মাত্র ছয় বছর বয়সে তিনি কুরআন মাজীদ মুখস্থ করে ফেলেন ও দশ বছর বয়সে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এরপর তিনি বুখারার শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দীস ইমাম দাখিলী (র) এর হাদীস শিক্ষাকেন্দ্রে প্রবেশ করেন। তার সহপাঠীরা খাতা কলম নিয়ে ওস্তাদ থেকে শিখা হাদিস লিখে রাখতেন। কিন্তু তিনি সাথে খাতা কলম নিয়ে যেতেন না। সহপাঠীরা তাকে এই বলে ভর্ৎসনা করত যে, খাতা কলম ছাড়া তুমি অযথা কেন এসে বসে থাকো? একদিন বিরক্ত হয়ে তিনি বললেন, তোমাদের খাতা কলম নিয়ে এস।
কথামতো তারা তাই করল। এরপর তিনি তাদেরকে এতদিনে শোনা ১৫ হাজারের বেশি হাদীস মুখস্থ শুনিয়ে দিলেন, কোন রকম ভুলত্রুটি ছাড়া। বরং সহপাঠীরা তাদের ভুল গুলো সংশোধন করে নিল। এই ঘটনা দেখে বিষ্ময়ে তারা হতবাক হয়ে গেল। আর এই বালকের প্রখর স্মৃতিশক্তির কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
তিনি আর কেউ নন। ইমাম বুখারী (র)! কাল প্রবাহে একটি বিস্ময়ের নাম। স্মৃতির প্রখরতা, জ্ঞানের গভীরতা, চিন্তার বিশালতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, অটুট সততা আর বিশাল পর্বত সম হিম্মতের এক মূর্ত প্রতীক এই মহাপুরুষ। মুসলিম পন্ডিতগন বলেছেন, পবিত্র কুরআনের পর সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন কিতাব হচ্ছে এই বুখারী শরীফ।
হাদীস সংগ্রহ করার জন্য তিনি তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের জ্ঞানকেন্দ্র কুফা, বসরা, বাগদাদ,সিরিয়া, মিশর, খুরাশান বার বার ভ্রমন করেন।
তিনি প্রায় একহাজারের বেশি মুহাদ্দিসের নিকট থেকে হাদীস শিক্ষা লাভ করেছেন এবং তার নিকট থেকে হাদীস শ্রবনকারীর সংখ্যা নব্বই হাজারের অধিক বলে উল্লেখ করা হয়। তার ছাত্রদের মধ্যে ইমাম মুসলীম, ইমাম তিরমিযী, আবু হাতিম আর রাযী (র) এর নাম উল্লেখযোগ্য।
কাজাকস্থানের বুখারা অঞ্চলে জন্মগ্রহনকারী এই ইমাম হাদীস সংরক্ষনের গুরুত্ব অনুধাবন করে বহু দূর্গম পথ পাড়ি দিয়ে অমানুষিক কষ্ট স্বীকার করে সনদসহ প্রায় ৬ লক্ষ হাদীস সংগ্রহ করেন এবং দীর্ঘ ১৬ বছর হযরত মুহাম্মদ (সা) এর রওজায়ে আকদাসের পাশে বসে তা সংকলন করেন। এক লাখ সহীহ ও দুই লাখ গায়ের সহীহ হাদীস ইমাম বুখারী(র) এর মুখস্থ ছিল। এছাড়া তার কাছে সংগৃহীত আরো তিন লাখ, মোট ছয় লাখ হাদীস হতে যাচাই বাছাই করে মাত্র সাত হাজার তিনশত সাতানব্বইটি হাদীস এই গ্রন্থে তিনি সংকলিত করেন।
বুখারী শরীফের সংকলনকালে তিনি সর্বদা রোজা রাখতেন এবং প্রতিটি হাদীস গ্রন্থ সন্নিবেশিত করার আগে গোসল করে দু' রাকাত নফল নামাজ আদায় করে মুরাকাবা ও ধ্যানের মাধ্যমে হাদীসের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতেন। এই গ্রন্থে তিনি সকল সহীহ হাদীস সংকলন করেননি। বরং সহীহ হাদীসের মাঝে যেগুলো তার নির্ধারিত শর্তে উন্নীত হয়েছে,সেগুলো লিপিবদ্ধ করেছেন। এরুপ কঠোর সতর্কতা অবলম্বনের ফলে বুখারী শরীফ মুসলিম জাহানে পবিত্র কুরআন শরীফের পরেই সর্বাপেক্ষা সহীহ গ্রন্থ হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
ইমাম বুখারী ১৯৪ হিজরীর ১৩ই শাওয়াল জুমআর দিনে জন্মগ্রহন করেন।
ছোট বেলায় পিতাকে হারান তিনি। শৈশবে রোগে তার চোখ নষ্ট হয়ে যায়, কিন্তু পরবর্তীতে তার মায়ের প্রার্থনার কারণে অলৌকিকভাবে তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পান। ১০ বছর বয়স থেকে তিনি হাদীস মুখস্ত করা শুরু করেন। ১৬ বছর বয়সেই তিনি "আবদুল্লাহ বিন মুবারক" এবং "ওয়াকীর পান্ডুলিপিসমূহ" মুখস্ত করে ফেলেন। তার এই অস্বাভাবিক ও বিষ্ময়কর স্মৃতিশক্তির খ্যাতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল।
বিভিন্ন শহরের মুহাদ্দিসগন তার এই স্মৃতিশক্তির পরীক্ষা করে বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে গেছেন এবং একবাক্যে স্বীকার করেছেন হাদীস শাস্ত্রে তার সমকক্ষ কেউ নেই। এ সম্পর্কে তার জীবনীগ্রন্থে বহু চমকপ্রদ ঘটনার বর্ননা আছে। মাত্র এগার বছর বয়সে বুখারার বিখ্যাত মুহাদ্দিস "দাখিলী"র হাদীস বর্ননাকালে যে ভুল তিনি সংশোধন করে দেন, হাদীস বিশারদদের কাছে তা সত্যিই বিষ্ময়কর। তৎকালীন খিলাফতে বনী উমাইয়ার রাজধানী বাগদাদে ইমাম বুখারী (র) কে পরীক্ষা করার জন্য এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় এবং এর জন্য বাগদাদের দশজন খ্যাতিমান মুহাদ্দিসকে নির্বাচন করা হয়। তাঁরা প্রত্যেকে দশটি করে হাদীস সনদ ও মতন এলোমেলো করে মোট একশত হাদীস ইমাম বুখারীর সামনে উপস্থাপন করলে ইমাম বুখারী (র) প্রথমেই প্রত্যেকের প্রতিটি হাদীসের ভুলগুলো বর্ণনা করত: তার সঠিক সনদ ও বিশুদ্ধ মতন এক এক করে ধারাবাহিকভাবে বিস্ময়কর পারদর্শিতার সাথে বর্ণনা করে দেন।
ইমাম বুখারী (র) মহৎ চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। পিতার রেখে যাওয়া বিরাট ধন সম্পদ তিনি গরীব দু:খীদের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। নিজে অতি সামান্য আহার করতেন। কখনো কখনো সারাদিনে মাত্র দুতিন টি বাদাম খেতেন। দীর্ধ ৪০ বছর তরকারী ছাড়া শুধু রুটি খাওয়ার ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।
ইমাম বুখারী (র) জীবনে কখনো গীবত শিকায়াত করেননি। তিনি রমজান মাসে পুরো তারাবীহে এক খতম, দিবাভাগে একখতম ও প্রতি তিন রাতে একখতম কুরআন মাজিদ তিলওয়াত করতেন। এভাবে ইবাদত বন্দেগী, তাকওয়া পরহেযগারী ও দান খয়রাতের বহু ঘটনা তার জীবনীকারগন বর্ননা করেছেন যা সত্যিই বিষ্ময়কর।
শেষ বয়সে তাকে অনেক দু:খ কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে। বুখারার গভর্নরের সাথে দ্বন্ধের কারনে তাকে জন্মভুমি ত্যাগ করতে হয়েছিল।
তিনি ২৫৬ হিজরীর ১লা শাওয়াল ঈদের দিনে ৬২ বছর বয়সে মৃত্যুবরন করেন। দাফনের পর তার কবর থেকে সুগন্ধ বিচ্ছুরিত হতে থাকে। লোকে দলে দলে তার কবরের মাটি নিতে থাকে। কোনোভাবে তা নিবৃত্ত করতে না পেরে কাঁটাতার দিয়ে তার কবর রক্ষা করা হয়। পরে জনৈক ওলীআল্লাহ মানুষের আকীদা নষ্ট হওয়ার আশংকায় তা বন্ধে আল্লাহর কাছে দুআ করেন, তারপর তা বন্ধ হয়ে যায়।
৭ম হিজরী শতাব্দীর বিখ্যাত আলীম ইবনে তাইমিয়া বলেছেন,"আকাশের নীচে ও মাটির উপরে ইমাম বুখারীর চেয়ে বড় কোন মুহাদ্দীসের জন্ম হয়নি। "
তথ্যসূত্রঃ বুখারী শরীফ বঙ্গানুবাদ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।