পাতায়া সৈকত
পাতায়া সৈকতে এসে মনটায় ভালো হয়ে গেল। এই সেই বিখ্যাত পাতায়া সৈকত? এইখানেই বড় বড় সিনেমার স্যুটিং হয়? আরে এইটা কোন সমুদ্র সৈকত হলো। বাংলাদেশ থেকে যখন আসি তখন মাথায় কত পরিকল্পনা ছিল। সমুদ্র সৈকতে ফুটবল খেলবো না ভলিবল না বিচ ক্রিকেট? খেলাধুলা তো দূরে থাক এতই অপরিসর সমুদ্রসৈকত যে পাশাপাশি হাটার যায়গাও নেই।
[দিনের আলোয় পাতায়া সৈকত]
[রাতের আলোয় পাতায়া সৈকত]
দুইজন মানুষ পাশাপাশি হাটার যায়গা রেখে ছোট্ট সমুদ্রসৈকতের বাকি অংশ সূর্যস্নানের জন্য আরাম কেদারার দখলে।
পাতায়া সৈকতে এসে এই কথা ভেবে ভালো লাগছিল যে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের তুলনায় পাতায়া সমুদ্রসৈকত কিছুই না। কক্সবাজার সমুদ্রে যে বিশাল ঢেউ, সমুদ্রের গর্জন রোমাঞ্চ জাগায়, সেই ঢেউ, মনমাতানো সমুদ্রের গর্জন পাতায়া সমুদ্র সৈকতে নেই। আমাদের যে সুবিস্তৃত বেলাভুমি তার পাশে ঝাউবনের অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য এরা কল্পনাও করতে পারে না। দুঃখের বিষয় আমরা সেই ঝাউবন কেটে বিনাশ করছি, সৈকতের যায়গা দখল করে বড় বড় হোটেল-মোটেল তৈরি করছি। আর এরা এদের যতসামান্য প্রাকৃতিক দানকেই দুই হাত ভরে সাজিয়ে রাখছে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে আমরা অনেক এগিয়ে কিন্তু আমাদের মানসিক দৈন্যতা আমাদেরকে হ্যাচকা টানে নিচে নামিয়ে দেয়। সমুদ্রের তীর ঘেষেই পাতায়া শহর গড়ে উঠেছে। পর্যটন হোটেলগুলো সমুদ্রের কাছাকাছিই। তাই বলে এরা সমুদ্রের বুকে আঘাত দেয়নি। সমুদ্রকে তার আপন খেয়ালে চলতে দিয়ে তার তীর ঘিরে গড়ে তুলেছে জনপদ।
আনন্দ করতে এসে কেউ যাতে নিরান্দের শিকার না হয়, কারও বুকে শোকের ছায়া নেমে আসে তার জন্য যথেষ্ট সতর্কব্যবস্তা এরা করে রেখেছে। সমু্দ্রে গোসলের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় যায়গা নির্দিষ্ট করা আছে। আমাদের দেশে যেইটা হয়, প্রতিবছরই কক্সবাজার সমুদ্রে নেমে কয়েকজন না ফেরার দেশে পারি জমায়। পাতায়া কর্তৃপক্ষ চাই না এমন কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটুক। অবশ্য কক্সবাজার সমুদ্রে কিছুদূর পর পর বিপদজনক গিরিখাদ এখানে তেমনটা নাই অথবা আছে।
আমরা জানি না। কারণ এরা সমুদ্রের সব যায়গায় নামার জন্য অনুমতি দেয় নি। সমুদ্রে নামার যায়গা নির্ধারিত করে দিয়েছে। সেই যায়গায় আপনি নামলে বিপদমুক্ত থাকবেন।
পাতায়া সমুদ্রসৈকত নিয়ে আর তেমন কিছু বলবার নেই।
পাতায়ার মূল আকর্ষণ কোরাল আইল্যান্ড। অপ্রকৃতির অকৃপণ দান বলতে যেমনটি বোঝায় কোরাল আইল্যান্ডে তেমন সৌন্দর্য্য পর্যটকদের অভিভূত করে। তাই পাতায়া সমুদ্র ছেড়ে ঘুরে আসা যাক কোরাল আইল্যান্ড থেকে।
কোরাল আইল্যান্ড
স্পীডবোটে আধাঘন্টায় ... সমুদ্র পাড়ি দিয়ে যেতে হয় কোরাল আইল্যান্ডে। সমুদ্রের মাঝখানে সবুজ পাহাড়সন্নিবেশিত নয়নাভিরাম দ্বীপ।
স্পীডবোটে কোরাল আইল্যান্ডে যাবার অভিজ্ঞতাটা দারুন। সমুদ্রের নীলজল চিরে দূরন্তবেগে আমাদের স্পীডবোট কোরাল আইল্যান্ডের পানে ছুটে চলে। এখানকার স্পীডবোটগুলো আকারে বড় এবং দূরন্তগামী। একেকটা স্পীডবোটে পঁচিশজন উঠতে পারে। পঁচিশজন মানে পঁচিশজনই।
এরা ছাব্বিশজন কখনই উঠাবে না। এতবড় স্পীডবোটে পঁচিশজন মাত্র! আমাদের দেশে হলে পশ্চাশ নির্বিঘ্নে উঠতে পারতো! স্পীডবোটে উঠেও অনেকনিয়ম কানুন। চুপচাপ বসে থাকতে হবে। এমনকি দাড়ানো যাবে না। আমরা বাঙালী বসে থাকার জাত! ফলাফল যা হলো মাঝ সমুদ্রের স্পীডবোট ড্রাইভার হুট করে স্পীডবোট বন্ধ করে দিল।
কী ব্যাপার? কী সমস্যা? স্পীডবোটে কয়েকজন দাড়িয়ে ছবি তুলছে। তারা না বসা পর্যন্ত স্পীডবোট চালু হলো না। চুপচাপ বসে থাকা সম্ভব না এইটা স্পীডবোট ড্রাইভার বেটা তো বুঝবে না। দূর থেকেই পাতায়ার সৌন্দর্য্য বেশি ভালো লাগে। ঝকঝকে নীল আকাশে, আকাশের নিচে চকচকে নীল জল, পাতায়া সমুদ্রসৈকতের পাশেই মাথা উচুকরে দাড়ানো আকাশ ছোয়া অট্টালিকা।
[ঐ দূরে পাতায়া শহর]
ক্যামেরা নিয়ে আসছি কী খাপ বন্দি রাখার জন্য। তোদের দেশে ঘুড়ে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা যদি ক্যামেরাবন্দি না করতে পারি তাহলে আসলাম কেন? এতসব নির্বোধ স্পীডবোট ড্রাইভাররে বোঝানো গেল না। তাই শুয়ে, বসে, ক্রলিং করে যতটুকু পারা যায় সমুদ্রভ্রমণের অভিজ্ঞতা ক্যামেরাবন্দি করার চেষ্টা করলাম। কোরাল আইল্যান্ডের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য নিঃসন্দেহে পাতায়া সমুদ্র সৈকতকে হার মানায়। কোরাল আইল্যান্ডের পানি গাঢ় নীল, স্বচ্ছ, এতটাই স্বচ্ছ যে পানির নিচে মাছের ঝাক দেখা যায়।
পাতায়া সৈকতের মতো এখানকার সমুদ্রসৈকত ছোট নয় যথেষ্ট বড়। আরামসে ফুটবল খেলা যায়। কিন্তু কোথায় খেলা? কিসের খেলা? কোরাল আইল্যান্ডে নেমেই বাঙালীরা স্বভাবতই ছত্র ভঙ্গ হয়ে গেল। যে যেদিকে পেরেছে দৌড় দিছে। এমন প্রকৃতিতে কাউকে কী ধরে রাখা যায়?
নানাদেশের পর্যটকে টইটম্বুর কোরাল আইল্যান্ডের সৈকত।
পশ্চিমারা যেমন এসেছে, ভারতীদের সংখ্যাও অনেক, থাইদেশটা যেহেতু অনেক বড় তাই স্বদেশীদের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য। শুধু কালো চামড়া মানুষই চোখে পড়লো না। নানাবর্ণের মানুষ তাই পোশাক-আচারেও বৈচিত্রে ভরপুর কোরাল আইল্যান্ডের এই ছোট দ্বীপটি। প্রকৃতির সানিধ্যে এসে প্রকৃতির সাথেই মিশে যেতে হবে এমন ধারণায় পশ্চিমারা বিকিনিকিতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
স্বদেশী থাইদের পাওয়া গেল ঝলমলে রঙের পোশাকে।
তাদের বিকিনিকিও ঝলমলে রঙের।
ভারতীয় আর বাঙালীরা পোশাক খূলবে কী খুলবে না এমন দ্বিধাদ্বন্দ্বে ঘোরাঘোরি করতে দেখা গেল।
ট্যুর গাইড আমাদের বলে দিয়েছে ঠিক একটায় ছাতার নিচে (আমাদের বসার জন্য নির্ধারিতস্থান) উপস্থিত হতে হবে। প্রথমদিনেই বুঝে গেছি, একটা মানে একটা পাঁচ হতে পারে কিন্তু একটা দশ কখনই নয়। সমুদ্রের জলে মাত্রই গলা পর্যন্ত ডুবেয়েছি এর ভিতরেই একটা বেজে গেল।
সময় কী এখানে দ্রুত গতিতে এগোয়? ভেবেছিলাম, একদম পাহাড়ের মাথায় উঠবো। নিচ থেকে দেখা যাচ্ছে, পাহাড়ের মাথায় মানুষের জটলা। নিশ্চয়ই ওইখানে প্রকৃতির অপার্থিব কোন সৌন্দর্য্য লুকিয়ে আছে। পাহাড়ের ওপাশে অন্যকোন সৈকত হয়তো আছে। মনের মাঝে এমন হাজারো হয়তোর জন্ম নিয়ে ঠিক একটায় ছুটতে ছুটতে ছাতার নিচে হাজির হলাম।
সেই সকাল থেকে দেখছি সাদা চামড়ার মানুষগুলো কী আলস্য ভঙ্গিতে সূর্যস্নান করছে। সৈকতের তীরে নানা ভঙ্গিমায় বিকিনিকি পরিহিত কয়েকজন সুন্দরী মডেলকে দেখা গেল ফটোস্যুটে ব্যস্ত।
কেউ কেউ মহিষের মতো গলা পানিতে শরীর ঢুবিয়ে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। কারও কোন তাড়া নেই। যত তাড়া ভারতীয় আর আমরা বাঙালীদের।
হুড়োহুড়ি করে কোনরকমে নীল জলে ঢুব দিয়ে, ত্যাড়াব্যাকা করে দাড়িয়ে ফটাফট ছবি তুলে দে দৌড়। দুপুরের খানার জন্য লাইনে দাড়িয়ে গেল। কোরাল আইল্যান্ডে আমরা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টের খাবার খেলাম। একদম বাঙালী খাবার। ভাত, মুরগীল ঝোল, ডাল, আলূর ডোম।
আমার কাছে ডালটাই যা একটু খাবারযোগ্য মনে হলো। আর কোন খাবারেই কোন স্বাদ পেলাম না। এমনকি পানিটাও বিস্বাদ। খাবার শেষতো ট্যুর গাইডের দায়িত্ব শেষ। আমাদেরকে কোনরকমে স্পীডবোটে উঠিয়ে দিতে পারলেই বাঁচে।
দুপুরের খাবারের পর পর আমাদের স্পীডবোটে উঠে পড়তে হলো। কোরাল আইল্যান্ড যতই সুন্দর হোক, এক কোরাল আইল্যান্ডে পরে থাকলে তো চলবে না। পাতায়া শহর জুড়েই দর্শনীয় অনেককিছুই রয়েছে। কিন্তু আমাদের হাতে অফুরন্ত সময় নেই। যতসামান্য সময়টা যতটুকু কাজে লাগানো যায়, তাই কোরাল আইল্যান্ডে অল্প সময়ে দারুন মুহুর্ত কাটিয়ে ফিরে এলাম পাতায়া শহরে।
আমার দেখা থাইল্যান্ড পর্ব-১
আমার দেখা থাইল্যান্ড পর্ব-২
আমার দেখা থাইল্যান্ড পর্ব-৩ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।