mostafizripon@gmail.com
পৃথিবীর সব ছেঁড়া ছাতা দেয়ালে হেলান দিয়ে বিশ্রাম নেবে একদিন; জবুথবু বৃষ্টিতে ভিজবে বেগনী নয়নতারা, শাদা রাজহাঁস, ধূসর ছেলেবেলা। রূপোর জল কুচি হবে তেতুল পাতায়, রবি শঙ্করের সেতারে। আষাঢ়ের বুনোবৃষ্টি বইয়ের তাকে কালিদাসের মতো পা দুলিয়ে বসবে, জ্যামিতির অজানা সম্পাদ্য কাগজের নাওয়ের মতো টেবিলে বিব্রত হামা দেবে। মেঘদূতের খোঁজ কে নেয় এমন দিনে! এমন দিনে কে কড়া নাড়ে খিল-কপাটে, বলে, ‘বাড়ী আছো?’
আমি বাড়ীতেই ছিলাম। আলনায় ঝুলানো শার্ট, শার্টের হাতা, আর বক্রম দেয়া সটান কলার বিশ্রাম নিচ্ছিল হ্যাঙ্গারে।
এ দৃশ্য লোভীর মতো দেখতে দেখতে আমিও ঝুলে পড়ি কড়িবর্গায়। দোল খাই। একবার ডানে, আরেকবার ডান থেকে বায়ে। হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরির মোটকা বয়ামের গায়ে কয়েকটি লাল পিপঁড়ে, একবার আমাকে দেখে নেয়। আমি হাত নাড়িয়ে তাদের ‘হ্যালো’ জানাই।
উঁচু থেকে সবকিছুই ছোট দেখায়, এমন কী পিপঁড়েদেরও। আমার পড়ার টেবিলে কালিদাস, যিনি পা দুলিয়ে বসে আছেন, বলেন, ‘মাই টার্ন’, আজ তারও দোল খাওয়ার শখ। আমি সে কথা না শোনার ভান করে আলোচনায় ফিরে আসি। বলি, ‘তারপর?’ ‘তারপর আর কী? মেঘগুলো বৃষ্টি হলো। আর ছাতাওয়ালারা কোমর ভিজিয়ে পরেরদিন অফিসে গেল!’, কালিদাস ঝটপট উত্তর দেন।
এভাবে গল্প জমে না। একজন সিলিংয়ে, আরেকজন টেবিলে- এমন রুদ্ধদ্বার বৈঠক অসফল হবে- চোখ বুজেই বলা যায়। আমি চোখ বন্ধ করি। গল্পটি আবার শুরু যাক, যাকে বলে- একেবারে শুরু থেকে শুরু। কিন্তু বুড়োটিও যে চোখ বুজে আছে! ভুল হলো, বলা উচিত, তিনি আঁখি মুদে আছেন।
কালিদাস চোখ বুজেছিলেন কোন কালে!
‘ও দাস বুড়ো, তন্দ্রা এলো বুঝি?’ বয়স বাড়লেই মানুষ উবু হয়ে চশমা খোঁজে, গল্পের বিরতিতে ঘুমিয়ে নেয়। কালিদাসেরও হয়তো বয়স বেড়েছে। আমার কথা শুনে তিনি মাথা নাড়েন। বলি, ‘সর্ষে-তেলে মুড়ি মাখিয়ে দেব? সাথে চানাচুর, আর আদা-পেঁয়াজ কুচি; দেব?’ কালিদাস আবার মাথা নাড়েন, ডানে-বায়ে। বলেন, ‘গেল বর্ষায় খুব রসবাতে ভূগলাম।
কুচকিতে এখনো টাটায়। ’ বাতের অসুখে আমার আগ্রহ নেই। চুপ থাকি। তিনি হাতের আঙ্গুলে কুচকির জটিল কোনো অবস্থান টিপে ধরে রাখেন, তারপর সুখ-সুখ-ব্যথা পাওয়া স্বরে বলেন, ‘সময় পেলে অলকাধাম থেকে ঘুরে এসো একবার। ’ আমি যক্ষের মতো যে স্যাণ্ডেল দু’টোকে অলকা নগরীর ম্যাপ চিনিয়েছি গতরাতে, বুড়োর কথা শুনে তাদের ভ্রমণজনিত অবসাদ শুরু হলো।
ওরা মিনমিন করে বলল, ‘আরেকটু রেষ্ট নিই!’ বুড়ো কালিদাস বলেন, ‘এত ভাবনার কিছু নেই। গাবতলী থেকে দক্ষিণের বাস নাও। সোজা রাস্তা। ’ মুখরা স্যাণ্ডেলদুটো ঝটপট বলে, ‘তাহলে তুমি নিজে যাও না কেন?’ এইবার কালিদাস বাবু কান-মাথা চুলকে একাকার করলেন। এমন কঠিন প্রশ্ন কেউ কোনোদিন তাকে করেনি।
আমি মজা পাই। স্যাণ্ডেল দু’টোকে মনে মনে বাহবা দেই, সাবাস! বাঘের বাচ্চা!
বাইরে বৃষ্টির ছাঁট বাড়ল বোধ হয়। নিম-আলোতে কালিদাস, দু’পাটি স্যাণ্ডেল, হ্যাঙ্গারে ঝোলানো ফুলহাতা শার্ট, আর আমি- রুবিকস কিউব খেলতে থাকি। তিন পাক ডানে, এক পাক বায়ে। আবার দুই পাক ডানে, এক পাক বায়ে।
কখনো কালিদাস, স্যাণ্ডেল, আর আমি, আবার কখনো ফুলহাতা শার্ট, আমি আর কালিদাস। আমি বলি, ‘সবকিছু মিলতেই হবে, এমন কথা নেই। অমিলও ভাল। ’ কথাগুলো বলে খুব আরাম লাগে; গূঢ় ঐশীবাণী নাজিল করে ঈশ্বর যেমন প্রীত থাকেন, তেমন লাগে আমার। আমার কথা শুনে কালিদাস বলেন, ‘সিলিংয়ে বসে সবাই বড় বড় কথা বলে!’ আমি বলি, ‘সিলিং নয় হে কবি, রামগিরি, রামগিরি পর্বত!‘
- ‘ওই একই কথা!’
- ‘মাকড়সার ঝুলের মতো কিছু বেশরম মেঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে ক্যালেণ্ডার ঝোলানো দেয়ালে; ওদের বলব?’
- ‘ওসব দিন গেছে।
পারলে এসএমএস করো। পিগমী সাইজের ম্যাসেজ পাঠাও!’
আমি মুঠোফোন খুঁজি। ওটি টেবিলে পড়ে আছে, মেঘদূতের পাশেই। অফিসের কলিগদের সাথে কথা বলার ঢংয়ে বলি, ‘কালিদাস বাবু, ফোনটা দেবেন, প্লিজ?’ কালিদাস বলেন, ‘খুব আলসেমী লাগছে, নিয়ে নাও। ’ আমারও আলসেমী লাগে।
আমি ভরপেট আলসেমী নিয়ে হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরীর মোটকা বয়ামটা দেখি। লাল পিপঁড়েদের শবযাত্রা দেখি। হ্যাঙ্গারে ঝুলানো শার্ট আর টেবিলে উবু হয়ে বসে থাকা কালিদাসকে দেখি। বাইরে কড়া নাড়ার শব্দ। নাকি ঝড়ের ঝাঁপটা? এমন দিনে খিল-দরজায় কে কড়া নেড়ে বলবে, ‘বাড়ী আছো?’ আমি অযুত-বিযুত জোনাকপোকার ওড়াউড়ি দেখি আকাশময়।
আহ আকাশ! আমার পিতার সমান উচ্চতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আকাশ! এতকাল কার বারান্দায় ঝুলে ছিলে অতিথি আমার? এই ঝড়-বাদলের দিনে কী দিয়ে নারায়ণ সেবা করি আমি? সর্ষে-তেলে মুড়ি মাখিয়ে দেব? সাথে চানাচুর, আর আদা-পেঁয়াজ কুচি, একফোঁটা কাগজি-লেবুর রস, চলবে? আমাকে অস্থির হতে দেখে কালিদাস মাথা নাড়েন। কবিদের সবকিছুতেই প্রবল ভক্তিভাব থাকে বোধ হয়; এমন কি ডানে-বায়ে মাথা নাড়াতেও।
- ‘মেঘেদের কোনো প্রজনন ঋতু নেই, জানতো?’
- ‘ভুল, দাসবাবু এসব ভুল কথা। মেঘের পরাগায়ন কৌশল জটিল, তবে অসম্ভব নয়। এবারও বর্ষায় মেঘছানারা হামা দিচ্ছে কলতলায়, কৈলাশ শৃঙ্গে!’
- ‘এসব বানানো কথা।
গুলগাপ্পি। জোনাকপোকার নিতম্বে ফসফরাসের গল্পের মতো!’
জোনাকপোকার প্রসঙ্গ উঠতেই আমার ভেতরে জন্ম নেয়- তুলশী ঝোঁপ, একটা বাঁশঝাড়, তারই পাশে এক টুকরো হলুদের ক্ষেত, একটা দীঘি, বিঘে তিনেক ধানী-জমি, দুব্বো গজানো মাঠ, মাঠ পেরুনো বাদামী ইস্টিমার, ভূঁইফোঁড় একটা নদী, বাঁশের সাঁকো, নদীতে পা ডুবিয়ে বসে থাকা ছেলেবেলা। আহ্ ছেলেবেলা! কতকাল দেখিনা তোরে! একবার আমার কাঁধে উঠে বোস, বাল্যসখা আমার- আকাশ চেনাই তোরে! অথবা শিখবি আলু-পটলের দরদাম, পায়রার ঠোঁটে চুমু খাওয়ার ঊনিশটি গোপন কৌশল? আমার চেয়ে কে আর ভাল জানে তক্ষকের জীবন্মামৃত! ওরে ধুলোমাখা বন্ধু আমার, তোর হাতের দশটি আঙ্গুলের মতো আমারও ভেতরে জন্ম নেয় সাতশ’ পঞ্চাশ বর্গফুটের এক হলদে বিবর, বড় হয়; ভেতরে ভেতরে আমিও বেড়ে উঠি, আকাশের ঔরশে মেঘ যেমন বেড়ে ওঠে!
আমি জন্ম বদল করব। ও কালিদাস, প্লিজ, তুলোর বালিশের সাথে বদল করবে যক্ষের জীবন?
এত জটিলতায় কালিদাস বিরক্ত হয়ে ওঠেন, বলেন, ‘দোষটা তোমারই!’ আমি জানি, আমারই দোষ। কথাটা সবাই জানে এবং তারা জানে বলেই বিশ্বাসও করে।
তিনি বলেন, ‘মানস সরোবরে ডুব সাঁতার দিও এইবার। ’
আমি চুপ থাকি। কী আর বলব! চৌরঙ্গীর গন্ধবণিকেরা কেশতেলের ব্যবসা গুটিয়েছে- সে দোষ আমার! অবন্তী নগরের রমনীরা সুগন্ধী চুলে খোঁপা বাঁধে না আর- সে দোষও আমার! আমি দেবদারু বন ঘেরা ক্রোঞ্ছ পর্বতে বসে থাকব। নাকে স্বেদকণা নিয়ে নীলক্ষেতের মোড়ে অপেক্ষা করুক অবন্তীর নারীরা, তাদের হাতব্যাগ, মিহিসূতোর রুমাল। আমার জন্য অপেক্ষা করুক- কৈশোরের এক বোকা বাইসাইকেল।
ঠিক কোন কারনে বাইসাইকেলের জন্য এত দরদ আমার, জানিনা। তবু একটা বাইসাইকেলের কথা মনে হয়। মনে হয়, শহরের কোনো নির্জন এভিনিউয়ে এক অলৌকিক দ্বি-চক্রযান শিস কেটে বেড়িয়ে যাচ্ছে। যেনো গ্লোবের কোনো প্রান্তে পৌঁছুলেই সে পেয়ে যাবে কেন্দ্রাতিক শক্তি। যেন মেঘ, উত্তরের পাখিদের বাড়ী ফেরার পথ, সূতো ছেঁড়া ঘুড়ি- সবার সাথে পাল্লা তার।
কিংবা এসব কিছুই না। ক্রোঞ্ছ পর্বতে তার নিরন্তর বিশ্রাম! আজ সবাই অপেক্ষা করুক আমার জন্য। আমার কী!
কালিদাস বলেন, ‘বৎস, সবকিছু শেয়ার করতে শেখো। সিলিংটা তোমার একার নয়!’
আমি বলি, ‘টেবিলটাও তোমার একার নয়!’
- ‘নেমে এসো! এবার আমার পালা। ’
- ‘দরজায় কে কড়া নাড়ে?’
- ‘ঝড়ো-মেঘ! এ বাড়ীতে মেঘের নাইয়োর আজ!’
- ‘দরজা খুলে দাও!’
- ‘ইচ্ছে করেনা, খুব আলসেমী লাগে!’
- ‘মেঘদূতকে বলোনা!’
- ‘পূর্ব-মেঘ, উত্তর-মেঘের সাথে বিশ্রাম্ভালাপে ব্যস্ত।
নিজে খুলে নাও!‘
- ‘খুব আলসেমী লাগে। ‘
বাইরে অঝোর দেয়া। অলকার নারীরা ভিজছে বৃষ্টিতে আজ, ভিজছে চড়ুইয়ের ডানা, বিসমিল্লাহর সানাই, হিজলতলায় দাঁড়িয়ে থাকা বাল্যকাল, মেঘদূতের চূয়ান্ন স্তবক, কৈলাশ শৃঙ্গ, খিল-দরজার ওপাশে বৃষ্টিছাঁট অথবা রাজহাঁসের মতো কারো কোমল গ্রীবা।
- ‘ও কালিদাস বাবু, ঘুমাই?’
- ‘আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা!’
- ‘খুব বেসুর আপনার!’
- ‘ঘুমালে উদ্যানের হাতি কে তাড়াবে?’
- ‘তাহলে আবার রামগিরি!’
- ‘হ্যা, নির্বাসন!’
বৃষ্টির ভেতর অখণ্ড নির্বাসন ঘটে আমার। মেঘদূতেরও আর আসতে হবেনা এপাড়ায়; তার বাধ্যতামূলক অবসর।
তবুও এমন দিনে কে কড়া নাড়ে খিল-কপাটে? বলে, ‘বাড়ী আছো?’
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।