"জীবনবোধ মানুষকে তার রূপ-রস-রঙে ভরে তোলে কানায় কানায়, জীবনকে দেখবার প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গি তার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৃথিবীটাকে মোচড় দিয়ে বদলে দিতে চায়" প্রবাসী লেখিকা তসলিমা নাসরীন আবার একটা বোমা ফাটিয়েছেন। অবশ্য এটাকে বোমা ফাটানো বলা যাবে কিনা সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ নই। তিনি এর আগেও এ ধরনের কাজ করেছেন। এবার তার অঙ্গুলি নির্দেশিত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের লেখক সুনীল গাঙ্গুলীর প্রতি। সুনীলের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছেন তিনি।
এর আগেও তার বিভিন্ন আত্মজীবনীমূলক বইয়ে সৈয়দ শামসুল হক, ইমদাদুল হক মিলন সহ অন্যান্য কিছু লেখকের বিরুদ্ধে এ জাতীয় অভিযোগ করেছেন। টুইটারে তার বক্তব্যে তিনি বলেছেন সুনীল নাকি তসলিমা ছাড়াও আরো কিছু নারী লেখকের সাথেও যৌন হয়রানিমূলক আচরণ করেছেন। আমার জানামতে, এর বেশি কিছু তিনি এখনো প্রকাশ করেন নি। কথা হলো, এই অভিযোগ যদি তিনি করেই থাকেন তাহলে কবে, কোথায় এবং কখন এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল সে সম্পর্কে তাকে বিস্তারিত বলতে হবে। এই ‘যৌন হয়রানি’মূলক ঘটনা ঘটার সময় তার নিজের কী ভূমিকা ছিল, তিনি নিজে এটাকে যৌন হয়রানি হিসেবেই তখন বিবেচনা করেছিলেন কিনা, করে থাকলে তখন এর বিরুদ্ধে কী উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন এসবই প্রকাশ করা দরকার।
তসলিমা নাসরীনের মতো লেখকেরা আলোচনায় থাকতে পছন্দ করেন। প্রচারণার প্রতি তাদের এক ধরনের আকর্ষণ রয়েছে। এই আকর্ষণের তাগিদে তারা বিভিন্ন সময় চমক সৃষ্টি করেন, সত্য/মিথ্যা বিভিন্ন অভিযোগ সময়-সুযোগ বুঝে উপস্থাপন করে থাকেন। আমাদের দেশে নিকট অতীতে এবং বর্তমানে শহীদুল জহির, মাহমুদুল হক, মঈনুল আহসান সাবেরদের মতো লেখকেরা লেখালিখি করেছেন এবং এখনো করছেন। তাদেরকে আমজনতার বড় অংশই চেনে না, তাদের পরিচয় সম্পর্কেও তারা অবহিত হয় না।
তার বড় কারণ তারা নিরবে নিজেদের কাজ করে যান, লেখালিখির মাধ্যমে চমক সৃষ্টি করেন না। তাদের লেখার মান যতো উন্নতই হোক না কেন, তারা পাঠকপ্রিয়তা বা পরিচিতি অর্জন বলতে যা বোঝায় সেটা তাদের বেলায় ঘটে না। এই কারণে শহীদুল জহির বা মাহমুদুল হকের জীবনের মতো তাদের মৃত্যুও নিভৃতেই সংঘটিত হয়; এই নিয়ে প্রচারণা, মাতামাতি, মিডিয়ার গরম সংবাদ পরিবেশন কিংবা প্রতি ঘণ্টায় নিউজ আপডেটের মতো বিষয় দেখা যায় না। অন্যদিকে কিছু লেখক রয়েছেন, তারা শুধু বিতর্ক সৃষ্টিই অধিক গুরুত্ব সহকারে করে থাকেন; শুধু তা-ই নয়- প্রচারণার আলো যাতে তাদের ওপর সর্বক্ষণ থাকে সেই দিকেও তারা লক্ষ রাখেন। দায়বদ্ধতা কিংবা শিল্পগুণের পরিবর্তে নাটকীয়তা তাদের লেখালিখি/কর্মকাণ্ডের উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিদ্যমান থাকে।
দেশের বাইরে তসলিমা নাসরীন, দাউদ হায়দারদের মতো লেখকদের নির্বাসিত জীবন যাপন বাংলাদেশের জন্য একটি লজ্জাকর বিষয়। একজন লেখক তার লেখালিখির চর্চা দ্বারা যতো বিতর্কই সৃষ্টি করে থাকুন না কেন- তার জন্য তাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হবে, তার বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করা হবে কিংবা তার মৃত্যুর মূল্য হাঁকা হবে এটা সভ্য সমাজে কোনো গ্রহণযোগ্য তৎপরতা নয়। তিনি যদি লেখনির মাধ্যমে বিতর্ক সৃষ্টি করেই থাকেন, যদি জ্ঞাতসারে মিথ্যাও উচ্চারণ করে থাকেন- লেখনির মাধ্যমেই তার জবাব দেয়া হোক, যুক্তি তর্কের মাধ্যমে পাল্টা-বক্তব্য উপস্থিত করা হোক- এটাই কাম্য হওয়া উচিত। এ বিষয়টি তসলিমা-সংক্রান্ত সাম্প্রতিক আলোচনায় অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও এর অবতারণা করার মূল কারণ হলো, যুক্তি-পাল্টা যুক্তির মাধ্যমে বক্তব্যের বিপরীতে বক্তব্য উপস্থাপনে আমাদের সমাজের ব্যর্থতার কারণে এক ধরনের উগ্রতার জন্ম হয়। পত্র-পত্রিকায় অথবা গ্রন্থাকারে কোনো কথিত বিতর্কিত লেখা ছাপা হলে তার বিপরীতে যদি অভিন্ন মাধ্যমেই পাল্টা জবাব দেয়া হয় তাহলে বিষয়টি নির্দিষ্ট পরিসরে সীমাবদ্ধ থাকে।
কিন্তু এই নিয়ে রাজপথ গরম করা হলে, খোলা তরবারি হাতে ‘নারায়ে তাকবির’ শ্লোগান তোলা হলে বিতর্কিত ব্যক্তির পরিচিতি বৃদ্ধি পায়, তাকে নিয়ে আলোচনা বৃদ্ধি পায়- এটা আমাদের দেশের বাস্তবতা। কেননা লেখার জবাব পাল্টা লেখা দিয়ে প্রদান করার সংস্কৃতি এই সমাজে নেই; যার মূল কারণ হলো, সেই সক্ষমতা এখনো অর্জিত হয় নি, মানসিকতাও সেভাবে গড়ে ওঠে নি। বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিরোধের পরিবর্তে ফাঁপা, অন্তঃসারশূন্য চিৎকার, হুমকি-ধমকি এবং ফতোয়া জারি সমাজের ব্যাপক অংশের ওপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে, নিজের অজান্তেই একটা উল্লেখযোগ্য অংশ এই প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে পড়ে। যে লেখাটিকে কেন্দ্র করে বিতর্ক সৃষ্টি হয়, সেটা হয়তো বিরুদ্ধতাবাদীদের অধিকাংশই পড়ে পর্যন্ত দ্যাখে না, কারণ তার প্রয়োজন তারা অনুভব করে না; সর্দার শ্রেণীর লোকদের সৃষ্ট উত্তেজনাকর পরিস্থিতির তারা ক্রীড়নক হয়ে ওঠে। অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের অনুপস্থিতিই এখানে অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিরাজ করে।
আর প্রচারণাপ্রিয় লেখকগণ এর সুযোগ গ্রহণ করেন, তারা রাতারাতি পরিচিতি লাভ এবং বিখ্যাত হয়ে যাবার পথ পেয়ে যান।
সুনীল প্রসঙ্গে তসলিমা যে অভিযোগ তুলেছেন, সেটা হয়তো অসত্য নয়। সুনীল নিজেও বিষয়টি অস্বীকার করেন নি, ব্যস্ততা দেখিয়ে এ বিষয়ে মন্তব্য প্রদানে বিরত থেকেছেন। তার হয়তো বলবার মতো কিছু নেই। কোনো কারণে তিনি বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করতে পারছেন না, আবার স্বীকার করলেও পারস্পরিক সম্মতিতে কিছু একটা হয়েছে এটা বলাও তার পক্ষে অসুবিধাজনক।
কিন্তু এক্ষেত্রে আপত্তিকর বিষয় হচ্ছে তসলিমা যেভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন সেটা। তার বক্তব্য থেকে তিনি যে বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত করেছেন সেটা সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনা একথা মনে করার কোনো কারণ নেই। বরং কিছু একটা ঘটে থাকলে সেটা অতীতে হয়েছিল এ সম্ভাবনাই বেশি। তাহলে এই ঘটনার সময়ে তসলিমার ভূমিকা কী ছিল এটা আলোচিত হওয়ার বিষয়। কেননা এই ‘যৌন হয়রানি’ নির্যাতনমূলক পর্যায়ে সংঘটিত হয়েছিল কিনা অথবা পারস্পরিক সম্মতি সেখানে ছিল কিনা সেটা আগ্রহী ব্যক্তিবর্গের জানা প্রয়োজন।
যদি সম্মতির মাধ্যমেই বিষয়টা ঘটে থাকে তাহলে বর্তমানে এ নিয়ে অভিযোগ অথবা বিতর্ক তোলা এখন অর্থহীন। এই অভিযোগের চরিত্রও এর মাধ্যমেই পরিষ্কার হবে, প্রচারণাপ্রিয়তার দিকটি উন্মোচিত হবে। অন্যদিকে এটি সম্মতিহীন নির্যাতনমূলক বিষয় হলে প্রশ্ন উঠবে আপৎকালীন এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ তোলা হয় নি কেন। এই প্রশ্ন তুলতে হবে এবং তসলিমার কাছ থেকে বিস্তারিত পরিপ্রেক্ষিত সমেত বক্তব্যও আদায় করতে হবে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।