আমার কপালে ফণী মনসার চাদ বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ড পাওয়া প্রধান আসামী লে. কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমানের দণ্ড কার্যকর করার পথে সকল বাধা অপসারিত হওয়ার সময় তার চার ছেলে-মেয়ের কেউই দেশে ছিলেন না। অনেক আগেই স্ত্রী, ছেলে-মেয়েরা অপ্রিয় হয়ে উঠেছিল তার কাছে। স্ত্রী ফরিদার সঙ্গে তার ডিভোর্স হয়ে যায় ১৭ বছর আগে ১৯৯৩ সালে। ফরিদা তখন বিদেশে। ফারুক রহমান তাকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেয়।
শুধু স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগই নয়, বনানী ডিওএইচএসে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া বাড়ির নিজের অংশটুকুও ফারুক রহমান তার ছেলে-মেয়েদের জন্য না রেখে মা মাহমুদা রহমানের নামে লিখে দিয়ে যায়। ছেলে-মেয়ে সবাই বিদেশে। ফরিদাও দেশ ছেড়েছেন। দু'মাস আগে দেশ ছাড়ার আগে এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে তিনি ফারুক সম্পর্কে মন্তব্য করেন, 'ওর কৃতকর্মের দায়ভার আমাকে, আমাদের সন্তানদেরও বহন করতে হচ্ছে। ছেলে-মেয়েরা তার বাবার পরিচয় দিতে বিব্রত বোধ করে, ভয় পায়।
'
ফরিদার এক নিকট-আত্দীয় জানান, ফারুকের বাবা ডা. সৈয়দ আতাউর রহমান সেনাবাহিনীর ডাক্তার ছিলেন। সেই সূত্রেই পাকিস্তান আমলে ওই বাড়ি বরাদ্দ পান। সেই বাড়ি এখন ভেঙে ফেলে নতুন করে নির্মাণ করানো হচ্ছে। তালাকপ্রাপ্তা ফরিদা একসময় দেশে ফিরলে তার ছেলে-মেয়েরাই তাকে ওই বাড়িতে নিয়ে আসেন। ফারুক রহমান তখন জেলে।
তখন থেকে ফরিদা রহমান ওই বাড়িতেই বসবাস করছিলেন। বাড়িটি ভাঙার আগে তাকে সেখান থেকে উচ্ছেদের অনেক চেষ্টা করা হয়, কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী তার আত্দীয় বিধায় সে চেষ্টা সফল হয়নি। ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পর মহিলা পুলিশের সহায়তা নিয়ে তাকে একেবারে খালি হাতে সেখান থেকে বের করে দেওয়া হয়। আশ্রয় নেন প্রতিবেশী একজনের বাসায়। সেখান থেকে তার বড় ছেলে, ছেলের বিদেশি বউ ও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি লে. কর্নেল খন্দকার আব্দুর রশীদের মেয়ে মেহনাজ এসে তাকে নিয়ে যান।
ডিওএইচএসে বসবাসকারী অনেকের ঘটনাটি স্মরণ রয়েছে।
সেদিন ফরিদাকে আশ্রয়দাতার মন্তব্য, 'নিষ্ঠুরতার, পাপের প্রাকৃতিক শাস্তি হয়তো এ রকমই। ' গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই প্রিয়তমা স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে তার কাছে অপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এক বিষাদময় নিঃসঙ্গতা পেয়ে বসেছিল তাকে। ১৯৯৬ সালে সৈয়দ ফারুক রহমানকে যখন গ্রেপ্তার করা হয়, তখন সে বেশ নাটকীয় আচরণ করেন।
অট্টহাসি হাসে এবং পুলিশ সদস্যদের বলে, 'এতদিন পর কেন গ্রেপ্তার করতে এসেছেন? এত দেরি কেন?'
ফারুক রহমানদের অপর এক প্রতিবেশী বলেন, ফরিদা রহমানের কাছে আমরা শুনেছি, কারাগারে দেখা করতে গেলেও সন্তানদের সঙ্গে ফারুক কথা বলতে চাইতেন না। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে থাকত। এজন্য সন্তানরাও তার সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। তবে এ তথ্য সমর্থন করেননি ফারুক রহমানের বোন ইয়াসমিন রহমান। তিনি ২৬ জানুয়ারি রাতে কালের কণ্ঠের এক প্রশ্নের জবাবে জানান, গত ডিসেম্বরে ফারুক রহমানের দুই মেয়ে বিদেশ থেকে দেশে এসে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তাদের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বাবাকে শেষ বারের মতো দেখে যান।
সার্বিক এই অবস্থায় ফারুক রহমানের মামলার খোঁজখবর নেওয়া, আইনজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা এবং কারাগারে তাকে দেখতে যাওয়ার দায়িত্বটি তার মা মাহমুদা রহমান ও বোন ইয়াসমিন রহমানই পালন করেন। জানা যায়, সৈয়দ ফারুকের প্রবাসী ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বড় ছেলে তারেক ফ্লাইং ক্লাবের লাইসেন্সধারী। বিয়ে করেছেন রাশিয়ার মেয়ে। ছোট ছেলে জুবের দুবাইয়ে চাকরি করেন। দুই মেয়ের মধ্যে বড় মেয়েও বিদেশি নাগরিককে বিয়ে করে বিদেশে বসবাস করছেন।
ছোট মেয়ে ফিল্মের ওপর পড়াশোনা করেছেন এবং হেজাব বিষয়ে তার একটি ডকুমেন্টারিও রয়েছে। গত অক্টোবর মাসের শেষ দিকে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য এমপি তাপসের গাড়িতে বোমা হামলা ও তার জের হিসেবে খন্দকার আব্দুর রশীদের মেয়ে মেহনাজ গ্রেপ্তার হলে ফরিদাও একই পরিণতির আশঙ্কায় দেশের বাইরে চলে যান।
প্রসঙ্গত, সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকার্নহাসের 'বাংলাদেশ: এ লিগ্যাসি অব ব্লাড' গ্রন্থেও সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ঘটনায় ফরিদা প্রসঙ্গ উঠে আসে। ওই গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী, নারকীয় সেই ঘটনার আগের দিন অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট বিকেলে ফরিদা তার স্বামীর নির্দেশে চট্টগ্রামের হালিশহরে 'আন্ধা হাফিজ'-এর কাছে একটা জরুরি খবর পেঁৗছানোর চেষ্টা করছিলেন। খবরটি হচ্ছে, ১৫ আগস্টই ফারুকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কাজটি করতে যাচ্ছে।
ফরিদা আন্ধা হাফিজকে বার্তাটি পেঁৗছে দিয়ে পাল্টা কিছু নির্দেশনামা জানাতে ফারুককে ফোন করতে গিয়ে দেখেন ঢাকার টেলিফোন লাইন অচল। লাইন সচল হলেও ফারুক টেলিফোন ধরেননি। তিনি তখন ঘুমাচ্ছিলেন। পরে শ্বশুরের সহায়তায় তাকে সেই নির্দেশনামা পাঠিয়ে দেন।
বনানী ডিওএইচএসের এক মহিলা বাসিন্দা জানান, সেই ফরিদা এখন তার নামের শেষে রহমান শব্দটি আর ব্যবহার করেন না।
নিজের নাম বলেন তাসমিয়া ফরিদা
আমি জিন্দা পীরের আওলাদ। মৃত্যুকে ভয় করি না। আমার পূর্বপুরুষ এসেছে ইয়েমেন থেকে। আমি নিজেও কিন্তু একজন পীর। তবে কখনো পীরগিরি করিনি।
তওবা আমাকে পড়াতে হবে না ইমাম সাহেব। কলেমা আমার জানা আছে।
ফাঁসির মঞ্চে নেয়ার দুই ঘন্টা আগে কারাগার মসজিদের ইমাম হাফেজ মনির হোসেন কনডেম সেলে তওবা পড়াতে গেলে কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান এভাবেই তার শেষ কথাগুলো বলেছিলেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়। আরো জানা যায়, রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন শেষ মুহূর্তে ফারুক রহমান তড়িঘড়ি করে দিলেও লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ প্রাণভিক্ষার আবেদন না করে সাদা কাগজে পাল্টা লিখে পাঠান, ‘আমি একজন ফিন্সডম ফাইটার। এর সাথে আমি জড়িত না।
তাই নীতিগত কারণে রাষ্ট্রপতির কাছে আমি প্রাণভিক্ষা চাইতে পারি না। ’
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গত ২৭ জানুয়ারি যখন পাঁচ আসামির ফাঁসি কার্যকরের প্রস্তুতি চলছিল, তখন আইজি প্রিজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশরাফুল ইসলাম খান, ডিআইজি প্রিজন গোলাম হায়দার, সিনিয়র জেল সুপার তৌহিদুল ইসলাম, জেলার মোখলেছুর রহমান, ডেপুটি জেলার বাহার ও মাসুদ ছাড়াও উপস্খিত ছিলেন স্বরাষ্ট্র সচিব, ঢাকার জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, সিভিল সার্জন, কারাগারের ডাক্তার ও ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার এ কে এম শহিদুল হক। তারা কারাগারের ভেতর প্রবেশ করলেও দায়িত্বশীল কয়েকজন ছাড়া অন্যরা রাত পৌনে ১২টার আগে ফাঁসির মঞ্চের সামনে যেতে পারেননি।
সূত্র জানায়, রাত ১০টায় কনডেম সেলে ফারুক তার বিছানায় বসেছিলেন। এ সময় কারাগারের পেশ ইমাম ফারুকের সেলের সামনে হাজির হন।
এ সময় কারা কর্মকর্তারাও সেখানে ছিলেন। ফারুককে শুরুতেই এক কর্মকর্তা বলেন, স্যার হায়াত মউত রিজিক দৌলত এগুলো সব আল্লাহর হাতে। আজ রাত ১২টায় প্রথম আপনার ফাঁসি কার্যকর হবে। তাই আপনি গোসল করে নামাজ পড়ে নিন। আপনাকে ইমাম সাহেব তওবা পড়াবেন।
তখন ফারুক তাদের বলেন, তওবা আমি নিজেই জানি। আমি জিন্দা পীরের আওলাদ। আপনারা জানেন না, আমার পূর্বপুরুষরা ইয়েমেন থেকে এসেছেন। আমি নিজেও একজন পীর। তবে কখনো পীরগিরি করতে যাইনি।
আর মৃত্যুকে আমি কখনো ভয় পাইনি।
এ সময় কারা কর্মকর্তারা তাকে স্মরণ করিয়ে দেন, ফাঁসি মঞ্চে যাওয়ার আগে আপনাকে কয়েদি ড্রেস পরতে হবে। তখন ফারুক তাদের আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলেন, ওই যে ড্রেস দেখছেন সেটি আমি আগেই ধুয়ে রেডি করে রেখেছি। নামাজও আমি আগেই পড়েছি।
তখন তাকে জানানো হয় আপনি যেহেতু দুই ঘন্টা পর মারা যাবেন, তাই আরো দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে নিন।
তবে পরে তিনি নামাজ আদায় করেছেন কি না তা আর তারা জানাতে পারেননি।
রাত ১২টায় জল্লাদ যখন তাকে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার জন্য যম টুপি পরাচ্ছিলেন তখন কারা কর্মকর্তাদের কাছে অনুরোধ করে বলেছিলেন, আমি জুতো পায়ে দিয়েই মঞ্চের দিকে যেতে চাই। তবে মঞ্চ আসার আগেই সেটি খুলে নিয়েন। তখন কারা কর্মকর্তারা তার শেষ ইচ্ছা পূরণের অনুমতি দেন ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।