আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বার্ধক্য (আগে একবার দিয়েছিলাম,সেফ ছিলাম না, কেউ উকি দিয়াও দেখে নাই।আজকে সেফ হলাম,এই জন্য আবার দিলাম।কেউ বিরক্ত হলে ক্ষমা চাই।)

একটা বয়সের পর সব বয়ষ্ক লোকদের মনে হয় তিন ভাগে ভাগ করা যায়। এক দল,যারা খুবই বিরক্ত দুনিয়ার উপরে,প্রচলিত বাংলায় এদের কে বলে “খাইষ্টা বুইড়া”। এদের একমাত্র কাজ সারাদিন ক্যাচ ক্যাচ করা। আরেকদল থাকেন যারা থাকেন অসুখ বিসুখ এর দোকান,মাথা ব্যাথা,পা ব্যাথা,কোমরে ব্যাথা......এমন কোন জায়গা নাই যেখানে ব্যাথা নাই। আরেক দল থাকেন আনন্দিত বৃদ্ধের দল,এরা খুব খুশি থাকে সবসময়।

প্রিয় ছেলেটা দেশ ছেড়ে চলে গেলেও হাসি মুখে আরেকজনের সাথে গল্প করেন-“জানেন ভাই,আমার ছেলেটা আমেরিকা থাকে,ওখানে তার বিরাট বড় একটা বাড়ি আছে... শীতের সময় বাড়িটার সামনে বরফ পড়ে...” ইত্যাদি ইত্যাদি। উনাদের একবার মনেও হয় না যে উনার গুনধর ছেলে উনাকে এই বয়সে দেশে রেখে বাইরে থাকে,উনার খবরও নেয় না। আমার দাদা,মানে চৌধুরী আনোয়ার হোসেন পরেন চার নাম্বার দলে। উনি মোটামুটি বিরক্ত,অসুস্থ এবং ছেলেদের গর্বে গর্বিত। যদিও উনার বড় দুই ছেলে আসলে বড় দুই কুলাঙ্গার ছাড়া কিছুই না,নিজের নিজের পরিবার নিয়ে বিদেশে আছেন,বাবার কথা মনেও করেন না।

আর তিন নাম্বার জন আমার বাবা,তিনিও মাঝারি ধরনের কুলাঙ্গার। কুলাঙ্গার- কারন উনিও তার বাবার তেমন খোঁজ করেননা,মাঝারি- কারন অন্তত তিনি তার বাবাকে থাকার জন্য একটা ঘর দিয়েছেন,অসুখ বিসুখ এ ডাক্তার দেখান মাঝে মাঝে, এই। আমি হচ্ছি এই চার নাম্বার দলীয় বৃদ্ধর নাতি...। আরও ভালোভাবে বললে বেকার নাতি। এই বাড়িতে একমাত্র আমার সাথেই উনার কিছু খাতির আছে...স্বার্থজনিত খাতির।

আমি উনার গল্প শুনি,উনি মাঝে মাঝে আমাকে কিছু হাত খরচ দেন। প্রায় রাতেই আমি যখন শেষ সিগারেটটা খেতে বারান্দায় যাই উনি অপেক্ষা করেন আমার হাতের সিগারেট শেষ হওয়ার জন্য,এরপরই শুরু হয় উনার গল্প। বেশিরভাগ সময়ই অবশ্য শুরু হয় ‘চাকরি বাকরি কিছু হল?” টাইপ কথাবার্তা দিয়ে। এরপর এইদিক ওইদিক ঘুরতে ঘুরতে চলে যান দাদির কথায়,উনি কত ভালো ছিলেন,সে কি ভালবাসা ছিল তাদের এইসব। এই বৃদ্ধের গল্প আমি খুব আগ্রহ করে শুনি এমন না,বিরক্ত হই প্রায়ই।

কিন্তু সহ্য করি কারন ঐ যে! উনি মাঝে মাঝে উনার পেনশন এর টাকা থেকে আমাকে কিছু দেন। বেকার যুবকের জন্য এই টাকা টা যে কত কাজের তা শুধু একজন বেকারই বলতে পারবে। আজকে সকাল থেকেই দেখি উনি ঘুরঘুর করছেন আমার পিছনে,বুঝলাম কোনো একটা মতলব আছে, নিশ্চয়ই কোথাও নিয়ে যেতে বলবেন। উনার সাথে যেতেও সমস্যা,সিগারেট খাওয়া যায় না,আর উনি সবাইকেই পরিচয় দেন আমি উনার নাতি,দারুন নাকি ব্রিলিয়ান্ট। স্রেফ কপাল দোষে চাকরি হচ্ছেনা ইত্যাদি।

তারপরই শুরু হয় একটা চাকরি আমাকে দেওয়া যায় কিনা তার আলাপ, মোটামুটি অপমানের চুড়ান্ত । যাইহোক যা বুঝলাম উনার আজকের ঘুরঘুর এর কারন হচ্ছে উনাকে নিয়ে আজিম্পুর যেতে হবে,উনার কি নাকি জরুরী কাজ। একবার বললাম পারবনা,তারপর আবার মনে হল যদি সামনেই কিছু টাকা পয়সা লাগার সম্ভাবনা আসে,দাদু যদি রাগ করে আর না দেয়,তাই ভাবলাম নিয়েই যাই। রিক্সায় উঠেই দেখি ভদ্রলোকের মন একটু খারাপ,একবারও রিকশাওালার বাড়ি কই জিজ্ঞেস করলনা! বললাম “আজিম্পুর কোথায় যাবা দাদু?” উদাস কন্ঠে বললেন –‘দেখি কই যাই!‘ আমি মনে মনে বলি বুড়ার ভাব কত! শেষ পর্যন্ত রিকশা রাখলেন আজিম্পুর গোরস্থানের গেট এ। “অ,এতক্ষনে বুঝলাম উনার মন খারাপ কেন,দাদির কথা মনে পড়েছে!“ দাদু আস্তে আস্তে দাদীর কবরটার কাছে দাড়ালেন,বিরবির করে কি জানি আবার বলছেন ও।

ইনিয়ে বিনিয়ে কত কথা...সব ছেলেদের খবর বললেন,আমার খবর বললেন,এমনকি পাড়ার রহিম মিয়ার যে আর একটা ছেলে হয়েছে এইটাও বললেন। কিছুক্ষন পর বলেন ‘চল ফিরে যাই’। ফেরার পথে আবার সেই সাধারন দাদু,রিকশাওয়ালার বাড়ি কই ,ওই খানে কি পাওয়া যায় হেন তেন বিরাট গল্প। আমি প্রায়ই দাদুকে নিয়ে আসি এইখানে,এই আজিম্পুর গোরস্থানে। প্রত্যেকবারই দাদুর একইরকম ফিরে যাওয়া,একই চেহারায় কষ্ট চাপা।

বৃদ্ধকালীন তীব্র আনন্দে তিনি ঝকমক করার চেষ্টা করে যান। আর আমি আমার নিরীহ,প্যানপ্যানানি দাদুর অভিনয় দেখি। আমাদের সাথে,সবার সাথে, এমনকি নিজের সাথেও নয় কি?সুখে থাকার সে কি দুর্দান্ত অভিনয়!!দিনে,রাতে,সবসময়। আমি হঠাত করেই আমার নিরীহ,বিরক্তিকর দাদুর একাকিত্ত টা কে দেখি,দেখি একটা মানুষ কতটা একলা হলে মৃত স্ত্রীর সাথে গল্প করতে আসে। আমার বোকা দাদু আমার মতলব বোঝে না,ভাবে আমি নিজ শখ করে উনাকে নিয়া আসি।

বলে “তুই অনেক ভালরে,তোর জন্য দোয়া করি তোর যেন চাকরি হয়। ” আমি হাসি,দাদুর মতই অভিনয় করি খুশি হওয়ার। আর মনে মনে পরম করুনাময়ের কাছে বলি,ঈশ্বর !আমাকে ভয়ংকরতম শাস্তি দাও। কিন্তু আমাকে বৃদ্ধ বয়সে বাচিয়ে রেখোনা খোদা। আমি দাদুর মত অসাধারন অভিনেতা নই! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।