সকালে কানাডা থেকে বন্ধু বাবলু খবর দিলো,আমাদের আরেক বন্ধু নোমান অসুস্থ,হার্ট অ্যাটাক হয়েছিলো,এখন বারডেমে ভর্তি আছে!দিল্লী থেকে নোমানের বোন তসলিমা(লেখিকা তসলিমা নাসরীন)ফোন করে ওকে এই সংবাদ জানিয়েছে। তসলিমার নিজেরও নাকি ডেঙ্গু হয়ে শঙ্কটাপন্ন অবস্থা হয়েছিলো!নোমানের আরেক বোন ইয়াসমীনও,নিউইয়র্ক থেকে ফোন করেছিলো। দুই বোনই ভাইয়ের জন্য অনেক কান্নাকাটি করলো। তসলিমা তো ভাইকে দেখতেও আসতে পারবে না!শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেলো!
তসলিমার লেখার সাথে আমার পরিচয় নেই। সে আমার কাছে পরিচিত,বন্ধুর বোন,আমাদের ফ্যামেলি ফিজিশিয়ান ডা.রজব আলীর মেয়ে,ময়মনসিংহ শহরের আমার পাড়ার মেয়ে,আমার প্রাক্তন স্কুল এবং আমার মেডিকেল কলেজের ছাত্রী হিসেবে।
আমরা যখন লেখালেখি শুরু করি,তখন তসলিমা বলতে গেলে শিশু!লেখালেখির প্রশ্নই আসে না!আমরাও ষাটের দশকের শেষভাগে যারা লিখতাম,নিরবে নিভৃতে,বন্ধুরা সেই লেখা পড়ে প্রশংসা ট্রশংসা করতো,মাঝে মাঝে পত্রপত্রিকা,ম্যগাজিনে লেখা ছাপতো,তাও জানতো বন্ধুরা এবং গর্বিত হতো তারাই!এখনকার মতো সাহিত্য সম্মেলন,অনুষ্ঠান,আড্ডা, ব্লগ,ফেসবুক তো ছিলো না,তাই তেমন পরিচিতিও ছিলো না!আমরা পড়তাম রবীন্দ্র,নজরুল,বঙ্কিম চন্দ্র,শরৎ চন্দ্র,সুকান্ত,জীবনানন্দ,নীহার রঞ্জন,শংকর,তারাশঙ্কর,বিভূতি ভূষণ,ফাল্গুনী আর দস্যু মোহন সিরিজ!এগুলো কোথায় কীভাবে ছাপা হতো,এ ধারনাও ছিলো না!নিজের বই ছাপানোর কথা কল্পনায়ও স্থান পায়নি!৬৮-৬৯এ ৩-৪টি উপন্যাস লিখেছিলাম,যদি জানতাম,বুঝতাম এগুলো বই আকারে ছাপা যায়,এবং সাহস করে ছাপা যেতো,তবে বিরাট একটা হৈচৈ অবশ্যই পড়ে যেতো!ঐ উপন্যাসের ডায়েরিগুলো একাত্তরে হারিয়ে গেছে!ভারী আফসোস হয় আজ ওগুলোর জন্য!
বলছিলাম তসলিমার কথা। মেয়েটি অত্যন্ত লাজুক,মুখচোরা,শান্তশিষ্ট ছিলো!এখনও কিন্তু ও বেশ চুপচাপই!তারা টি.ভি.-তে একটা সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে দেখলাম,সব প্রশ্নের উত্তরে কোনরকম হু,হা করছে!সেই একই অনুষ্ঠানে সুচিত্রা ভট্টচার্যকে দেখলাম অনেক সপ্রতিভ ভাবে কথা বলছে,উত্তর দিচ্ছে। একটি দিনের কথা মনে পড়ছে আজ। । আমি তখন থার্ড কি ফোর্থ ইয়ারের স্টুডেন্ট।
তসলিমা বোধহয় ৫ম-৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। এক বিকেলে সে এলো পাশের বাসার জীবন নামে মেয়েটিকে নিয়ে আমার সাথে দেখা করতে!ওর বাবা পাঠিয়েছে আমার সাথে দেখা করতে!আমি পাড়ার এবং শহরের ভালো ছাত্রী,মেডিকেলে পড়ি,তখনকার দিনে ভালো ছাত্র-ছাত্রীকে দেখাও পূণ্যের কাজ বলে মনে করা হতো!খবর পেয়ে ড্রয়িংরুমে এসে দেখি,ও জড়োসড়ো হয়ে এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে!আমি হেসে ওদের বসতে বললাম,ওরা বসলো না,দাঁড়িয়েই রইলো!জীবন সবসময়ই আসে আমাদের বাসায়,অতি রূপবতী মেয়েটি কথাবার্তায়ও চটপটে!তসলিমা ততক্ষণে জীবনের পেছনে গিয়ে ওর কাঁধের ওপর দিয়ে আমার দিকে তাকালো!আমি জিজ্ঞেস করলাম,‘তুমি নোমানের বোন?’ও কথা না বলে মাথা নাড়লো!নাম জিজ্ঞেস করলাম,এবারও উত্তর না দিয়ে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইলো!ওর হয়ে জীবনই উত্তর দিলো সব কথার!সেই মেয়ে আজ দেশছাড়া!
ওর লেখা যেহেতু আমার পড়া হয়নি,তাই আলোচনা বা সমালোচনা কিছুই করতে পারবো না!মত প্রকাশের স্বাধীনতা,বাক স্বাধীনতা মানুষের অধিকার!ওর লেখা যদি সমাজ,সংসার,রাষ্ট্র বা দেশের জন্য ক্ষতিকারক মনে হয়,তবে সে লেখা নিষিদ্ধ,বাজেয়াপ্ত করা যেতো,তাই বলে তাকে দেশ থেকে বের করে দিতে হবে কেন?এ দেশ তসলিমার জন্মস্থান,তার বাবা,মা,ভাই-বোন,আত্মীয়-বন্ধু সব এদেশেরই মানুষ!কত রাজাকার,যুদ্ধাপরাধী এ দেশে বুক ফুলিয়ে,দেশের শত্রুতা করেও এ দেশেই রয়ে গেছে,আর একজন তসলিমার জায়গা এখানে হলো না,কেন?শুনেছি,ওর বাবা-মায়ের মৃত্যুর সময়টিতে ওকে আসতে দেয়া হয়নি!এ কেমন আইন?ঘরের মেয়ে অন্যায় করলে তাকে শাসন করে ঘরের ভেতরই রাখতে হয়,বাইরে বের করে দিলে সর্বনাশ হয়!তসলিমার বিরুদ্ধে যখন মোল্লারা মিছিল করলো,ওর বিরুদ্ধে মামলা হলো,কোর্টে ওকে দেখলাম,শাড়ি পরে,মাথায় ঘোমটা দিয়ে হাজির হয়েছে!আর ওকে যখন দেশছাড়া করা হলো,তখন দেখলাম বিদেশ থেকে একটা টি.ভি অনুষ্ঠানে দেখাচ্ছে,হাতে সিগারেট নিয়ে,শার্ট প্যান্ট পড়ে,ও পবিত্র কোরআনের পাতা উল্টাচ্ছে!এর জন্য দায়ী কে বা কারা?ওকে তো আর পৃথিবী ছাড়া করা যায়নি?তবে কেন এররকম বিচার করা হলো?
আমি জানি আমার কথায় কিছু আসবে যাবে না!তবু বলছি,পাখিরও বাসা আছে, পরিযায়ী পাখিও একসময় ফিরে যায় নিজের নীড়ে!কিন্তু এ দেশেরই এক মেয়ে আজও ফিরতে পারছে না!আজ তার ভাই অসুস্থ,সে তার ভাইয়ের পাশে একদন্ড বসে,মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিতে পারছে না!অসহায়ের মত দূর দেশ থেকে কাঁদছে!একী নিষ্ঠুরতা!তসলিমা কি কখনও ফিরতে পারবে তার জন্মভূমিতে,তার মাটিতে রাখতে পারবে পা?দেখতে পারবে এ দেশের আকাশ,বাতাস?গায়ে মাখতে পারবে তার দেশের আলো হাওয়া?বসতে পারবে তার ভাইয়ের পাশে?এক নজর দেখতে পারবে তার বাবা-মায়ের শেষ মাটির বিছানা?মনটা খারাপ হয়ে আছে,নোমানের অসুস্থতার খবর শুনে,সেই সাথে ওর বোনদের কান্নার হাহাকারে!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।