড লাইন লাগবে। সদ্য বিবাহিত কোরিয়ান বস মি. ইয়ুন, হেয়সং সোয়েটার ফ্যাক্টরির মালিক।

টিএন্ডটিতে আমার একজন পরিচিত কর্তাব্যক্তি আছেন। বিশ হাজার টাকা খরচায় চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই বন্ধুর বসের জন্য একটি ল্যান্ড টেলিফোনের ব্যবস্থা করে দিলাম। মি. ইয়ুন দারুণ খুশী। এত দ্রুত টিএন্ডটি ল্যান্ড টেলিফোন! তিনি এতই খুশী যে বন্ধূকে বললেন আমি যেন তাঁর সাথে দেখা করি। আমি মি. ইয়ুনের দক্ষিণ খানের হেয়সং সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে দেখা করতে গেলাম।

কোরিয়ান ভদ্রলোক আমাকে বেশ আপ্যায়ন করলেন। বেশ কিছুক্ষণ কথাও হল। আসার সময় পঁচিশ হাজার টাকার একটি চেক ধরিয়ে দিলেন। আমি চেকটি দেখে বললাম, তুমি এখানে পাঁচ হাজার টাকা বেশী লিখেছ। সে একটি হাসি দিয়ে বলল, বেশীটা তোমার গিফট।

এত তাড়াতাড়ি যে আমি একটি টেলিফোন পেতে পারি ভাবতেই পারিনি। আর তুমি তো জান আমি কিছুদিন আগে বিয়ে করেছি। বউটা ঘরে একা একা থাকে এখন দুই মিনিট পর পর কথা বলতে পারি। এটা টাকা দিয়ে কি পাওয়া যাবে। আমি বললাম, না তা যাবে না।

কিন্তু এই জন্য আমাকে কোন গিফট দিতে হবে না। তুমি এই চেকটা ফেরত নিয়ে বিশ হাজার টাকার চেক দাও। সে তো নিবে না আমিও ছাড়ব না। শেষ পর্যন্ত সে আমার কাছে পরাজয় মেনে বিশ করে আরেকটি চেক দিল। কিছুদিন পর আমার বন্ধু বলল, মি. ইয়ুন তোর ব্যবহারে খুব খুশী।

তোর জন্য একটি লাঞ্চ পার্টির ব্যবস্থা করেছেন। কথা শুনে বেশ ভাল লাগল। আমি কোথায় খেতে চাই সেখানেই তিনি আমাকে আপ্যায়ন করবেন। লাঞ্চ পার্টিতে অনেক কথাই হল। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, সেদিন তুমি তো আমার গিফট একসেপ্ট করনি বল আমি তোমার জন্য আমি কি করতে পারি? তুমি কি চাও বল? আমি বললাম, দেখ আমি তোমার দেশে ঘুরতে যেতে চাই।

তোমার দেশে যেতে হলে বাংলাদেশীদের জন্য কোন ভিসা লাগেনা। তোমার দেশে যেতে আমাদের জন্য পোর্ট এন্ট্রি। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই এয়ারপোর্ট থেকে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। আমার এলাকার অনেক পরিচিত বন্ধুরা এভাবে কয়েকবার ফেরত এসেছে। তুমি যদি আমাকে কিছু দিতেই চাও তাহলে আমাকে একটি ভিসার ব্যবস্থা করে দিতে পার।

কথার ছলেই বিষয়টা উপস্থাপন করলাম। কিন্তু সে বলল, তোমার সঙ্গে কি পাসপোর্টটা আছে? আমি বললাম, হ্যাঁ পাসপোর্ট আমার সাথেই আছে। পাসপোর্টটা তাঁর হাতে দিতেই বলল, তোমরা একটু বস আমি আসছি, বলেই খুব দ্রুত বেড়িয়ে গেল। ঘণ্টা খানিকের মধ্যে ফিরে এসে বলল, এই নাও তোমার পাসপোর্ট। এরপর যদি ভিসার দরকার হয় তাহলে সরাসরি এমবাসিতে চলে যাবে।

সেখানে সরকার নামে একজন ভদ্রলোক আছেন। তোমার কথা বলা আছে, আমার দেশে যাওয়ার জন্য তোমার ভিসার সমস্যা হবে না। পরে জেনেছিলাম এখানকার ভিসা অফিসার মি. ইয়ুনের ছেলেবেলার বন্ধু। দুদিন পর আমার বন্ধুটি বলল, মি. ইয়ুন আমাকে দেখা করতে বলেছেন। আমি ওঁর অফিসে গিয়ে দেখা করলাম।

কুশল বিনিময়ের পর হাসিহাসি মুখে বললেন, কোরিয়া কবে যাচ্ছ? আমি কিছু বলার আগেই বলল, আমার বউ আগামী সপ্তাহে দেশে যাচ্ছে। তুমি চাইলে তাঁর সাথে যেতে পার। আমি বললাম, না আমি এখনও তৈরি হইনি। আমার নামটা নিয়ে বলল টিকিট রেডি থাকবে, সে বলল তৈরি হয়ে নাও। পরদিন আমাকে টিকিট দিয়ে আমার বন্ধু বলল you’re so lucky man।

কোরিয়ানরা সচরাচর এত ভাল হয়না। অনেকদিন ওদের সাথে আছি, কোরিয়ানরা হাড়ে হাড়ে বজ্জাত। তোর সাথে অন্য রকম ব্যবহার করছে। আমি একটু হাসি দিয়ে বললাম, সব আল্লাহ্‌র ইচ্ছে। ঢাকা এয়ারপোর্টে পৌঁছানোর কিছুক্ষণ আগে জেনেছি মি. ইয়ুন সাহেবের বউ আজ যাচ্ছেন না।

হঠাৎ বাথরুমে পিছলে পরে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছেন। মি. ইয়ুন বলেছেন আমি যেন চলে যাই। আমি তো মহা বিপত্তিতে পড়লাম। একা একা কোরিয়া সফর। কেমন হবে কে জানে।

শুনেছি ওঁরা ইংরেজিতে তেমন কথা বলতে পারেনা। ভাষা না জানলে ওখানে গিয়ে কি হবে। কিন্তু ফেরার তো আর পথ নেই। আর তাছাড়া অনেকদিন যাবতই ভাবছি ঐ দেশটাতে ঘুরতে যেতে পাড়লে যাব। তাই দুশ্চিন্তা না করে উড়োজাহাজে উঠে বসলাম।

ঢাকা-সিঙ্গাপুর হয়ে দক্ষিণ-কোরিয়ার সউলে ঘুরে এলাম। সেই প্রথম ভ্রমণেই আকস্মিক ভাবে চন্দন আর হাবিল ভাইয়ের সাথে পরিচয় হয়। তারপর আরও অনেকের সাথে পরিচয় হয়েছে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিপ্লব, বিপ্লব ভাই। চন্দন, বিপ্লব ও আমি মিলে যৌথ ভাবে গোল্ডেন-ডাস্ট নামে গার্মেন্টস, টয়, লাইটিং এবং অফিস এক্সোসরিসের একটি ব্যবসা শুরু করে দিলাম।

পরবর্তীতে আরও বেশ কিছু আইটেম নিয়ে গুলশানে আমাদের বিজনেসের একটি শাখা অফিস উদ্বোধন করলাম। ধীরে ধীরে আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আশার আলো দেখতে শুরু করেছে। কিন্তু বড় মূলধনের অভাবে অনেক ব্যবসায়ীক কর্মকাণ্ড স্থগিত রাখতে হয়েছে। এরই মধ্যে আমাদের প্ল্যান হয়েছে কোরিয়ান-মার্ট নামে একটি আধুনিক ডিপার্টমেন্টাল স্টোর করা। অবশ্য পরবর্তীতে সেটা আর করা সম্ভব হয়নি।

এরই মধ্যে প্রায় দুই বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। গুলশানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আমি কাজও করছি। আর দক্ষিণ-কোরিয়ার বন্ধুদের সাথে টুকটাক বিজনেসটা তো আছেই। পার্টনারশিপের ব্যবসা, তাই সঠিক জবাব-দেহিতার অভাবে যা হয়। বিশ্বাসের ঘাটতি, তারপর সম্পর্কের অবনতি।

তাই আমাদের পার্টনারশিপের ব্যবসাটাও বেশিদূর এগোল না। নোয়া এরিয়ল চলে যাওয়ার পর চাকুরীতেও মনটা আর তেমন বসছে না। তাই ভাবছি অস্ট্রেলিয়াই চলে যাব। মাইগ্রেশন নিয়ে যেতে হলে এক বছরের আগে যাওয়া অসম্ভব। আমার যা মানসিকতা তাতে এতটা সময় অপেক্ষা করাও অসম্ভব।

তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে চলে যাব। তাছাড়া বন্ধুদের সাথে যে ব্যবসা শুরু করেছিলাম তাতে অবিশ্বাস দেখা দিয়েছে। ঠিকমত হিসেব-নিকাশ হচ্ছে না। হিসেব চাইলেও আজ দিব কাল দিব বলে ওরা গড়িমসি করছে। যে ধ্যান ও আদর্শ নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলাম তা থেকে ওরা বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছে।

আসল ব্যবসা থেকে নকল ব্যবসায় ইনভেস্ট বেশী হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে কোরিয়ার বন্ধুদের সাথে বিজনেসে আমার যে সম্পৃক্ততা সেটাও ধীরে ধীরে গুটিয়ে ফেলার চেষ্টা চলছিল।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।