সাত মাস তদন্তের পর বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত কর্মকর্তা মতিউর রহমান চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর হাতে ৩৭৩ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনসহ মোট ৯৫৫৭ পৃষ্ঠার দালিলিক প্রমাণাদি তুলে দেন।
যুদ্ধাপরাধের জন্য জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতার সাজার পর গতবছর খোদ দলটির বিরুদ্ধে এই তদন্ত শুরু করে তদন্ত সংস্থা।
এর আগে ট্রাইব্যুনালের বিভিন্ন রায়ে যুদ্ধাপরাধে দল হিসেবে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি উঠে আসে। সর্বশেষ গোলাম আযমের রায়ে জামায়াতকে একটি ‘ক্রিমিনাল সংগঠন’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
ইতোমধ্যে তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান জানিয়েছেন, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামী ও তাদের তখনকার সহযোগী সংগঠনগুলো যে সারা বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটিয়েছিল, তার প্রমাণ তারা তদন্তে পেয়েছেন।
জামায়াত ও সহযোগীদের বিরুদ্ধে একাত্তরে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, জেনেভা কনভেনশন ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন, মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের চেষ্টা ও ষড়যন্ত্র এবং এসব অপরাধ ঠেকাতে ব্যর্থতাসহ সাত ধরনের অভিযোগ আনা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।
এতে বলা হয়েছে, জামায়াতে ইসলামী, তাদের সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ; পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা দিতে গঠিত শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনী এবং জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের ৪ এর ১ ও ৪ এর ২ ধারা অনুযায়ী অপরাধ করেছে।
“এসব সংগঠনের নীতি, নীতিনির্ধারক ও সব নেতাকর্মী এসব অপরাধের জন্য দায়ী। ”
গত বছর ১৮ অগাস্ট প্রসিকিউশনের তদন্ত কর্মকর্তা মতিউর রহমান জামায়াতে ইসলামীর যুদ্ধাপরাধের এই তদন্ত শুরু করেন।
নির্বাচন কমিশনের শর্ত পূরণ না করায় ইতোমধ্যে রাজনৈতিক দল হিসাবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছে উচ্চ আদালত।
তবে একাত্তরে ভূমিকার জন্য দলটিকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ ঘোষণার জন্যও জোরালো দাবি রয়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল হিসাবে কর্মকাণ্ড চালালেও একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করার জন্য কখনোই ক্ষমা চায়নি জামায়াত, বরং দলটির শীর্ষনেতারা স্বাধীনতার পরও বলেছিলেন, একাত্তরে তাদের ভূমিকা সঠিক ছিল।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, উস্কানি, হত্যাকাণ্ডে সায় ও সহযোগিতা দেয়ার দায়ে জামায়াতের তখনকার আমির গোলাম আযমকে গত ১৫ জুলাই ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।
ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে জামায়াতে ইসলামীকে ‘ক্রিমিনাল দল’ আখ্যায়িত করে বিচারক বলেন, দেশের কোনো সংস্থার শীর্ষ পদে স্বাধীনতাবিরোধীদের থাকা উচিত নয়।
ট্রাইব্যুনালের আগের রায়গুলোতেও জামায়াতের স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে দলটির সরাসরি সংশ্লিষ্টতার বিষয়গুলো উঠে আসে।
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন থেকে ‘যুদ্ধাপরাধী’ দল হিসেবে জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি উঠে।
জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার রায়ের পর গড়ে ওঠা এই আন্দোলনের পর আইন সংশোধন করে দলের বিচারের বিধানও যোগ করা হয়। আগের আইনে শুধু যুদ্ধাপরাধী ব্যক্তির বিচারের সুযোগ ছিল।
গোলাম আযমের আগে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আব্দুল কাদের মোল্লা ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানের সাজার রায়েও একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি উঠে আসে।
গোলাম আযমের মামলার রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেছে, সাধারণ জ্ঞান ও দালিলিক প্রমাণাদি থেকে এটা স্পষ্ট যে, জামায়াত ও এর অধীনস্থ সংগঠনের প্রায় সবাই সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছেন।
“গোলাম আযমের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী একটি ক্রিমিনাল দল হিসাবে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কাজ করেছে, বিশেষ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকালে। ”
১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের স্বাধীনতার সময় গোলাম আযমের ‘গুরু’ আবুল আলা মওদুদী তার বিরোধিতা করেছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় সেই ধরনের ভূমিকাই ছিল গোলাম আযমের।
জামায়াত দুই সময়েই সাধারণ মানুষের মন বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল মন্তব্য করে ট্রাইব্যুনাল দলটির দূরদৃষ্টির অভাবের পেছনে উগ্র মৌলবাদী চেতনাকেই চিহ্নিত করেছে।
“স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও স্বাধীনতাবিরোধী কিছু মানুষ জামায়াতের হাল ধরে আছেন।
যার ফলে জামায়াতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নতুন প্রজন্ম স্বাধীনতাবিরোধী চেতনা ও সাম্প্রদায়িক অনুভূতির মানসিকতায় বেড়ে উঠছে, যা দেশের জন্য বড় ধরনের উদ্বেগের বিষয়। ”
ট্রাইব্যুনাল বলেছে, একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধীরা শহীদদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে কিংবা অনুশোচনা প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছেন বলে কোনো প্রমাণ জাতির সামনে নেই।
রায়ে বলা হয়, একটি গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়তে সরকারের নির্বাহী বিভাগ, সরকারি বেসরকারি সংগঠনসহ সামাজিক ও রাজনৈতিক দলের কর্ণধার হিসাবে এ ধরনের স্বাধীনতাবিরোধীরা থাকা উচিত নয়।
এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পদে স্বাধীনতাবিরোধীরা যাতে না আসতে পারে, সেজন্য সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে বলে রায়ে বলা হয়েছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।