ওয়াল্ড জেমস গ্যালারী এবং আমাদের ব্যর্থ বিকাল
হীরা রত্ন জহরতের প্রতি আমার বিন্দু মাত্র আগ্রহ নেই। তারপরও সকলের সাথে আমিও আমাদের নির্দিষ্ট ট্যুর বাসে চড়ে বসলাম। আমাদের এই বাসটা ওয়াল্ড জেমস গ্যালারীতে নিয়ে যাবে। এইটা নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ডায়মন্ড গ্যালারী। আমার আর আমার রুমমেট-এর পরিকল্পনা ছিল আমরা ট্যুর বাসে চেপে ওয়াল্ড জেমস গ্যালারী পর্যন্ত যাবো।
তারপর ঔখান থেকে নিজস্ব ব্যবস্থায় পাতায়া শহরের একদম শেষপ্রান্তে সমুদ্রের তীরঘেষে অবস্থিত স্যাঙচুরি অব ট্রুথ দেখতে যাবে। কাঠের তৈরি এই সুউচ্চ মন্দিরটি থাইশৈল্পিক স্থাপত্যের একক অনন্য সৃষ্টি। অন্তর্জাল থেকে পাওয়া তথ্য, স্যাঙচুরি অব ট্রুথে শিল্পের ছোয়ায় হিন্দু, বৌদ্ধ ধর্ম, থাইল্যান্ড, চীন, কম্পোডিয়ার পুরাণকাহিনী, সেই সময়কার মানুষের দর্শণ তুলে ধরা হয়েছে।
(স্যাঙচুরি অব ট্রুথ, উৎস: অন্তর্জাল)
ওয়াল্ড জেমস গ্যালারী থেকে দূরত্বটা কম হবে তাই সকলের আমরাও ওয়াল্ড জেমস গ্যালারীতে হাজিরা দিই। ভেবেছিলাম বাস থেকে নেমেই দলছুট হবো।
দলছুট হওয়া হলো না। বাস থেকে নামতেই কিছু বোঝার আগেই আমাদের ঠেলে ওয়াল্ড জেমস গ্যালারীর ভিতরে নিয়ে যাওয়া হলো। সবার গলায় একটা ভিজিটিং কার্ড ঝুলিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো অন্ধকার হলরুমে। সেখানে দশ মিনিটের একটা প্রামান্যচিত্র প্রদর্শিত হলো। ডায়মন্ড আহরণ থেকে শুরু করে তার বাজারজাতকরণের সমগ্র প্রক্রিয়া সুন্দরভাবে সেই প্রামাণ্যচিত্রে তুলে ধরা হয়েছে।
প্রামাণ্যচিত্র শেষ হবার সাথে সাথেই একজন চৌকস বিপনন কর্মী হাজির। সে আমাদের ওয়াল্ড জেমস গ্যালারীর বিভিন্ন শিল্পকর্মের নিপুন বর্ণনা দিচ্ছে আর সেই সাথে দামটা উল্লেখ করতেও ভুল করছে না। প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থীদের মধ্যে একজন দর্শনার্থীও যদি বিপননকর্মীর উপস্থাপনায় মুগ্ধ হয়ে কোন শিল্প কর্ম কেনে তাহলেই সারাদিনের ব্যবসা হয়ে যাবে। কারণ একেকটা শিল্পকর্মের দাম লাখ থেকে মিলিয়ন বাথ। সাধ্যের ভিতরেও কেনাকাটা করার ব্যবস্থাও আছে।
(রত্নসজ্জিত শিল্পের কারুকাজ)
ডায়মন্ডপ্রিয়দের জন্য এই গ্যালারীটা ভালো লাগবে আমার মতো নিরাসক্ত ব্যক্তির জন্য এইটা উপযুক্তস্থান নয়। তাই ওয়াল্ড জেমস গ্যালারী থেকে বের হবার পথ খুঁজছি। কিন্তু ভিতরে এতো বেশি চোরাগলি যে ওয়াল্ড জেমস গ্যালারী থেকে বের হবার পথ খুঁজে পাচ্ছি না। অবশ্য প্রতিটি গলিতেই চমক আছে। এতো কাছে এতো মূল্যবান রত্নসম্ভার দেখার সুযোগ হলো।
একদম কাছ থেকে দেখার সুযোগ হলো কিভাবে কর্মীরা ডায়মন্ড তৈরি। ওয়াল্ড জেমস গ্যালারীর ভিতর থাইল্যান্ডের নিজস্ব তৈজসের একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর আছে। কিন্তু দামটা একটু বেশি চড়া। ওয়াল্ড জেমস গ্যালারীর ঠিক অপরপাশেই রুয়েন থাই ওটপ। থাইল্যান্ডের নিজস্ব পণ্যসম্ভারের অনেক বড় একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর।
কি নেই এখানে? আসবাবপত্র, কসমেটিক সামগ্রী, পোশাক-আশাক, চকলেট আরও বহুরকমের তৈজসপত্র। থাইল্যান্ড থেকে স্যুভেনিউর হিসেবে কেনা কাটা করার জন্য আমার মতে একটা আদর্শ দোকান। দামটাও তুলনামূলকভাবে কম।
(পাতায়া শহর)
ওয়াল্ড জেমস গ্যালারীতে বের হয়ে এখানে ঘোরাঘুরি করে হাতের অনেকটা সময় নষ্ট করে ফেললাম। কেনাকাটার নেশাকে রদ করে অবশেষে আমি আর আমার রুমমেট স্যাঙচুরি অব ট্রুথের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম ।
আমাদের পরিকল্পনা ছিল ম্যাপ দেখে হাটতে হাটতে যাবো। সময় একটু বেশি লাগলেও শহরটা দেখতে দেখতে যাওয়া হবে। তাছাড়া ম্যাপ দেখে আন্দাজ করেছিলাম ওয়াল্ড জেমস গ্যালারী থেকে আধাঘন্টা হাটলেই স্যাঙচুরি অব ট্রুথে পৌছে যাবো।
দেখা গেল আমাদের ধারণা ভুল। আধাঘন্টা হেটে আমরা মাত্র অর্ধেক পথ আসতে পেরেছি।
রাস্তায় সব জায়গায় থাই ভাষায় লেখা। ঠিকপথে এগোচ্ছি কিনা মাঝে মাঝে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছিলাম। কিন্তু কারও কাছে যে জিজ্ঞেস করবো তার কোন উপায় নেই। কেউই থাইভাষা ছাড়া দ্বিতীয় কোন ভাষা জানে না। ম্যাপ দেখিয়ে অনেক কষ্টে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে বুঝে নিতে হচ্ছে আমরা ঠিক কোথায় আছি।
আধাঘন্টা এভাবে হাটার পর সিদ্ধান্ত নিলাম এভাবে হবে না। দিনের আলো নিভে আসতে শুরু করেছে। স্যাঙচুরি অব ট্রুথে যেতে হলে এখনই আমাদের কোন যানবাহনে উঠতে হবে। অনেক কষ্টে এক জীপওয়ালাকে বোঝাতে সক্ষম হলাম কোথায় আমরা যেতে চাচ্ছি কিন্তু সে আমাদের হতাশ করা তথ্য দিলো যে স্যাঙচুরি অব ট্রুথ ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে। এখন যাওয়া থেকে না যাওয়ায় ভালো।
ব্যর্থ মনোরথের ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হলো। তবে ফিরে আগেই আমরা অল্পসময়ের জন্য ওয়াট ফোটিস্যাম্পানে একবার ঢু মারার সুযোগ হলো। এটিও একটি কাঠের তৈরি বৌদ্ধমন্দির। এই পাতায়া শহরে এমন অসংখ্য মন্দির পাবেন। হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকলে মন্দির এবং সেই সাথে থাই শিল্পের সাথেও পরিচিত হবার সুযোগ পাবেন।
বিগবুদ্ধ দর্শণ
আগামী সকালেই আমরা পাতায়া শহর ছেড়ে যাবো। এক পাতায়া শহরেই প্রচুর দর্শণীয় স্থান আছে যার অনেক কিছুই সময়ের অভাবে দেখা হয়নি। তাই আজকের রাতটা যতটুকু কাজে লাগনো যায়। ম্যাপ দেখে দ্রুত বের করলাম কোথায় যাওয়া যায়? গন্তব্য বিগ বুদ্ধ। পাতায়া শহরের সবচেয়ে উচুতে বিশাল বড় বৌদ্ধমন্দির।
হোটেল থেকে স্থানীয় জিপ গাড়িতে চড়ে আমরা একটা ফ্লাইওভারের নিচে নেমে পড়লাম। বর্তমানে আমাদের দলের সদস্যসংখ্যা চার। এখন ম্যাপ দেখে পথ এগোনো। এর আগে কখনো এভাবে ম্যাপ দেখে পথ আবিস্কার অভিজ্ঞতা হয় নি। তাই বেশ একটা এ্যাডভেঞ্চার এ্যাডভেঞ্চার মনে হচ্ছে।
উচু পাহাড়ে আমরা চারজন আর কোথাও কেউ নেই। হুট করে দুএকজন স্থানীয় বাসিন্দা সামনে চলে আসছে। পাহাড়ী এই এলাকা পাতায়া থেকে সম্পূর্ণ অন্যরকম। নির্জন, আমার কাছে বেশ গুরগম্ভীরও মনে হলো। ক্যামন একটা গা ছমছমে ভাব আছে।
হয়তো রাত এবং রাস্তার আধো আলো আধো অন্ধকারের জন্যই এমনটি মনে হচ্ছে। সবচেয়ে ঘাবড়ে গেলাম যখন একদল কুকুর ঘেউ ঘেউ করতে করতে আমাদের পথ রুদ্ধ করে দাড়ালো। আক্রোশে কুকুরগুলো গড়গড় করছে। পারলে এখনই কাঁচা খেয়ে ফেলে। কি বাবা! তোদের দেশে এসেছি বলে এই তোদের আতিথিয়তা।
আমরা সামনে এগোবো কি এগোবো না বেশ দ্বিধাদ্বন্দ্বে পরে গেলাম। কুকুরগুলো যেভাবে পথ রোধ করে দাড়িয়ে আছে যে সামনে যাওয়া মুশকিল। আমাদের এই দূরাবস্থা দেখে অন্ধকার ফুরে এক স্থানীয় ভারতীয় লোক আমাদের সাহায্যে এগিয়ে এলো। সেই আমাদেরকে বিগবুদ্ধের মূর্তির কাছে নিয়ে গেল। এবং আবারও প্রমাণ হলো যত গর্জে তত বর্ষে না।
কুকুরের ঘেউ ঘেউ আমরা সামনে যেতেই মিইয়ে গেল। বজ্জাতগুলো আস্তে করে রাস্তা ছেড়ে কু কু করছে।
বিগবুদ্ধে এসে আপসোস হচ্ছিল কেন দিনের আলো থাকতে থাকতে এখানে আসতে পারলাম না। দিনের উজ্জল আলোয় সোনালী রঙের বৌদ্ধমূর্তিগুলোর দ্যুতিময় আলোকচ্ছটা দেখা হলো না। পাতায়া শহরের একদম উচুতে বিগবুদ্ধ মুর্তি।
সম্পূর্ণ সোনালী রঙের সবচেয়ে মূর্তিটার উচ্চতা হবে আনুমানিক ২০ মিটার। স্থানীয় ভাষায় মুর্তিটার নামকরণ Khao Phra Ya)। এই Khao Phra Yai কে ঘিরেই ছোট বড় আরো সাতটা সোনালী বর্ণের বৌদ্ধ মুর্তি রয়েছে। সব ধর্মীয়স্থানের মতো এখানেও শান্তি শান্তি পরিবেশ। রাতের বেলা বলেই হয়তো মানুষের সমাগম নেই।
আমরা যখন সেখানে গেলাম দেখি তিন থাইযুবতী প্রার্থণারত। বিগবুদ্ধের একদম শেষপ্রান্তে সাদাচামড়া একজোড়া যুবক-যুবতী অন্তরঙ্গভাবে বসে গিটারে টুংটাং করছে। আমাদের দেশে ধর্মীয় উপসানলয়ে সব সময় নিরবতা পালন করা হয়ে থাকে তাই বিগবুদ্ধ মন্দিরে গিটারে টুংটাং শব্দে একটু অবাকই হয়েছিলাম। ধর্মটা আসলে নিজের ভিতর। যে যেমনভাবে পারে পালন করে।
একদম শহরের মাথায় দাড়িয়ে এক পলকে রাতের লালনীল রঙিন বাতিতে উজ্জল পাতায়া শহরকে দেখার অনুভুতিটাও অন্যরকম। পায়ে হেটে পাহাড়ের মাথায় উঠতে যথেষ্ট ঘাম ছড়াতে হয়েছে। এখন এই উপরে আকাশের কাছাকাছি পৌছে সেই ক্লান্তি দূর হয়ে গেল।
(চলবে...)
আমার দেখা থাইল্যান্ড পর্ব-১
আমার দেখা থাইল্যান্ড পর্ব-২
আমার দেখা থাইল্যান্ড পর্ব-৩
আমার দেখা থাইল্যান্ড পর্ব-৪
আমার দেখা থাইল্যান্ড পর্ব-৫
আমার দেখা থাইল্যান্ড পর্ব-৬
আমার দেখা থাইল্যান্ড পর্ব-৭
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।