সময় বেশী নেই। আর একটু পরই পশ্চিমাকাশে টুকটুকে আভাটা মিলিয়ে যাবে। চোখের সামনে বহমান ধানসিঁড়ি। রক্তিম ছায়া পড়েছে ঝকঝকে জলের প্রশস্ত বুকজুড়ে। চারপাশ নিরব নিথর জনশূন্য।
একাকী আনমনে দীপ্র ভাবছে অর্পিতার কথা। অর্পিতার সাথে ওর যখন দেখা হয় তখনও সময়টা এমনই ছিলো। আকাশ ছিলো লালে লাল। ফাগুনের আগুন তখন ফিকে হয়ে যায়নি। ভাব ভালোবাসার প্রথম প্রহরে তারা দু'জন দেখেছিলো স্বপ্নের সাজানো বাগান।
গল্পের বিকেলে ওর হাতটা ধরে বলেছিলো- 'তোমার মনের সমস্ত আভা জুড়ে আছে নীল দিগন্তে। নীল সেজেছে আজ লালে। আমরা বেঁচে থাকবো এমন রঙেই।
গ্রামের বাড়িতে খুব কম আসা হয় দীপ্র'র। বাবাহীন সংসারে একমাত্র মা'ই সব।
কত সুন্দর করে আগলে রেখেছেন মা! হাজার কথাতেও এই মাকে তার নিজের কাছে রাখতে পারেনি সে। ইট কাঠের নগর তার মায়ের কাছে নাকি কবুতরের বাক্সের মতই লাগে। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। এজন্য সেই বাক্সের মাঝে কযেকমাস পর পর একটু বন্দী হলেও হাপিয়ে ওঠেন তিনি। ফিরে আসার ব্যাকুলতা প্রকাশ করেন বারবার।
ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে থাকেন- সদর দরজার সামনে দন্ডায়মান শিরীষ গাছটার কথা। যে গাছের সাথে মিশে আছে তার প্রাণের ছোঁয়া। যাকে স্পর্শ করলে তার প্রাণটাকে স্পর্শ করা হয়। দীপ্র'র জন্মের কিছুদিন আগে এই গাছটা লাগিয়েছিলো দীপ্র'র বাবা। এর পাতাগুলো নাকি অদ্ভুত সুন্দর।
বাতাসে একধরনের শব্দধ্বনি হয় যা তাকে আলোড়িত করে ভীষণরকম। স্মৃতির জানালায় এভাবেই হাতিয়ে বেড়ান তার মা মনোয়ারা বেগম।
একই গ্রামে খুব কাছাকাছি বাস করতো দীপ্র আর অর্পিতা। মাঝখানে ধানসিঁড়ি নদী। নদীটাই একমাত্র ব্যবধান।
মা মনোয়ারা বেগমের খুব কাছের মানুষ হলেন অর্পিতার পরিবার। দীপ্র'র তাই ছোট থেকেই আনাগোনা ঐ পরিবারকে ঘিরে। নদীর দুরত্ব আহামরি কিছু না হলেও মনের দুরত্ব ছিলো একেবাড়ে শূন্যের কোঠায়। একদিন শীতের ভোরে, ভরা উঠোনের এককোণে বসে বসে শিউলিমালায় জড়িয়ে রেখেছিলো অর্পিতা নিজের শরীরটাকে। পড়নে তার শুভ্র পোশাক।
সেই মুহূর্তটিকে দীপ্র'র অসাধারণ মনে হয়েছিলো। মনে হয়েছিলো- আকাশ থেকে কোনো এক শুভ্র পরী আচমকাই পথ ভুলে, এ বাড়ির উঠোনে ক্লান্ত হয়ে বিশ্রামে মগ্ন হয়ে আছে। কতইবা বয়স তখন তাদের! কিন্তু ভালোলাগার প্রথম পাঠ সেই থেকেই শুরু।
মনের অজান্তেই মনঘরের অলিগলি ঘিরে থাকে ফুল, পাতা, লতা আরো কত কি! একই গাঁয়ের জল, বাতাসে মাখামাখি করে যখন তারা অন্য অনেকের সাথেই তারুণ্য স্পর্শ করতে যাচ্ছে ঠিক তখনই অর্পিতা চলে যায় সাগরের কাছাকাছি, পার্বত্য শহরে। সেখানে তার বড় কাকু থাকেন।
তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। শখ করে ছোট ভাইয়ের বড় কন্যাটিকে তার কাছে রেখে পড়াবেন এমন আব্দার ফেলতে পারেননি অর্পিতার মা। অর্পিতা বাড়ি থেকে যাওয়ার পর বাকী চার সন্তানকে নিয়ে অর্পিতার মায়ের অন্যরকম ব্যস্ততায় কাটতে থাকে। আর দীপ্র একটা পর্যায়ে পড়াশুনার জন্য চলে আসে জটের শহরে। শুরু হয় হাজারো ব্যস্ততার দিন।
পেছনে পড়ে থাকে শান্ত ধানসিঁড়ি আর মনের কোণে বয়ে যায় অশান্ত মনের ওলটপালট ঢেউ।
এরপর অনেকগুলো দিন পেরিয়ে যায়। অর্পিতার সাথে তার অনেক বছর দেখাদেখি নেই। ইচ্ছে করেই কোনো ধরনের যোগাযোগই তারা রাখতোনা। তারা উভয়েই মনে করতো- মন ঠিক থাকলে সব ঠিক থাকবে।
দেখা হওয়া বা কথা বলা এসব তেমন জরুরী কিছুই না। তবুও ইচ্ছে যে করতো না তা কিন্তু নয়। দু'জনেরই নিয়ন্ত্রণক্ষমতা ছিলো অসীমের কাছাকাছি। অর্পিতা পড়াশুনা শেষ করে একটা ব্যাংকে নিজেকে থিতু করেছে। নিজের গ্রামে সময় পেলেই ঢু দিয়ে যায়।
কখনো একরাশ স্মৃতির বাতাস এসে এলোমেলো করে দেয় তাকে। খুব ছুটতে ইচ্ছে করে তার সেই শহরে, যেখানে তার প্রাণের অংশ আছে। আর এদিকে দীপ্র একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে খুব ভালো বেতনে নিজের জীবনটাকে সাজাচ্ছে । ঝকঝকে মুখটার বাম গালে ছোট্ট একটা টোল পড়তো হাসির সময়। এখন আরাম আয়েসের জীবনে, প্রসারিত হাসিতে সেই টোলও যেনো প্রসারিত হচ্ছে।
অনেকদিন মা'র সাথে দেখা হয়না দীপ্র'র। তার এই একাকী জীবন নিয়ে তার মায়ের দুশ্চিন্তার সীমা নেই। একদিন মায়ের অসুস্থ্যতার জরুরী সংবাদ পেয়ে মায়ের কাছে ছুটে আসা দীপ্র অবাক হয়ে যায়। শিরীষ গাছের নিচে পেতে রাখা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে অচেনা একজন। পেছন থেকে তার দুই বিনুনী ছাড়া কিছুই নজরে পড়ছেনা।
কাছে এসেই চোখ ছানাবড়া অবস্থা। স্মৃতির জানালা দিয়ে বাড়িয়ে দেয় হাত। সেই হাতে উঠে আসে একরাশ শিউলি আর স্নিগ্ধ সেই মুখ! নিজের কাছে নিজেরই এক অপার বিস্ময়। মুখোমুখি হলো দু'জন। কেউ কোনো কথা বলতে পারছেনা।
অতি আনন্দের প্রকাশটা গড়ালো দু' চোখ বেয়ে। কিছু না বলেও বলা হয়ে গেলো নিযুত কথামালা। স্পর্শ না করেও করা হয়ে গেলো কত কি!! এদিকে, বাড়ির ভেতরে চেনা মানুষের কন্ঠ শোনা যাচ্ছে। মা ছাড়াও আরো অনেকেই আছেন। অর্পিতাদের বাড়ি থেকে কয়েকজনকে দেখা গেল।
দীপ্রকে নিয়ে হুলুস্থুল শুরু হয়ে গেলো। ইতিমধ্যে ছেলের একাকী জীবনটাকে দোকলা করার মানষে তার মা যে কত নিপাটভাবে সবটা গুছিয়েছেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। বেশ জাকজমকপূর্ণ অবস্থায় জীবনের শ্রেষ্ঠ ঘটনাটা ঘটে গেলো দীপ্র আর অর্পিতার। শুরু হলো অন্যরকম সম্ভাবনার জীবন।
সেই রাতে আকাশ পেতেছিলো মেঘের চাদর।
ভীষণ বাতাস বইছিলো। পুরো বাড়িটাকে দোলনচাঁপায় সাজানো হয়েছিলো। দীপ্র সেই রাতে দেখলো নতুন রুপে অর্পিতাকে। যে অর্পিতাকে সে দেখেছে সাদামাটা, নারীসুলভ প্রসাধনীর লেশমাত্র যার কোথাও আশ্রয় হয়নি সেই অর্পিতা আজ ফুলের সাজে। কী অপরুপ লাগছে তাকে! শুরুটা করলো দীপ্র নিজেই।
অর্পিতার মুখটা সুখদর্শন ফুলের মতই নিচু হয়ে আছে। মাটি ছুঁই ছুঁই অবস্থা। চোখটা মেলতেই পারছেনা। এ না পারাতে একধরনের পুলক করা বিষয় কাজ করে ভেতরে, যার পুরোটাই দীপ্র অনুভব করতে পারছে এক নিমিষেই।
'রাত্রি সাঁজাবো আজ মেঘের আঁচলে।
শেষটায় ঝরবে প্লাবন,
ঘড়ির কাঁটায় ঢলবে শেষ রাত্রি
ভোর ঠোঁটে হবে চুম্বন। '
তাদের কথা শুরু হয়। অনেকদিনের লুকানো কথা। যে কথা ছিলো ইটচাপা ঘাসের নীচে বিবর্ণ, সেই কথাগুলো ঘাসফড়িংয়ের মত উড়তে থাকে সবুজ বনে, ফুলের বনে। একটা রাত্রি মুহূর্তেই কেটে গেলো তাদের।
এ যেনো স্বপ্নের রাত। যে রাতে হাজারো জোনাকের সাথে দলবেধে উড়ে বেড়িয়েছে তারা দু'জন। মেঘের চাদরে কেঁপেছে তারা, ভেসেছে মেঘেদের ভিড়ে। এরপর তারা সোনাঝরা সকালে, সময়ের হাত ধরে চলে যায় সেই ধানসিঁড়ির ধারে। উপচে পড়া নীলাকাশ পুরো বুকটা পেতে রেখেছে নদীর জলে।
কী গভীর ভালোবাসা তাদের! শুরু হয় কথার খুনসুটি। সব ক্ষণগুলোকে তারা স্পর্শ করলো পরম মমতায়। নদীর ধার, সেই বিদ্যাপিঠ, শৈশবের কাঁশবন, বকুল বাগান, নীলাদের পুকুর ধার থেকে শুরু করে সবই যেনো নতুন করে দেখা হলো তাদের। সেই সাথে স্মৃতি রোমন্থন।
ছোট্ট একটা চারতলা বাড়ির তিনতলায়, দু' বেডের ছিমছাম একটা ফ্ল্যাট।
ব্যালকনিটা যেনো সুন্দর একটা বাগান। বেলি আর গোলাপে ঠাসা পুরো প্রান্তর। নতুন সংসার। কর্মব্যস্ত দু'জন মানুষের ছুটে চলার গপ্প। দিনশেষে একসাথে বাড়ি ফেরে তারা।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে টংদোকানের চা-ও পান করা হয় তাদের! রিক্সা করে ঘুরে বেড়ানো, ফুসকা খাওয়া, একসাথে মুভি দেখা, আড্ডা দেয়া সবই চলে দারুণভাবে। 'জীবন সত্যিই সুন্দর' এই বোধটা তাদের ভেতর আরো বেশী পোক্ত আসন গেড়ে বসে। এরই মাঝে একদিন শ্রাবণের দিন চলে আসে। বাইরে ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছিলো। দীপ্র'র অফিস শেষ হলে অর্পিতাকে নিয়ে একটা দারুণ মজার মুভি দেখবে দু'জন।
এমনি পরিকল্পনা করে ঘড়ি ধরে অপেক্ষা করছিলো দীপ্র। আজ অর্পিতার জন্মদিন। তার এই বিশেষ দিনে তাকে একটা বড় সারপ্রাইজ দেয়া হবে। বাসায় আজ অর্পিতার মা আসবেন। খবরটা দেয়া হয়নি ওকে।
মুভি দেখে বাসায় যেয়ে কী খুশিই না হবে ও!
কিন্তু অর্পিতার অফিস শেষ করে এখানেই আসার কথা। উশখুশ করতে থাকে সে। এরই মাঝে তার মুঠোফোনে বেজে ওঠে পরিচিত নাম্বার থেকে অপরিচিত কন্ঠস্বর। অর্পিতার নাম্বারে এ কার গলা শুনলো সে! এ কে!! কি বললো লোকটা! হাসপাতাল, ইমার্জেন্সী.....। মুহূর্তেই ছুটে চলে সে।
চারপাশে নেকড়ের আঁধার নেমে এসেছে সহসা। খুব বেশী তড়িঘড়ি করা ওর স্বভাব। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বেশকিছু কদম ফুল কিনে ব্যস্ত রাস্তা অতিক্রম করতে যেয়েই অঘটনটা ঘটে যায়। হাসপাতালের করিডোরে অপেক্ষার মুখ বাড়ছে। ছুটছে সময় নিজের মত করে।
এরপর শেষ হয় অপেক্ষার পালা। দুর্ঘটনাটা মারাত্মক পর্যায়ের ছিলো। সম্ভাবনা খুব কমই ছিলো। সরাসরি মাথায় আঘাত। তারপরও শেষ চেষ্টা করেছিলেন ডাক্তাররা।
ফেরাতে পারেননি তাকে সেই না ফেরার দেশ থেকে।
সময় থেমে থাকেনা কারো জন্য। সেই বিকেলে দীপ্র এসেছিলো ধানসিঁড়ির পারে। দীপ্র'র সময় থেমে আছে অর্পিতাকে ঘিরে। যেখানেই যায় তার দীর্ঘ ছায়া তাকে ছুঁয়ে দেয়।
পশ্চিমাকাশে লাল আভা মিলিয়ে গিয়েছে অনেক আগে। সেই আভা হয়তো অর্পিতারই ছিলো। তার রক্তেই হয়তোবা রক্তিম হয়েছিলো প্রিয় নীলাকাশ! এখন আকাশে কত সুন্দর রুপার থালার মত বিশাল চাঁদ উঠেছে। নীল আকাশে শুভ্র মেঘেরা ভেসে বেড়াচ্ছে। কত জোনাক উড়ছে দলবেঁধে।
সেই জোনাকের ভিড়ে আমার অর্পিতাও কি আছে!! এমনি কতশত ভাবনায় ডুবে যায়, সাঁতরে যায় একজন দীপ্র'র আদিগন্ত ভাবনার ফেনিল পারাবার। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।