বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ ‘কি ঘর বানাইমু আমি শূন্যেরও মাঝার ...’
একদা প্রাচীন বাংলার উর্বর মননক্ষেত্রে চর্চিত হয়েছিল সাংখ্য, তন্ত্র ও যোগ-এর মতো নিগূঢ় সব তত্ত্বদর্শন। প্রাচীন বঙ্গবাসীর এই সমস্ত দার্শনিক ভাবনা পরবর্তীকালে উত্তর ভারতীয় বৈদিক আর্যদের ধর্মীয় চিন্তায় বিপুল পরিবর্তন সাধন করেছিল। সাংখ্যের প্রকৃতিপুরুষ তত্ত্বর ওপরই করে গড়ে উঠেছিল তন্ত্র- যা বৈদিক শৈব ও শাক্ত ধর্মের অন্যতম ভিত।
আজও বাংলার রাধাকৃষ্ণের অপূর্ব যুগলমূর্তি যেন প্রকৃতিপুরুষ তত্ত্বের প্রবক্তা ‘আদিবিদ্যান’ কপিল-এর কথা মনে করিয়ে দেয়। এই সব তত্ত্বদর্শন চর্চার কারণে আবহমান কাল থেকেই বাংলা হয়ে উঠেছিল দার্শনিক চিন্তার পবিত্র পীঠস্থান। বাংলার এই মহত্তম দিকের ইঙ্গিত করে কবি আল মাহমুদ লিখেছেন:
‘আবাল্য শুনেছি মেয়ে বাংলাদেশ জ্ঞানীর আতুড়
অধীর বৃষ্টির মাঝে জন্ম নেন শত মহীরূহ। (সোনালি কাবিন)
গৌতম বুদ্ধ খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ট শতকে প্রাচীন বাংলার চিন্তাশীল মহলের কাছে তাঁর শূন্যতার ধারণা উপস্থাপন করেছিলেন; যে শূন্যতার ধারণাটি বাংলার চিন্তাশীল সাধুসমাজে যে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছিল -তার প্রমান মিলেছে। চিন্তার ইতিহাসে বুদ্ধের শূন্যতার ধারণা একটি মৌলিক ধারণা।
এবং বুদ্ধ এই তত্ত্বের প্রবক্তা হিসেবেই বিশ্বময় শ্রদ্ধেয়।
বুদ্ধ মনে করতেন মানবদেহের উপাদান বা স্কন্ধ হল পাঁচটি। (১) রূপ;(২) বেদনা;(৩) সংজ্ঞা; (৪) সংস্কার এবং (৫) বিজ্ঞান। রূপ হল- বস্তুগত উপাদান; বেদনা হল- অনুভূতিগত উপাদান; সংজ্ঞা হল- অভিজ্ঞতা লব্দ উপাদান; সংস্কার হল- মানসিক উপাদান এব বিজ্ঞান হল- চৈতন্যময় উপাদান। বুদ্ধ মনে করতেন, এই পাঁচটি উপাদানই মানবসত্তা গঠন করে এবং এই উপাদানগুলি আত্মাবিহীন (অনাত্ব); অচিরস্থায়ী (অনিত্য) এবং অকাম্য (দুঃখ)।
বুদ্ধ আরও বিশ্বাস করতেন যে -যিনি উপাদান সমূহের মধ্যে আত্মার অনুপস্থিতি উপলব্দি করেন, তিনি জানেন যে ব্যক্তি হিসেবে তার কোনও প্রকৃত অস্তিত্ব নেই, এবং সেই কারণেই তার সঙ্গে তার চারপাশের বস্তজগতের কোনও সর্ম্পক গড়ে ওঠা অসম্ভব। কাজেই জগতে এমন কিছুই নেই যা তাকে আনন্দিত অথবা দুঃখিত করতে পারে।
বুদ্ধের জীবদ্দশায় প্রত্যেক ভিক্ষুই বুদ্ধের শিষ্য ছিলেন। এদেরই একজন ছিলেন সারিপুত্র (পালিভাষায় ‘সারিপুত্ত। ’) বুদ্ধ তাঁর শিষ্য সারিপুত্তকে বলেছিলেন-
Here, Sariputra, form is emptiness and the very emptiness is form; emptiness does not differ from form, form does not differ from emptiness; whatever is form, that is emptiness, whatever is emptiness, that is form, the same is true of feelings, perceptions, impulses and consciousness.
শোন, হে সারিপুত্র, রুপ হল শূন্যতা এবং শূন্যতাই হল রূপ।
শূন্যতা রূপের চেয়ে আলাদা কিছু নয়; রূপ শূন্যতার চেয়ে আলাদা কিছু নয়: শূন্যতা-তা যাইই হোক না কেন-তাই রূপ। অনুভূতি, উপলব্দি, তাড়না/প্রেরণা এবং চৈতন্যের সম্বন্ধেও ওই একই কথা প্রযোজ্য।
এইই হল বৌদ্ধদর্শনের শূন্যতার ধারণা। এবং বুদ্ধের এই তত্ত্বের অনিবার্য অভিঘাতে প্রাচীন বাংলার সংবেদনশীল মনন আলোরিত হয়েছিল। বাংলা যে এই তত্ত্বটি কেবল গ্রহন কিংবা ধারণ করেনি- সেটি বিকশিতও করেছিল- তারও প্রমান মিলেছে।
কেননা, মধ্যযুগে পাল আমলে বুদ্ধের শূন্যতার ধারণার ওপরই গড়ে উঠেছিল তান্ত্রিক বৌদ্ধসম্প্রদায়ের বজ্রযানী মতবাদ। ওই সময়কার অর্থাৎ মধ্যযুগের বাংলার অন্যতম একটি তান্ত্রিক গ্রন্থের নাম হল "গূহ্যসমাজতন্ত্র। " ওই বইতেই সম্বন্ধে তান্ত্রিক বৌদ্ধদের বজ্রযানী ভাবনার মূল কথাগুলি পাওয়া যায়:
‘সৃষ্টির আদি ও অকৃত্রিম উৎপত্তিস্থল একমাত্র শূন্য। এই শূন্য মহাসুখ এবং আনন্দস্বরূপ। এই শূন্য ঘনীভূত হয়ে প্রথমে শব্দরূপে দেখা দেন; পরে শব্দ হতে পুনরায় ঘনীভূত হয়ে দেবতা রূপ গ্রহন করেন।
’
আমাদের মনে রাখতে হবে যে- এসব কথা বুদ্ধের না। কেননা, আমি বলেছি যে মধ্যযুগের বাংলা বুদ্ধের শূন্যতার তত্ত্বটি গ্রহন করেছিল এবং বিকশিত করেছিল। মধ্যযুগের বাংলার বজ্রযানী তান্ত্রিক বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অন্যতম চিন্তাবিদ ছিলেন বাংলাদেশের বিক্রমপুরের অতীশ দীপঙ্কর। তিনি বলেছিলেন:The greatest medicine is the emptiness of everything. অতীশ দীপঙ্করের এই উক্তিতে বুদ্ধের শূন্যতার ধারণারই যেন প্রতিধ্বনি শোনা যায়! বুদ্ধের যে শূন্যতার ধারণার ওপরই গড়ে উঠেছিল মধ্যযুগের বাংলার তান্ত্রিক বৌদ্ধসম্প্রদায়ের বজ্রযানী মতবাদ।
সে যা হোক।
শূন্যকে বজ্রযান দর্শনে ‘বজ্র’ বলা হয়েছে। কিন্তু, কেন? কারণ শূন্য বজ্রের মতোই (ক) অবিনাশী, (গ) অভেদ্য ও (গ) দৃঢ়। কাজেই ‘শূন্য’-র অপর নাম ‘বজ্র’। এবং যে মার্গ (বা যে পথ অবলম্বন করলে ) শূন্যের সঙ্গে মিলিত হওয়া যায় তাকেই শূন্যযান বা বজ্রযান বলে। মধ্যযুগের বাংলার পাল রাজারা বজ্রযান বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
কিন্তু, বাংলায় তান্ত্রিক বজ্রযানের উৎপত্তি ঠিক কোথায় হয়েছিল?
এ রকম একটি প্রশ্ন উঠতেই পারে। পন্ডিতদের মতে তান্ত্রিক বজ্রযানের চারটি প্রধান কেন্দ্র ছিল। (এক) উড্ডীয়ান, (দুই) কামাখ্যা, (তিন) সিরিহট্ট এবং (চার) পূর্ণগিরি। এর মধ্যে, পন্ডিতদের মতে, তান্ত্রিক বজ্রযানের উৎপত্তি স্থল ছিল উড্ডিয়ান। উড্ডিয়ান কে পন্ডিতগণ বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী বলে মনে করেন।
অর্থাৎ, তান্ত্রিক বজ্রযানের উৎপত্তি স্থল ছিল ছিল মধ্যযুগের প্রখ্যাত পন্ডিত অতীত দীপঙ্কর-এর জন্মভিটা বাংলাদেশের বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী!
তান্ত্রিক বজ্রযানের অন্য তিনটি পীঠস্থানে মধ্যে কামাখ্যা ও পূর্ণগিরি ছিল আসামে। এবং সিরিহট্ট হল বর্তমান বাংলাদেশের সিলেট।
বাংলার মরমি লোককবির গীতিকবিতা সংগত কারণেই বাংলার মৃত্তিকা-উদ্ভূত দর্শন-প্রভাবিত । যে কারণে বাংলার মরমি কবির রচনায় সাংখ্য-তন্ত্র-যোগ-বৌদ্ধ-বৈষ্ণব-সুফি ও বাউলদর্শনের অনিবার্য ছায়া পড়ে। তখন একবার উল্লেখ করেছিলাম যে- গৌতম বুদ্ধ খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ট শতকে প্রাচীন বাংলায় শূন্যতার ধারণা নিয়ে এসেছিলেন ।
গৌতম বুদ্ধ বাংলায় শূন্যতার ধারণা প্রচারের প্রায় আড়াই হাজার বছর পরে তান্ত্রিক বজ্রযানের অন্যতম কেন্দ্র সিরিহট্ট বা সিলেটেরই মরমী কবি হাসন রাজার একটি গানে বুদ্ধের শূন্যতার ধারণা প্রকাশ পেয়েছে এভাবে-
লোকে বলে বলে রে
ঘরবাড়ি ভালা না আমার।
কি ঘর বানাইমু আমি
শূন্যের মাঝার ...
আবহমান বাংলা এভাবেই তার ঋদ্ধ চিন্তাস্রোত ধরে রাখে।
আবহমান বাংলা কালের গর্ভে তার জ্ঞানমানিক্য কিছুতেই হারিয়ে যেতে দেয় না ...
সম্পূর্ন গান:
লোকে বলে বলেরে
ঘর-বাড়ি ভালা নাই আমার
কি ঘর বানাইমু আমি শূণ্যেরও মাঝার। ।
ভালা কইরা ঘর বানাইয়া
কয়দিন থাকমু আর
আয়না দিয়া চাইয়া দেখি
পাকনা চুল আমার।
।
এ ভাবিয়া হাসন রাজা
ঘর-দুয়ার না বান্ধে
কোথায় নিয়া রাখব আল্লায়
তাই ভাবিয়া কান্দে। ।
জানত যদি হাসন রাজা
বাঁচব কতদিন
বানাইত দালান-কোঠা
করিয়া রঙিন। ।
গানের সূত্র:
http://banglalyrics.evergreenbangla.com/11
তথ্যসূত্র:
ড. বিনয়তোষ ভট্টাচার্য, বৌদ্ধদের দেবদেবী
নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ধর্ম ও সংস্কৃতি: প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।