পতাকায় ফালগুন মানচিত্রে বসন্ত
কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় ১০ জুলাই ‘ভারতে ঠাঁই নেই, দেশে ফিরতেই আর্জি তসলিমার’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন তসলিমা নাসরিন। আমাদের সময়ে প্রকাশিত সংবাদ ভাষ্যে, নিউইয়র্কে বার্তা সংস্থা এনাকে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের মৌলবাদিরা নয়, সে সময়ের বিএনপি সরকারের চাপেই তিনি দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। মৌলবাদিরা কখনোই তার শত্র“ ছিল না। রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য তদানিন্তন বিএনপি সরকার তাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করেছে। তার কথা এক অর্থে সত্য; কিন্তু তসলিমা নাসরিনের একটি বিষয় উপলব্ধি করা দরকার যে, বিএনপি সরকার নীতিগতভাবে কাদের ধ্যান-ধারণা সরকার পরিচালনায় ব্যবহার করেছিল? মৌলবাদিদের প্রশ্রয় কারা দিয়েছিল? মৌলবাদী বনাম তসলিমা নাসরিন ছিল তখনকার সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য আন্দোলন।
মুক্তচিন্তার মানুষমাত্রই বিশ্বাস করেন যে, তসলিমা ছিলেন মৌলবাদিদের জন্য দুঃস্বপ্ন। কারা তাকে দগ্ধ করেছে, শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছে, কর্তনের জন্য তার মস্তক নির্বাচিত করেছে এমনকি ঢাকায় বিষাক্ত সাপ ছেড়ে দেবার হুমকী দিয়েছে। এবং এরই এক পর্যায়ে তিনি দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়ে প্রায় ১৫ বছর নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন। তিনি প্রবাসে বিভিন্ন সেমিনারে মৌলবাদের বিরুদ্ধেই তার অবস্থান পুণঃব্যক্ত করেছেন মর্মে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হয়েছে। মুক্ত চিন্তার মানুষ মাত্রই আজও বলতে পছন্দ করেন, মৌলবাদী সন্ত্রাসীরা ক্রসফায়ারের চেয়েও তসলিমাকে বেশি ভয় পান।
যিনি নারী স্বাধীনতার পে আজও অনড়; তার কলম নিসৃত দুঃসাহসী শব্দাবলী কারা স্তব্ধ করে দিতে চায় তাকি তিনি জানেন না? জীবনবাজী রেখে অনেকটাই একাকিত্বে লড়েই চলেছেন ধর্মান্ধ অপশক্তির বিপÑে এটি কারো অজানা নয়। দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ গণতান্ত্রিক আবহে এ মুহূর্তে তিনিই একমাত্র স্বদেশি যিনি জন্মভূমিতেও স্বাধীন বসবাসে অধিকারহীন। তসলিমা কী ভুলে গেছেন মৌলবাদ ও ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে লেখালেখির জন্য তারা ১৯৯২ সালে হত্যার জন্য একটি কমিটিও গঠন করে। ১৯৯৩ সালের একুশে বই মেলায় তিনি শাররিকভাবে আক্রান্তেরও শিকার হন। এই গোষ্ঠিই তো ফতোয়া দিয়ে তার মস্তক কর্তনে পুরস্কারও ঘোষণা করে।
এটি সত্য যে, তৎকালীন সরকার তার বিরুদ্ধে জামিনহীন পরোয়ানা জারি করে। কিন্তু অবশ্যই তা সেই মৌলবাদি গোষ্ঠির প্ররোচণায়। এরই প্রেেিত তিনি ১৯৯৪ সালে দেশত্যাগে বাধ্য হয়ে নির্বাসিত হন। দীর্ঘ দশ বছর পশ্চিম ইউরোপ এবং দণি আমেরিকায় নির্বাসিত-নিঃসঙ্গ জীবন শেষে ২০০৪ সালে কোলকাতায় ফিরে আসেন। নির্বাসিত হয়েও তিনি কি তার মুক্তচিন্তা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে লেখায় পিছপা হয়েছেন? তিনিই তো ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট, ফ্রান্স ন্যাশানাল অ্যাসেমব্লি, বেলজিয়াম পার্লামেন্ট, ইউনেস্কোসহ বিশ্বের বহু গুরুত্বপূর্ণ সভায় তার চিন্তা-চেতনা ও মুক্ত চিন্তক লেখার পে জোরালো বক্তব্য রাখেন।
নরওয়ে, সুইডিস, ইটালি, আইসল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াসহ বহুদেশে আয়োজিত সেমিনারে বহু প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন দু দুবার আনন্দ পুরস্কারপ্রাপ্ত তসলিমা নাসরিন। তার লেখা ২০টি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। মুক্ত চেতনার প্রতীক তসলিমা নাসরিনের আত্মজীবনীর আখ্যান ‘আমার মেয়েবেলা’ ২০০২ সালে ইংরেজিতে অনুবাদ হয়। এটি ওয়াশিংটন পোস্ট, লস এজ্ঞেলস টাইমস্য়ে গুরুত্বসহকারে ছাপা হয়। এবং গ্রন্থটি শ্রেষ্ট পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়।
তিনি কী ভুলে গেছেন নিষিদ্ধ গ্রন্থের তালিকায় সম্ভবত তার গ্রন্থই সর্বোচ্চ। ১৯৯৩ সালে ‘লজ্জা’, ১৯৯৯ সালে ‘আমার মেয়েবেলা’র প্রথম খণ্ড, ২০০২ সালে ‘উতল হাওয়া’র দ্বিতীয় খণ্ড, ২০০৩ সালে ‘ক’, ২০০৩ সালে ভারত সরকার কর্তৃক ‘দ্বিখণ্ডিত’ (কোলকাতা মহিলা সমিতির মামলায় ২০০৫ সালে নিষিদ্ধাদেশ প্রত্যাহার) নিষিদ্ধ করা হয়। ২০০৭ সালের আগষ্টের ৯ তারিখে ‘রিভেনজ’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসবে তিনিই তো হায়দ্রাবাদে মুসলিম মৌলবাদিদের দ্বারা আক্রান্ত হনÑ এসব মৌলবাদিরা কারা সেটি কি তিনি অনুধাবন করতে পারেন না? ভারত সরকার তাকে দিল্লীতে গৃহবন্দী করে। এ সময় মহেশ্বেতা দেবী, অরুন্ধুতি রায়সহ অনেকেই তসলিমার পে তাদের দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করেনÑ তারাও কিন্তু মৌলবাদের বিরুদ্ধে বারবার কথা বলেন, লেখেন। দীর্ঘ ৮ মাস গৃহবন্দি থাকার পর ২০০৮ সালের ১৯ মার্চ তিনি যুক্তরাষ্ট্র যান।
বাংলাদেশের মতো ভারতেও তসলিমা নাসরিন তার নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য আলোচিত হন। আর নারীবাদকে কী মৌলবাদিরা কখনও প্রশ্রয় দিতে চায়? সুইডিস গায়কের কণ্ঠে বারবার ধ্বণিত হয়েছে ‘গডেস ইন ইউ তসলিমা’। ফ্রান্সের বিখ্যাত ব্যান্ড জেবডা ‘ডোন্ট ওরি তসলিমা’ গানে তাকে মানুষিকভাবে শক্তি যুগিয়েছেন। তসলিমার কবিতার কম্পোজিশনে স্যাকসোফনিস্ট জাজ সপরানো ‘দ্যা ক্রাই’ প্রদর্শন করে ইউরোপ ও আমেরিকায়। মানবতাবাদের নির্দশনে তসলিমা নাসরিন মরণোত্তর শরীর দান করেছেন কোলকাতার ‘গানা দর্পন’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকেÑ এটিও কী মৌলবাদিরা কখনই ভালো চোখে দেখেছেন? সামাজিকভাবে অগ্রসর তসলিমা তার মা ইদুলআরা’র নামে ময়মনসিংহের গবীর মেধাবী ছাত্র-ছাত্রিদের জন্য (৫০ হাজার-১ ল) বৃত্তি প্রচলন করেন।
ইউরোপিয়ান পার্লমেন্ট পদক (১৯৯৪), হিউম্যান রাইট পুরস্কার (১৯৯৪), আনন্দ পরস্কার (১৯৯২, ২০০০), ইউনেস্কো পুরস্কার (২০০৪) সহ প্রায় ত্রিশটি আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। কিন্তু স্বদেশ তাকে কী পুরস্কার দিয়েছে? ৪৬ বছর জীবনে ১৫ বছরই নির্বাসিত জীবন তার। প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে দেশের বাইরে রক্তাক্ত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। তাকে বুঝতে হবে ফতোয়া মৌলবাদ-জঙ্গীবাদ বিরোধি আওয়ামীলীগ নের্তৃত্বাধীন সরকার যখন মতায়; যখন নারীর কল্যাণে পাশ হচ্ছে একের পর এক সুবিধান, তখনই নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় সর্বোচ্চ উচ্চকিত তসলিমা নাসরিনের স্বদেশে ফেরায় কোন বাধা থাকতে পারে না। বাধা যদি থাকে তা-ও ঐ মৌলবাদিদের কারণে।
কারণ সরকার কখনই চান না এই মুক্তচিন্তার লেখিকার জীবনের ওপর কোন বিপর্যয় নেমে আসুক। নীতিগত দিক থেকে তসলিমার সঙ্গে শেখ হাসিনার আন্দোলনের তো কোন পার্থক্য নেই! তবে তার দেশে ফেরার আবেদনে সায় দিতে মৌলবাদ বিরোধি সরকারের বাধা হয়তো একটাই এবং তাকে মৌলবাদিদের থাবা থেকে নিরাপত্তা বিধান করা। এবং তা একমাত্র তসলিমার সাহসের কাছে পরাজিত হবে এবং হবেই।
[ংশহধুৎঁষ@ফযধশধ.হবঃ]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।