ব্যাঘ্র যুগে শুধু মৃত হরিণীর মাংস পাওয়া যায় ঘরটার ভেতরে ভ্যাপসা, স্যাঁতসেঁতে একটা পরিবেশ। ওপরে দুটো ফ্যান দুলে দুলে আলসে ভারবাহী গাধার মত অবিশ্রান্ত ভাবে ঘুরে যাচ্ছে। দেয়ালে ফ্যাকাসে মানব-বর্জ্যের মত রং এবং কোন এক নাম-না-জানা ওষুধের মাথা ধরানো তীব্র গন্ধ বাদ দিলেও, নিচে পড়ে থাকা ময়লা সাদা কাপড়ে ঢাকা সারি সারি লাশগুলোকে পর্যবেক্ষণ করা খুব একটা আনন্দের বিষয় নয়। লাশগুলো পঁচে যাচ্ছে হয়তো, নইলে এত ওষুধের গন্ধ কেন? এসব জায়গায় হিমাগার বা ফ্রিজ-ট্রিজ থাকার কথা, কিন্তু কোথাও সেসবের চিহ্নমাত্র নেই। আরিফ কিছুটা সংকীর্ণভাবে ঘরের কোণায় চাকা লাগানো বেডগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল।
সম্ভবতঃ উচ্চপদস্থ লাশগুলো ওখানে রাখা হয়। হাঃ! লাশের মধ্যেও বিভাজন! দারুণ! ওর মন বিষিয়ে ওঠে।
আরিফ এখন আছে জেলা শহরের একটা লাশকাটা ঘরের ভেতর। ওর পাশে একটা চৌদ্দ বছরের ছেলে আর থানার দারোগা দাঁড়িয়ে আছে। আরিফের দাড়ি ঘামে কুটকুট করে উঠছে, গাল চুলকাতে গিয়ে ও একবার তাকাল দারোগার দিকে।
লোকটা ঘাড় নিচু করে হাতের প্যাডে কিছু লিখছে। নেমপ্লেটে নাম, 'ইয়ামিন'। অদ্ভুত তো! কেমন একটা মেয়েলি মেয়েলি নাম। দারোগা পুলিশের নাম হবে জবরদস্ত- ফারুক, জব্বার বা এই কিসিমের কোন একটা। 'ইয়ামিন' ঠিক মানায় না।
আরেকবার লোকটার দিকে তাকায় ও। হাতগুলোও কেমন, লম্বা লম্বা আঙ্গুল, মনে হচ্ছে প্যাডের ওপরে লোমশ মাকড়সা নেচে বেড়াচ্ছে। এই মুঠি দিয়ে বেচারা ঘুসি মারে কিভাবে?
দারোগা সাহেব ছেলেটাকে একটা ইংগিত করল। ছেলেটা শুয়ে থাকা শরীরসমূহের পা সাবধানে এড়িয়ে কোণার 'উচ্চপদস্থ' লাশগুলোর একটাকে টেনে আনল ওদের কাছে। লাশটার পা বেরিয়ে আছে, ছোট ছোট পা।
ওটাকে ঢেকে রাখা সাদা কাপড়টার একটা অংশ মেঝেতে লুটাচ্ছে। ছেলেটা কাপড়টা হাতে ধরে আরিফের দিকে তাকাল।
আরিফ আস্তে আস্তে বলল, 'আচ্ছা, সরাও তাহলে। '
ছেলেটা মাথা নাড়ল, তারপর লাশটার মুখের ওপরের কাপড় ধীরে ধীরে সরিয়ে ফেলল। মোঃ শরিফ খানের রক্তশূন্য, পাণ্ডুর মুখটা আরিফের চোখের সামনে উন্মোচিত হল।
চোখ দুটো বন্ধ ছিল, ভাগ্যিস! নিজের মৃত ভাইটির খোলা চোখের দৃষ্টি অনুভবের কোন ইচ্ছে ওর ছিল না। শরিফের মাথাভরা কোঁকড়ানো চুল, মাইকেলএঞ্জেলোর ডেভিডের মত খাড়া নাক, আর ক্লিনশেভড ধারাল চিবুক- সবই খুব অদ্ভুতরকম পরিচিত। আরেকটু নিচে, ঠিক হৃদপিণ্ডের মাঝখানে একটা জলজ্যান্ত বুলেট না থাকলে ওকে ঘুমন্ত ভেবে ভুল করলেও দোষ ছিল না। শরিফ...
আরিফ দু'পা পিছিয়ে এলো। দাঁতে দাঁত চেপে বড় একটা নিঃশ্বাস নিতেই ও আবিস্কার করল, কয়েক ফোঁটা নোনতা জল গালে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
আরিফ চোখ বন্ধ করে ফেলল। কয়েক সেকেন্ড পর, সে ঘোলাটে, ভেজা চোখে তাকাল দারোগার দিকে, 'এটা...এটাই আমার ভাই', নিজের গলাই অপরিচিত ঠেকল ওর কাছে, 'ও-ই শরিফ খান'।
এবারে দারোগা নড়েচড়ে উঠল। মাথাটা হ্যাঁ-সূচক ভঙ্গিতে দু'বার নাড়িয়ে প্যাডে কিছু লিখল, তারপর স্থির চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করল আরিফকে, 'মৃতের বয়স কত?'
চোখ মুছে কিছুক্ষণ ইতস্ততঃ করে জবাব দিল আরিফ, 'বত্রিশ বছর। আমাদের জন্মতারিখ ৭ই জুন, ১৯৮১ সাল।
ও আমার চেয়ে কয়েক মিনিটের ছোট'।
'কি করতেন উনি? পেশা কি ছিল?'
-'ঢাকায় একটা মেডিকেল কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভ ছিল। আমাকে বলেছিল কোম্পানির দেওয়া হোন্ডায় করে ওষুধ বিক্রি করে, ভাল আয় নাকি হয়। '
'প্রেমিকা-স্ত্রী কেউ ছিল? ওনার পরিচিত কাউকে চেনেন?
-'ও বিয়ে করেনি। প্রেমিকা ছিল একজন, শারমিন।
মিষ্টি মেয়ে, বাড়িতে দুই একবার এসেছে। বন্ধুদের কাউকে চিনিনা, কখনো দেখিনি। তবে ঢাকায় ওর অনেক বন্ধু আছে। বাড়িতে এলে ঘণ্টায় ঘণ্টায় কল করত। '
প্যাডে খসখস শব্দ আবার।
দারোগা সম্ভবতঃ সারাদিন পুলিশগিরি করে ক্লান্ত; একঘেয়ে স্বরে জিজ্ঞেস করল, 'মৃতের সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল?'
এতক্ষণের জমাটবাঁধা দুঃখ-ক্ষোভে আরিফের চোখ দিয়ে দরদর করে পানি ঝরতে লাগল, 'সম্পর্ক কেমন ছিল মানে? ও আমার মায়ের পেটের ভাই। আব্বা-আম্মা বেঁচে থাকতে যদ্দিন ও বাড়িতে ছিল, ওকে ছাড়া একবেলা ভাত খাই নি। কোন কিছু কিনলে সব সময় জোড়ায় জোড়ায় কিনেছি। সব কাজ একত্রে করেছি। আর ওর লাশের সামনে দাঁড় করিয়ে আপনি জিজ্ঞেস করছেন সম্পর্ক কেমন ছিল?'
এমনতর হঠাৎ আবেগীয় বিস্ফোরণে দারোগাকে তেমন বিচলিত হতে দেখা যায় না।
'তার মানে আপনার বাবা মার মৃত্যুর পর উনি ঢাকা যান?'
নিজেকে শান্ত করে আরিফ, কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে, 'হ্যাঁ। আব্বা-আম্মা অ্যাকসিডেন্টে মারা যাবার পর ও ঠিক করে, ঢাকা গিয়ে চাকরি খুঁজবে। আমি এখানেই একটা মসজিদে ইমামের চাকরি নেই, ওকে কিছু কিছু টাকা পাঠাতে থাকি। অনেক দিন বাড়িতে আসেনি, আমি তবুও টাকা পাঠানো বন্ধ করিনি। মাঝে মধ্যে চিঠি দিত, বলত পড়ালেখা করছে, কখনো মোবাইলে যোগাযোগ করে নি।
'
কেন? উনি মোবাইল ব্যবহার করতেন না?
-'করত, কিন্তু আমাকে মোবাইলে যোগাযোগ করতে নিষেধ করে দিয়েছিল। নাম্বারও দেয়নি। কেন জানি না। '
'আচ্ছা। তারপর?'
-বছর দুয়েক আগে ও হঠাৎ বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়।
বলে, ভাল একটা চাকরি পেয়েছে। তারপর মাসে দু-একবার করে নিয়মিত আসত। ওর সাথে শারমিনও কখনো কখনো আসত। সেই থেকে ওর সাথে আমার যোগাযোগ নিয়মিত হতে থাকে। আমাকে ওদের ফ্ল্যাটে গত সপ্তাহে যেতেও বলেছিল।
আমি যেতে পারিনি, কাজ পড়ে গেছিল কয়েক...'
'আপনার ভাইয়ের কোন ক্রিমিনাল রেকর্ড ছিল?'
আরিফ হঠাৎ যেন ধাক্কা খায়, 'ক্রি...ক্রিমিনাল রেকর্ড? শরিফ? কি বলছেন এসব?' দারোগা কিছু না বলে তাকিয়ে রইল আরিফের দিকে, উত্তরের অপেক্ষা করছে। আরিফের রাগ উঠে যায়, 'অসম্ভব! দেখুন, শরিফ একটু ঘাড়ত্যাড়া প্রকৃতির ছিল, কারো কথা শুনতে চাইত না। কিন্তু আমি আমার মরা বাপ-মায়ের কসম খেয়ে বলতে পারি, ও কোন ক্রিমিনাল ছিল না। '
দারোগা অনেকক্ষণ আরিফের দিকে তাকিয়ে রইল। প্যাডে আবার খসখস।
তারপর সোজা চোখে চোখ রেখে শুকনো গলায় বলল, 'আমাদের কাছে তথ্যসাবুদ আছে, আপনার ভাই ড্রাগ স্মাগলিংয়ের একটা কার্টেলের সাথে যুক্ত ছিল। কার্টেলটা অনেক বড়, বর্ডার থেকে ড্রাগ এনে সারা কান্ট্রিতে ডিস্ট্রিবিউট করত। '
আরিফ মুখ তুলে আরেকবার ভাইয়ের লাশের দিকে তাকাল, হাতের মুঠো শক্ত হয়ে যাচ্ছে ওর, 'বিশ্বাস করি না। আমার ভাইকে আমি চিনি, এসব করা ওর পক্ষে কক্ষনো সম্ভব নয়। এরকম ছেলেই না ও।
'
'মি. আরিফ, প্লিজ। আপনার ভাই অনেক দিন ধরে এসবে জড়িত। বহু বহু প্রমাণ আছে। তাকে হাতেনাতে ধরার জন্য আমরা অনুসরণ করছিলাম কয়েকদিন ধরে। তিন দিন আগে ওদের দুজনের মৃতদেহ আবিষ্কার করি আমরা, শরিফের অ্যাপার্টমেন্টে।
ওর পকেটে ড্রাগ ছিল। কয়েক হাত দূরে, শারমিনের মৃতদেহের কাছে, একটা পিস্তল পাওয়া যায়। ফরেনসিক ডিপার্টমেন্ট বলছে, ওই পিস্তল দিয়েই ওদের খুন করা হয়েছে। '
হঠাৎ যেন মনে পড়ে গেছে, এমন ভঙ্গিতে দারোগা বলতে লাগল, 'ও হ্যাঁ, জানতেন না বোধহয়, শারমিনকেও খুন করা হয়েছে। সে শরিফের মতই জড়িত ছিল কার্টেলের সাথে।
কি আশ্চর্য দেখুন', দারোগা হেসে ফেলে, 'আগে হাইক্লাস প্রস্টিটিউট ছিল, ভালই ছিল, শরিফের সাথে লটকাতে গিয়ে মরল! কার ভাগ্যে কি আছে কে বলতে পারে?'
আরিফ নিশ্চুপ হয়ে গেল। কথাগুলো হজম করতে কষ্ট হচ্ছে ওর।
'আমাদের ধারণা লাভের বখরা নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল, কিংবা শরিফ ওদের কাছ থেকে টাকা মেরে দিয়েছিল। যাই হোক, কোন একটা সূত্র ধরে ওদের মাঝে কথা কাটাকাটি হয়, অসন্তুষ্টি-অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়, এবং কার্টেলগুলোর যা নিয়ম - বেঈমানদের গুলি করে মেরে ব্যাপারটা সেরে ফেলে। '
আরিফ ভগ্নস্বরে যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করে, 'হয়তো...হয়তো ওকে ফাঁসানো হয়েছে দারোগা সাহেব।
কেউ ওকে খুন করে পকেটে ড্রাগের প্যাকেট ঢুকিয়ে দিয়েছে, হয়তো ও এসবে জড়িতই নয়, সব হয়তো ষড়যন্ত্র...হতেও তো পারে, তাই না?'
দারোগা বিরক্তমুখে হাত নেড়ে বাতিল করে দেয় সব যুক্তি, 'অনেক বেশি 'হয়তো' এসে যাচ্ছে, তারমধ্যে আপনার ভাইয়ের ক্রিমিনাল হিস্টোরি অনেক সমৃদ্ধ। ওসব পরে দেখা যাবে। আর লাশ আমরা এখন ছাড়তে পারছি না, তবে ইনভেস্টিগেশন কয়েকদিন পর শেষ হয়ে যাবে, তখন আপনার কাছে লাশটা হস্তান্তর করা হবে। আপনি আপাততঃ যেতে পারেন। '
অর্থাৎ ভদ্রভাবে ওকে নাক না গলিয়ে ভেগে যেতে বলা হল।
আরিফ টলোমলো পায়ে হেঁটে মর্গের বাইরে আসে। এই জায়গাটা শহর থেকে অনেকটা দূরে, নিরিবিলি। দূরে একটা বটগাছ দেখা যাচ্ছে, মাটি পর্যন্ত অসংখ্য ঝুরি নামিয়ে বসে আছে। চারপাশের গাছপালা, পাতা কেমন যেন কালচে সবুজ। পরিবেশটা মর্গের গায়ে একটা প্রাচীন, জান্তব ছাপ লাগিয়ে দিয়েছে।
মানুষ এদিকে খুব একটা আসে না বোধহয়। 'লাশকাটা ঘর'- নামেই ভয় ভয় একটা কিছু আছে। মাথা থেকে সাম্প্রতিক কথোপকথন মুছে ফেলার চেষ্টা করতে করতে আরিফ বটগাছের দিকে হাঁটা দেয়। মাথা অনেকটা হালকা মনে হচ্ছে।
তখন মৃদু গর্জন করতে করতে পেছন থেকে ওর পাশে একটা হোন্ডা এসে থামে।
একটা কালো, বেঁটে, নাকভাঙা লোক হোন্ডার ওপরে বসা, চোখে চতুর অনুগত দৃষ্টি। লোকটা অনুচ্চ স্বরে জিজ্ঞেস করে, 'শরিফ ভাই! দারোগায় কি কইল?'
আরিফ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। এতক্ষণের উদাসীনতা অদৃশ্য হয়ে ওর সারা মুখে শীতল, ক্রুর একটা হাসি ছড়িয়ে পড়ে।
'বৎস', হোন্ডার পেছনে বসার প্রস্তুতি নিতে নিতে ও বলে, 'আমাকে আরিফ বলে ডাকবে। আরিফ।
' ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।