আমার চোখে বর্তমান... ১
রেশমা আপার মাথায় দুদিন পরপর নতুন নতুন ভুত এসে সওয়ার হয়। কখনো রান্নাবান্না, কখনো বুটিক কিংবা কখনো গান বাজনা। তবে সর্বশেষ যে ভুতটি তার মাথায় সওয়ার হয়েছে সেটি বোধহয় কিছুটা গৃহী ধরনের। অন্যান্য ভূতের তুলনায় এ ভূতটি দীর্ঘ সময় ধরে রেশমা আপার মাথায় ভর করে আছে- একারনেই ভূতটিকে গৃহী বলা।
অনেকদিন ধরেই রেশমা আপা সমাজ সেবা নিয়ে খুব মেতে আছেন।
আজকাল অবশ্য চাইলেও সব জায়গাতে অনাথ দুঃস্থদের খোঁজ পাওয়া যায়না। ঢাকার বেশীরভাগ নিম্ন আয়ের মানুষের থাকার নির্দিষ্ট কোন জায়গা নেই। জলে ভাসা পদ্ম’র মত এরা ক্রমাগত ভেসে বেড়ায়। ভাসমান এইসব মানুষের পেছনে ঘুরতে ঘুরতে রেশমা আপা এক সময় উপলব্ধি করলেন আপাত দৃষ্টিতে চোখে দেখা না গেলেও ঢাকায় এধরণের ভাসমান মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কমনা।
খোদ ঢাকাতেই এতোগুলো মানুষ দারিদ্রসীমার এতো নিচে বাস করে যে দুলাভাইয়ের অজস্র ঘুষের টাকাও এর তুলনায় নস্যি মনে হল।
মানুষের এমন পশুর মত বেঁচে থাকা দেখে রেশমা আপার মাথা ঘুরে গেল, সেই সাথে বোধহয় গৃহী টাইপের ভুতটার মসনদ ও টালমাটাল হয়ে গেল।
দিনরাত ভূতের মত বেগার খাটতে খাটতে রেশমা আপার নিজের দিকে তাকানোর সুযোগ হয়নি। কাজের মাঝে থাকলে মানুষ মূলত সুস্থ থাকে। সমস্যা হল রোদ-বৃষ্টিতে দৌড়ঝাঁপ করতে করতে রেশামা আপার গায়ের রঙটাই নষ্ট হয়ে গেছে।
আগেই বলেছি, রেশমা আপার মাথা ভূতদের খুব প্রিয় একটি জায়গা, খুব বেশিদিন সেটি ফাঁকা থাকেনা।
গৃহী ভূতের বিদায়ের ঠিক দুই দিন পর রেশমা আপা যখন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়ালেন- ঠিক সেই মুহূর্তটিতেই তার মাথার উপরের ফাঁকা জায়গাটি নতুন একটি ভুত এসে দখল করে নিল। এই ভুত অবশ্য আগের ভূতটার মত ত্যাগী-নিষ্ঠাবান ধরনের নয়।
নতুন এই ভুতটি স্বভাবে কিছুটা অস্থির প্রকৃতির, সুযোগ পেলেই সেটি অতি আধুনিকাদের মত কোমর বেঁকিয়ে ক্যাটয়াক করে নেয়।
হিসেব অনুযায়ী অনেক আগেই এই ভূতের আগমন হবার কথা ছিল। অবশেষে যখন সে এল, ততদিনে রেশমা আপার চেহারায় বলিরেখারা উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করেছে, সিঁথির কাছটা অনেকটা ফাঁকা।
এতোদিনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে রেশমা আপা দ্বিগুণ উদ্যমে রূপচর্চা শুরু করলেন। পার্লার- ম্যাসেজিং, হারবাল- ইয়োগা, কিছুই বাদ রাখলেননা।
সেদিন কমলা খেতে খেতে টিভিতে মুন্নী সাহার টক শো দেখছিলাম, রেশমা আপা হঠাৎ এসে আমার আর মুন্নী সাহার মাঝে এসে দাঁড়ালেন, আমার হাত থেকে কমলাটা কেড়ে নিয়ে খোসা ছাড়ালেন, তারপর কমলাটা ফেরত দিয়ে খোসা চামড়া সমেত বিদেয় হলেন।
বোঝা গেল, কমলা লেবুর চামড়া বেঁটে ত্বকে লাগালে ত্বক উজ্জ্বল হয়- এ জাতীয় কোন তথ্য কোথাও সদ্য পেয়েছেন।
২
কথা ছিল সুরভীর সাথে দেখা হবে দুপুর বেলা, টিএসসিতে।
দুপুর পেরিয়ে বিকেল হতে চললো, সুরভী এলোনা। বেশ কবার মোবাইল ফোনে চেষ্টার পর ওকে পাওয়া গেল।
শুরুতেই ওপাড়েতে ফ্যাঁচোৎ ফ্যাঁচোৎ শব্দ, কথা কিছুই বোঝা যায়না। অবিরত ফোঁপানির মাঝে যা বোঝা গেল- তা হল ‘ইস্ত্রি দিয়ে ডলাডলির সময় সুরভীর চুল পুড়ে গেছে!’
আমি কিছুক্ষণ বোকার মত করে সংযোগহীন ফোনটি কানে লাগিয়ে দাড়িয়ে রইলাম। বলে কি এরা! চুলের ইস্ত্রি থেরাপি! রেশমা আপার স্টাইল সচেতন ভূতটা কি অ্যালফেবেটিক অর্ডার অনুসরন করে সুরভী পর্যন্ত পৌঁছে গেছে!
মনটা বিবশ হয়ে গেল।
আমি মোটামুটি উদারপন্থী মানুষ, কিন্তু ন্যাড়া মাথার উপর স্কার্ফ পড়া গার্লফ্রেন্ড... নাহ! আর ভাবা যাচ্ছেনা।
বাসায় ফিরে দেখি আমার সদ্য ‘রিটায়ার্ড ফাদার’ গভীর মনোযোগে ডিসকভারি চ্যানেলে কিছু একটা দেখছেন। এটা নতুন কিছুনা, রিটায়ার করার পর বাবা আজকাল প্রায় সারাদিনই টিভির সামনে বসে থাকেন।
যাব যাব করেও আমি হঠাৎ দাড়িয়ে পড়লাম। টিভিতে দেখাচ্ছে চিরযৌবনপ্রাপ্তির ঔষধের উপকরণ- ‘ব্লাড অর্কিড’ এর সন্ধানে একদল বিজ্ঞানী চষে বেড়াচ্ছেন কিলিমাঞ্জেরো পর্বতমালা সংলগ্ন বিপদসংকুল জঙ্গল।
হঠাৎ আমার চারপাশটা কেমন যেন অস্পষ্ট হয়ে গেল। তাকিয়ে দেখি ঘড়ির সর্বকনিষ্ঠ কাঁটাটির চলার গতিও কেমন যেন স্লথ হয়ে গেছে। কিছু একটা ঘটেছে, কেউ একজন আড়াল থেকে সুক্ষ সব নিদর্শনের মাধ্যমে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে যেন!
গত কদিনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর মাঝে কেমন যেন একটা কমন প্যাটার্ন আছে। প্যাটার্নটা এতোই সুক্ষ যে ধরতে পারছিনা।
সারা বিকেল বিছানায় শুয়ে আকাশ পাতাল ভাবলাম।
সন্ধ্যায় চা খেতে বের হব, এমন সময় খেয়াল করলাম দাদুর ঘরে বাতি জালানো হয়নি। সন্ধ্যার মৃতপ্রায় আলোতে দাদু নিশ্চল হয়ে বসে আছেন।
আমি একটু থমকে গেলাম। একসময় দাদুর খুব ন্যাওটা ছিলাম, সেয়ানা হবার পর আকর্ষণটা হঠাৎ কমে গেল। দাদু ও অবশ্য একটু গম্ভীর প্রকৃতির, একলা থাকতেই বেশি পছন্দ করেন।
আমি ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালতে গেলে দাদু অস্ফুট স্বরে বললেন- উঁহু ...
দাদুর বয়স পঁচাত্তরের আশেপাশে। স্বাস্থ্য এখনও বেশ ভালো। একাত্তর সালে নাকি রাইফেল হাতে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন গোটা দেশ, উন্মত্ত’র মত লড়াই করেছিলেন প্রবল সব প্রতিপক্ষের বিপক্ষে।
কিছুদিন আগেও রাজনৈতিক দলের লোকজন এসে বসার ঘরে বসে থাকতো, ওদের মিটিং মিছিলে দাদুকে নেবার জন্য বিস্তর ঝুলোঝুলি করতো। নিভৃতচারী দাদু কখনো তাতে সাড়া দেননি।
কজন আবার ছিল কিছুটা নাছোড়বান্দা ধরনের। নানারকম সুযোগ সুবিধা, উপঢৌকন সহ তারা অনেক চেষ্টা করেও কোন সাড়া পায়নি। ধীরে ধীরে একসময় তাদের আসা যাওয়া পুরোপুরি থেমে যায়।
একটা সময় ছিল প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে দাদুকে জেরবার করে দিতাম। দাদু অবশ্য চেষ্টা করতেন ধৈর্য ধরে আমার সকল প্রশ্নের জবাব দিতে।
আমি একটা মোড়া টেনে দাদুর পাশে বসি। গত দশবছরে দাদুর চেহারায় খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। কিংবা হয়তো হয়েছে... গত দশ বছরে যতদূর মনে পড়ে- কখনো এভাবে এসে দাদুর কাছে বসা হয়নি।
- তোমাকে খুব অস্থির মনে হচ্ছে ... তুমি কি কোন কারনে খুব বেশি চিন্তিত?
আমি একটু চমকে উঠে দাদুর দিকে তাকাই। বয়সের কারনে দাদুর ঘাড়ে কি একটা সমস্যা হয়েছে- বাঁকাতে পারেননা।
দাদু খানিকটা কুঁজো ভঙ্গীতে সামনের মেঝের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আমার দিকে না তাকিয়ে তিনি আমার মনের কথা কিভাবে বুঝলেন!
আমি দাদুকে গত কদিনে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা বিশদভাবে খুলে বললাম। দাদু নিবিষ্টভাবে আমার কথাগুলো শুনলেন তারপর অনেক পরিশ্রম করে ঘাড় বেঁকিয়ে আমার দিকে তাকালেন।
অবাক হয়ে দেখি দাদুর চোখের মনিগুলো কেমনযেন ঘোলাটে, ধূসর বর্ণের। সময়ের মন্থর ঘুণপোকারা সেখানটাতেও পৌঁছে গেছে।
- তোমার অবসারভেশনটা খুব ভালো হয়েছে। হ্যাঁ, ঘটনাগুলোতে একটা কমন প্যাটার্ন আছে। প্যাটার্নটা তোমার নিজেরই ধরা উচিৎ ছিল, মানসিক অস্থিরতার কারনে হয়তো ধরতে পারোনি। প্যাটার্নটা আসলে খুব সিম্পল... খুব কমন- ‘মানুষের অমরত্ব লাভের আকাঙ্ক্ষা’... রেশমার কমলার খোসার ট্রিটমেন্ট কিংবা ব্লাড অর্কিডের সন্ধানে বিজ্ঞানীদের অভিযান- এসব কিছুই ঘটছে মানুষের অমরত্ব লাভের আকাঙ্ক্ষা থেকে।
- আচ্ছা, আপনার তো ডায়বেটিস আছে, আপনাকে তো কখনো দেখলামনা ভোরবেলা হাঁটাহাঁটি করতে! অমরত্বের প্রতি কি আপনার কোন আকাঙ্ক্ষা নেই!
প্রশ্ন শুনে দাদু এই প্রথম একটু হাসলেন।
- আমার কাছে আসলে অমরত্বের সংজ্ঞাটা ভিন্ন। জরাকে জয় করে সবার যে শারীরিকভাবে অমর হবার আকাঙ্ক্ষা, সেটা আমার কাছে অর্থহীন। আমি যে এর অনেক আগে থেকেই অমর হয়ে বসে আছি।
আজকাল কোন কিছুতেই দীর্ঘক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখতে পারিনা। দাদুর কথার মাঝখানে বেকুবের মত হা করে অন্যকিছু ভাবছিলাম।
শেষ কথাটা অস্পষ্টভাবে কানে আসতেই বিষম খেলাম যেন। বলে কি এই বুড়ো! অ্যাঁ! অমর হয়ে বসে আছে! একি পাগল হয়ে গেল নাকি? কামড়ে টামড়ে দেবেনাতো আবার!
দাদু আগের মতই নুজ্যভাবে সামনের মেঝের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, তবে আমি নিশ্চিত আমার চমকে ওঠাটুকু তিনি টের পেয়েছেন।
- হমম... চমকে ওঠারই কথা। গোটা দুনিয়া যে জিনিষটার সন্ধানে হন্যে হয়ে ছুটছে, আমার মতো সেকেলে-অথর্ব একটা বুড়ো সেটা কিভাবে বগলদাবা করে ফেললাম! পাগল-টাগল ভাবছো নাতো আবার!
দেখো- এযুগের মানুষজন ভীষণ আলসে ধরনের। এরা সবসময় শর্টকাট মেথড খোঁজে।
অথচ একটু পরিশ্রম- একটু নিষ্ঠার সাথে কাজ করলেই কিন্তু অমরত্বকে অনায়াসে হাতের মুঠোয় পোড়া যায়। আমার সেটা করতে সময় লেগেছে নয় মাসের মত, উনিশ শো একাত্তরে ... আমার বর্ণমালা, আমার ভাষা, আমার সংগ্রাম, আমার স্বাধীনতাই আমাকে অমরত্বের স্বাদ দিয়েছে। যে কারনে কামুক ধনকুবেরের মত প্লাস্টিক সার্জারি করে অজস্র বছর বেঁচে থাকার মাঝে আমি কোন মানে খুঁজে পাইনা।
সূর্য ডুবে গেছে অনেকক্ষণ হল। দূর নক্ষত্রের ম্লান আলোয় আমি দেখছিলাম আরেক প্রদ্যোত সূর্যকে, যিনিও কিনা পৌঁছে গেছেন শেষের খুব কাছাকাছি।
ঘুণপোকাদের আক্রমণে একের পর এক দুর্গের পতন ঘটছে- ঝরে যাচ্ছে মাথার চুল, ক্ষয়ে গেছে হাড়, দৃষ্টিশক্তি ও অতি ক্ষীণ।
কিন্তু একটা জায়গায় সময় সম্পূর্ণভাবে হার মেনেছে। অনেক চেষ্টাতেও সে পারেনি দাদুর চোখের গভীরের আগুনকে নেভাতে। এ আগুনের উৎস যে অনেক গভীরে প্রোথিত। দেশের জন্য আত্মত্যাগের প্রবল বাসনাই কেবল পারে যে আগুনকে জ্বালাতে।
অস্তগামী সূর্যের সেই অবিনাশী অগ্নিশিখার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ আমার মনে হল- বিজ্ঞানীর দল অহেতুকই কিলিমাঞ্জেরো পর্বতমালা সংলগ্ন দুর্গম জংগলটিতে মাথা কুটে মরছে।
এই পোস্টটি abac-bd.com এর অফিসিয়াল ব্লগের জন্য রনীল এর লেখা Quest for Blood Orchid এর লেখক কর্তৃক অনুবাদ । ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।