আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শৈশবের শামিমা আপু ও কিছু স্মৃতি

আমি তাকিয়ে আছি তার চোখের দিকে, সেও তকিয়ে আছি কোনও পলক না ফেলে। এভাবে চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে কেমন যেন একটা ঘোর লাগা অনুভুতি হয়। ধীরে ধীরে চারপাশের আওয়াজ গুলো যেন স্তিমিত হয়ে আসে। শুধু দু জোড়া চোখ একে অপর কে ভেদ করে যেন আর এক জগতে নিয়ে যায়। সে জগতের কথা প্রকাশ করা যায় না শুধু অনুভব করতে হয়।

এ সময় একটা ভয় হয় এ চোখের পলক ফেললেই মনে হয় এ ভালোলাগা শেষ হয়ে যাবে। মন তার সমস্ত শক্তি দিয়ে তখন এ আপাত প্রায় ভর হীন চোখের পাতাটিকে ধরে রাখতে চেষ্টা করে। আমাদের এ চোখে চোখ রেখে চেয়ে থাকা, আমাদের তৈরি উদ্ভট খেলা গুলোর একটি। যার শর্ত হল চোখের পলক না ফেলে চোখের দিকে চেয়ে থাকতে হবে। অসাধারন ভালোলাগার এক অনুভূতি হলেও একে ধরে রাখা যায় না ।

এক সময় চোখ এত ভারী হয় যে মনে হয় মনের ভালোলাগার অনুভূতি গুলোই ভর হয়ে ভর করেছে চোখের পাতায়। এ খেলায় আর অনেকের সাথে পেরে উঠলেও শামিমা আপুর কাছে আমার হার মানতেই হয়। অসাধারন তার এ পলক না এলে চেয়ে থাকার শক্তি। শামিমা আপু আর আমরা পাশাপাশি বাসায় থাকি। আমার থেকে চার বছর এর বড় উনি।

গোলগাল মুখটি তার। চোখদুটি তে যেন সবসময় এক মায়াময় জ্ঞানী জ্ঞানী ছায়া। শ্যামলা মুখের বা চোখের নিচে ছোট্ট একটা তিল। আর পড়া লেখায় মফস্বলে নাম ডাক অয়ালা ছাত্র ছাত্রী দের মাঝে অন্য তম। কারন সে শুধু লেখা পড়াই করে না অন্য দের মত, স্কাউটিং এ প্রায় প্রেসিডেন্ট পদক পাওয়ার কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন।

ছবি আঁকেন সুন্দর, কথা বলার ধরন এত ভালো যে উনি কোন আজগুবি কথা বললেও মনে হত বসে বসে শুনি। আমাদের পাশাপাশি আরো কয়েকটি বাসার আমাদের কাছা কাছি বয়সের ছেলে মেয়ে মিলে আমাদের একটা বেশ মজার পরিবেশ ছিল। সেই সময় শুধু একটা টেলিভিশন চ্যানেল এর যুগে আমরা কি যে মজা করতাম তা লেখার সাহস আমার নেই। লিখতে গেলে কলমও কেদে দিবে আর আমি যত বার ই মনে করতে গেছি তত বারই একা একা কেদেছি কখন কোন একটা কথা মনে করে পাগলের মত একা একা হেসেছি হাসতে হাসতে চোখে পানি চলে এসেছে। আসবে না বাই বা কেন সেই সোনা ঝরা দিন গুলো আর ফিরে পাবনা এ কষ্ট সহ্য করা যে খুবই কঠিন।

সবার মাঝে এ আপুটি কে আমি মনে রেখেছি অন্য রকম ভাবে। উনি যে শৈশবে অনেক ভালোলাগার অনেক ভালো কিছু মুহূর্ত আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। সেসব কিছু কিছু কথা লিখতেই আজ বসেছি। আষাঢ়ে দিন মান অন্ধকার করে বৃষ্টি নামত। স্কুল্গুলো অঘোষিত ছুটি।

বাড়ির খাবার এর মেনুতে অন্য সব কিছু কে সরিয়ে খিচুড়ি দখল করে নিয়েছে। সারাদিন জানালা ধরে বৃষ্টি দেখা বা একটু সাহস করে লুকিয়ে বৃষ্টিতে গোসল করা সব কিছুর পরেও যেন এ বৃষ্টির থামার নাম নেই। বিকালে খেলার সময় যখন বৃষ্টি থাকত তখন সবচেয়ে বেশি মন খারাপ হত। সে মন খারাপ করা সময় এর সঙ্গী হত আমার এ আপুটি। ঊঠনে বিছিয়ে দেয়া ইট গুলোকে পাশ কাটিয়ে মাথায় ছাতা দিয়ে পানিতে ছপ ছপ শব্দ তুলে আপুর বাসায় চলে যেতাম।

তাদের পাকা মেঝের টিনের বেড়া টিনের চালের বাড়িটির তার ঘর টি আমার কাছে খুব ভালোলাগত। ঘরটির বিছানার পাশে পড়ার টেবিল, একটি কাঠের চেয়ার তাতে নীল কভারে সাদা সুতয় ফুলতোলা একটি কভার। বিছানার পাশে বেতের র্যাাকে অসঙ্খ্য বই। ঘরের টিনের দেয়ালে কাঠের উপর পেরেক দিয়ে কয়েকটি ফুলতোলা চালুন। দুটি ক্যালেন্ডার।

বিছানায় মাথার পাশে জানালা টির উপরের অংশ খোলা নিচের পাশটা বন্ধ। মেঘলা দিন হওয়ায় এই বিকেলে ঘরের ভেতর টা বেশ আলো আধারি। তবে জানালার পাশে বই পড়তে কোন অসুবিধা হয় না। এ রকম পরিবেশে গায়ে একটা কাথা জরিয়ে শুয়ে শুয়ে বই পড়ার আলাদা মজা আছে। পড়তে পড়তে মনে হয় নতুন কোন জগতে নতুন কোন রহস্য ঘেরা এক পরিবেশ চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

আপুর রুমে ঢুকতেই তার কড়া হুকুম পা ধুয়ে আস ভালো করে। বাইরে থেকে চাল থেকে পরা পরিষ্কার পানিতে পা ধুয়ে এসে বিছানায় উঠি। কাথার ভিতর কোমর পর্যন্ত সেধিয়ে বসি বা পিঠে একটা বালিশ ঠেস দিয়ে বসি। তারপর আপু কখন কবিতা পড়ে শোনান, কখনও গল্প পড়ে শোনান। কখনো বা কোন অর্থ হীন খেলা।

আমি মুগ্ধ হয়ে শুনি সেসব। উনি যখন গল্প পড়ে শোনান তখন তার মুখে সেই আলো আধারির আলো পরে বেশ মায়াময় হয়ে থাকে। আমি গালে হাত দিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে শুনি। কোন কোন দিন বিকেলে বৃষ্টি একটু থামলেও মাঠে খেলার মত অবস্থা থাকে না। তখন আমরা পুরোন লেখার খাতার পাতা ছিড়ে নৌকা বানাই।

অনেক গুলো নৌকা একসাথে আমাদের বাসার পিছোনের মাঠের পুব পাশে নিচু জায়গাটিতে হাটু সমান পানি জমে যায়। সেখানে সেই পানিতে নেমে আমরা নৌকা গুল ভাসিয়ে দেই। এরপর পানিতে পা টেনেটেনে নৌকা গুলোকে পেছনে ঢেউ দিতে দিতে ভাসিয়ে নিয়ে যাই। অনেক গুলো নৌকা দেখতে কি যে ভালোলাগে! সবসময়ই তারপ্রতি অসম্ভব এক ভালোলাগা অনুভব করতাম। ভালোলাগার এখন কত ধরন, কত সংজ্ঞা কিন্তু শৈশবের সেই ভালোলাগার সাথে কোন কিছুরই তুলনা করা যায় না, তুলোনা করতে ইচ্ছাও করে না।

সেই ভাবেই নানা হাসি কান্না র মাঝে সোনা ঝরা দিন গুলো কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু এ সদা চলমান পৃথিবীতে কোন কিছুই স্থীর থাকে না। আপন নিয়মে বয়ে যায়। আমরা যত আবেগ দিয়ে ভালোলাগা দিয়ে চাইনা কেন তাকে থামিয়ে রাখতে পারব না। বড় এ নিষ্ঠুর এ সময় এর বয়ে চলা।

সেই ভাবে একদিন আপু রা তাদের ভাড়া বাসা ছেড়ে চলে যায় আর এক শহরে। চলে যাওয়ার কথা শোনার পরথেকে খুব মন খারাপ হতে থাকে। অবুঝ মন হাজার টা যুক্তি খোজে তাদের থেকে যাওয়ার, কিন্তু এ ছোট্ট মনের অর্থহীন চাওয়ার কোন দাম নেই এ পৃথীবিতে। যাওয়ার আগে আপু আমাকে তার পাথরকুচি গাছগুল, গোলাপের গাছ গুলো আর আমি যে বই গুলো পছন্দ করতাম সেগুলো আমাকে দিয়ে গেলেন। পাথর কুচি গাছ গুলো ঠাই পেলো আমার ছোট্ট বাগানটির মাঝে আর গোলাপ এর গাছ গুলো টবে লাগিয়ে বারান্দায় রেখে দিলাম।

এ গুল আমার এত আপন ছিল যে কেউ এগুলো কে স্পর্শ করলেও চেচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলতাম। ছোট ছোট লাল ফুলে যখন পাথরকুচি ঝারটা ভরে যেত তখন এত ভালোলাগত যে কি বলব। আর গোলাপ এর কলি থেকে শুরু করে ফুলফুটে সেগুলো শুকনো হয়ে ঝরে যাওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন আমি দেখতাম। মনে হত যেন এদের মাধ্যমেই আপু আমার সাথে কথা বলছেন। যেদিন তারা ছোট্ট ট্রাকটাতে করে মালপত্র বোঝাই করে চলে যাচ্ছিলেন সেদিন কিছুক্ষন ট্রাকের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করেছি।

আপু একবার ডেকে আমার মাথার চুল গুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললেন ভালো করে লেখা পড়া করবে। আমি মাথা নিচ করে পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে শুধু মাটি খুটেছি কছু বলতে পারিনি। গলায় কান্না নিয়ে কথা বলা যায় না। মনে হচ্ছিল তাকে জড়িয়ে ধরে বলি আপু তুমি জেও না। কিন্তু কিছুই বলা হল না।

শুধু সেখান থেকে ছুটে মাঠের কোনায় কাঠাল গাছটাতে উঠে কেঁদেছি অনেক অনেক কেঁদেছি। দুপুরে যখন নেমে এসেছি সেখান থেকে তখন বাড়িটি ফাকা। বাহির থেকে মনে হচ্ছিল এ বাড়ির জীবনটি যেন নেই। মৃত মানুষ এর মত সবই আছে শুধু হৃদ স্পন্দন নেই। ভেতরে ঢোকার সাহস আমার হয় নি।

সবার প্রতি অসম্ভন রাগে অবুঝ মন ভরে গিয়েছিল। কিন্তু তাতে এ বিশাল পৃথীবির কোন কিছুরই কোন ক্ষতি অয় নি। তারপর সময় অনেক গড়িয়েছে। স্কুল এর পেছনের বকুল গাছে অনেক বার ফুল ফুটেছে, কুড়োতে যাওয়া হয় নি। আপু যে নেই কে বসে বসে মালা গাঁথবে? পুকুরে শাপলা ফুটেছিল অনেক আগের মত গিয়ে সেগুল দেখা হয় নি মুগ্ধ হয়ে।

আপুই যে শিখিয়েছিল মুগ্ধ হতে। নাহ আর পারছি না। উনি যে আমার সবকিছু জুড়েই আছেন। সব কি লিখে শেষ করা যাবে? এদিকে চোখ ও বার বার ঝাপসা হয়ে আসছে। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।