আমার এই ব্লগের কোনো লেখা বা লেখার কোনো অংশ আমার লিখিত অনুমতি ছাড়া যে কোনো প্রকার মিডিয়াতেই প্রকাশ করা যাবেনা। যদি তা করা হয়, তাহলে আমি আইনগত এবং অবস্থাভেদে ব্লগের আইন/প্রসিজিওর অনুযায়ী ব্যাবস্থা নিতে বাধ্য হব
মূলত সাঈদীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহন চলাকালীন অবস্থাতেই একটা কথা চারিদিকে শুনতে পাওয়া যায় যে, সাঈদীর বিরুদ্ধে আসা সাক্ষীরা চোর, বাটপার কিংবা নারী নির্যাতনকারী। মোট কথা হচ্ছে, ট্রাইবুনালে আসা সাক্ষীরা নাকি ভালো না। এদের বানিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে ইত্যাদি অভিযোগ শুনতে পাই। এই পুরো ব্যাপারটি মূলত ছড়িয়েছে ভুল তথ্যের মাধ্যমে এবং জামাতী পত্রিকা ও ব্লগের কল্যানে।
আমি বিষ্ময় নিয়ে লক্ষ্য করেছি যে অনেক শিক্ষিত, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষজনও এই বিষয়ে তাদের হতাশা বার বার প্রকাশ করছে। অথচ কেউ ব্যাপারটি খতিয়ে দেখবার চেষ্টা করেনি এক্টিবারের জন্য। ব্যাপারটা শুরু থেকেই আমার কাছে কৌতূহলের। কেননা আমরা ভালো করেই জানি আন্তর্জাতিক অপরাধে অভিযুক্তদের আইনজীবিরা যখন প্রসিকিউশনের আনা সাক্ষীদের জেরা করবে তখন খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাদের কয়েকটি লক্ষ্য থাকবে। আর এই লক্ষ্য অনুযায়ী তারা কাজ করবে।
কেননা তাদের এজেন্ডাই বা মিশনই হচ্ছে এই অভিযুক্তদের নিরপরাধ প্রমাণিত করা ও তাদের মুক্ত করে আনা।
এই বিভ্রান্তি থেকে আপনাদের খানিক্টা সরিয়ে আনবার জন্যই আমি কয়েকটি পর্বের এই লেখাটি শুরু করেছি। যাতে করে আপনারা প্রসিকিউশনের সাক্ষীদের প্রদত্ত সাক্ষ্য ও এই ব্যাপারগুলো ভালো করে জানতে ও সহজে বুঝতে পারেন।
অভিযুক্ত আইনজীবিরা কিছু লক্ষ্য নিয়ে সামনে আগাচ্ছে। এই লক্ষ্য বা টার্গেট গুলো হচ্ছে-
টার্গেট-১: সাক্ষীর ক্রেডিবিলিটি নষ্ট করে দেয়া (যেমন এটি প্রমাণ করা যে- সাক্ষীর চরিত্রই এমন যেখানে এই সাক্ষীর দেয়া কোনো কথাই আসলে আমলে নেবার মত না)
টার্গেট-২: জেরা গ্রহনকারী আইনজীবি নিজে সাক্ষীর বিরুদ্ধে যে ধারনা বিচারকের সামনে তৈরী করতে চাচ্ছে তা যেভাবেই হোক তৈরী করা এবং আইনজীবির বক্তব্যই যে সঠিক তা প্রমাণ করা।
এই দুইটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে সাঈদীর আইনজীবি যা করেছে তা হোলো-
(ক) সাক্ষীর বিরুদ্ধে পূর্বে কোনো অভিযোগ ছিলো ( যা প্রমাণিত নয়) সেটিকে ফোকাস করে মিডিয়া, সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা। আইনজীবি কিন্তু কোনোভাবেই এটি বলছে না যে এটা কেবল মাত্র অভিযোগ অথবা মোটেও প্রমাণিত কিছু নয়। বরংচ, এই অভিযোগটাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখিয়ে বিচারককে বুঝাতে চাইছে যে আসামীর বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ ছিলো সুতরাং এই লোকের কথার দাম নেই।
(খ) সাক্ষীকে অহেতুক এই মামলা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুত করে অন্য বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলছে এবং সাক্ষীকে বিভ্রান্ত করবার চেষ্টা করছে। এতে করে সাক্ষী ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে এবং মানসিক ভাবে খানিকটা দমিত হয়ে যাচ্ছে।
(গ) সাক্ষীর প্রদত্ত জবানবন্দীকে টুইস্ট করবার চেষ্টা করছে এবং ভিন্ন পথে ব্যাখ্যা করছে।
(ঘ) সাক্ষীকে অহেতুক প্রশ্ন করে সাক্ষীর মুখ থেকে যতটুকু সম্ভব "জানি না" ধরনের উত্তর বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে, যাতে করে মনে হতে পারে যে, এই সাক্ষী আসলে একেবারেই ফালতু, এই লোক কিছুই জানেনা।
(ঙ) সাক্ষীর সাথে অভিযুক্তের রাজনৈতিক কলহ আছে, এটি প্রমাণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এতে করে বিচারককে এটি-ই বুঝাবার চেষ্টা চলছে যে, এই লোক আক্রোশের বশবর্তী হয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছে।
(চ) বয়সের কথা তুলে প্রমাণ করার চেষ্টা করছে যে, সাক্ষী ঘটনার সময় যে বয়সের ছিলো সে সময় থেকে এই পর্যন্ত এই স্মৃতি তার পক্ষে ধারন করা সম্ভব নয়।
(ছ) আইনজীবি এটা প্রমাণ করবার চেষ্টা করছে যে, এই সাক্ষী সাক্ষ্য দেবার কারনে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ভাবে ক্ষমতাসীন দলের কাছ থেকে লাভবান হবে এবং ক্ষমতাসীন দলের প্ল্যানিং টুলস হিসেবেই সে সাক্ষ্য দিচ্ছে। মোট কথা, তার লাভবান হবার সম্ভাবনা থেকেই সাক্ষী সাক্ষ্য দিচ্ছে।
(জ) সাক্ষ্যর পূর্বে প্রদত্ত জবানবন্দীর প্রতিটি লাইন, অক্ষর এসব থেকে এক চুল সরে এসে একই মিনিং কিন্ত ভিন্ন বাক্যে বা একই আউটকাম হয় এমন কথা বল্লেও বলা হচ্ছে যে, “আপনি মিথ্যে বলছেন”, “আপনি বানিয়ে বলছেন” “আপনি আগে বলেছেন খুন করা হয়েছে এখন বলেছেন যে হত্যা করা হয়েছে” – এই জাতীয় বিভ্রান্তি মূলক কথা বলে এবং প্রতি লাইনে লাইনে ভুল ধরে সাক্ষীর মনোবল নষ্ট করে দেয়া হচ্ছে।
(ঝ) সাক্ষী ওই সময় ওই স্থানে কি করছিলো কিংবা সে কেন তখন মুক্তিযুদ্ধে যায়নি, সাক্ষী নিজেই পাকিস্তানী আর্মির সাথে একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করেছিলো, সাক্ষীর বাবা-দাদা তথা পরিবারের অন্য লোকেদের কি ভূমিকা ছিলো মুক্তিযুদ্ধের সময় সে প্রসঙ্গ তুলে সাক্ষীর আদর্শগত অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। এতে করে সাক্ষীকে সকলের সামনে আন-রিলায়েবল করে তোলা হচ্ছে।
(ঞ) সাক্ষী ৩০ বছর আগে অমুক যায়গায় অমুক কথা বলেছিলো এসব রেফারেন্স তুলে ধরে বর্তমানের বক্তব্যের সাথে জোর করে সে বক্তব্যের অমিল বের করার চেষ্টা করে সাক্ষীকে বিভ্রান্ত করবার চেষ্টা।
(ট) সাক্ষী চাপে পড়ে বক্তব্য দিচ্ছে তা প্রমাণ করার চেষ্টা।
(ঠ) পারিবারিক বা ব্যাক্তিগত দ্বন্দের কারনে সাক্ষীর বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে চুরির, এবং পরে সেটি মিমাংসাও হয়ে গিয়েছে নিজেদের মধ্যে। কিন্তু তা কোনোভাবেই বলা হচ্ছে না আদালতে।
(ড) কোনো কোনো সাক্ষীর সামান্য পারিবারিক সমস্যা বা স্বামী স্ত্রীর ভুল বোঝাবুঝিকে নারী নির্যাতন হিসেবে দেখিয়ে সাক্ষীর ক্রেডিবিলিটি নষ্ট করছে।
একেবারেই পারিবারিক ব্যাক্তিগত বিষয়কে সামনে এনে সাক্ষীকে হেয় করার চেষ্টা। এমনকি ডিভোর্স হয়েছে এমন সাক্ষীর ব্যাক্তিগত ব্যাপারটিকে নারী নির্যাতনের কারনে এমনটি ঘটেছে বলে প্রমান করার চেষ্টা।
আপাতত এই বিষয়গুলো আমার গবেষনায় বের হয়ে এসেছে। সামনের পর্বগুলোতে এই ব্যাপারগুলো নিয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা করব সংশ্লিষ্ঠ আইনের রেফারেন্স সহ এবং আইনজীবিদের করা জেরা, অন্যান্য দেশের করা জেরা ইত্যাদি উদাহরন সহ। উপরে আমি যেসব পয়েন্ট ফোকাস করেছি সেসব ব্যাপারগুলো জামাতের পত্রিকাগুলো সাক্ষীকে জেরা করার পর পরই প্রকাশ করে দেয় সাক্ষীর সম্পূর্ণ বক্তব্য না প্রকাশ করেই।
এতে করে এই বিচার পক্রিয়ার পক্ষে যারা রয়েছেন তারা হতাশ হয়ে পড়েন এবং তারা কখনো প্রসিকিউশনের আইনজীবিদের দূষতে থাকেন, কখনো সরকারকে দুষতে থাকেন, কখনো দুষতে থাকেন পুরো ট্রাইবুনালকেই। এতে করে প্রতিটি কনসার্ন্ড কম্পোনেন্টে চাপ বেড়ে ও ক্ষতির কারন হয়ে দাঁড়ায়। সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে যায়। আর সেটিই হচ্ছে জামাতীদের একমাত্র লক্ষ্য। (চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।