আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গ্রাম্য মধ্যবিত্তের ঈদ-উল-ফিতর

শান্তির জন্য সংগ্রামী বেশ ক'দিন ধরে ঈদ স্মৃতি রোমন্থন করার চেষ্টা করছি। হঠাৎ স্বিদ্ধান্ত বদলিয়ে শুধু ঈদ-উল-ফিতরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবো ঠিক করলাম। লেখার শুরুতেই সবাইকে ঈদ-উল-ফিতরের শুভেচ্ছা। ঈদ মুবারক। এখানে বলে রাখি লেখাটি একহাজার শব্দের মধ্যে আটকে রাখার প্রানান্তকর ইচ্ছা সত্বেও পারিনি।

আসলে যেকোন স্মৃতি কথাই ব্যক্তির নিজের ঘটনা সমুহের পরম্পরতায় পরিবার, সমাজ ও উল্লিখিত সময়ের রাষ্ট্র ব্যবস্থারও সংকেত আপনা আপনিই লেখার ভিতরে স্থান করে নেয়। এক্ষেত্রে লেখকের দায় খুবই সামান্য বরং সেগুলোকে এড়িয়ে যাওয়াই হতো লেখকের তথ্যগোপনের মতো অপরাধ এবং হীনমন্যতা। সেজন্য লেখাটির পরিসর বড় হওয়ায় আমি ক্ষমাপ্রার্থী। সেই জন্মের পর থেকে মেট্রিক পাশ করা নাগাদ একটানা গ্রামে কাটিয়েছি। এখনও মনে পড়ে আমার ছোটবেলার ঈদ ইংরেজি বর্ষের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর এই সময়গুলোতেই হয়েছে এবং সেইসব কথাই বেশি মনে পড়ছে।

রোযা'র ঈদকে আমরা বলতাম ছোট ঈদ আর কোরবানি'র ঈদকে বড় ঈদ। সে সময়ে ঈদের আনন্দ মুলত স্কুল বন্ধ হওয়াতেই শুরু হতো। কিন্তু মনে প্রাণে চাইতাম ঈদ যেন না আসে! ঈদ হয়ে গেলেই তো স্কুল খোলা। তাছাড়া স্কুল থেকে দেওয়া বাড়ির কাজ তথা হোম টাস্ক(এই শব্দটি তখন জানতাম না) শেষ করার ঝামেলাটাও কম কথা নয়! এখন নাকি স্কুল অর্ধেক রোযা'র পর থেকে বন্ধ দেওয়া হয়। আমাদের সময়ে রোযা শুরু হওয়ার প্রথম দিন থেকেই বন্ধ।

চাঁদের হিসাবে গড়মিলে একদিন আগেও হয়ে যেতো কখনো। তবে খোলার দিনটি নির্ধারিতই থাকতো। আসল সমস্যাটা হতো স্কুল বন্ধ হতেই বাড়তি টিউটরের কাছে পড়ার ব্যাপারটা। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, গত শতকের আশির ও নব্বইয়ের দশকে আমাদের দেশে প্রাইভেট পড়া ও পড়ানো দুটোই প্রাতিষ্ঠানিক রুপ পায়। কাজেই নৈতিক কারনে কেউ তাদের ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট টিউটরের নিকট পড়ায়নি এমনটি খোদ শহুরে শিক্ষিত সকল শ্রেণীতেই পাওয়া দুষ্কর! আর গ্রামে যারা পড়তো না বা পড়ায়নি সেটা আর্থিক সংকটজনিত ব্যাপার।

মোটামুটি আর্থিক সঙ্গতি সম্পন্নদের ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট না পড়িয়ে এতোটুকু রিস্ক নেওয়ার সুযোগ নেই। সম্ভবত এখনো অনেকেই মুখে বললেও কাজের বেলায় ঠনঠন! সরাসরি টিউটর না রাখলেও সন্তানদেরকে বাবা অথবা মা যেকেউ বাসায় পাঠদান অবশ্যই করেন। যাহোক, আসল কথায় ফিরে আসি। আমাদের ভাইবোনদের বেলায়ও এমন ঘটেছে প্রাইভেট টিউটরের নিকট পড়তে হয়েছে। রোযা'র মধ্যে স্কুল বন্ধ কাজেই সময় অফুরন্ত।

পড়ালেখায় না বসলে নিশ্চিত ঘুরাঘুরি করে বখে যাবে! কাজেই চাপাও একজন বাড়তি মাষ্টার! তাতে কী! এপাড়া ওপাড়া এই মাঠে ওই মাঠে এই খেলা সেই খেলা ঠিকই হতো। তবে ঘরে বসে ক্যারম, দাবা ও লুডু খেলাই বেশি হতো। এটাতে বাঁধা দেওয়ার কিছু ছিলনা। কারন একেবারে পারিবারিক পরিবেশে ভাইবোনেরা খেলতাম। উপরন্তু বেশি পড়েছি একথা বলে একটু বাড়তি সহানুভুতিও আদায় করতাম।

ঈদের নির্দিষ্ট দিন যতই ঘনিয়ে আসতো ততই আব্বা-আম্মার মন মজিয়ে চলার চেষ্টা করতাম বেশি বেশি। ভাইবোনদের মধ্যে রীতিমত প্রতিযোগিতা শুরু হতো কে আবা-আম্মার ফুট-ফরমায়েশ বেশি খেটে বেশি কাছে যাবে! এই কারণটা সবাই জানতাম কিন্তু কেউই স্বীকার করতো না। আব্বা-আম্মা ঠিকই বুঝতো! আমিতো প্রায় ৬ষ্ঠ শ্রেনীতে পড়া পর্যন্ত আব্বা-আম্মার সঙ্গে ঘুমিয়েছি। এখনো এক ধরনের কুসংস্কার থেকে গায়ের রঙ দেখে সুন্দর নির্ধারণ করা হয়। এটিই বোধকরি আব্বা-আম্মার কাছাকাছি বেশি থাকার পক্ষে আমার ক্ষেত্রে অন্যতম কারন।

আমি ছাড়া ছয় ভাইবোনের সবাই সাদা চামড়ার হওয়াতে আমার একটু অভিমান ছিল। বিশেষ করে, ভাইবোনদের মধ্যে কারো সঙ্গে ঝগড়া লাগলে এই প্রসঙ্গটা বেশি খচখচ করতো। আমিও এজন্য আব্বা-আম্মাকেই না বুঝে দোষারুপ করতাম! আব্বা-আম্মা সেজন্য বাড়তি সুবিধা হিসেবে তাদের সঙ্গে ঘুমানোর সুযোগ দিয়ে উনারাও হয়ত একধরনের আত্মপ্রসাদ লাভ করতেন। তো তাদের সঙ্গে রাতে ঘুমানোর কারনেই ঈদে কাকে কী কিনে দিবেন আমি আগেই জেনে ফেলতাম। অবশ্য ছোটভাইও আমাদের সঙ্গেই ঘুমাতো।

কিন্তু সে অনেক ছোট থাকায় এসব বুঝতোও না তাছাড়া ঘুমিয়েও পড়তো আগে আগে। আব্বা-আম্মার আলোচনায় আমিও যোগ দিতাম প্রায়শই। আব্বা-আম্মা যখন আমার শিশুমনের অনুভুতি বুঝে এটা সেটা জিজ্ঞাসা করতো নিজেকে তখন ভাইবোনদের মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হতো। সব ভাইবোনের বিষয়টা আমি আগেই জানতাম এটা আবার অন্যদের ঈর্ষার কারন হলেও কারো কিছুই করার ছিলনা। উপরন্তু তারা আমাকে খবর সংগ্রাহক নিয়োগ করতো আর্থিক লেনাদেনার মাধ্যমে।

তবে তাদের সঙ্গে এই লেনদেনটা মুলত তাদের প্রত্যাশা পুরন হলেই পূর্ণ হতো। মানে তাদের ইচ্ছেমতো কাপড়-চোপড় হাতে পাওয়ার পরেই আমার পাওনা দিতো। আমিই আব্বা-আম্মাকে অনেকসময় সকলের ইচ্ছের কথাগুলো জানাতাম। আব্বা-আম্মা সায় দিলে তো কথাই নেই। সকাল হতেই প্রত্যেককে খবরটা প্রচার না করে শান্তিই আসতো না মনে।

আব্বা সাধারনত ঈদের কেনাকাটা করতে যেতো ঈদের আগের ঠিক শুক্রবারে। কারন এই শুক্রবারেই আমাদের পার্শ্ববর্তী উপজেলা সদরের হাঁটবার ছিল। সেই শুক্রবারের দিনের বিষয়টা ছিল খুবই আনন্দের। টানটান উত্তেজনা সবার মধ্যেই। অন্য কোন শুক্রবারে আব্বা সেই বাজারে গেলে মুলত শিক্ষা বিষয়ক উপকরনই ভাইবোনদের কারো না কারো থাকতো।

কিন্তু ঈদের আগের শুক্রবার ভিন্ন তাৎপর্যতা নিয়ে হাজির হতো। এখন গ্রামগঞ্জের বাচ্চা ছেলেমেয়েরাও দোকানে গিয়ে নিজের পছন্দে জিনিস পত্র কিনে। আমার ছোটবেলায় সেটা ভাবতেই পারতাম না। তাছাড়া আমাদের ভাইবোনদের কারো এত সাহসই ছিলনা যে, বাজারে/দোকানে যেতে চাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করবে। এটার অন্যতম প্রধান কারন ছিল যাতায়াত ব্যবস্থা।

বাড়ি থেকে একেবারে খাঁটি লাল এঁটেল মাটির কাঁচা রাস্তায় প্রায় ছয় কিলোমিটার রিক্সা/হেটে বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে তারপরেই বাসে চড়ে পাঁচ/দশ/তিরিশ কিলোমিটারের দুরত্বে উপজেলা ও জেলা শহরে যেতে হতো। এখন অবশ্য সেই কাঁচা রাস্তা পিচঢালা পাকা সড়ক, বাস/টেম্পু নিয়মিত চলাচল করে। কিন্তু আমাদের ছয় ভাইবোনের পাঁচ জনই বাইরে থাকি। তিন বোনের বিয়ে হয়েছে তারা স্বামী সংসার করছে। আমি ও ছোট ভাই ঢাকা ও আমাদের জেলা শহরে থাকি।

যাইহোক, ঈদুল ফিতরের আগে ও পরের সময়গুলো মুলত কৃষ্ণপক্ষের রজনী হওয়াতে তখন আবহাওয়া ভালো থাকলে আমরা সবাই রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে উঠোনে খেজুর পাতার পাটি বিছিয়ে গল্প করতে বসতাম। পাশে হারিকেন ও কয়েল জালিয়ে রেখে। তবে বলা প্রয়োজন যে, সেই শুক্রবার ঈদের ছয় দিন আগে থেকে আগের দিন এমন যেকোন তারিখেই এখনকার মতো চাঁদের হিসেবে পরিবর্তিত হতো। সেজন্য ঈদের বেশি দূরবর্তী শুক্রবার হলে গল্প করতে বসে সবাই উসখুস করলেও কেউই উঠে যেতো না। ছোট ভাই আগের মতোই ঘুমিয়ে পড়তো।

আমরা তিন বোন, আমি ও আম্মাই ছিলাম এই সময়ের গল্প সারথী। বড় ভাই এসব বিষয়ে এখনকার মতো আগেও বরাবরই উদাসীন বা এড়িয়ে চলতো। তবে সে ও কখনো সখনো যোগ দিতো। সবচেয়ে মজা হতো সেই শুক্রবার যদি ঈদের আগেরদিন বা নিদেন পক্ষে এক দিন আগে হতো। তাহলে আমার আপারা গাছ থেকে মেহেদী পাতা পেড়ে শিল-পাটাতে বাটতো।

আমাদের সেই মেহেদী গাছটি অনেক বড় ছিল। রীতিমতো গাছে উঠে পাতা পাড়তে হতো এবং যথারীতি আপাদের সঙ্গে ঝগড়ার সম্পর্ক না থাকলে আমিই গাছে উঠে পাতা পেড়ে দিতাম। সে জন্য বাড়তি হিসেবে আমার দুই হাতেই মেহেদী লাগানোর সুযোগ পেতাম। তবে আমাদের দাদু বাম হাতে, পায়ে ইত্যাদি স্থানে মেহেদী লাগাতে নিষেধ করলেও যার যেখানে খুশি লাগিয়ে ঠিকই দাদুকে দেখাতাম। দাদু তখন সুন্দর হয়েছে বলে খুব তারিফ করতো।

দাদুও দাড়িতে লাগাতো খুব আয়েশ করে। দুঃখের বিষয় সেই গাছটি এখন আর বেঁচে নেই। অথচ আমাদের সেই গাছটি বিশাল জনগোষ্ঠীর একটি গ্রামের সকল ঈদ, বিয়ে, পুজায় একমাত্র ভরসা ছিল। এখন তো কত নামের বাহারি টিউবে মেহেদী পাওয়া যায়। তখন গ্রামে কিনে মেহেদী লাগানোর বিষয়টি ভাবাই যেত না।

মাঝখানে অনেক দিন আপাদের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরেও সেই গাছ শুধুই প্রতিবেশির সেবা দিয়ে গেছে। কারন তখন আমাদের বাড়িতে মেহেদী লাগানোর কেউই ছিলনা। এখন মেহেদী পাগল আমার ছোট ভাতিজি মেহেদি পাতার জন্য কত আবদার করে অথবা নতুন রোপিত কোন বাড়ি থেকে আনিয়ে দিতে হয়। তারপরে সে নিজে তার ছোট শিল-পাটা দিয়ে বেঁটে নিজের ইচ্ছেমতো লাগাবে। আমাকে কয়েকদিন আগেই ফোনে বলেছে, কাকা ঢাকা থেকে আমার জন্য মেহেদী গাছের চারা নিয়ে আসবা।

শুনে আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল। হায়রে আমাদের গাছের পাতায় কত বঁধু হাত রাঙিয়েছে, কত সৌখিন বৃদ্ধ তাঁদের দাঁড়ির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে আর কত তরুনী সেজেছে মনের মাধুরী মিশিয়ে। এখন আমার ভাতিজি'র গাছ লাগিয়ে তারপরে সেই গাছ বড় হবে এবং তারপরে তার স্বাধ মিটিয়ে মেহেদী দেওয়ার শখ পুরন করতে হবে! আমার আম্মা তার নাতনীর বাসনা শুনে শুধুই কাঁধে। কী আর করা! আসলে ছোট বেলার কথাগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা উপরন্তু এখনকার বাস্তবতার সঙ্গে তুলনা করলে লেখার পরিধি বাড়তেই থাকবে। আজ বরং ঈদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকার চেষ্টা করবো।

আমি মেট্রিক পাশ করে শহরে ইন্টারমিডিয়েট পড়তে গিয়েই প্রথম বুঝেছি শহুরে ভদ্দরনোকের ঈদের কেনাকাটা রোযা আসার প্রারম্ভেই উদ্ধোধন হয়ে যায়! অবশ্য তেনারা সারা বছরই কেনাকাটা করে থাকেন। কিন্তু গ্রামের মানুষেরা আমাদের সময়ে বছরের একবার কাপড় কিনতো বাধ্যতামুলকভাবে। বাকী সময়ে নিতান্তই প্রয়োজনে কেনা হতো। গ্রামের একটু স্বচ্ছল পরিবারে অবশ্য ভিন্ন নিয়ম। তখন ঈদ যদি ফসল উঠানোর অব্যবহিত পরেই হতো তাহলে আব্বা-আম্মার মন খুব ভালো থাকতো।

কারন এই ফসল বিক্রি করেই ঈদের কেনাকাটা করতে হতো যে! আর যদি ফসল উঠেনি বা বন্যা, খরায় ফসল নষ্ট হয়ে যেতো এমন দিনের ঈদের কথা ভাবলেই গা শিউরে উঠে। যখন এমন সংকটাপন্ন অবস্থা হয়েছে আব্বা তখন দিশেহারা হয়ে যেতো। আম্মা আমাদের সব ভাইবোনদের কঠোর শাসনের মধ্যে রেখে বুঝাতো এই ঈদে কোনকিছু আবদার করা যাবেনা। হয়ত গোপনে চোখের জল ঠিকই ফেলতো। আমরা মোটামুটি একটা মানসিক স্বিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতাম।

এবার কিছুই কেনা হবেনা। কিন্তু এরমধ্যেই কখনো কখনো আম্মা কোথা থেকে কিভাবে টাকা জোগাড় করে আব্বাকে দিতেন। তখন হয়ত খুব প্রয়োজনীয়টুকু আমাদের কিনে দিতেন। তখন সেটুকুতেই অনেক বেশি খুশি লাগতো। গ্রামে সাধারনত এলিট বা স্বচ্ছল বলতে তারাই তখনো এবং এখনো যারা প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা বা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে।

সেজন্য শিক্ষক পরিবারের ফসলের সঙ্গে তেমন সম্পর্ক নেই। আমাদের ছোটবেলার বন্ধুদের মধ্যে যারা শিক্ষক/চাকুরীজিবির সন্তান তারা ঠিকই সবকিছু পেয়ে যেতো। আমরা এসব দেখে অনেক মন খারাপ করলেও আব্বা-আম্মার আসলেই কিছু করার থাকতো না। আমার কৃষক আব্বার একমাত্র ভরসা ফসল। সেটাও যদি উত্তোলন না হয় বা প্রাকৃতিক কারনে নষ্ট হয়ে যেতো তাহলে কী করার আছে! তারপরেও আব্বা-আম্মার প্রানান্তকর চেষ্টার কমতি থাকতো না।

আমার আব্বা বরাবরই রাশভারী মানুষ। কারো কাছ থেকে ধার করা কোনদিনই পছন্দ করেন না। আমাদের যৌথ পরিবার তখনো এবং এখনো। আমার দুই চাচা তখনই শহুরে মধ্যবিত্তে পরিনত হলেও বাড়ির সকল কিছু আমরাই ভোগ করতাম তথা দেখাশুনা বেচাকেনা এগুলো আব্বার নিয়ন্ত্রনেই এখনো। উনারা কখনোই কিছু নেন না।

স্বাভাবিকভাবে সেই সীমিত সম্পত্তির ফসলই অনেক হলেও যখন ফসল নষ্ট হয়ে যেতো তখনকার অবস্থা বলে বুঝানো যাবেনা। যাহোক, চাচারা হয়ত আঁচ করতে পারতো। কিন্তু যোগাযোগ মাধ্যম অত সহজ ছিলনা। উনারা এতদুরে দূরে থাকতেন যে, চিঠিই একমাত্র ভরসা। দাদু তখন তার ছেলেদের সঙ্গে চিঠি আদান-প্রদান করতেন।

অবশ্য সকল সময়ে যোগাযোগ দাদুই করতেন। আমাদের দাদী আমরা ভাইবোনেরা তো বটেই আমার ছোট চাচার জন্মের ১১দিনের মাথায় দাদী এক্লামশিয়ায় মারা যান। তারপরে মাত্র ১৩ বছর বয়সে আম্মার বিয়ে হওয়ার পর থেকে আম্মা শুধু আমাদেরই জন্মদায়িনী জননী নন। চাচাদেরও কাছেও মাতৃত্বের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছেন। চাচারা তখন নিঃশঙ্ক চিত্তে সহায়তা করতেন।

কিন্তু আব্বা এটা পছন্দ করতেন না। তখন আমাদের বৃদ্ধ দাদু(দাদাকে আমরা দাদু ডাকতাম) সংসারের ঘাটতি পুরনে সক্রিয় হতেন। দাদুকেও দেখেছি আমাদের চাচাদের কাছ থেকে এই আর্থিক সহায়তা নেওয়ার ব্যাপারে তিনিও আব্বাকে ভয় পেতেন। দাদু শুধু আম্মার সঙ্গে পরামর্শ করে আর্থিক সংকট মোকাবেলায় ব্যবস্থা নিতেন। এমনো দেখেছি, দাদু বা আম্মা টাকার ব্যবস্থা করে আব্বাকে কেনাকাটা করতে বলেছেন কিন্তু আব্বা প্রত্যাখান করেছেন।

এমনিতে দাদু সবসময় আব্বাকে(উনার বড় ছেলে) সংসারের অভিভাবক মনে করলেও এবং আমরাও জানতাম আব্বাই এই সংসারে শেষ কথা। কিন্তু সকলের দেখা সত্যকে দাদু এক ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিয়ে তার ছেলের উপর পিতার হুকুম জারি করতেন। সেই বৃদ্ধ বয়সে দাদুর এমন রোদ্রমূর্তি ধারন আমাদের অবাক করলেও মনে মনে খুব খুশি হতাম। কারন তাতে যে আমাদের জন্য কেনাকাটা করার বিষয়টি জড়িত! দাদু সেই পঞ্চাশের দশক থেকেই নিয়মিত পত্রিকা পড়তেন। ইত্তেফাক, সংবাদ এগুলো।

আশির দশকেও দেখেছি আজকের পত্রিকা একদিন, দুইদিন বা তিনিদিন পরে পাওয়া যেত। পত্রিকা বাসী হলেও দাদু খুব মনযোগ দিয়ে পড়তেন। আমাদের ভালো লাগবে এরকম নিউজ দাদু পড়ে শোনাতেন। বাকী সময়ে আমরা নিজেরাই পড়তাম। মনে আছে তখনো পত্রিকাগুলোতে ঈদ ফ্যাশন অতটা বিজ্ঞাপিত বা সংবাদ আকারে প্রকাশ হতোনা।

তবে টুকিটাকি তো হতোই। আমরা সেটুকু দেখেই পুলকিত হতাম। ঈদের আগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ বিটিভিতে ঈদ অনুষ্ঠান সুচী। এই পাতাটি আলাদা করে যত্ন করে রাখতাম। বলতে ভুলেই গেছি, আমাদের দাদু ব্রিটিশ আমল থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে ১৯৭৫সালে অবসরে গিয়েছিলেন এবং ১৯৯৬সালে শত বর্ষের কাছাকাছি বয়সে পরলোকগত হন।

যাহোক দাদু তখন পত্রিকা পড়তেন আর আমাদের বলতেন, তোরা মন খারাপ করিস না। তোদের আব্বাকে কষ্ট দিস না। আমি সব ব্যবস্থা করবো। এই যে দেখ পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে কত মানুষ অভাবের তাড়নায় ঈদ কী জিনিস জানেইনা। তাদের চেয়ে তো তোরা অনেক ভালো আছিস।

আসলে দাদু আমাদের শিখিয়েছেন, উপরে তাকিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখা হলেও সুখ খুঁজার জন্য সবসময় নিচের দিকেই তাকাতে হয়। তখন এমন বাস্তবতায় আমরা এমনিতেই চুপ হয়ে থাকতাম। এমন ভাব করতাম যেন কারো কিছুই লাগবে না। এরকম টানাপড়েনের সময়ে ঈদ ঘনিয়ে আসার একেবারে শেষদিকে দাদু জিজ্ঞাসা করতেন কার কী লাগবে? আমরা সবাই একজন আরেকজনকে দেখিয়ে বলতাম, আমার কিছু লাগবে না, একজন আরেকজনকে দেখিয়ে বলতাম তাকে কিনে দাও। এরকম অবস্থায় আমাদের কথা শুনে দাদু লিস্ট করে আব্বাকে ধরিয়ে দিতেন।

অন্যদিকে সংসারের অন্যান্য যাবতীয় কেনাকাটার কথা আম্মার কাছ থেকে শুনে দাদু সেটারও লিস্ট করতেন। অন্যান্য স্বাভাবিক সময়ে আমরা সবাই যার যার ইচ্ছের কথা লিখে দাদুকে দিতাম। আত্মীয়, প্রতিবেশি বা আরো কিভাবে কি কাকে দিতে হবে সেগুলোও দাদুই নির্ধারণ করতো। দাদু সেগুলোকে একত্রে করে আব্বা ও আম্মার সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করে তবেই আব্বাকে কেনাকাটা করতে যেতে বলতেন। এর মধ্যেই আমাদের বাড়িতে যে কাজ করতো(বলা হয়ে থাকে বছরী কামলা, শুদ্ধ বাংলাটা বলতে না পারায় ক্ষমাপ্রার্থী) তাকে ডেকে নিয়ে তার প্রয়োজন জেনে নিতো।

আমার ছোটবেলায় বা তারও আগে যারাই এই কাজে আমাদের বাড়িতে ছিল তাদের সবাই দীর্ঘদিন ধরে নিয়োজিত ছিল। সবাই বড় হয়ে বিয়ে করে অথবা আব্বাই তাদেরকে বিয়ে করিয়ে দিয়েছে কোথাও এবং তারপরেই তারা বছর ভিত্তিক কাজে ইস্তফা দিয়েছে। তারপরেই শুরু হয় আমাদের অপেক্ষার প্রহর গুনা। আব্বা যতক্ষন না ফিরে ততক্ষন জেগে অপেক্ষা। আব্বা বাজারে যাওয়ার ১/২দিনের মধ্যেই ঈদ হলে আপারা ব্যস্ত থাকতো মেহেদী লাগাতে।

আম্মা ব্যস্ত থাকতো এটা সেটা কাটাকাটি বাঁটাবাঁটিতে। শহুরে ভদ্রলোকেরা ঈদের আগের রাতেই মিষ্টান্ন রান্না করে রাখলেও গ্রামে সেটা তখন কল্পনাও করা যেত না। উপরন্তু তখন বিদ্যুৎ ছিলনা। অবশ্য এখন বিদ্যুৎ থাকলেও রান্নাবান্নার আয়োজনে আগের ধারাবাহিকতাই আম্মা চালু রেখেছেন। আমরা তখন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেই খেয়েদেয়ে পাতিল নিয়ে বাড়ির আশেপাশেই বিভিন্ন স্থানে ছুটতাম মাংস আনতে।

অনেকেই হয়ত জানবেন যে, তখনো এবং এখনো অনেক গ্রামেই ঈদের আগে মাংস কেনার ব্যবস্থা নাই। ঈদের দিন সকালেই পাড়ায় গরু খাসি জবাই করে পাড়ার লোকজন যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী কিনে নিতো। সেখানেও ক্ষেত্রবিশেষে নগদ ও বাকীর প্রচলন ছিল। হয়ত ঈদের আগের সন্ধ্যায়ই যারা এই জবাই কর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে জেনে আসতো কোন পরিবার কতটুকু মাংস নিবে। সেই অনুযায়ী লিস্ট করে ফেলতো।

আম্মা সাধারনত আমাকে ও আমাদের দীর্ঘদিনের কাজের মানুষটিকে পাঠাতো। তাড়াহুড়ো করে মাংস নিয়ে এসেই পুকুরে ছুটতাম সাঁতার কেটে গোসল করতে। পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে সাঁতার শেষের আগেই দাদুর বকাবকিতে উঠে আসতে হতো। আরেক দফা মিষ্টান্ন গলাধঃকরণ করেই ঈদের নামাজে যাওয়ার প্রস্তুতি। আমদের কারোরই কাউকে পা ছুঁয়ে ছালাম করার অভ্যাস ছিলনা।

বিশেষ করে দাদু এটা পছন্দ করতো না বলেই হয়ত এভাবে শিখেছি। তাই কাউকে ছালাম না করলেও দাদু ও আব্বা খুব অল্প টাকা(বেশি হলে পাঁচ টাকা) বকশিস দিতেন। অবশ্য চাচারা ঈদ পালনে বাড়িতে আসলে এটার পাল্লা অনেক বৃদ্ধি পেতো। দাদুর সঙ্গে নামাজে যাওয়া শুরু করতেই দাদু মজা করে বলতো, বেশভুষা ঠিক থাকলেই হবে না রে, এই ঈদ শুধু রোযাদারদের জন্য। তুইতো রোযা রাখস নাই তোর নামাজ পড়লেই কী আর না পড়লেই কী! আমি কিঞ্চিৎ অভিমানে ঘোষণা দিতাম, তোমার সঙ্গে যাব না।

আমি একাই যাব। নাইলে যাইতামই নাহ। এমন কথা বলতে বলতেই দেখতাম দাদু তার মাথা বাকানো হাতের লাঠি দিয়ে আমার গলায় আটকে ধরে আম্মাকে ডাকতেন। বউ এইডা দেখি খুব পেকেছে। তারে কিছুই কওয়া যায়না।

আম্মা ভাবতেন আমি বোধহয় কোন অন্যায় করেছি। আম্মা তখন হাতে যা থাকতো লাঠি, চামচ, উলটানি কাঠি, ঝাড়ু, জালানি খড়ি ইত্যাদি সেটা নিয়ে দৌড়ে আসতো। দাদু আম্মাকে এই অবস্থায় দেখে আবার উল্টা আম্মাকে মৃদু মধুর ধমক দিতেন। আমাদের দাদা-নাতির কান্ড দেখে আম্মা বোকা বনে গিয়ে রান্না ঘরে ঢুকতেন। আমরা নামাজ থেকে এসেই প্রথমে পারিবারিক গোরস্থানে কবর জিয়ারত করে বাড়িতে এসেই খাওয়া দাওয়া সেরে টিভি’র অনুষ্ঠান সূচিটা পকেটে নিয়ে দুরের ক্লাবে যেতাম টিভি দেখতে।

অথবা পাড়ায় পাড়ায় বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত হাডুডু, দারিয়াবান্দা, গোল্লাছুট ইত্যাদি খেলায় কখনো নিজেও অংশ নিতাম এবং দেখে উপভোগ করতাম। ফুটবলের মতো বড় আয়োজনের খেলা সাধারনত ঈদের পরদিন গ্রামের বড় মাঠে অনুষ্ঠিত হতো। খেলোয়ারদের বিভাজন করা হতো বিবাহিত পক্ষ ও অবিবাহিত পক্ষ। তখন এবং এখনো একই পক্ষেই আছি!!! এভাবেই ইদ-উল-ফিতরের দিনের সমাপ্তি ঘটার মধ্য দিয়ে আগের সেই স্বাভাবিক নিয়মের মধ্যে নাধ্যগত বলিদানের শুরু হয়। এসবের মধ্যেই কখনো কখনো আমরা ভাইবোনেরা শহুরে বা ধনাট্য আত্মীয়দের বেড়াতে আসার হিড়িকে খুবই হীনমন্যতায় ভুগেছি।

আমার এখনো এগুলো স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠে। তবে আমাদের আব্বার মধ্যে বিত্তকে এক ধরনের উদাসীনতার মাধ্যমে উপেক্ষা করার মানসিকতা আমাদেরকে খুব দ্রুতই প্রভাবিত করেছে। যা আমাদের ছয়ভাইবোনের মধ্যেই তীব্রভাবে এখন বিদ্যমান। একারনেই বোধকরি এখনো মাঝেমাঝে খুব সংকটাপন্ন অবস্থাতেও বেঁচে থাকার সাহস পাই। তবে সকল সুবিধা বা অসুবিধার মধ্যেও আমাদের ঈদ আনন্দে বাড়তি আনন্দ যোগ হতো যখন দুই চাচাই পরিবারসহ বাড়িতে ঈদ পালন করতে আসতেন।

অবশ্য সেটা প্রতি ঈদে হতো না। তাদেরও অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেই বাড়িতে যেতে হতো। কুরবানির ঈদ বা ঈদ উল আযহা নিয়ে আশাকরি পচাত্তর দিন পরেই আরেকটি লেখা লিখতে পারবো। ইনশাল্লাহ। আমার এখনো বিশ্বাস হয় যে, আমাদের দেশের অনেক গ্রামে এখনো আমার ছোটবেলার মতোই অবস্থা।

কৃষি নির্ভর অনেক পরিবারেই এই সংকটগুলো বিদ্যমান। হয়ত একটি পরিবার শিক্ষালাভের মধ্য দিয়ে ক্রমশ শহুরে মধ্যবিত্তে পরিনত হওয়ার প্রানান্তকর চেষ্টা করছে অপরদিকে আগের সেই শুন্যস্থান ঠিকই নিম্নবিত্তের কেউ পুরন করছে। উল্টোটাও হয় কখনো কখনো। সন্তানদের কষ্ট করে জমিজমা বিক্রি করে পড়িয়েও ঘুষ দিয়ে চাকুরী গ্রহন করতে গিয়ে ভুমিহীনে পরিনত হতে হয়, যার হারানো সহায়সম্পত্তি অর্জন করতে সারাজীবন শেষ হয়ে যায়। হয়ত এর মধ্যে দেখা যায় বাবা-মা দুনিয়া চেড়ে চলেও যায়! নয়ত দেশে কিছু করতে না পেরে বিদেশে যায়।

অথবা বিদেশে যেতে চেয়ে জমি বিক্রি করে যে টাকাটা দালালকে দেয় হয়ত পুরোটাই ধ্বংসে পরিনত হয়। এভাবেই সমাজের উত্থানপতন নির্ধারিত হচ্ছে। যেকোন শ্রেণীর মুসলমান পরিবারে অর্থনৈতিক সঙ্গতির সঙ্গে আনন্দেরও তারতম্য ঘটে। অনেকেই যেমন বলে থাকেন, অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কালের মধ্যে বর্তমান মুলত কোন কালই নয়। কাজের সুচক নির্ধারক মাত্র।

তেমনি মানুষের শ্রেণীর মধ্যে মধ্যবিত্ত কোন অবস্থানই নয়। যদিও বলা হয়ে থাকে এটি বরাবরই একটি সুবিধাবাদী অবস্থান। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে এটাও এখন দীর্ঘস্থায়ী অবস্থানে পরিনত হয়েছে এবং সুবিধার চেয়ে অসুবিধা ঢের বেশি। যারফলে মানুষ একূল ওকূল কোন কূলেই ভিড়তে না পেরে মাঝ সমুদ্রে সাঁতার কাটছে অবিরত। তবু মানুষ আশায় বুক বাঁধে দিন বদলাবে।

কবি আবুল হাসান লিখেছেন, কিছুটা বদলাতে হবে বাঁশী কিছুটা বদলাতে হবে সুর সাতটি ছিদ্রের সূর্য, সময়ের গাঢ় অন্তঃপুর কিছুটা বদলাতে হবে মাটির কনুই, ভাঁজ রক্তমাখা দুঃখের সমাজ কিছুটা বদলাতে হবে...” প্রতিটি ঈদের নামাজে মানুষের এই হোক প্রত্যাশা। সবাইকে ঈদ মুবারক। রমজানের ওই রোযা শেষে এলো খুশির ঈদ... ... ... ... ঈদ মুবারক! ঈদ মুবারক! ঈদ মুবারক! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.