আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পোড়া বিষয়ক গবেষনা পত্র

আমরা অনেক সময় অনেক দুর্ঘটনার মুখে পতিত হই তার মধ্যে একটা হচ্ছে পুড়ে যাওয়া। রান্না করতে গিয়ে,কাপড় ইস্তিরি করতে গিয়ে বা অন্য কোনো ভাবে একটু আধটু পুড়ে যাওয়ার বা ছ্যাকা লাগার অভিজ্ঞতা আমাদের সকলের ই আছে। আর তেমনটা হলে কি করতে হয় মোটামুটি সকলেই জানে। কিন্ত আমার এই লেখাটা আর একটু জটিল ধরনের পুড়ে যাওয়া নিয়ে। উইকিপিডিয়ার মতে বার্ন হলো শরিরের চামড়া বা মাংশের এমন একটা ক্ষত বা ইনজুরি যা আগুন বা উত্তপ্ত বস্তু,বিদ্যুত, রাসায়নিক পদার্থ এবং তেজস্ক্রিয় বিকিরন থেকে তৈরী হতে পারে।

বেশির ভাগ বার্ন চামড়ার উপরের অংশ তে হয়। যেটা খুব বেশি ভয়ানক কিছু নয় এবং কিছু অয়েন্টমেন্ট এবং ব্যথানাশক ঔষধ দিয়েই এর চিকিতসা করা যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে চামড়ার ভেতরের অংশ বা পুরো চামড়া এবং মাংশ পেশি পর্যন্ত পুড়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে অনেক বেশি নিবিড় যত্ন ও চিকিতসা প্রয়োজন হয়। বার্নের প্রকারভেদঃ ১- ফার্স্ট ডিগ্রিঃ এধরনের ক্ষত চামড়ার উপরিভাগে হয়ে থাকে।

পোড়া জায়গা লাল দেখায় এবং এতে কোনো ফোস্কা থাকে না। সাধারনত ২ থেকে ৩ দিনে রোগী সুস্থ হয়ে উঠে। এধরনের ক্ষততে জ্বালাপোড়া বা ব্যাথা থাকে তাই ব্যাথানাশক ঔষধ দরকার পরে। ২-সেকেন্ড ডিগ্রি (সুপারফিসিয়াল পারসিয়াল থিকনেস) –এধরনের ক্ষত চামড়ার আর একটু গভির পর্যন্ত যায়। পোড়া স্থানে পানি ভর্তি ফোস্কা দেখা যায়।

ক্ষততে ব্যাথা থাকে এবং সুস্থ হতে ১ থেকে ২ সপ্তাহ সময় লাগে। ক্ষত স্থানে ইনফেকশন হওয়ার ভয় থাকে তাই জীবানুনাশক ক্রিম,এন্টিবায়োটিক ও ব্যথানাশক ঔষধ দিয়ে চিকিতসা করা হয়। ৩-সেকেন্ড ডিগ্রি (ডীপ পারসিয়াল থিকনেস) – এই ক্ষত চামড়ার যথেষ্ট গভীরে যায়। ক্ষত স্থান লাল এবং সাদা দেখায়,রক্তাত্ত ফোস্কা থাকতে পারে। ক্ষত ব্যথাযুক্ত এবং সেরে উঠতে ৩ থেকে ৪ সপ্তাহ লাগে।

পোড়া স্থান সঙ্কুচিত হতে পারে এবং পরে দাগ হতে পারে। এক্ষেত্রে ইন্ট্রাভেনাস ফ্লুইড(স্যালাইন), জীবানুনাশক ক্রিম,এন্টিবায়োটিক ও ব্যথানাশক ঔষধ দিয়ে চিকিতসা করা ছাড়াও ক্ষত স্থানে স্কিন গ্রাফটিং অপারেশন বা প্লাস্টিক সার্জারী করা দরকার হতে পারে যা ক্ষততে বাজে দাগ হওয়া থেকে রক্ষা করে। ৪-থার্ড ডিগ্রি (ফুল থিকনেস) –থার্ড ডিগ্রি বার্ন হলে পুরো চামড়াটাই পুড়ে যায়। পোড়া স্থান শক্ত সাদা বা বাদামী রঙ ধারন করে। এই ক্ষত ব্যাথাহীন এবং সেরে উঠতে অনেক সময় লাগে।

ক্ষত স্থান সঙ্কুচিত হয় এবং দাগ হয়। এধরনের রোগীর অনেক বেশি যত্ন প্রয়োজন। জরুরি বিভাগে এই সমস্ত রুগীকে নিবিড় পর্যবেক্ষনে রাখা হয়। ৫-ফোর্থ ডিগ্রি – এই ধরনের বার্ন সবচে ভয়ানক। এই ক্ষত চামড়া ছাড়িয়ে তার নিচের অংশ,মাংশপেশি এমনকি হাড়ে পর্যন্ত যেতে পারে।

পোড়া স্থান কালো হয়ে যায় এবং সেই স্থান কেটে ফেলার প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে পাকাপাকি ভাবে অঙ্গহানি হতে পারে। পরবর্তিতে গ্যাংগ্রীন হতে পারে বা পচন ধরতে পারে। এধরনের পোড়া রোগীর অনেক ক্ষেত্রেই মৃত্যু হয়। (উল্লেখ্য অনেক স্থানে বার্নের শ্রেনীবিভাগে ফোর্থ ডিগ্রি বলে আলাদা ভাগ নেই।

পুরো চামড়া ,মাংস এবং হাড় পর্যন্ত পুড়ে গেলে সেটাকে থার্ড ডিগ্রি আর সবচে সিরিয়াস বার্ন হিসাবে শ্রেনীভুক্ত করা হয়েছে) পোড়ার তীব্রতা পরিমাপ করা যায় অনেক ভাবে। পোড়া ক্ষতের গভীরতা মেপে উপরের শ্রেনী অনুযায়ী। যেটা অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন। কারন প্রথম থেকে প্রাথমিক চিকিতসা দেওয়ার পরও অনেক সেকেন্ড ডিগ্রি পারসিয়াল থিকনেস বার্ন থার্ড ডিগ্রি বার্নে পরিনত হয়। তাছাড়া শরীরের কতটুকু স্থান পুড়েছে এটাও একটা গুরুত্তপুর্ন বিষয়।

এই পরিমাপ করা হয় পুরো শরীর কে ১০০% ধরে কত % অংশে ইনজুরি হয়েছে। একজন পুর্নবয়ষ্ক মানুষের জন্য ১০%এর নিচে হলে মাইনর,১০-২০% হলে মডারেট এবং ২০% এর বেশি হলে মেজর ইনজুরি বলা হয়। ছোট বাচ্চাদের হিসাবটা আলাদা। তাই পোড়ার তীব্রতা নির্ভর করে কতটুকু স্থান পুড়েছে,কি দিয়ে পুড়েছে,কতটা গভীর হয়েছে,কি কি অঙ্গ পুড়েছে,রোগীর বয়স কত ইত্যাদির উপর। আগুনে পুড়লে কি করবেন? শরীরে আগুন ধরলে যত তারাতারি সম্ভব নেভানোর চেষ্টা করুন।

লজ্জা করবেন না এক্ষেত্রে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। আগুন ধরা কাপড় খুলে ফেলুন বা ছিঁড়ে ফেলুন। কোনোকিছু দিয়ে বারি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করুন। কম্বল বা কিছু দিয়ে চেপে ধরবেন না,এতে ক্ষত গভীর হওয়ার সম্ভবনা থাকে। পোড়া স্থানে ঠান্ডা পানি ঢালুন যতটা পারেন।

সম্ভব হলে বরফ মেশানো পানি দিন। তবে বরফ পোড়া যায়গাতে চেপে না ধরাই ভাল এতে ক্ষত বেশি হতে পারে। মাথা ঠান্ডা রাখুন,যারতার পরামর্শ শুনবেন না ক্ষত স্থানে হাবিজাবি কিছু দিবেন না। যত তারাতারি সম্ভব ডাক্তারের কাছে যান এবং তার পরামর্শ মত কাজ করুন এবং ধৈর্য রাখুন। চিকিতসা – যদি বেশি পুড়ে যায় তবে ডাক্তারের পরামর্শ মত কিছুদিন হাসপাতালে থাকতে হতে পারে।

পোড়া স্থান সাধারনত জীবানুনাশক দিয়ে পরিস্কার করে সেখানে শীতলকারি কোনও ক্রিম দেয়া হয় এবং এন্টিবায়োটিক ক্রিম দিয়ে ব্যন্ডেজ করা হয়। পোড়ার পরিমান অনুযায়ি স্যালাইন চলতে পারে। তাছাড়া টিটেনাস,এন্টিবায়োটিক ও পেইনকিলার ইঞ্জেকশন দেয়া হয়। এসময় রোগীকে বিশ্রাম নিতে হবে,প্রচুর পরিমান প্রোটিন যুক্ত খাবার ও ভিটামিন সি যুক্ত ফল্ খেতে হবে। রোগিকে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ি নিয়মিত ড্রেসিং করাতে হবে।

পোড়া ক্ষত অবহেলা করা ঠিক নয়। সঠিক চিকিতসা না নিলে ক্ষতস্থানে ব্যকটেরিয়া আক্রমন করে ইনফেকশন ঘটাতে পারে এবং পচন ধরতে পারে। এভাবে একটা সাধারন ক্ষত মারাত্মক আকার নিয়ে অঙ্গ হানির কারন হতে পারে। রোগিকে পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। বার্নের ক্ষেত্রে প্লাস্টিক সার্জারি –বেশি পুড়েগেলে অনেক সময় সেই ক্ষততে দাগ থেকে যায়।

যা অনেক ক্ষেত্রে আপত্তিকর ও সৌন্দর্যহানিকর হতে পারে। অনেক সময় কিছু ক্ষত দ্রুত শুকাতে চায়না। এজন্য স্কিন গ্রাফটিং অপারেশন একটা ভাল সমাধান। এখানে শরীরের সুস্থ কোনো স্থান যেমন পা বা উরু থেকে চামড়া অপারেশনের মাধ্যমে আলাদা করে ক্ষত স্থানে লাগিয়ে দেয়া হয়। কিছুদিন পর এই চামড়া ক্ষততে নিজ থেকে জোড়া লেগে যায়।

যেখান থেকে চামড়া নেয়া হয় সে স্থান ও সাধারনত ১০-১৪ দিনের মাঝে শুকিয়ে যায়। দুই স্থানের দাগ ই সময়ের সাথে ঠিক হয়ে যায়। বাংলাদেশে বার্ন চিকিতসার ইতিহাস –স্বাধিনতার পর ১৯৭২ এ ডক্টর আর.জে গার্স্ট আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যের জন্য এদেশে আসেন এবং তখন একজন প্লাস্টিক সার্জনের অভাব খুব বেশি অনুভব করেন। তিনি ভারত থেকে একজন প্লাস্টিক সার্জন এদেশে আনার ব্যবস্থা করেন যিনি ১৯৭৪ এ শহীদ সোরওয়ারদি হাসপাতালে যোগদান করেন। এটাই ছিল বাংলাদেশে প্লাস্টিক সার্জারির ধারনার সুচনাপর্ব।

ডক্টর মোঃ শহীদুল্লাহ প্রথম বাংলাদেশি প্লাস্টিক সার্জন হিসাবে ১৯৮১তে ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে যোগদান করেন। তিনি কিছুদিনের মাঝেই এখানে আলাদা একটা বার্ন ইউনিটের প্রয়োজন অনুভব করেন এবং ১৯৮৬তে বাংলাদেশ সরকারের কাছে এর জন্য প্রস্তাব পাঠান। ২০০০ সালে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এর জন্য কাজ করে গেছেন। পরে তার সহকর্মী ও অনুসারিরা তার কাজের অগ্রগতি ঘটান এবং ২০০৩ সালে অবশেষে এখানে আলাদা বার্ন ইউনিট তৈরী হয়। এখন এদেশে উন্নত মানের চিকিতসা ও প্রশিক্ষনের কাজ চলছে।

পুড়ে গেলে কোন হাসপাতালে যাবেন? ১- এজন্য ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিট সহজ সমাধান। এখানে সুলভে চিকিতসা করানো সম্ভব কিন্ত বাংলাদশে রোগীর সংখ্যা কম নয় তাই স্থান সঙ্কটে ভুগতে পারেন। তবে এখানে স্পেশালিস্ট ডাক্তারের চিকিতসা পাবেন। ২-যারা সরকারি হাসপাতালের চেয়ে উন্নত ব্যবস্থাপনায় চিকিতসা নিতে চান তারা অনেকেই ল্যাবেইড আপোলোতে ছুটবেন কিন্ত তারা আপনাকে চিকিতসা দেবেনা বরং পাঠাবে সিটি হসপিটালে। কারন বেসরকারি হাসপাতালের মাঝে বার্ন এবং প্লাস্টিক সার্জারির জন্য সবচে পরিচিত এবং অভিজ্ঞ ধানমন্ডির সিটি হসপিটালের বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট।

কিন্ত অন্যসব বেসরকারি হাসপাতালের মত এখানে খরচটা অনেক বেশি তবে সেবার মান ভাল। তাছাড়া এখানে সব রকম কসমেটিক সার্জারি করা হয়। ৩-এছাড়া এসিড বার্নের জন্য রয়েছে এসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেসন আমি যেহেতু ডাক্তার নই এবং বেশির ভাগ তথ্য ইন্টারনেটলব্ধ তাই তথ্য বিভ্রাট থেকে থাকলে তার জন্য আমি মোটেও দায়ি নই ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।