আল্লাহ মহান, যাহা বলিব সত্য বলিব।
রাসুল (সা.) নারী-অধিকারের কথা বললেও হেফাজতিরা তাদের অধম মনে করে..। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমপ্রতি বলেছেন, মদিনা সনদ ও বিদায় হজের ভাষণের আলোকে দেশ চলবে। তার এ বক্তব্যের দ্বিবিধ অর্থ করা হচ্ছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং আইনজ্ঞরা বলছেন যে, এ বক্তব্য ঠিক নয়।
কেননা দেশ চলবে সংবিধানের ভিত্তিতে। আরেক দল, যারা ইসলামপন্থী বলে নিজেদের পরিচয় দিতে পছন্দ করেন (এবং অন্যরাও অজ্ঞতাবশত তাদের ইসলামপন্থী বলে মনে করেন। কার্যত এরা কেউ ইসলামপন্থী নন। যেমন জামায়াতকে হেফাজতপন্থীরা ইসলামপন্থী মনে করে না। অনুরূপ কওমিওয়ালাদেরকেও অনেকেই, যেমন রেজভিপন্থীগণ, মুসলমানই মনে করেন না), তারা এটার ব্যাখ্যা দাবি করেছেন (যেমন ১৬ এপ্রিল ২০১৩ এর দৈনিক ইনকিলাব দ্রষ্টব্য : ‘প্রধানমন্ত্রী কি সত্যিই মদিনা সনদের আলোকে রাষ্ট্র চালাবেন’ শিরোনামে রাজনৈতিক ভাষ্যকারের বক্তব্য)।
আমাদের মনে হয়, উভয় পক্ষই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বুঝতে ভুল করেছেন। প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন তার সোজাসাপ্টা অর্থ হচ্ছে এই, তথাকথিত ইসলামপন্থীরা ধর্মের নাম ব্যবহার করে যা বলছেন, তা ইসলাম নয়। রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে ইসলামের সত্যিকার গাইড লাইন হচ্ছে মদিনা সনদ নামে খ্যাত চুক্তি, যাকে ইতিহাসে কেউ-কেউ প্রথম লিখিত সংবিধান বলেছেন। আর বিদায় হজের ভাষণেও ইসলামের সামাজিক রীতি-নীতি কী হবে সে সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়েছে, যেমন নারীর অধিকার প্রসঙ্গ এবং মানুষের ঐক্য সম্পর্কিত।
মদিনা সনদ (যা পরবর্তীকালে ইসলামি চিন্তাবিদগণ এবং সকল ঐতিহাসিক এ নামকরণ করেছেন) বাস্তবে মোহাজের ও আনসার মুসলিমগণের সঙ্গে (যাদের সংখ্যা তখনও দেড় শতাধিক ছিল কি না সন্দেহ আছে) ইয়াসরিবে ও এর আশপাশের এলাকায় বসবাসরত অধিবাসীদের মধ্যে একটি চুক্তি, যা ক্রমান্বয়ে মদিনা রাষ্ট্র গড়ে ওঠার একটি ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে এবং পরবর্তী সময়ে আবু বকর, ওমর, ওসমান ও আলী (রা.)এর সময়ে রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি-আদর্শ হিসেবে ব্যবহূত হয়েছে।
এই চার খলিফার পর মুসলমানদের রাষ্ট্র সাধারণভাবে অন্যান্য আর দশটি রাজতান্ত্রিক (সড়হধত্পযরপ) রাষ্ট্রব্যবস্থার মতো পরিচালিত হয়েছে। তবে মদিনা সনদের মৌল দর্শন— রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতা কখনও-সখনও মুসলিম রাজতন্ত্রসমূহও অনুসরণ করেছে। মদিনা সনদ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এমনকি আইনের অনুসরণের ক্ষেত্রে এই চুক্তি চুক্তিবদ্ধ গোষ্ঠীগুলোয়, মুসলিম ও অমুসলিম নির্বিশেষে, প্রচলিত আইনকেই প্রাধান্য দিয়েছে। মুসলমানদের আইন, কোরআন ও সুন্নার আইন, অন্য ধর্মাবলম্বীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার কোনও চেষ্টাও হয়নি এবং সুযোগও ছিল না।
বিদায় হজের অভিভাষণে মহানবী (সা.) মানুষের ঐক্য ও নারীর অধিকারের কথা সুস্পষ্টভাবে বলেছেন।
তিনি বলেছেন, দাস বা মুক্ত মানুষ, মুসলমানদের ক্ষেত্রে কোনও পার্থক্য নির্ধারণ করে না (আমাদের তথাকথিত আলেমগণ নিজেদের সাধারণ মুসলমানদের চেয়ে উঁচু স্তরের ভেবে থাকেন)। অনুরূপ ভাবে সাদাকালো বা আরব অনারবের মধ্যে কোনও পার্থক্য না করার কথা বলেছেন মহানবী (সা.) । অথচ আমাদের বর্তমান যুগে উর্দু ভাষী, আরবি ভাষী ভাইয়েরা বা আরবরা আমাদের থেকে উন্নত স্তরের মানুষ মনে করে থাকেন নিজেদেরকে। রসুল (সা.) নারীদের অধিকারের কথা বলেছেন আর হেফাজতিরা নারীদের দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষের চেয়েও অধম মনে করে। তিনি বলেছেন, হে মানুষ (লক্ষ করবেন, তিনি হে মুসলমান বলেননি)! মহিলাদের ওপর তোমাদের অধিকার রয়েছে।
তোমাদের ওপরও মহিলাদের অধিকার রয়েছে। —এখানে রাসুল (সা.) সম অধিকারের কথা বলেছেন। বিশ্বের অগ্রযাত্রায় মানুষের অধিকার চেতনায় যে পরিবর্তন এসেছে বর্তমানে তারই আলোকে এই অধিকারের বিষয়গুলো বিচার করতে হবে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, পুরুষরা যা উপার্জন করবে তা তাদের আর নারীরা যা উপার্জন করবে তা তাদের। অর্থাত্ নারীদের উপার্জন করার স্বাধীনতাকে কোরআন করীম স্বীকৃতি দিয়েছে এবং নারীদের উপার্জনের ওপর তার একচ্ছত্র অধিকারকেও কোরআন করীম স্বীকৃতি দিয়েছে।
মনে রাখতে হবে নবী করীম (সা.) যখন এই অভিভাষণ প্রদান করেন বা কোরআন করীম-এ যখন এই বিষয়ে বক্তব্য রাখা হয়, আরবসহ সমগ্র বিশ্বে সেই সময়ে নারীর স্বাধীনতা ও স্বতন্ত্র সত্তাকে অস্বীকার করা হত। মানুষ তথা পুরুষের অন্যান্য সম্পদের মতো তাদের সামগ্রী হিসেবে বিবেচনা করা হত। দাস-দাসীদের তুলনায় হয়তোবা তারা মর্যাদায় কিছু ঊর্ধ্বে অবস্থান করতেন। এই পরিস্থিতি পরিবেশে বিদায় হজের ভাষণে নারীদের সম্পর্কে যে বক্তব্য এসেছে, তা নিঃসন্দেহে বিপ্লবাত্মক এবং পৃথিবীর সমাজ মানচিত্রে তা নারীর অবস্থানকে দৃঢ় ভিত্তি দিয়েছিল।
বিশ্ব বহু পথ অতিক্রম করে যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, তারই প্রেক্ষিতে নারীর পারিবারিক, সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক অবস্থানকে বিচার-বিশ্লেষণ করাই হচ্ছে ইসলামের দাবি ও শিক্ষা।
ইসলাম পশ্চাত্পদতাকে অস্বীকার করে এবং অগ্রসরমানতাকে আপন করে নেয়। অশ্লীলতা ও উলঙ্গপনা যেমন ইসলাম সমর্থন করে না, অনুরূপ তা আধুনিকতাও নয়। মানব সভ্যতার সূচনা থেকেই অশ্লীলতা ছিল; শত প্রকার ধর্মীয় ও নৈতিক বাধা-বিঘ্ন সত্ত্বেও এখনও আছে (আমাদের মাদ্রাসাগুলোয় আরবি সাহিত্যের পাঠ্যক্রমে ইমরুল কায়েস ও মুতানাব্বীর যে কাব্যগ্রন্থ আছে, সে গ্রন্থগুলো সাহিত্যের বিচারে যেমন উত্কৃষ্ট, তেমনি অশ্লীলতার বিচারেও চরম অশ্লীল। এরই প্রভাবে কি না জানি না, মাদ্রাসা ও এতিমখানাগুলোয় সমকামিতা ব্যাপক আকারে বিদ্যামান)। সুতরাং অশ্লীলতা ও উলঙ্গপনার অজুহাতে আধুনিকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া ইসলাম সমর্থন করে না।
অশ্লীলতা ও উলঙ্গপনা রোধে ফৌজদারি কার্যবিধিতে যথেষ্ট প্রতিকার রাখা আছে। আমরা মনে করি, তা যথেষ্ট।
আমরা যে আলোচনা করলাম তা প্রধানমন্ত্রীর সামপ্রতিক বক্তব্যের আলোকে দেখলে কোনও সংশয় বা তর্কের অবকাশ থাকে না। মদিনা সনদ বা বিদায় হজের অভিভাষণ শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, সব মানুষের জন্যই অনুসরণযোগ্য। জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ এবং আমাদের আলোচনায় আসা দুটি বক্তব্য (মদিনা সনদ ও বিদায় হজের অভিভাষণ) প্রায় সমানভাবেই দেখা যেতে পারে।
পার্থক্য শুধু সময়ের ব্যবধান এবং মানব সভ্যতার অগ্রসরমানতা। মুসলমানরা মদিনা সনদ ও বিদায় হজের অভিভাষণের আলোকে সার্বজনীন মানবাধিকার সনদকে সাজিয়ে নিতে পারেন। সম্ভবত শেখ হাসিনা এ কথাই বোঝাতে চেয়েছেন এবং এতে আপত্তি করারও কিছু নেই। নিজেদের সংবিধান থাকা সত্ত্বেও যেমন ইউনিভার্সাল হিউম্যান রাইটস মেনে নিতে হয়, তেমনি মদিনা সনদ ও বিদায় হজের অভিভাষণও অনুসরণ করা যায়। কোনওটিই সাংঘর্ষিক নয়।
বরং পরষ্পরের পরিপূরক।
এখানে বিদায় হজে নবী (সা.) এর একটি বক্তব্য দিয়েই আমরা শেষ করতে চাই। তিনি উদাত্ত কণ্ঠে বলেছেন : সাবধান! ধর্মীয় ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন করবে না। কেননা ধর্মের সীমা অতিক্রম করার ফলে তোমাদের আগে বহুজাতি ধ্বংস হয়ে গেছে।
সুত্র ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।