আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

‘ব্লাড পাওয়ার’ : বুয়েটের অভিজ্ঞতা

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুর্নীতিবাজদেরকে অপসারন করুন গত ৩ সেপ্টেম্বর বুয়েটের ক্যাম্পাসে যা ঘটল, শিক্ষাঙ্গনের রাজনীতি তো বটেই, বলা যেতে পারে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিবাদের ভাষায় এটা নতুন এক সংযোজন। বুয়েটের ছাত্ররা নিজেদের শরীরের রক্ত ঢেলে দিল ভিসির কার্যালয়ের সিঁড়িতে। ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত হল ক্যাম্পাস। এটা তাদের প্রতিবাদের ভাষা- ভিসি ও প্রোভিসির ক্ষমতা ধরে রাখা এবং দীর্ঘায়িত করার প্রতিবাদ। বাংলাদেশের ইতিহাসে অতীতে এ রকমটি কখনোই ঘটেনি।

তবে সমসাময়িক দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে এ ‘ব্লাড পাওয়ার’-এর ঘটনা নতুন নয়। পাঠক, ২০১০ সালের মার্চে থাইল্যান্ডের গণআন্দোলনের কথা স্মরণ করুন। সেদিন ‘লাল মাটি’ আন্দোলনকারীরা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছিলেন। ক্ষমতায় ছিলেন অভিজিৎ ভেজ্জাজিভা। একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা নিজেদের শরীরের রক্ত সংগ্রহ করে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের গেটে ঢেলে দিয়ে তৈরি করেছিলেন এক ইতিহাস।

সমাজ বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ এ ঘটনাকে ‘ব্লাড পাওয়ার’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। প্রতিবাদের ভাষা কত নগ্ন হলে এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারে! প্রতিবাদকারীরা প্রতিবাদের একপর্যায়ে নিজেদের রক্ত সংগ্রহ করে তা ঢেলে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের গেটে। পরিণতিতে অভিজিৎকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়। নয়া নির্বাচনে (২০১২) বিজয়ী হন ইংলাক সিনাওয়াত্রা। সে এক ভিন্ন কাহিনী।

কিন্তু বুয়েটের তরুণ প্রজন্ম আজ যে ঘটনার জন্ম দিল, ইতিহাস তার মূল্যায়ন করবে কীভাবে? যুগে যুগে এ তরুণরাই প্রতিবাদী হয়েছে। তারাই সমাজে পরিবর্তন এনেছে। আজকে যারা যুক্তরাষ্ট্রের ‘অকুপাই মুভমেন্টের’ কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন ওই আন্দোলন মূলত তরুণরাই পরিচালনা করছে। গত ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ আন্দোলন তার ৩৫১ দিন পার করেছে। বুয়েটের তরুণদের আন্দোলনের সঙ্গে আমি ‘অকুপাই মুভমেন্ট’-এর আন্দোলনের কোন তুলনা করতে চাই না।

কিন্তু এক জায়গাতে তো মিল আছে- আর তা হচ্ছে ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী’ হওয়া। বুয়েটের এ তরুণ প্রজন্ম অন্যায়ের শুধু প্রতিবাদ করেছে মাত্র। তরুণদের ধর্ম এটাই। বুয়েটের ভিসি ও প্রোভিসি এ ঘটনা থেকে কী শিক্ষা নেবেন আমি জানি না। কিন্তু বুয়েটের মতো একটি উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে তারা কলঙ্কিত করলেন।

কী পেলেন তারা? অধ্যাপক নজরুল ইসলাম যথেষ্ট বিতর্কিত ব্যক্তি। অধ্যাপক হাবিবুর রহমানও কম যান না। অধ্যাপক ইসলাম যখন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ছিলেন, তখনও তিনি বিতর্কিত হয়েছিলেন। তারপর বুয়েটের মতো একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যখন ভিসি হয়ে এলেন, তখন তার উচিত ছিল নিজেকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা। কেননা বুয়েটকে অন্য কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না।

এখানে অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষক রাজনীতিও নেই। অধ্যাপক ইসলাম আজ বুয়েটের সব ঐতিহ্যকে নষ্ট করে দিলেন। আজ ছাত্রদের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকদের রক্তেও রঞ্জিত হল ভিসি কার্যালয়ের সিঁড়ি। এরা তো তার সহকর্মীও ছিলেন। এতে করে কী পেলেন নজরুল সাহেব? তিনি কি এখন তার মানসম্মান নিয়ে এ সমাজে থাকতে পারবেন? তার ছাত্ররা তার কুশপুত্তলিকা দাহ করেছে।

এর চেয়ে আর লজ্জাজনক কী হতে পারে? আমরা তো শিক্ষক। এ শিক্ষকতা কখনও কখনও আমাদের কাউকে ভিসি বানায়, কাউকে বানায় ইউজিসির সদস্য বা চেয়ারম্যান। কিন্তু একজন শিক্ষকের চেয়ে এ পদ কখনোই বড় নয়। শিক্ষক হিসেবে আমাদের যে সম্মান, ভিসি হিসেবে আমাদের সম্মান তাতে বাড়ে না। ইতিহাস নজরুল সাহেবের নাম ঘৃণাভরেই স্মরণ করবে।

যে সহকর্মী ও সন্তানের (ছাত্র তো সন্তানতুল্যই) রক্তে সিঁড়ি ভিজেছে, সেই সিঁড়ি ভেঙে কীভাবে অফিস করবেন নজরুল সাহেব! ভিসি হিসেবে থাকাটা কি বড় হয়ে গেল? পদত্যাগের জন্য সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকার তো আদৌ কোন প্রয়োজন নেই। যে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা তাকে চায় না, ছাত্ররা চায় না- সেখানে কোন লজ্জায় তিনি ক্ষমতায় থাকেন! তিনি যত বেশিদিন ক্ষমতা ধরে রাখবেন, তত বেশি বিতর্কিত হবেন। আমার ভাবতে অবাক লাগে, ভিসির নির্দেশে ৪৯ জন শিক্ষককে অভিযুক্ত করে দুটো চুরির মামলাও দায়ের করা হয়েছে। এভাবে কি শিক্ষকদের বিরুদ্ধে মামলা করা যায়? শিক্ষকরা হচ্ছেন সম্মানিত ব্যক্তি। সবাই শিক্ষক হতে পারেন না।

তাদের বিরুদ্ধে কিনা চুরির মামলা! ভিসির মানসিকতা কোন পর্যায়ে গেলে এ ধরনের মামলা করার নির্দেশ দিতে পারেন! প্রোভিসি অধ্যাপক হাবিবুর রহমানকে নিয়ে কোন কিছু বলার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে আমি মনে করি না। যেখানে সিনিয়রিটির দিক থেকে তিনি প্রায় ত্রিশজনের নিচে, সেখানে শুধু রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা তাকে প্রথমবারের মতো বুয়েটের ইতিহাস এ পদে নিয়োগ দিয়েছে, তার সম্পর্কে কোন মন্তব্য না করাই শ্রেয়। তিনি আদৌ আলোচনার যোগ্য নন। বুয়েটের এ অসন্তোষ আজকের নয়। শিক্ষক তথা শিক্ষার্থীদের আন্দোলন অনেক পুরনো।

এ আন্দোলন নিয়ে উচ্চ আদালত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে একটি রুলও দিয়েছিলেন। ওই সময় শিক্ষক সমিতি আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাদের আন্দোলন সাময়িকভাবে স্থগিত ঘোষণা করেছিল। এটা সত্যিই দুঃখজনক যে, একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সমস্যা নিয়ে উচ্চ আদালতের কাছে রুল চাওয়া হয়েছিল। এ ব্যাপারে ভিসির যে পরোক্ষ সমর্থন ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে ভিসি ও প্রোভিসি ক্ষমতা ধরে রাখার কারণে।

শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা সচিবও পুরোপুরি ব্যর্থ। আজ ছাত্র-শিক্ষকদের ‘স্বেচ্ছায় রক্তপাত’ আন্দোলনের জন্ম হতো না, যদি শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথম থেকেই সংকটের গভীরতা অনুভব করত। তারা আলোচনার নামে অতীতে সময়ক্ষেপণ করেছেন। গত ৩ সেপ্টেম্বর গভীর রাতেও তারা শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন। যদিও শেষ পর্যন্ত একটা সমাধানে তারা এসেছেন।

প্রোভিসি অধ্যাপক হাবিবুর রহমানকে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে সমস্যার আপাতত সমাধান হয়েছে। কিন্তু বুয়েট কলংকমুক্ত হবে না, যদি না ভিসি নজরুল ইসলাম সরে যান। তিনি স্বেচ্ছায় সরে গিয়ে সরকারকে সব ঝামেলা থেকে মুক্তি দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি ‘গোঁ’ ধরে আছেন।

পদত্যাগ তিনি করবেন না। ইতিহাস তিনি পড়েছেন কিনা জানি না। কিন্তু এটা ইতিহাসেরই এক নিয়ম- জোর করে ক্ষমতায় থাকা যায় না। কেউ থাকতেও পারেনি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসিও পারেননি।

আপাতত বুয়েটে ‘দুই উইকেট’ পরে যায়নি এটা সত্য। তবে একটি ‘শিক্ষা’ তো ভিসি নজরুল ইসলাম পেয়েছেন। এটাই তার জন্য যথেষ্ট। এ ক্যাম্পাস তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ‘চুরির’ মামলা দিয়ে তিনি নিজেকে ‘অযোগ্য’ প্রমাণ করলেন।

তাকেও চলে যেতে হবে আজ অথবা কাল। বর্তমান সরকারের আমলে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এমন অনেকে ভিসি হয়েছেন, যাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদান তো দূরের কথা, নাম পর্যন্ত শুনিনি। আর ভিসিদের কর্মকাণ্ড দেখে ভিসি নামক একটি ‘প্রতিষ্ঠানের’ ওপর থেকে সব ধরনের শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস উঠে গেছে। কোন শুভবুদ্ধির মানুষ আগামীতে আর ভিসি হতে চাইবেন না।

ভিসিরা কী ধরনের কাজ করে চলেছেন, তা তো নিত্য পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এবার বিদ্রোহী কবির ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হল না। এটা চিন্তা করা যায়! দুর্ভাগ্যজনকভাবে যিনি ওখানকার ভিসি, তিনি আমার শিক্ষক। আমি নিজেও একসময় ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ছিলাম। শিক্ষা মন্ত্রণালয় কি ভিসির কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে? জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসির আমলে ছাত্রদের ওপর পুলিশ রাবার বুলেট ছুড়েছে।

চিন্তা করা যায়! স্বাধীন বাংলাদেশে পুলিশ ছাত্রদের ওপর গুলি ছোড়ে! হোক না তা রাবার বুলেট! রোকেয়া, পাবনা আর বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ীভসিদের কাজ বোধহয় একটিই- আর তা হচ্ছে নিজস্ব আত্মীয়স্বজন, ছেলেমেয়ে, নিজস্ব এলাকার লোকদের ‘চাকরি’ দেয়া। বিশ্ববিদ্যালয় যেন চাকরির একটা জায়গা! টাকার বিনিময়ে শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় কি এসব বিষয় নিয়ে তদন্ত করেছে? তদন্ত করার প্রয়োজনীয়তা কি বোধ করেছে? শিক্ষামন্ত্রীকে যত সজ্জনই বলি না কেন, শতভাগ সফল বলতে পারছি না। যোগ্য লোককে যোগ্য জায়গায় না দেয়ার কারণেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় একের পর এক সংকট তৈরি হচ্ছে। বুয়েটের ভিসি ও প্রোভিসিকে চলে যেতে হবে, এটা কোন সমাধান নয়।

সমাধান হচ্ছে তারা বুয়েটের যে ক্ষতি করে গেলেন, তার জন্য তাদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো। একজন ব্যর্থ ভিসির জন্য রাষ্ট্র সব দায়দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারে না। ড. তারেক শামসুর রেহমান : বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।