বাংলাদেশের শ্রমিকদের তৈরি একটি সোয়েটার ইউরোপে বিক্রি হয় ৫০ ডলারে। অথচ সারা মাস কাজ করে এদেশের একজন শ্রমিক বেতন পান মাত্র ৩৭ ডলার। বিশ্বের সবচেয়ে কম মজুরি পান বাংলাদেশের গার্মেন্ট শ্রমিকরা। জীবনযাপনের ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় এই সামান্য অর্থ দিয়ে তাদের জীবন চলে না। বাধ্য হয়ে এসব শ্রমিক যখন বেতন বৃদ্ধির জন্য আন্দোলন শুরু করেন তখন শ্রমিকদের প্রতিবাদী কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য সরকার তার সব নিরাপত্তাযন্ত্রকে ব্যবহার করে।
শ্রমিকদের ওপর চালানো হয় নির্মম নিপীড়ন। হত্যা করা হয় আমিনুল ইসলামের মতো গার্মেন্ট শ্রমিক নেতাকে।
বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমসের গতকালের প্রতিবেদনে গার্মেন্ট শ্রমিকদের এ বেদনাদায়ক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ‘এক্সপোর্ট পাওয়ারহাউজ ফিলস প্যাঙ্গস অব লেবার স্ট্রাইফ’ শিরোনামে পত্রিকাটির প্রিন্ট সংস্করণে প্রায় আড়াই হাজার শব্দের দীর্ঘ এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের গার্মেন্টে শ্রমিক অসন্তোষে ওবামা প্রশাসনও উদ্বিগ্ন।
উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের আমদানিকারকরাও। তারা চান শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো হোক। কিন্তু এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে সরকার ও মালিকপক্ষ। সরকারের ওপর গার্মেন্ট মালিকদের প্রভাব ব্যাপক। প্রতিবেদনেদেশের ইপিজেডগুলোকে ‘দেশের ভেতরে আরেক দেশ’ হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে এখানে দেশের প্রচলিত আইন অচল।
ইপিজেডগুলো পরিচালনা করে থাকেন সেনা কর্মকর্তারা। গার্মেন্ট মালিকরা এখনগণমাধ্যমের মালিকানা অর্জনের দিকে ঝুঁকছেন বলেও জানানো হয়েছে প্রতিবেদনে। বিশিষ্ট গার্মেন্ট মালিক ও এফবিসিসিআই সভাপতি একে আজাদ সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলের মালিক হয়েছেন। দুই কিস্তির প্রতিবেদনের প্রথম কিস্তি গতকাল প্রকাশিত হয়। প্রথম কিস্তিতে বেশ কয়েকজন গার্মেন্ট শ্রমিকদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনীর বর্বর নির্যাতনের কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এক সময় বাংলাদেশ ছিল দরিদ্র ও বিশ্ব অর্থনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক। তবে বর্তমানে চীনের পরই পোশাক রফতানি বাংলাদেশের অবস্থান। টমি হিলফিগার, গ্যাপ, কেলভিনক্লেইন এবং এইচঅ্যান্ডএম’র মতো বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডগুলো এখন পোশাকআমদানি করছে বাংলাদেশ থেকে। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় রিটেইলার টার্গেট ও ওয়ালমার্টের মতো কোম্পানির অফিস রয়েছে ঢাকায়। বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য গার্মেন্ট জরুরি।
দেশের মোট রফতানির ৮০ ভাগেরও বেশি আসে পোশাক রফতানি করে এবং এ খাতে ৩০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে।
আমেরিকার স্টোরগুলোতে এখন ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ খ্যাত পোশাকের ছড়াছড়ি। বাংলাদেশের পোশাক খাতের এ সাফল্যের মূলে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে সস্তা শ্রম। গার্মেন্ট শ্রমিক ন্যূনতম মাসিক বেতন মাত্র ৩৭ ডলার। গত দু’বছরে মূল্যস্ফীতি ডাবল ডিজিট ( ১০ শতাংশ বাতার বেশি) অতিক্রম করায় এ সামান্য আয়েজীবন চালানো শ্রমিকদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে এবং হরহামেশাই প্রতিবাদ ও পুলিশের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে শ্রমিকরা।
শ্রমিকদের দমনে সরকার তার পুরো নিরাপত্তাযন্ত্রকে নিয়োজিত করেছে। সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গার্মেন্ট খাত তদারকি করে থাকে যে কমিটিতে রয়েছে সামরিক বাহিনী, পুলিশ ওগোয়েন্দা সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। অনেক শিল্প এলাকার জন্য মোতায়েন করা হয়েছে বিশেষ টহল পুলিশ বাহিনী। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো শ্রমিক নেতাদের ওপর নজরদারি করে থাকে। কড়া গোয়েন্দা নজরদারিতে থাকা শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামকে নির্যাতনের পর গত এপ্রিলে হত্যা করা হয়েছে।
ওই হত্যার কুলকিনারা হয়নি এখনও
নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, বাংলাদেশের শ্রমিক অসন্তোষ ওবামা প্রশাসনের ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত মে মাসে বাংলাদেশ সফরকালে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন শ্রমিক আন্দোলন ইস্যু ও আমিনুল হত্যার প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন। বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা বলেছেন, শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত না করা হলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
বিশ্বের সেরা ব্র্যান্ডগুলো সব সময় সস্তা শ্রমের সন্ধানের দেশ থেকে দেশান্তরে ছুটে বেড়ায়। চীনের শ্রমিকের মজুরি বাড়ার পর বাংলাদেশ তাদের কাছে চমকপ্রদ স্থানে পরিণত হয়েছে।
বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ম্যাককিনসি বাংলাদেশকে ‘পরবর্তী চীন’ অভিহিত করে পূর্বাভাস দিয়েছে যে ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি বর্তমান ১৮ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে তিনগুণ হতে পারে।
জিম ইয়ার্ডলির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি বলে মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু তারপর থেকেই বাংলাদেশের নারী শিক্ষা, শিশু ও মাতৃ মৃত্যুহার হ্রাস, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ও গড় আয়ু বৃদ্ধিতেউল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।
তবে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গার্মেন্ট মালিকদের পক্ষ নিয়ে শ্রমিকদের ওপর নিপীড়ন চালায় বলে যে অভিযোগ আছে তা অস্বীকার করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক লিখিত প্রতিক্রিয়ায় বলা হয়, সরকার শ্রমিকদের ওপর মালিকদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিচ্ছে না। সরকার শুধু রেফারি বা আম্পায়ারের ভূমিকা পালন করছে।
তবে শেখ হাসিনার সরকার শ্রমিকদের অধিকার বৃদ্ধির ইস্যুটি প্রতিহত করে আসছে। বাংলাদেশের ৫ হাজার গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির মালিকরাব্যাপক প্রভাবশালী। গার্মেন্ট কারখানার মালিকরা প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান চাঁদাদাতা (ডোনার)। এখন তারা গণমাধ্যমে বিনিয়োগ করতে শুরু করেছে। তারা সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেল কিনে ফেলছে।
সংসদ সদস্যদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই দেশের প্রধান তিনটি বণিক সংগঠনের সদস্য। ৩০ জন এমপিই গার্মেন্ট কারখানার মালিক অথবা তাদের পরিবারের সদস্য।
দেশের ভেতর আরেক দেশ : তিন দশক আগে বাংলাদেশে রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (ইপিজেড) প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমানে দেশের অনেক গার্মেন্ট ইপিজেডের বাইরে অবস্থিত হলেও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে এই বিশেষ এলাকাই প্রিয়। ঈশ্বরদীর মতো বিশেষ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা যেন দেশের ভেতরে আরেকটি দেশ।
তারা বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলকর্তৃপক্ষ (বেপজা) নামের আলাদা কর্তৃপক্ষ দ্বারা পরিচালিত হয়। এর আইনকানুনও আলাদা। প্রথানুসারে কোনো কর্মরত অথবা অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তার দ্বারা বেপজা পরিচালিত হয়। নিরাপত্তার জন্যও অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকদের নিয়োগ করে থাকে অনেক কারখানা। ইপিজেডের শ্রমিকদের বেতন ও কাজের পরিবেশ তুলনামূলক ভালো।
তবে শুরুর দিকে সেখানে শ্রমিক ইউনিয়ন নিষিদ্ধ ছিল। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০০৪ সালে কারখানাভিত্তিক শ্রমিক সংগঠন করার অনুমতি দেয়া হয়।
বাংলাদেশের প্রধান দুটো রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে রক্তাক্ত সংঘাত থাকলেও বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাত রক্ষার ব্যাপারে তারা একমত। ২০১০ সালে ব্যাপক বিক্ষোপের পর শেখ হাসিনা গার্মেন্টের ন্যূনতম মজুরি ২০ ডলার থেকে বাড়িয়ে ৩৭ ডলারে উন্নীত করেন। তবে অনেক শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ডের নির্বাহীরা বেতন বাড়ানোর পক্ষে কথা বললেও শেখ হাসিনার সরকার তাতে সায় দিচ্ছে না।
গত জুনে সুইডেনের রিটেইলার এইচঅ্যান্ডএম শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার ব্যাপারটি সুরাহা করার অনুরোধ করে।
তবে অনেক বড় বড় কোম্পানিও ব্যাপক দুর্নাম কুড়িয়েছে। ওয়ার অন ওয়ান্ট নামের একটি অলাভজনক গোষ্ঠী দেখতে পায় নাইকি, পুমা ও অ্যাডিডাসের মতো কোম্পানির পোশাক তৈরি করছে এমন কারখানাগুলোও ন্যূনতম মুজরির চেয়েও কম বেতন দিচ্ছে। তাদের বিররুদ্ধে শ্রমিকদের হয়রানি ও যৌন নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। টমি হিলফিগারের পোশাক তৈরি করে এমন একটি কোম্পানির আগুন লেগে ২৯ শ্রমিক নিহত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক আমদানিকারক সংগঠনের সভাপতি জুলিয়া কে হাগস বলেন, তারাও চান বাংলাদেশের পোশাক কারখানার উন্নত ও মানসম্মত পরিবেশ। তিনি বলেন, ‘কেউ বাংলাদেশে মজুরি বাড়াতে বাধা দিচ্ছে না। বেতন অবশ্যই বাড়ানো উচিত। ’ তবে বাংলাদেশের অনেক গার্মেন্ট মালিক সন্দিহান যে আমদানিকারকরা সত্যিই মজুরি বাড়াতে চায় কি না। অনেক বাংলাদেশী শ্রমিক নেতাও বলেছেন, বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশের শ্রমিকদের শোষণ করছে।
প্রভাবশালী শ্রমিক নেতা রায় রমেশ চন্দ্র বলেন, ‘পুরো সাপ্লাইং চেইনকে আমাদের সঠিক পথে নিয়ে আসতে হবে। ব্র্যান্ডগুলোকে তাদের দায়িত্ব পালনকরতে হবে। উত্পাদকদেরও তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। সরকারকেও আন্তর্জাতিক শ্রমমানকে নিশ্চিত করতেহবে। ’
নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ শিশুশ্রম বন্ধ ও কর্ম পরিবেশের উন্নতির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক চাপকে সামাল দিয়েছে।
তবে বর্তমানে শ্রমিকদের দাবি সংগঠন করার অনুমতি ও বেতন বৃদ্ধির জন্য দর কষাকষির সুযোগ। এজন্য দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা। কিন্তু এখন রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে গার্মেন্ট খাতসহ ব্যবসায়িক স্বার্থ। এফবিসিসিআই সভাপতি একে আজাদ গার্মেন্ট খাতের রাজনৈতিক ভূমিকার কথা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা ক্ষমতাধর নই।
ক্ষমতাধর হলেন রাজনীতিকরা। ক্ষমকাধর হলো গণমাধ্যম। ’
অনেক গার্মেন্ট মালিক রাজনীতিতে যোগদান করেছেন এবং গণমাধ্যমের মালিক হয়েছেন। তারা সংবাদপত্র কিনে নিচ্ছেন অথবা টিভি চ্যালেন চালু করছেন। দেশের অন্যতম গার্মেন্ট ব্যবসায়ী একে আজাদও একটি বাংলা দৈনিক (সমকাল) ও একটি টিভি চ্যানেলর (চ্যালেন টুয়েন্টিফোর) মালিক।
অনেক পশ্চিমা কূটনীতিক ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলেছেন, বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর খবরে দেখানো হয় শ্রমিক আন্দোলনের ফলে কতটা ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। শ্রমিকদের উদ্বেগগুলো সেখানে উপেক্ষিত থাকে।
written by: ইলিয়াস হোসেন ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।