আমি যা বিশ্বাস করি না... তা বলতেও পারি না! সফিক এহসান
(১০ মার্চ ২০০৮ইং
একটা সময় ছিল যখন মোবাইলে কলরেট ছিল ৬/৭ টাকা। তখন মোবাইল ব্যবহার করতো হাতে গোনা কয়েকজন ধনী ব্যক্তি, নেতা-মন্ত্রী-শীল্পপতিগণ। কিন্তু- ‘সেই দিন কি আর আছে? দিন বদলাইছে না!’ এখন মোবাইলের কলরেট সর্বোচ্চ দেড়-দুই টাকা। মোবাইল সেট ও সীমের দামও কমেছে কল্পনাতীত। যার ফলে আজকাল আমাদের বাসার কাজের বুয়াটিকেও রান্না ঘর থেকে বলতে শোনা যায়: ‘হিলো, মজিদের মা ইছপিকিং!’
ব্যাপারটাতে আমি খারাপ কিছু দেখি না।
তবে প্রযুক্তি উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রেই যেমন সুবিধা রয়েছে, তেমনি রয়েছে অসুবিধাও। না; আমি মোবাইলের অপব্যবহার নিয়ে কথা বলতে (থুক্কু, লিখতে) বসিনি। কেননা, এই বিষয়ে পাঠকের জ্ঞান আমার চেয়েও অনেক বেশি। আমি আলোচনা করতে চাই অন্য একটি বিষয় নিয়ে।
আমরা অনেকেই হয়তো কম-বেশি আত্মীয়-স্বজন, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধব কিংবা পাড়ার চেনা-অচেনা লোকজনের কাছ থেকে এক ধরনের লিফলেট পেয়েছি।
যার বিষয়বস্তু এরকম:
“এটি একটি সত্য ঘটনা। ওমুক দেশের (সাধারণতঃ আরব, ইরাক, ইরান ইত্যাদি) জৈনক ব্যক্তি স্বপ্নে দেখেছেন, রাসুল (সঃ) তাকে বলছেন- নামাজ পড়, সৎ পথে চল, পাপাচার থেকে বিরত হও...(ইত্যাদি)।
সুপ্রিয় পাঠক। লিফলেটের এই অংশটুকুতে আমার কোন আপত্তি নেই। আমি পূর্ণ ঈমানের সাথে এই অংশটুকু বিশ্বাস করছি এবং তওবা করছি- আর পাপাচার করব না; এখন থেকে সৎপথে চলব, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ব (আমিন)।
কিন্তু লিফলেটের পরের অংশে যা লেখা থাকে তার সারাংশ হচ্ছে: “উক্ত কথাগুলো বলার পর রাসুল (সঃ) ঐ ব্যক্তিকে বলেছেন- স্বপ্নের এই কথা সবাইকে কাগজে লিখে জানিয়ে দাও। আর যে লোক উক্ত কাগজ পেয়ে সেটিকে (লিফলেটটিকে) ২০০ কপি করে বিতরণ করবে সে ঐ (কেয়ামতের) দিনের জন্য সুফল পাবে। ”
তারচেয়েও মজার ব্যাপার হচ্ছে- এই পত্র তথা লিফলেট পেয়েও যে যে লোক অবিশ্বাস ও অবহেলা করেছে এবং ২০০ কপি ছাপায়নি তাদের কার কী ক্ষতি হয়েছে এবং ২০০ কপি ছাপিয়ে বিলি করায় কার কী উপকার হয়েছে (অনেকে মাটি খুঁড়ে সোনা-দানা, টাকা-পয়সা পেয়েছে) তা পর্যন্ত এই একই লিফলেটে লেখা থাকে। পরিশেষে লিফলেট পাঠকের প্রতি এই নিবেদন করা হয়েছে যেন সেও এই লিফলেটটি অবহেলা করে ছিঁড়ে না ফেলে ২০০টি কপি ছাপিয়ে বিতরণের ব্যবস্থা করে।
এখন সুপ্রিয় পাঠক, আপনারা ভাবুন একবার; আপনি দ্বীনের প্রচারের উদ্দেশ্যে একটি কাগজে কিছু ভাল কথা লিখে তা জনগণের মধ্যে বিলিয়ে দিলেন।
জনগণ সেই কাগজ পড়ে কিরূপ আচরন করবে সেটা আপনার আগে থেকে জানার কথা না। সুতরাং কাগজটি অবহেলা বা গুরুত্ব দেয়ায় কার কী ক্ষতি হবে বা লাভ হবে তাও আপনার জানা সম্ভব নয়। তাই যদি হয়, তবে ঐ লিফলেটে তার বর্ণনা আপনি কিভাবে দিলেন? তাহলে কি এটা স্পষ্ট নয় যে- আপনার কথা বিশ্বাস ও নিজ খরচে প্রচার করানোর জন্য আপনি মানুষকে বানিয়ে বানিয়ে ঘটনা তৈরী করে ভয় কিংবা প্রলোভন দেখাচ্ছেন? যদিও এই প্রচারণার উদ্দেশ্য মহৎ কিন্তু প্রতারণা করে মানুষকে ভয় দেখিয়ে বাধ্য করে কোন কাজ করা কি উচিৎ? উক্ত লিফলেটটি যে পড়বে তাকে যে শুধু তা আমলই করতে হবে তাই নয়; এই কাগজটি ২০০ কপি করে বিলি করতে বাধ্য থাকবে। নয়তো তার ক্ষতি হবে! (লক্ষ্য করুন- উক্ত বিষয় আমল না করলে ক্ষতি হবে না কিন্তু লিফলেটটি ২০০ কপি না করলে ক্ষতি হবে। অর্থাৎ, দ্বীনের আদর্শ নিজে আমল করার চেয়েও সেটা অপরের নিকট প্রচার করা বেশি জরুরী!)
এ বিষয়ে আমি কথা বলেছিলাম আমাদের স্থানীয় জামে মসজিদের ইমাম জনাব আলহাজ্ব রবিউল ইসলাম সাহেবের সাথে।
তিনি বললেন: মানুষকে নামাজের প্রতি, দ্বীনের আদর্শ আমল করার প্রতি এই আহ্বান নিঃসন্দেহে সওয়াবের কাজ। কিন্তু তার প্রচারণার জন্য যদি প্রতারণার আশ্রয় নেয়া হয় তা অবশ্যই অনুচিৎ। কারণ, “নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রতারণাকারী ও মিথ্যাবাদীকে পছন্দ করেন না। ”
লিফলেটের ভাষাটা যদি এমন হতো যে, “ভাই আসুন আমরা দ্বীনের পথে চলি, অপরকেও দ্বীনের পথে আহ্বান করি- অনেক ফায়দা হবে। ” তাহলে কোন কথা ছিল না।
তবলীগের মূল কাজও এটাই। কিন্তু কোন রকম ক্ষতির ভয় বা লাভের আশ্বাস দেয়ার মালিক তো মানুষ নয়। সেই ক্ষমতা বা অধিকার তো মানুষের নেই।
শুরু করেছিলাম মোবাইল নিয়ে। হয়তোবা প্রসঙ্গটা পাল্টে গেছে বলে অনেকে ভাবছেন।
এবার মোবাইলেই ফিরে আসছি। বিভিন্ন অপারেটরে আজকাল ফ্রি এস.এম.এস সুবিধা দেয়ায় সেই লিফলেটগুলোই ইদানিং মেসেজ আকারে আমাদের মোবাইলে পাওয়া যাচ্ছে। আমার নিজের মোবাইলেই এরকম ৪/৫টি মেসেজ আছে। এদের কোনটিতে মহান আল্লাহ তায়ালার নয়টি নাম লিখে বলা হয়েছে অন্ততঃ নয়জনকে এই মেসেজটি পাঠিয়ে দিতে। এতে আগামী নয় ঘণ্টার মধ্যে একটা সুসংবাদ পাবে।
অন্যাথায় নয় বছর পর্যন্ত দুর্ভোগ পোহাতে হবে। (‘৯’ এর ছড়াছড়ি!)
আবার কোন কোনটিতে কালেমা তাইয়্যিবা, সূরা এখলাস বা কোরআন শরীফের একটি আয়াত লিখে অনুরূপভাবে ১০/১২ জনকে পাঠাতে বলা হয়েছে (কিন্তু একবারও তা পাঠ করতে বা আমল করতে বলা হয়নি!)। তাতে অমুক কল্যাণ, অন্যাথায় অশেষ ক্ষতি!
এখন আমার প্রশ্ন- উক্ত মেসেজটি যেই আবিষ্কার করে থাকুক তার উদ্দেশ্য কি দ্বীনের খেদমত করা, নাকি মেসেজটি পেয়ে তার বন্ধুরা কতটা বোকা বনে গিয়ে সত্যি সত্যি আরও ১০/১২ জনকে, তারা আবার আরও ১০/১২ জনকে, এভাবে হাজার হাজার লোককে বোকা বানায় তা দেখে মজা পাওয়া?
হয়তো বলবেন, এটা একটা নিছকই ফান! বিশ্বাস না করলেই হল। কিন্তু ধর্মকে তো আমরা জন্মের পর থেকেই না দেখে, না বুঝেই বিশ্বাস করে এসেছি। আমরা জেনে এসেছি, ঈমান মানে বিশ্বাস।
অন্ধবিশ্বাস। এই অন্ধ বিশ্বাসকে জিম্মি করে এধরনের খেলা বা ফান করাটা কোন পর্যায়ের পাপ, কত বড় অপরাধ তা কি ভেবে দেখেছেন? এটা কি মুসলমানদের ‘এপ্রিল ফুল’ বানানোর সেই ঐতিহাসিক জঘণ্য প্রতারণার সামিল নয়? ধর্মের মত একটা স্পর্শকাতর বিষয়ে এইভাবে ভয় দেখিয়ে যত মহৎ কাজই করা হোক না কেন, তা কি উচিৎ?
তাই আমি বিনীতভাবে সেই সব “দ্বীনের খেদমতকারী” ভাইদের (নাকি বোনেরাও আছেন?) অনুরোধ করছি- এরকম মেসেজ বা লিফলেটের ফাঁদে পা দিয়ে প্রতারণায় অংশ গ্রহণ করবেন না। তারচেয়ে বরং আসুন- নিজেরা সৎ পথে চলি, সৎ কথা বলি, সৎ চিন্তা করি। অপরকেও সৎ পথে, দ্বীনের পথে আহ্বান করি। ভাল কাজ আমল করার চেষ্টা করি।
মানুষকে লিফলেট বিলি করে ইহকালের ধন সম্পত্তির লোভ কিংবা আর্থিক বা শারীরিক ক্ষতির মিথ্যা ভয় না দেখিয়ে আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত পরকালের পুরষ্কার এবং কঠিন শাস্তির কথা প্রচার করি। ইনশাল্লাহ্, অনেক ফায়দা হবে।
---------- ০ ---------- ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।