আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শৈশবের কিছু কথা

ভালোবাসার ঊর্বশী বুকে লেখা আছে এক নাম- সে আমার দেশ, আলগ্ন সুন্দর ভূমি- বিমূর্ত অঙ্গনে প্রতিদিন প্রতিরাত জেগে ওঠে তার উদ্ভাসিত মুখ

সে এক ভীষণ দিন ছিলো আমার। বই হাতে স্কুলে যাওয়া, সারাদিন ছোটাছুটি, গাছে চড়ে ফল পাড়া, পাখির বাসায় ঢিল ছোড়া আরও কতো কী! খেলাধুলার মধ্যে ছিলো দাঁড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, মার্বেল, কুতকুত, ফুটবল এসব খেলা। সন্ধ্যাকালে কুপি বা হারিকেনের আলোয় কিছুক্ষণ পড়ালেখা করতাম। তারপর খেয়েদেয়ে বড়োদের কাছে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তাম। এরকম দিন গেছে আমার সারা শৈশববেলায়।

আমাদের বাড়িতে নিয়মিত গল্পের আসর বসতো। সারা গ্রাম থেকে গল্প বলার ও শোনার লোকজন জড়ো হতো আমাদের উঠানে। খড়, বিচালী, পাটখড়ি, মাদুর, চাটাই- যে যা পেতো সেখানে বসে পড়তো। আমরা ছোটোরা বাবা অথবা মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে শুয়ে গল্প শুনতাম। পাশের বাড়ির চাচা-চাচী, পাড়াতো ভাই-ভাবী অনেকেই আসতো।

পড়শি হিন্দু বাড়ির লোকজনও আসতো প্রচুর। পাগু মুন্সী, হাশেম খাঁ, ওয়াদুদ খাঁ, ইন্তাজ, গুপি, সতীশ মাস্টার এরকম কতো নামের মানুষ যে আসতো মনে নেই সবার নাম। গল্প বা কিসসা ছিলো মূল আকর্ষণ। আলাদিন, আলী বাবা ও চলি্লশ চোর, দাতা হাতেম তাই, সয়ফুল মুলুক বদিউজ্জামান, বানেছা পরী, ডালিমকুমার, বেহুলা-লক্ষিন্দর কতো যে গল্প-কিসসা হতো বলে শেষ করার মতো নয়। অনেক কিসসা-কাহিনীর নাম ভুলে গেছি আজ।

গল্প শুরু হতো বেশ রসিয়ে রসিয়ে। গল্পের সাথে চলতো পান-তামাক। মহিলারা ডালা ভরে পান সাজিয়ে রাখতো আর পুরুষরা সাজাতো হুক্কা। গল্প শুনতে শুনতে অনেকে কাঁদতো, অনেক সময় হেসে খুন হতো সবাই। হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়া বা চোখের জল মোছা ছিলো প্রতিরাতের স্বাভাবিক ঘটনা।

কিন্তু গল্প বলিয়ে লোক থাকতো অটল। তিনি কখনও নিজে হাসতেন বা কাঁদতেন না। অন্যকে কাঁদানো বা হাসানোই ছিলো যেন তার ব্রত। এ সুখময় শৈশবের স্মৃতির সময়টা ছিলো স্বাধীনতার আগের। আমাদের ছোট্ট পাড়ার সব মানুষের এ মিলনমেলা স্মৃতিতে আজও জীবন্ত আছে আমার।

তখনও স্কুলে ভর্তি হইনি। আমার সবচেয়ে বড়ো ভাই ছিলেন হাইস্কুলের শিক্ষক। বলা নেই কওয়া নেই 1971 সালে আমাদের গ্রামের সরকারী প্রাইমারিতে দ্বিতীয় শ্রেণীতে আমাকে ভর্তি করিয়ে দিলেন। আমার তো বেকায়দা অবস্থা- অক্ষরজ্ঞান পর্যন্ত নেই আমার। ক্লাসের সব ছেলেমেয়ে পড়া পারে, কিন্তু আমি কিচ্ছু পারি না।

শিক্ষকরা পড়া ধরলে শুধু কান্না করতাম। বানান করে বাংলা পর্যন্ত পড়তে পারতাম না, আর তো ইংরেজি, অংক! আমার অবস্থা খুব বেগতিক হয়ে গেলো। স্কুলে যেতে চাইতাম না। তবে শিক্ষকরা বড়ো ভাইকে চিনতেন বলে আমাকে খুব আদর করতেন। বলতেন, সব ঠিক হয়ে যাবে।

অবশেষে হাল ধরলেন বড়ো ভাই। বাড়িতে এক মাস একটানা আমাকে অরদান করলেন, ইংরেজি, অংক শেখালেন। পিছু ফিরে তাকাতে হলো না আর। তবে এই পূর্ণদ্যোমের পড়াশুনা বেশিদিন টেকেনি। শুরু হলো স্বাধীনতার সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ।

আমার আর দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়া হলো না। নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের শেষে বিজয়ের পরে অটোপ্রমোশনে সরাসরি উঠে গেলাম তৃতীয় শ্রেণীতে। স্বাধীনতার পরের দুটি বছর আমাদের বেশ ভালো কেটেছে। স্কুলে আমি খুব ভালো ছাত্র ছিলাম। সব সময় কাসে প্রথম হই।

শিক্ষকরা আমাকে সকল কাসের প্রথম স্থান অধিকারীদের মধ্যে সেরা ঘোষণা করতেন। কিন্তু আমি ফলাফল ঘোষণার দিন সাধারণত স্কুলে যেতাম না। গার্ডিয়ানরা বড়ো ভাইয়ের কাছে আমার কথা জিজ্ঞেস করতেন, দেখতে চাইতেন আমাকে। নিরুপায় হয়ে হাটবারের দিন বড়ো ভাই আমাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে হাটে নিয়ে এটা ওটা কিনে দিতেন। কোলে নিয়ে উঁচু করে হাটের মাঝে সকলকে দেখাতেন।

আমার লজ্জা লাগতো, আবার গর্বে বুক ফুলেও ওঠতো। আমার বড়ো ভাই বেশ সংস্কৃতিমনা ছিলেন। খেলাধুলায়ও বেশ উৎসাহ ছিলো তার। নিজে অভিনয় করতেন, নাটক পরিচালনা করতেন, ফুটবল টুর্নামেন্টে রেফারি করতেন। মনে পড়ে নাটকগুলোর নাম- নবাব সিরাজউদ্দৌলা, নবাব মীরকাশিম, পানিপথের যুদ্ধ, রূপবান, জংলী রাজা, রাজা হরিশ্চন্দ্র, প্রেমের সমাধি তীরে আরও কতো কী! নাটকগুলোর আগে স্টেজে পতাকা হাতে জাতীয় সংগীত পরিবেশন এবং মাঝে মাঝে দেশাত্মবোধক গান গাওয়া হতো।

নাটকের রিহার্সেলের সাথে আমরা ছোটরা গানের রিহার্সেলে যোগ দিতাম। তখন থেকেই আমার গান শেখার হাতেকড়ি এবং দেশের গানের প্রতি একটা দুর্বলতা চলে আসে। মনে পড়ে- এক সাগর রক্তের বিনিময়ে, সালাম সালাম হাজার সালাম, সোনা সোনা লোকে বলে সোনা, পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি এসব গান খুব সুন্দর করে গাইতাম আমরা। প্রশ্ন জাগে, আজকের প্রজন্ম শুনছে কী অমন গল্প অথবা প্রাণ খুলে গাইছে এমন দেশাত্মবোধক গান!? 01.04.2007

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।