যে মুখ নিয়ত পালায়......। ।
একটা রিকশার পিছনে কয়েকটা ছবি দেখে একদিন অবাক হলাম। ভয়ংকর সুন্দর কিছু ছবি। সস্তাদরের লাল কাল হলুদ রঙ ব্যবহার করে আঁকা।
তবে এমনভাবে আঁকা হয়েছে যেন মনে হচ্ছে জীবন্ত। এখনি বেরিয়ে আসবে।
আমার রিকশাটাকে দ্রুত এগুতে বলে সামনের রিকশাটাকে ধরলাম। সামনের রিকশাটা থেমেছে। রিকশাচালক লোক নামানোর পর তাকে জিজ্ঞেস করলাম পিছনের ছবিটা কে এঁকেছে।
সে ই আমাকে গ্যারেজের ঠিকানাটা দিল।
ঐদিন বাসায় ফিরে এলাম। গ্যারেজটা কিছু দূরে। আর মনে হচ্ছে গ্যারেজে গেলেই শিল্পী সাহেবকে পাওয়া যাবে না। হাটতে হবে।
তাই সময় নিয়ে যাওয়া দরকার।
শুক্রবার ছুটির দিন গ্যারেজের উদ্দেশ্যে বের হলাম। গ্যারেজে পৌছে অনেক চেষ্টা চরিত্র করে একটা ছোট গলির ভেতরে গিয়ে শিল্পী র খোঁজ পেলাম। ভদ্রলোক মধ্যবয়স্ক। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি।
পান খাচ্ছেন। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। পড়নে হাতকাটা গেঞ্জি আর লুঙি।
তার ঘরটাও ছোট।
বোঝা যাচ্ছে এখানেই তিনি আঁকেন। সমস্ত ঘরজুড়ে আঁকার জিনিস পত্র ছড়ানো ছিটানো।
আমি নাম জিজ্ঞেশ করতেই তিনি বললেন, আমার নাম তোরাব আলী। হে হে হে।
আপনি কি আকাঁ আঁকি ই করেন?
-জি জনাব।
আঁকাআঁকি করি। কাটাকুটি খেলি। দুনিয়া কাটাকুটি খেলার জায়গা। হে হে হে।
তোরাব আলীর হাতে তুলি ছিল।
তিনি রঙে চুবিয়ে তা দিয়ে সামনের কাগজে একটা ক্রসের মত দিলেন। প্রথম টান দেয়ার সময় বললেন কাটা দ্বিতীয় টানের সময় কুটি। তিনি বোধহয় কাটাকুটি জিনিশটা পরিস্কার করলেন আমার কাছে।
আমি সপ্রসংশ চোখে বললাম, আপনার আঁকা ছবিগুলো অসাধারন। সেদিন রিকশার পিছনে একটা দেখেছি।
আমি পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত ছবি দেখেছি। কিন্তু আপনার গুলো আসলেই ব্যতিক্রম।
তোরাব আলী আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। মুখের বা দিকে ডান হাতের আঙুল দিয়ে টেলে মুখ পাশ থেকে সুপারির গুড়াগুলো সরাতে সরাতে বললেন, আমি হইতেছি শিল্পী। ক্রিয়েটর।
অন্য যাদের আপনেরা শিল্পী বলেন ওরা নকলবাজ। অন্যের সৃষ্টি নকল করে।
আমি খানিকটা কৌতুকবোধ করলাম তার বলার ভঙ্গি দেখে। যেন তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছেন সবাইকে। তাকে জিজ্ঞেশ করলাম, মানে কি? আপনি কি বলতে চান পৃথিবীর বড় শিল্পীরা শিল্পী না?
তোরাব আলী আগের মতই বললেন, যারা অন্যের সৃষ্টি নকল করে হেরা শিল্পী না।
তারা হইল গিয়া মুখস্ত করা ছাত্রের মত। আমার আঁকা গুলো দেখেন। কোন নকল নাই। সব আমার সৃষ্টি। আমি কারো সৃষ্টির ছবি আঁকি না।
আমি তোরাব আলীর ছবিগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখলাম। ছবিগুলোর সাথে পৃথিবীর কোন প্রানী বা মানুষের কোন মিল নেই। সম্পূর্ন অদ্ভূত ধরনের আঁকা ছবিগুলো। প্রত্যেকটাই মনে হচ্ছে যেন জীবন্ত। এরকম জীবন্ত আর কোন ছবি কখনো মনে হয় নি।
তোরাব আলী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বিচিত্র সুরে হে হে করে হেসে উঠলেন। আমি প্রথম থেকেই লক্ষ্য করছি লোকটা হাসে অদ্ভুত ভাবে। হে হে করে টেনে টেনে।
তোরাব আলী হাসা বন্ধ করে বললেন, আপনি ভাবতেছেন ছবিগুলা ক্যান জীবন্ত লাগতেছে? ঠিক না?
এই প্রথম আমি তোরাব আলীর কথায় ভয় পেলাম। কেন জানি গায়ের রোম কাটা দিয়ে উঠল।
তার চোখদুটি মনে হচ্ছে জ্বলন্ত দুটি গোলক। যা আমার ভিতর পর্যন্ত পড়ে নিচ্ছে অনায়াসে। ভয়ে ভয়ে ইতস্তত করে বললাম, হ্যা। তবে আপনি জানলেন কী করে?
তোরাব আলী হেসে বললেন, ভয় পাইয়েন না। আমার ছবি যে দেখে সেই এমনে ভাবে।
তাই বললাম। আপনি যা ভাবতেছেন তাই। ছবিগুলো আসলেই জীবন্ত।
আতঁকে উঠে বললাম, জীবন্ত মানে?
তোরাব আলী নির্বিকার ভাবে পান চিবুতে চিবুতে বললেন, জীবন্ত মানে জেতা। জিন্দা।
এ কী করে সম্ভব?
তোরাব আলী আগের মতই বলেন, সব ই সম্ভব। আমি নিজে সৃষ্টি করি। তাই আমি জীবন দিতে পারি। আমি নকল করি না।
ঘরময় ছড়ানো কয়েকটা ছবির দিকে চোখ গেল।
দেখলাম সত্যি ই জীবন্ত ছবিগুলো। আস্তে আস্তে নড়ছে। আর সব ছবি ই অদ্ভুত এবং ভয়ংকর। ব্যাপারটা আগে আমার নজরে আসে নি এতটা প্রকটভাবে।
তোরাব আলী আমার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আমি পৃথিবীর একজন সার্থক শিল্পস্রষ্টা কিন্তু আমার কথা কেউ জানল না।
আফসোস!
আমি বললাম, আমি আপনার কথা প্রচার করব। ব্লগে ফেসবুকে পত্রিকায় দিব। তাহলে নিশ্চয়ই জানবে সবাই।
তোরাব আলী আমার দিকে আগের মতই হতাশ চোখে তাকালেন। তিনি এখনো পান চিবুচ্ছেন।
চিবুতে চিবুতে ই বললেন, আমার এই গুণের কথা জেনে কেউ এখান থেকে যাইতে পারে নাই। এইটা হইল কথা। নির্মম কথা। তয় সত্য। নির্মম কথাগুলো সত্য হইলেই ভয়ংকর।
আমার মেরুদন্ড দিয়ে হঠাৎ করেই ভয়ের শীতল স্রোত ভয়ে গেল। তোরাব আলীকে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেশ করলাম, কেন? এখান থেকে যেতে কি অসুবিধা?
তোরাব আলী আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রঙে ডুবানো তুলিটা হাতে নিলেন। সামনের কাগজে ক্রস টেনে বললেন, দুনিয়া কাটাকুটির খেলা ভাই সাহেব। আমি সৃষ্টি করে কাটা দিচ্ছি। কেউ আমাকে গোপন রেখে তার কুটি দিচ্ছেন।
এইতো কাটাকুটিরে ভাই। এইটাই জীবন। তবে আপনে ভাগ্যবান। একজন সার্থক চিত্রশিল্পী দেখলেন। এখন বিদায়।
অনেক দিন নতুন কোন ছবি আঁকি না। আজ আঁকব।
তারপর আর আমার কিছু মনে নেই। এরপর থেকে আমি আর আমার সত্তাকে আলাদাভাবে বুঝতে পারছি না। তবে আমি নিশ্চিত আমি বেঁচে আছি।
আমার সামনেই আছে তোরাব আলীর আঁকা কয়েকটা বিকটদর্শন ছবি। মাঝে মাঝে তোরাব আলীকেও দেখি। তোরাব আলীর কাছে আমার মত একজন দুজন লোককেও আসতে দেখি সপ্তাহে কিংবা মাসে। আমি আমার কানকে অনুভব করতে পারছি না, আমি কিছু শুনতেও পারছি না। তবে তোরাব আলী কাগজে তুলির কাটাকুটি দাগ দিয়ে যখন হে হে করে হাসে তখন তার পান খাওয়া দাত বের করা দেখেই আমি বুঝতে পারি তার হাসি।
এ ও বুঝতে পারি আমি ঝুলে আছি তোরাব আলীর রুমের বা দিকের দেয়ালের কোন অংশে।
ছবি-১-শিল্পী-Paul du Toit
ছবি-২-শিল্পী- Jean-Michel
Basquiat
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।