আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছোটগল্পঃ কলঙ্কিত চাঁদ

বুড়ো মোকলেস তার একমাত্র নাতনী বছর এগারো-বারোর মজিলাকে নিয়ে গত চার বছরের মত করে আজো চরে যাচ্ছিল কাশ কাটতে। হেমন্তের শেষ অর্থাৎ শীতের প্রারম্ভটা কাশ কাটার উপযুক্ত সময়। শরৎকালে কাশের শীর্ষে সাদা সাদা ফুলের থোকা অপার্থিব সৌন্দর্য ছড়িয়ে বায়ুর হিল্লোলে দোল খেতে খেতে হেমন্তে এসে বুড়িয়ে যায়। হেমন্তে এসে অন্যসব গাছের মত কাশের বনও রুক্ষ-শুষ্ক হতে শুরু করলে চরবাসীরা তা কেটে নিতে শুরু করে। এ কাশ বিক্রি করে চরাঞ্চলের অধিবাসীদের দিনকতক স্বচ্ছন্দে চলার ব্যবস্থা হয়।

এছাড়া চরজীবনে এমনকি চরের বাইরে নদীর দু’ধারে ছড়ান-ছিটান গ্রাম্য জনজীবনে কাশের কদর বেশ। ঘর ছাইতে, বিছানার তলায় দিতে , বেড়া কিংবা ঝাড়ু তৈরিতে কাশের মত সহজলভ্য উপকরণ এ অঞ্চলে মেলা ভার। যমুনার পাড় নিবাসী মোকলেস তাই নাতনীকে ডিঙ্গিতে বসিয়ে নিজে ডিঙ্গিটা বেয়ে নিয়ে কাশ কাটার উদ্দেশ্যে গিয়ে ঢোকে নামহীন চরের গহীনে। এ চরটার কোন নাম নেই। মাত্র বছর কয়েক হল গজিয়ে উঠে দ্রুতবর্ধনশীল কুমারী দেহের মত নিজে নিজেই ফুলে ফেঁপে দারূণ হয়ে উঠেছে।

চরটা খুব বড় নয়; দেখতে বেশ ছিমছাম, অশ্বক্ষুরাকৃতির। চরের মাঝামাঝি একটা জায়গায় শ্রাবন-ভাদ্রে নদীর ভরাযৌবনের উতলা ক্ষণে কোন বিচিত্র কারণে জানি স্রোতেরা এসে এখানটাতে পাক খায়। সেই পাকের দরুণ বালি ক্ষয়ে গিয়ে এখানে অশ্বক্ষুরাকৃতির ভাঁজটা গড়ে উঠে স্থায়ী হয়ে আছে। এ ভাজেঁর মাঝে নৌকা ভেড়ালে দুপাশের কাশঝোপের মাঝে সেঁধিয়ে নৌকাটা এমন লুকিয়ে থাকে যে চরের অস্থায়ী অধিবাসী কিংবা নিয়মিত ঘাসকাটা অতিথিদের কারো চোখেই তা আর ধরা পড়েনা। এ চরে দু’য়েক ঘর মাত্র অস্থায়ী বাসিন্দা আছে।

বছর কয়েক আগে জেগে উঠা এ চরের উপর নজর বহুজনের থাকলেও ভরসা কারো নেই। শ্রাবন-ভাদ্রে চরের চারপাশে পানি যে মেজাজে ফুঁবতে থাকে তাতে করে এ চরের আয়ু নিয়ে অভিজ্ঞ নদীশিকস্তিরা বিশেষ কোন আশা পোষণ করতে সাহস করেনা বলেই এ চর এখনো জনবিরল। কাশেরা তাই এ নিরুপদ্রব চরে বংশবৃদ্ধি করে চলেছে ইচ্ছেমত। শরতের শেষে পড়পড় যৌবনা কাশগুচ্ছ আগন্তুক অতিথির দল কেটে নিয়ে যায় ঠিকই কিন্ত সমূলে কাশের বংশ কেউ উৎপাটিত করেনা। তাই কাশদের জীবন এখানে এখনো নিরাপদ।

কাশ কাটতে পুরো দিন ব্যয় করতে হলে জনবিরল দ্বীপসম এ চরে রওনা দেবার সময়েই দানাপানির ব্যবস্থাটা সাথে নিতে হয়। বুড়ো মোকলেসও তা নিয়ে থাকে। নাতনী মজিলা তার মায়ের সাথে হাত লাগিয়ে সকাল সকাল রুটি গড়ে কি খিঁচুড়ি রেধে তা গামলায় বেড়ে গামছায় বেঁধে নেয়। এরপর ডিংগি নিয়ে রওনা করে দাদা-নাতনী পুরো দিনমান লোকালয় থেকে উধাও। মজিলার মা মাজেদা বিবি শ্বশুর আর কন্যাকে সকালের নাস্তা করিয়ে দুপুরেরটা বেঁধে দিয়ে ডিঙ্গি ভাসা দেখতে দেখতে ছোটে গঞ্জের চাতালে।

সেখানে তার পুরো দিন কাটে, এমনকি সন্ধ্যাটাও। রাতের আঁধার নামলে ঘরে ফিরে সে প্রদীপ জ্বালে, প্রদীপে তেল না থাকলে সে চাঁদের আলোতেই একমুঠো ফুটিয়ে নেয়, আর চাদেঁর আলো অপর্যাপ্ত হলে উনুনের আলোতেও সে কাজ সারতে পারে। মজিলার বাপ তার জন্মের একবছরের মাথাতেই নিরুদ্দেশ- ঢাকায় গিয়ে কাজ খোঁজার নাম করে লোকটা একদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফেরেনি। মাজেদা এখন বিবি নাকি বেওয়া তাও ঠিকঠাক জানেনা। তবুও সে মেয়েটাকে বুকে করে পড়ে আছে শ্বশুরের দেড়কাঠার ভিটেয় দুইখোপের একখানা খোড়োচালের তলায়।

বুড়ো মোকলেসের কাছে আজকের দিনটা একটু অন্যরকম মনে হয়। আজ সে একজন সদ্য নারীত্বের জগতে পা রাখা নবীনা নারীকে নিয়ে চলছে কাশবনের নির্জন গহীনে। দিন সাতেক আগে তার নারীত্বের লক্ষণ প্রথম চোখে পড়ে মোকলেসের; এই নির্জন কাশছায়ে মুখোমুখি বসে চিড়ের পুটুলি খুলে ভাগাভাগি করে খাওয়ার সময়টাতে। মজিলা সেদিন অজ্ঞতাজনিত ভয় ও নারীসুলভ লজ্জ্বায় সে কী কান্না! সেদিন তড়িঘড়ি বাড়ি ফিরেও মোকলেসকে সেই বিড়ম্বনা একাই সামাল দিতে হয়েছিল। মজিলার মা গঞ্জ থেকে ফিরবে সে-ই রাতে।

প্রথম রজঃস্বলা অনভিজ্ঞ কিশোরীকে নিয়ে মোকলেস ততক্ষণ আর কী করে! অগত্যা নিজেই নাতনীকে বুঝায়। একটুখানি রসিকতারও চেষ্টা করে বুঝি। অবশেষে মজিলা সব বোঝে। সেই কোন ‘ন্যাংটাকাল’ থেকে সে এই দাদার কোলে-পিঠে তারই সহকারী-সহযোগী হিসেবে মানুষ হয়ে আজ এতটা বড় হয়েছে। সেই দাদার কাছে তার আর লজ্জ্বা কী! সাতদিন ঘরে বসে কাটিয়ে আজ মোকলেস ডিঙ্গি ভাসিয়েছে যমুনার প্রশস্ত-প্রশান্ত বুকে| ভরা ভাদ্রে ভরাযৌবনা যমুনা আগ্রাসী কামজ সুন্দরী- যার কটাক্ষ মানেই ধ্বংস আর মৃত্যু।

কিন্ত হেমন্তের শেষে যমুনার সে ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা সীমিত হয়ে পৌঢ়া নারীর পয়মন্তী রূপ ধারণ করে আপন মনে ধীর শান্ত গতিতে বয়ে চলে। আজকের যমুনার শান্ত বুকে অভিজ্ঞ মাপা হাকে বৈঠা মারতে মারতে মোকলেস চেয়ে চেয়ে মজিলাকে দেখে। অন্য দিনের চেয়ে আজ কি মজিলাকে একটু বড়বড় দেখাচ্ছে? একটু নতুন নতুন, একটু বেশি লাবণ্যময়ী? মাত্রতো একটা সপ্তাহের ব্যবধান। কিন্ত বুড়ো মোকলেস জানে যে এ বয়সী কিশোরীর জীবনে এই মাত্র একটা সপ্তাহ সময়ও কত বদল নিয়ে আসে। উঠতি বয়সী মেয়েরা হচ্ছে ফুলের কুঁড়ির মত: প্রতিদিনই একটু একটু করে ফুটতে থাকে।

এই প্রস্ফুটন দেখার আনন্দ পূর্ণ প্রস্ফুটিত ফুল দেখার আনন্দের তুলনায় আনেক বেশি। প্রস্ফুটিত হয়ে যাবার পরের দিনগুলিতে থাকে জরার আভাস কিন্ত প্রস্ফুটন চলাকালে থাকে পূর্ণবিকশিত রূপটি দেখার অধীর আগ্রহ। মোকলেস তাই মজিলার সেই ভবিষ্যতের বিকশিত রূপটা কল্পনায় এখনই দেখার চেষ্টায় কেমন আনমনা, উদাস হয়ে পড়ে। মজিলা হয়ত অতশত ভাবেনা। দিনসাতেক আগে তার জীবনে যে বড় পরিবর্তনের সূচনা ঘটে গেছে সে বিষয়ে তার মনে কোন সচেতনতা স্থান পায়নি।

সে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে মা যখন তাকে অসময়ে ঘরে শুয়ে থাকতে দেখে কপালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল যে তার শরীর ঠিক আছে কিনা তখন সে কোন উত্তর দিতে পারেনি। তারা শরীর ঠিক আছে কি নেই সে তার কী জানে? একটা নতুন কিছু তার হচ্ছে বটে কিন্ত সেটাকে যে কী ভাষায় বর্ণনা করে তার মাকে বোঝাবে তা সে ভেবে পায়না। তারা মাও মেয়ের কপালে তাপ নেই দেখে এ বিষয়ে আর কথা না বাড়িয়ে দুটো খুদ ফুটাতে উঠোনের উন্মুক্ত হেঁসেলে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বোধহয় সঙ্কোচবশতঃ মোকলেস তার বঁধূমাতাকে এ বিষয়ে কিছু বলতে পারেনা। সেরাতে মজিলা কিছু খেতেও চায়না।

মাজেদা বিবি এ নিয়ে পীড়াপীড়ি করলে আবশেষে মজিলা বিছানায় বসেই কিছু খেয়ে নেয়। পরদিন সকালে বিছানা তুলতে গিয়ে মাজেদার চোখে ব্যাপারটা ধরা পড়ে। আর তখনই মেয়েকে ডেকে সে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়ে গালে হাত দিয়ে বসেঃ অবাক কাণ্ড! মাত্র কয় দিনেই মাইয়াডা এত্ত বড় হইয়া গ্যাল! ওর যে অহনতরি বারোও হইনি, নাকি হইছি? ক্যাডা জানে! এরপর মেয়েকে মাজেদা দুশলা পরামর্শ দেয়; কিন্ত সে ঐ এসময়ে পয়লা পয়লা কী কী বাছ-বিচার মেনে চলা উচিৎ- সে বিষয়ক। যেমন- ভুতেরা এ সময় মেয়েদের গায়ের গন্ধ খুব পছন্দ করে, তাই সাঁঝকালে চুল খুলে বাইরে যাওয়া যাবেনা। “মা, তুমারো কি এসব অয়?” মজিলা প্রশ্ন করে।

“অয়রে ছেঁড়ি, অয়। সব মাইয়ানুকেরই মাসে মাসে অয়। এহনেত্তে তোরও অইব”। মজিলা বুঝি একটু ভড়কেই যায়; মাসে মাসে! ঐ পর্যন্তই। এরপর আর এ বিষয়ে কথা বলার প্রয়োজন বা সময় কোনটাই মাজেদার নেই।

সকাল হতেই ঘরের কাজকর্ম সেরে ঝটপট কিছু রান্না করে মেয়েকে ঘরের বাইরে যেতে পুনঃপুনঃ নিষেধ করতে করতে সে ছোটে চাতালে। শ্বশুর তার এ কটাদিন ঘরেই বসে। কাজেই তাকে কামাই করলে চলবেনা মোটে। শ্বশুরের এ কয়টা দিন বসে থাকাটা মাজেদার তেমন পছন্দ নয় কিন্ত এনিয়ে বলার কিছু নেই। এত বয়সী মানুষটা কি আর একাকী পারে কাশ কেটে আঁটি বেঁধে নৌকায় তুলে যমুনার স্রোতের সাথে পাল্লা দিয়ে বৈঠা বেয়ে ঘরে ফিরতে? মজিলা সাথে থাকলে মানুষটার শ্রম কত কমে।

স্বামী উধাও হবার পর থেকে এই শ্বশুরের আশ্রয়ে মাজেদা এতকাল কাটিয়ে এসেছে। আশ্রয় বলতে ভিটেটুকু; কিন্ত সেইবা কম কী? নিরাশ্রয় হয়ে মেয়েটার হাত ধরে পথে পথে ভিক মেগে ফুটপাতে কি বাসায় বাসায় ঝিগিরি করে বস্তির ঝুপড়িতে রাত্রিযাপন করার চেয়ে এই ছোট্ট কুটির, নিকানো উঠান যে ঢের ভাল তা উপলব্ধির ক্ষমতা মাজেদার রয়েছে। শ্বশুরের প্রতি তাই সে যথেষ্ট কৃতজ্ঞ। আজ চরে পৌঁছাতে মজিলাদের একটু দেরীই হয়ে গেল। তার দাদা আজ নৌকা বেয়েছে বড়ই ধীরে।

অন্যদিন এতবেলায় তারা কাশ কাটা সেরে ফেলে। তারপর নদীর জলে হাতমুখ ধুয়ে গামছায় বাঁধা খাবারের পুটলি খুলে দাদা-নাতনী ভাগাভাগি করে খেয়ে নেয়। এরপর চলে আঁটি বাঁধার কাজ। বাঁধাবাঁধি সারতে সেই বিকেল। তারপর আঁটিগুলো নৌকায় সাজিয়ে নিয়ে নৌকা ভাসিয়ে যমুনা পাড়ি দিয়ে বাড়ির পথ ধরা।

আজ তাই দেরী পুষিয়ে নিতে ঝটপট হাতে কিছু কাশ কেটে ফেলাটাই নিয়ম। কিন্ত তার দাদা আজ সেসব কিছুই করেনা। কেমন অস্থিরভাবে চরের এমাথা-ওমাথা হেঁটে বেড়ায়। মজিলা দাদাকে তাড়া দেয়। তার দাদা হাসে; রঙ্গ করে বলে, “বেবাক জীবনডিতো চরে কাশ কাইটাই গ্যাল, আজ নয় যমুনার হাওয়া খাইয়াই দিন কাটাই”।

হাওয়ারাও আজ বয় বটে। যমুনা চরের কাশের বনকে উথালপাতাল করে এমন করে বয় যে মজিলার রীতিমত শীত করতে থাকে। সেই পাগলা হাওয়ার দাপটে মজিলা যত থরথর করে কাঁপে বুড়ো মোকলেস ভেতরে ভেতরে কাঁপে তার চেয়ে বেশি। ষাট বছরের মোকলেসের চামড়ায় হেমন্তের যমুনার নিরুত্তাপ বুক ছুঁয়ে ধেয়ে চলা এই উতল হাওয়া এমন কিছু নয়। একখানা গামছা কাঁধে খাটো লুঙ্গি পরা প্রায় উদোম দেহে সে যেখানে গোটা শীতকালটা কাটাতে অভ্যস্ত সেখানে হৈমন্তিক বাতাস তার কী করতে পারে? মোকলেসের শরীর তাই শীতে নয়, কাঁপে বুঝি কোন গভীর উষ্ণতার আকাঙ্ক্ষায়, কোনো বুনো আবেগে কিংবা কোন নিষিদ্ধ, অনৈতিক আদিম রিরংসায়।

মোকলেসের কাঁপন একসময় শেষ হয়। মজিলা পড়ে থাকে চুপচাপ- এক অন্যরকম আবেশে আবেশিত, খানিকটা রক্তাক্ত, ঈষৎ ক্লান্ত। না, কোন ধ্বস্তাধস্তি নয়, কোন পাশবিক বলপ্রয়োগও নয়; সেসবের কোন প্রয়োজনই মোকলেসের পড়েনি। নাতনিকে সে এমনই আদরে এমনই খুনসুঁটিতে মাতিয়ে এমন পর্যায়ে নিয়ে যায় যাতে করে পুরো বিষয়টাই তার শিশু থেকে সদ্য নারীত্বে পা রাখা নাতনি একটা খেলা হিসেবেই নেয়। ‘ব্যাথা লাগেগো দাদা’ বলে সে একবার কঁকিয়ে উঠেছিল বটে কিন্ত গঞ্জের হাট থেকে আলতা কিনে দেবে বলে মোকলেস তাকে অনায়াসে থামিয়েছে।

তাছাড়া বিশ বছর ধরে উপোসী ষাট বছরের বুড়োর আর কতইবা ক্ষমতা। মজিলাকে তাই দীর্ঘক্ষণ কষ্ট পেতে হয়না। গোধুলির সোনালী আলোয় কাশশুন্য নাও ভাসিয়ে মোকলেস বলে, “এই কতা যেনু কাউরে না কও, এইডা তুমার-আমার খেলা, অন্য কেউ যেনু জানবার না পারে”। নাতনী বলে, “ইডারে কী খেলা কয়, দাদা?” “হে আছে এট্টা নাম। তুমি খালি মনে রাখবা এ খেলার কতা কেউ কাউরে কয়না, ইডা গোপন খেলা”, মোকলেস বলে।

তারপর কত সোহাগের গলায় কতকিছু উপহার দেবার কথা মোকলেস বলে চলে। বিয়ের পর প্রথম দু’চারদির নতুন বৌয়ের আগ্রহ বাড়াতে সে যেসব উপহার সামগ্রীর লোভ বৌকে দেখাত সেসব বস্তুর লোভ দেখিয়ে নাতনীকে বাগে রাখতে আজ সে সচেষ্ট। কারণ মুখটা সে যতই হাসি হাসি করে নাতনির মন ভোলানী ভাব করে রাখুক না কেন ভেতরে ভেতরে এক দুরন্ত ভয় তার বুক চেপে কন্ঠনালী পর্যন্ত নাড়িয়ে দিতে চাইছে। কাঁপাকাঁপা গলাকে প্রাণপণ চেষ্টায় স্বাভাবিক রাখতে সচেষ্ট হয়ে নাতনিকে সে ফুসলিয়ে চলে অবিরাম। এভাবেই চলতে থাকে কতগুলো দিন, এমনকি কয়েকটি মাস অবধি।

মজিলা বোঝেনা কিছুই। হাভাতে মোকলেসের হাবড়া মাথায় কোন পরিনামচিন্তাই বুঝি কোনকালে উঁকি দেয়নি কিংবা দিলেও সে চিন্তাকে ভুলে থাকা ছাড়া তার পশু প্রবৃত্তিকে চরিতার্থ করার কোন নিরাপদ পন্থা তার জানা ছিলনা। বিষয়টা শুনতে এতটাই অসম্ভব শোনায় এবং এতটাই আকষ্মিকভাবে কবিরাজ কাম ডাক্তার ফজলু পরামানিক ঘোষণা করে যে মাজেদা বুঝি চিন্তিত হতেও ভুলে যায়। ব্যাপারটা তার মাথায় ঢুকতে কয়েক মিনিট সময় ব্যয় হয়, এরপর মেয়েকে জেরা করার পেছনে ব্যয় হয় ঘন্টাখানেক। তারপর স্তব্ধ হয়ে শুন্য চোখে ডাক্তারের চেম্বার ঘরের বারান্দাতেই পা ছড়িয়ে বসে থাকে।

মাজেদার জেরা চলাকালীন ফজলু ডাক্তারের পরিবারর মেয়েরা কেউ কান খাড়া করে, কেউ আগ বাড়িয়ে এসে যা শোনার তা শুনেছিল, যা বোঝার তা বুঝে নিয়েছিল। মাজেদাকে অমন করে বসে থাকতে দেখে তারা কিছুই বোঝেনি ভান করে একে একে এসে ঘিরে বসে। একজন বয়স্কাই প্রথমে কথা পাড়ে, “মাগো মা, এক রত্তি মাইয়া, তার কীবা অসুখ অইল, প্যাটটা কেমন ফুইলা উঠছে। কোবরেজ কী কইল মইজলার মাও?” মজিলার মা বুঝি এতক্ষণে সচেতন হয়, এতক্ষণে সে বুঝতে পারে যে এটা তার বাড়ি নয় এবং এধরণের বিষয় নিয়ে উচ্চ কণ্ঠে ক্ষোভ প্রকাশ কি কান্নাকাটি গাঁও-গেরামে নিজের ঘরে বসেও করা চলেনা। এখানকার মানুষেরা নিজের কাজে জল ঢেলে হলেও অন্যের ব্যাপারে উৎসুক এবং তারা একবার কোন কেচ্ছার গন্ধ পেয়ে গেলে শিকারী কুকুরের মত এমন অত্যুৎসাহে ছুটতে শুরু করে যে তাদের রাশ টেনে ধরবার উপযোগী কোন উপায়ই আর খুঁজে পাওয়া যায়না।

সরলমতি মাজেদাও এখন খুব চট করেই বুঝে ফেলে যে পরিস্থিতি এখনই নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে তারই সমূহ বিপদ। কিন্ত কী এখন করে সে? নাটাই তার হাতে থাকলেও ঘুড়ির সুতা যে তার বোকামীতেই কেটে গিয়েছে। একটু আগে মেয়েকে তার নাগরের নাম জানতে চেয়ে করা জেরা কি এরা শোনেনি? তা শুনেই কি এরা মজা দেখতে ছুটে আসেনি? এদের অপেশাদার অভিনয় টুটিয়ে চোখের ভাঁজে, ঠোঁটের কোনে বিদ্রুপের চাপা বক্র হাসি কি উঁকি দিচ্ছেনা? এখন কোন উপাযে সে এদের মুখে কুলুপ আঁটে? জগতে কারো কি জানা আছে সে উপায়? হায়রে! অবোধ মজিলার অশিক্ষিত-অজ্ঞ মায়েরও জানা ছিল যে পৃথিবীর বড় বড় নদীকেও শাসন করে তার গতিপথ বদলে দেয়া যায় কিন্ত মানুষের মুখের ধারাকে বন্ধ করা যায় এমন ওষুধ তার হাতে নেই। অর্থ নামের ওষুধ অপরিমিত পরিমানে ঢালতে পারলে হয়ত সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মত কথার অগ্নুৎপাত অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকে কিন্ত সময় ও সুযোগের অনুকূল পরিবেশেও কোনকালে তার যে উদ্গীরণ ঘটবেনা এমন নিশ্চয়তা কেউ পেতে পারেনা। মাজেদা তাই কারো ঔৎসুক্যের কোন জবাব না দিয়েই উপস্থিত মত নিষ্কৃতি পেতে ছুটে পালাতে চায় কি পাশ কাটিয়ে বাড়ির পথ ধরতে চায় কিন্ত কোনটাই না পেরে সে হঠাৎ ডুকরে ওঠে।

বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদতে কাঁদতেও সে কত কী ভেবে চলে। তার এতদিনকার শ্রদ্ধাষ্পদ, ভরসার স্থান, বটবৃক্ষসম শ্বশুরবাপ তার কতটা সর্বনাশ করল তা যতনা সে ভাবে তার চেয়ে ঢের বেশি ভেবে চলে এ বিপদ থেকে উদ্ধারের উপায়। গ্রামের কোন জোয়ান ডেকরার কাজ নয় যে তাকে ধরে এনে কলমা পড়িয়ে দিলে সব মিটে গেল, কোন অনাত্মীয় বুড়োর কারসাজি নয় যে তিন সতীনের ঘর হলেও মেয়েটাকে সাময়িকের জন্য পাঠিয়ে লোকনিন্দার হাত থেকে বাঁচা গেল। নিতান্তই আপন পিতামহ! হঠাৎ মাজেদার সমস্ত মনটা দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে-‘ওরে ও বিটলে বুড়ো, তুই একবারো ভাবলিনে যে এই কচি আবোধ বেটিডা তোর জম্মের ব্যাটারই জম্ম’। মুখে অবশ্য সে কিছুই বলেনা।

মনে মনে বুড়োটাকে লক্ষ-কোটি গাল পাড়ে আর কখনো হাউমাউ করে, কখনো ইনিয়ে বিনিয়ে কেঁদে চলে। বুড়োটাকে যতই গাল পাড়ুক, যত কঠিন শাস্তিই সে মনে মনে তার জন্য কামনা করুকনা কেন এ সত্যটাও তার মাথায় উঁকি দিয়ে যায় যে বুড়োর বসতবাড়ি আর পাগাড় সমেত দশ শতক জমি আছে। আর বুড়ো যদি সে জমি তার জীবদ্দশায় বিক্রি-বন্ধক দিয়ে না যায়তো একদিন সে জমি তাদেরই হবে। অগত্যা বুড়োটাকে বিচারের মুখোমুখি করার চেয়ে তার মৃত্যু কামনাই শ্রেয় বিবেচনা করে সে তাই করে চলে। এমন সময় হেঁকে ওঠে ফজলু পরামানিক।

উপস্থিত ভীড় করা নারীদের নানা সান্ত্বনার বানী, গা-পিঠ ডলানি, কৌতুহলপূর্ণ প্রশ্নবানের মরণস্তুপ থেকে মাজেদা ও তার মেয়েকে উদ্ধার করে সে ফের তাদের নিয়ে ঢোকায় নিজের চেম্বার ঘরে। ফজলু কবিরাজ চাপাগলায় মাজেদাকে খুব একচোট ধমক দিয়ে বলে, “এমুন কাম কেউ করে? বেটি ছাওয়ালের মা অইছ, অথচ বুদ্ধি-শুদ্ধি নাই তুমার। বুড়োর সাথে একলা বেটিরে কাশের চরে পাঠাইতা ভালা কতা, আপনা দাদা নানারে কেইবা অবিশ্বাস করে। কিন্তুক ফলদ্যাখা মাইয়ারে কিসে কী অয় মা অইয়া হেই জ্ঞানডা দিবানা? ইডা কেমুন কতা যে ছয়-ছয়ডা মাস পার অইয়া গ্যাল অথচ তুমি কিচ্ছু বুঝলানা? যাউকগা, যা অবার তাতো অইছে, এহন এই ফ্যাসাদের হাতেত্থন বেটিরে ক্যামনে বাচাইবা হেইডা ভাব। ছয়মাস অইয়া গ্যাছে, এহনতো আর রাতারাতি এ যন্ত্রণা খালাস করা যাইবনা।

ওষুধ আমি দিবার পারি কিন্ত তাতে মাইয়ার জীবনের ঝুঁকি থাইকা যায়। জেলা সদরে নিয়া গেলে কামের কাম অইবার পারে কিন্ত খরচ লাগব ভালই। হাজার কয়েকের বন্দোবস্ত করণ লাগব, পারবা করতে?” মাজেদা কাঁদতে কাঁদতে মাথা নাড়ে। বিরক্ত হয়ে ফজলু বলে, “তাতো পারবানা জানি, কিন্তক য্যামনে কান্দাকাটি কইরে মা-বেটি বুড়োর নাম ছড়াচ্ছ তাতে ক্ষেতিডা কার তাকি ভাবিছ?” লাচার মাজেদাকে অবশেষে ফজলু বুদ্ধি দেয়, তুমি এক কাম কর মইজলার মাও, বুড়োর নাম জড়াইয়া আপনা বিপদ আর বাড়াইয়োনা। বরং বুদ্ধি কইরা মাইনষেরে কও যে মাইয়া তুমার বিয়াত।

রাত্রি রাত্রি জামাই আহে, চালচুলো নেই, অহনো মাইয়ারে তুইলা নেয় নাই, তাই কাউরে কিচ্ছু জানাও নাই”। বোকা মাজেদা প্রশ্ন করে, মাইনষে বিশ্বাস যাইব? ফজলু এবার স্পষ্টতঃ বিরক্ত হয়। ধমক দিয়ে বলে, “বুড়োর নামে মাইয়া যা কইতাছে তা বিশ্বাসকরণের চাইতেতো এই গল্পই বিশ্বাসকরণই সুজা। আর মাইয়া মানুষ অইছ, গপ্পগাছা করণের অব্যেসও কি নাই? মিত্যে গপ্প ক্যামনে সাজাইয়া কইলে মাইনষে বিশ্বাস করে হেইডাও কি আমার শিখাইয়া দেওন লাগব?” না, আর কিছু মাজেদাকে সাজিয়ে দিতে হয়না। জেলা সদরের খরচ জুগিয়ে উঠতে না পেরে মজিলাকে যখন গ্রামের কম্যুনিটি ক্লিনিকে নিতে হয় তখন গল্প তাকে সাজাতেই হয়।

গল্প সে সুন্দর করেই সাজায়। ফজলু পরামানিকের খসড়া গল্পের কাঠামোতে মাপমত মশলা মেখে সে এটাকে পাকা করে তোলে। অপরিণত মজিলার মা হবার গল্প প্রচারিত হতে গোটা একটা দিনও ব্যয় হয়না। কৌতুহলী গ্রামবাসীর প্রশ্নের জবাব মাজেদা বেশ সাবলীল ভাবেই দেয়। যেমন- আলেক মাতবরের বৌ যখন তাকে প্রশ্ন করল, “হা লো বৌ, মইজলার নিহি ছাওয়াল অবি? তা জামোইর মুখখোনই যে অহনতরি চোহি দেখলামনা?” মাজেদা তখন সাধারণভাবেই বলল, “ক্যামনে দ্যাখবা, বড়চাচী; এমুন পোড়া কপাইল্যা জামুই আমার, না দেয় বেটিরে ভাত, না একখান পিন্দনের ত্যানা।

ও কালামুখ কি আর দিনের বেলা মাইনষেরে দ্যাহাইব? নাত্তিরি নাত্তিরি আহে আর ব্যান হতিই হেই গঞ্জে। হারাদিন ঘুরে ফিরে কী কাম অরে আল্লায় মালুম। কুনুদিনতো আধকেজি মিঠেইও আনেনা যা হাতে কইরা নিয়া তুমাগেরে মাইয়া বিয়ের খবর দেই”। আরেক মাতবরের বৌ এত সুন্দর গোছান জবাবেও কিছুমাত্র খুশি হয়না। মুখখানা বেজার করে বলে, “কী জানি বাপু তুমাগো কাণ্ড-কারখানা।

জামুই তুমার জজ-ব্যারিস্টার হবি আর তুমি মিষ্টি নিয়া গিয়া খবর দিবা- এমুন আশাতো কুনোদিন করিনাই। তয় হ, খবরডি তুমি এমনি দিলাই পারতা। জামুইর মুখ নাই দ্যাহালে, দোয়াডিতো চাইতে পারতা”। তা বটে। দোয়া চাওয়া মাজেদার উচিৎ ছিল।

নবদম্পতিকে আশীর্বাদের অধিকার থেকে প্রতিবেশীদেরকে বঞ্চিত করাটা মাজেদার উচিৎ হয় নাই। নিজের ভুল মাজেদা বার বার করে স্বীকার করে। অবশেষে আলেক মাতবরের বৌ এই বলে বিদায় নেয় যে মাজেদার উচিৎ তার জামাইকে একদিন ডেকে প্রতিবেশীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া। রাতের বেলা চোরের মত চুপি চুপি জামাই আসবে যাবে- এটা কেমন কথা! মাতবর বৌ তখনকার মত উঠে যায় কিন্ত মাজেদা ভাবতে বসে। কী করে সে এখন? আর কত জনকে এভাবে বোঝাবে সে? মজিলাকে সে পারতপক্ষে কারো সাথে কথা বলতে দেয়না; পাছে সে বেফাঁস কিছু বলে বসে।

মেয়েকে সে বুঝিয়েছে অনেক। দুনিয়াদারির হাজার জটিলতা সম্পর্কে মাত্র এ কয় দিনেই সে মেয়েকে অপরিমেয় জ্ঞান সরবরাহ করে রাতারাতি পরিপক্ক করে তুলতে চেষ্টা করেছে। মেয়ে বুঝেছেও অনেক, তবু গুছিয়ে মিছেগল্প বলার অভ্যেস তার রপ্ত হয়নি। যদিবা হু-হাঁ করে দু’য়েকটা প্রশ্নের জবাব দেয়তো পরক্ষণে সে হু-হাঁটাও গুলিয়ে ফেলে। এসব ক্ষেত্রে তথ্যবিভ্রাট হলে বড়ই মুশকিল।

একবার যে প্রশ্নের জবাবে সে হাঁ বলেছে পরক্ষণে সেই প্রশ্নের জবাবে না বললেতো বেজায় গণ্ডগোল। মাজেদা তাই পারতপক্ষে মজিলাকে ঘরের বার হতে দেয়না। ওদিকে হয়েছে আরেক যন্ত্রণা। হতভাগা পাপিষ্ট বুড়োটা গা-ঢাকা দিয়েছে। মা-মেয়েকে এই অথৈ বিপদ সমুদ্রে ডুবিয়ে নিজে দিব্যি সটকে পড়েছে।

হয়ত শহরে গিয়েছে। সেখানে ইট ভেঙ্গে হোক কি ভিক্ষে করে হোক দুমুঠো ঠিক খেতে পাবে। কিন্ত এই পোড়াকপালীকে নিয়ে মাজেদা এখন কী করে? পেটের আগুন নিভিয়ে রাখতে হলে চাতালের আগুনে গিয়ে না বসলেই তার নয়। অথচ মেয়েটা অসুস্থ। ‘আহারে! অবুঝ নাদান মাইয়াডারে লইয়া নাজানি কতদিন ধইরা বুইড়া হারামিডা.........’,মাজেদা যত ভাবে ততই তার রক্ত এক অক্ষম আক্রোশে টগবগ করে ফুটে উঠতে চায়।

এই বুড়োর আশ্রয়ে সে গত এগারটি বছর কাটিয়েছে। বুড়ো শ্বশুরকে সে আপন পিতার দৃষ্টিতেই দেখেছে, শ্বশুরও তাকে কন্যা ভিন্ন অন্যভাবে কখনো দেখেছে বলে তার মনে পড়েনা। কিন্ত কী হল তার মেয়ের ক্ষেত্রে? দাদা-নাতনীর সুন্দর মধুর সম্পর্ককে সে কেন এমন জঘন্যতার মাঝে টেনে নামাল? মাজেদার মাথায় কিছুই ঢোকেনা। অন্যদিকে কিছুই ঢোকেনা বুড়ো মোকলেসের মাথায়। কীভাবে যে কীসব ঘটে গেল।

কেন ঘটল তার ব্যাখ্যা অন্য কারো কাছে দূরে থাক, নিজের কাছে করার যোগ্যতাও তার নেই। মাঝে মাঝে নাতনীটার জন্য তার বড্ড মায়া হয়- আহা নিতান্তই কচি। পরক্ষণে মনে হয়, ঐ কচি হওয়াটাইতো ছিল যত নষ্টের মূল। সেই কোন উঠতি যৌবনে কচি দেখেইনা সে ঘরে এনেছিল ফুলি বিবিকে। কচি মেয়েছেরের শোভা, দেহজোড়া লাবণ্যের আভা, ঢলঢল মুখ, ফুলকলির মত ফুটতে থাকা দেহ- এসবইতো পুরুষকে টানে।

আজকালকার পুরুষদের রুচি দেখে মোকলেসের কেমন বিবমীষা বোধ হয়- এরা প্রথম বিয়েতেই ঘরে আনে একেকটা ধুমসী মাগী। নারীর কুমারিত্ত্বের কী সোয়াদ তাই এই ব্যাটাছেলে গুলো বুঝলনা। ঐসব কুড়ি পেরুনো বুড়িদের কি আর কুমারিত্ত্বের কিছু অবশিষ্ট থাকে, না থাকা সম্ভভ? কয়টা নাগরের সাথে কতকী ঘটিয়ে তবে তারা বিয়ের পিঁড়িতে বসে তা কে জানে। আগে শহরে মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে ধুমসী করে বিয়ে দেয়ার রেওয়াজ ছিল, এখন সে হাওয়া গাঁয়েও লেগেছে। কচি মেয়ে এখন আর কেউ বিয়েই দিতে চায়না।

আর যদিবা দেয়তো দেবে কোন উঠতি জোয়ান পুরুষ কিংবা সম্পদশালী বুড়োর সাথে। মোকলেসের মত হাড় হাবাতের ঘরে কদাপি নয়। কী আছে মোকলেসের? ঐতো দশ শতক জমি? ওর লোভে মাটি কামড়ে রুস্তমের কুরূপা বৌটা থাকতে পারে কিন্ত কোন চপলা কুমারী কিশোরী কোনদিনই মোকলেসের ঘরে পায়ের ধুলো ঝাড়তেও আসবেনা। অথচ মোকলেস কি একটা মানুষ না? দ্বিতীয় স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে তার বছর কুড়ি হল। তারপর বাপ-ব্যাটায় মিলে কিছুদিন রেঁধে বেড়ে খাওয়ার পর রুস্তম ঘরে আনে এক মস্ত বেটি।

বাপকে তৃতীয়বার বিয়ের পিঁড়িতে বসবার সুযোগ দিতে রুস্তমের প্রবল অনীহা। চওড়া হাড়ের কাঠামোয় আসুরিক স্বাস্থ্য লেগে অসুরতুল্য দেহ রুস্তমের। রাগলে তার হিতাহিত জ্ঞান সত্যিই লোপ পায়। গাঁয়ের আর পাঁচজনের মত মোকলেসও তাকে খানিকটা ডরায় বৈকি। সেই রুস্তম যখন তার প্রথম বৌটাকে তুচ্ছ কারণে ঠেঙিয়ে আধমরা করে অবশেষে তালাকটাও দিয়ে সারল তখন মামলা ঘাড়ে করে শহরে স্বেচ্ছানির্বাসিত দিনযাপন তার পক্ষে অনিবার্য হয়ে উঠল।

এই শহরেরই কোন গলি-ঘুপছি থেকে সে একদিন কুড়িয়ে নিয়ে এল কালাপাহাড় মাজেদাকে। মোকলেসের বড় আফশোস যে ছেলেটা তার রুচি পায়নি। তবে তার সুখ ছিল এটাই যে নাতনীটা তার মায়ের কুরূপ পায়নি। যাহোক, যে রুস্তমের ভয়ে মোকলেস তার কামনা-বাসনার বোতলে ছিপি এঁটে রেখেছিল সে যখন তার বৌ-মেয়েকে তার ঘাড়ে ফেলে পলাতক হল তখন মোকলেসের জীবন সংগ্রাম মোকলেসের বোতলটাকে ক্রমাগত সঙ্কুচিত করে তুলতে লাগল। নাতনীর প্রতি অসীম স্নেহবশতঃই সে মাজেদাকে তাড়িয়ে দিতে পারেনি।

বাতাসে কথারা ভেসে বেড়ায়। মানুষ টপটপ করে সেসব কথাদের পেড়ে আনে। তারপর আপন মনে বিশ্লিষ্ট করে ফের কথাদের বাতাসে ভাসিয়ে দেয়। এভাবে তৈরি হয় নতুন নতুন কথা। মজিলা-মোকলেসকে নিয়েও এ প্রক্রিয়ায় কথা ছড়ায়।

সেই যে ফজলুর ঘরে মাজেদা আগপিছ কিছু না ভেবেই মজিলার গর্ভধারণ বিষয়টাকে অবাস্তব, অসার এমনকি ফজলু কবিরাজ কাম ডাক্তারের ডাক্তারীবিদ্যাকে রোগ নির্ণয়ে ব্যর্থ প্রমান করতে মেয়েকে জেরা করতে শুরু করেছিল এবং নির্বোধ মেয়ের সরল স্বীকারোক্তিতে বিষয়টা ফজলুতো বটেই, তার কানখাড়া পরিবারবর্গের কানেও পৌঁছেছিল তারই জের এখন শুরু হয়েছে। বুড়ো মোকলেস পলাতক হওয়ায় এবং মাজেদার মেয়ে বিয়ের জমাট গল্প অন্যদের কর্ণে ও যুক্তিতে এবং ফজলু পরামানিকের কল্যানে বানোয়াট মূল্যায়িত হওয়ায় বুড়ো বনাম নাতনী উপাখ্যানটাই সবার কাছে বিশ্বাসযোগ্য এবং অরুচিকর অথচ উপভোগ্য মনে হয়। ফজলু কবিরাজ যে তার সাথে এমন ছলনা করবে তা মাজেদা ঘুনাক্ষরেও ভাবেনি। ভুয়া গল্প সাজাবার বুদ্ধি ধার দিয়ে সেই ধারের সুদ নিতে এসেছিল ফজলু। মাজেদা যে এমনই নিমকহারাম তা কি ফজলু জানত? ঐদিন ফজলু শুধু বুদ্ধিই ধার দেয়নি, রুগী দেখার ফিসটা পর্যন্ত নেয়নি।

শুধু কি তাই? পনের টাকা দামের যে প্রেগন্যান্সী টেস্ট স্ট্রিপটা তাকে ব্যবহার করতে হয়েছিল তার দামটাওতো সে মাজেদার কাছে চায়নি। মা-মেয়ের আকুল কান্নাকাটি দেখে সে দয়াপরবশ হয়ে সব খরচ মাফ করেতো দিয়েইছিল, এমনকি এবরশন করাবার কাজে সহযোগিতার আশ্বাসও সে দিয়েছিল। কিন্ত কী ছিল মাজেদার মনে ফজলু তার কী বুঝবে? এবরশন বিষয়ে ফজলুর সহযোগিতা চাইল সে এমনভাবে যেন ফজলু ছাড়া মাজেদার উপকার করার মত মানুষ আর দুনিয়াতে নাই। কিন্ত এতবড় উপকারটার বিনিময়ে ফজলু কী পাবে তা ভেবে দেখার মন মাজেদার নাই। অগত্যা মাজেদার মনোভাব বুঝতে ফজলুকে প্রায়ই যেতে হয় মাজেদার ডেরায়।

বুড়ো মোকলেস যে গা-ঢাকা দিয়েছে একথা গ্রামের ছেলে-বুড়ো সবাই জেনেছে। মাজেদার ঘরের আনাচে-কানাচে গ্রামের যুবক-বৃদ্ধের অকারণ চলাচলও ইদানীং বেড়ে গেছে। এতদিনে মাজেদা উপলব্ধি করে যে তার মাথার উপরে ছাতা ধরার মত কেউ আর বাস্তবিকই দুনিয়াতে নেই। যে মানুষটাকে সে এতকাল বটবৃক্ষ ভেবে এসেছিল সে যখন ছায়ার আড়ালে তাদেরকে জীবন্ত দগ্ধ করার সমস্ত আয়োজন নিঃশব্দে সম্পন্ন করতে পারল তথন অন্য কারো কাছে তার আর কী চাওয়ার থাকতে পারে। ফজলুকে তাই সে পাত্তা দেয়না।

গ্রামের আর পাঁচজন পুরুষের মত ফজলুর আনাগোনার কারনও সে উপলব্ধি করে। মাজেদা বোঝে যে ঘটনার করালচক্রে ও পুরুষ অভিভাবকের অভাবে আজ সে সম্পূর্ণ বেআব্রু, অসহায়। কী করা যায়, কী উপায়- এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ও নানাজনের নানা পরামর্শ শুনতে শুনতে আরো দুটোমাস কেটে গেল। মজিলা এখন আটমাসের পোয়াতি। পেট ফুলে ঢোল- পেটের কাঁটাটা এখন চন্দ্রকলার বৃদ্ধির হারেই বাড়ছে।

কমিউনিটি ক্লিনিক তাদের অপারগতা জানিয়েছে। এমন দূর্দিনে কেউ কি নেই যে মাজেদার পাশে দাড়াতে পারে? আছে বৈকি! কাঞ্চা বুড়ি! কাঞ্চা বুড়ি মাজেদাকে পরিচয় করিয়ে দেয় বেটি ডাক্তার খুরশিদার সাথে। ডাঃ খুরশিদা খানম বিদ্যায় এমএলএএফ কিন্ত স্মার্টনেসে এফসিপিএস-এর উপরে। যথোপযুক্ত টাকার বিনিময়ে তার কাছে যেকোন সমস্যা জলবৎ তরলং। অমন জটিল কেস তার বাছে প্রতিদিনই দু’চারটে আসছে এবং নিমেষে সব জঞ্জাল আঁস্তাকুড়ে ঝেড়ে ফেলে পায়ে হেঁটে বাড়ি যাচ্ছে।

ডাঃ খুরশিদার পরামর্শে ও ভরসায় মাজেদা বুকে কিছু বল পায়। ছয়-নয় মাসের পোয়াতি ডাঃ খুরশিদার কাছে নাকি কোন ঘটনাই নয়; জাস্ট একটা ডেলিভারী ইনজেকশন। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই প্রসব বেদনা তুঙ্গে। এরপর জরায়ুর ক্রমবর্ধমান চাপে পেটের পাপটা বেরুবার পথ খুঁজতে দিশা পায়না। মায়ের চিরান্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে নাড়ির বন্ধন ছিড়ে যে হতভাগাটা জগতের ষড়যন্ত্রে আগেভাগেই পৃথিবীতে নেমে আসে তার জন্য যে কী নিদারুণ অভ্যর্থনা অপেক্ষা করে!! যদিও কাঞ্চাবুড়ি আগেই ডাক্তারকে সব বলেছে তবু ডাক্তার ফের শোনে।

এমন বীভৎস গল্পই বুঝি বার বার শোনার যোগ্য! মানুষের আদিম প্রবৃত্তির কত বিচিত্র প্রকাশই যে খুরশীদাকে দেখতে হয় আর স্বীয় নিপুন হাতে তা মুছে ফেলতে হয়! তবু আজ এই মেয়েটির নিতান্ত কচি মুখে ডাগর দুটি চোখের দিকে তাকিয়ে তার কী যে হয়, আপনা থেকেই বুকের ভেতরটা কেমন মুছড়ে উঠে চোখদুটো টলমল করে। তার মেয়েটাও যে এ বয়সীই হবে। কিন্ত সত্ত্বর সে ভাবপ্রবনতাকে ঝেড়ে ফেলে খুরশীদা আবার ডাক্তার হয়ে ওঠে। নিজের মেয়েটাকে মানুষ করার তাগিদেই এমন বহু মেয়ের গর্ভে ঢেলে দেয়া অনাকাঙ্ক্ষিত বীজের অঙ্কুর এমনকি চারাগাছও উপড়ে-ঝেটিয়ে তাকে পরিষ্কার করতে হয়। তাই মাজেদার সাথে দর-দস্তুর সে ঠিকমতই করে।

কাঞ্চাবুড়ির কমিশন সমেত মাত্র দেড়টি হাজার টাকা তার চাই। নাগর সাথে এলে দু’হাজারের কমে কোন কাজে হাত দেয়া হয়না; কিন্ত এক্ষেত্রে দরিদ্র, অসহায় প্রভৃতি বিবেচনায়---ইত্যাদি। । অবশেষে বিস্তর অনুনয়-বিনয়, হাতে-পায়ে ধরার পালা শেষে একহাজার টাকায় রফা হয়। কী করে টাকার উপায় হতে পারে সে নিয়ে মাজেদা অনেক ভাবে।

প্রথমে উপায় কিছুই ভেবে পায়না। এই দুর্দিনে টাকাটা ধার দেবে এমন কেউ মাজেদার কোনকালেই ছিলনা, আর এখনতো গ্রামে তার তিষ্ঠানোই দায়। পাশে দাঁড়াবার, উপকার করার মত মানুষ কোথায়? দুশ্চিন্তিত মাজেদার হঠাৎ করেই চোখ পড়ে মেয়ের নাকের দিকে। হতভাগী, পোড়াকপালীর টিকালো নাকের পরে স্বর্ণের ছোট্ট নাকছাবিটা আজো কারণে-অকারণে কেবলই ঝিলিক মারছে। সাথে সাথে নিজের নাকছাবিটার কথাও তার স্মরণ হয়; সেটা আরেকটু বড়, বহুকাল আগে বাপজান গড়িয়ে দিয়েছিল- সেটা নাকি খাঁটি গিনির তৈরি।

ব্যস, উপায় মিলে যায়। কিন্ত সোনার দাম আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বাজারে যতই চড়া থাকনা কেন, পাশের গাঁয়ের সোনারু দাদা মাত্র একটা নাকফুলের বিনিময়ে একটি হাজার টাকা দিতে কিছুতেই রাজি হয়না। এতে নাকি অনেক খাদ। অগত্যা মজিলার নাকফুলটাও খুলতে হয়। নাকফুল খোলার সময় মজিলার চোখে পানি দেখে মাজেদার বুকটা টনটন করে ওঠে।

তবু নির্মম হাতে সজোরে টেনে নাকছাবির পুশটা সে খুলে নেয়। পাঁচশত টাকার দু’খানা নোট আঁচলের প্রান্তে শক্ত করে গিঁট বেঁধে নিয়ে মেয়ের হাত ধরে মাজেদা বাড়ির দিকে পা চালায়। * * * * * * * * * * * * মাত্র কয়েকটি ঘন্টা গর্ভধারিনীকে অপরিমেয় কষ্ট দিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত যে শিশুটি আক্ষরিক অর্থেই ধরণীর স্পর্শ পেয়ে ক্লান্ত, দূর্বল কন্ঠে কেঁদে উঠল তার প্রতি এ পৃথিবীর কারো কোন অঙ্গীকার ছিলনা। আর তাই সুকান্তের ছাড়পত্র হাতে কেউ এগিয়ে আসার বদলে তার গলাতেই ঝুলিযে দেয়া হল একটা জীবন্ত ছাড়পত্র। একটা হাত উঠে এল তার কণ্ঠ বরাবর।

তারপর পৃথিবীর আলোয় চোখ মেলার পূর্বেই জগতের পরিহাসকে উপহাস করবার কিছুমাত্র মুযোগ না পেয়েই অনাদিকালের জঞ্জালের স্তুপের মধ্যে সে চিরতরে হারিয়ে গেল। * * * * * * * * * * * * মজিলা ডাকল, মা! মাজেদা তার মুখের পরে ঝুঁকে ডাকল, কী,মা? -- তারে কুথায় ফালাইছিলা, মা? মাজেদা নিরব। --বাইচা থাকলি হ্যায় সম্পক্কে মোর কী অইত, মা? দু’চোখ ভরা পানি নিয়েও মাজেদা এবার খেকিয়ে ওঠে। তবে কঠিন গালি-গালাজ গত দুই-আড়াইমাসের অভ্যাসবশতঃ মুখের কাছাকাছি এসে গেলেও আজ সে তা গিলে ফেলে; বলেনা যে হতভাগী, পোড়াকপালী, খানকি তুই মর। বরং একটু স্থির হয়ে স্নিগ্ধ কণ্ঠে সে বলে, “মানিক আমার, এইবারকার মতন তুই সুস্থ হইয়া ওঠ, আমি তুরে লইয়া শহরে যামু।

ম্যালা বড় শহরে, চাই কি ঢাকায়ও যাবার পারি। সেহানে আমি কাম করুম, তরে লগে লগেই রাহুম। কুনো আবাগীর ছাওয়ের সাহস অইবনা যে তুর সব্বোনাশ করে”। মজিলা একটুখানি মলিন হাসে। এ কয়দিনে সে অনেক বড় হয়ে গেছে।

জীবনের সমস্ত কদাকার দিকের সাথেই একয়টা দিনে তার ঘনিষ্ঠ প।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।