জীবনটাতে যদি আনডু রিডু অপশন থাকত তাহলে খুবই ভাল হত..কিন্তু দুঃখ এখন আমি মৃত
কি? চমকে গেলেন? ভাবছেন, মৃত এই আমি কিভাবে লিখছি? ভাবছেন আত্মাদের আবার এ্যাকাউন্ট খোলার অপশন চালু করল কবে থেকে?
না, না, সবকিছু ঠিকই আছে। আপনার চারপাশের পৃথিবী ঠিক দাঁড়িয়ে আছে আগের জায়গাতেই। শুধু বদলে গেছে আমার জগত। আমি এখন অন্ধকার এক জগতের বাসিন্দা। কবরের করুণ এক নিঃস্তব্ধতার মাঝে আমি অপেক্ষা করছি কখন আসবে মুনকার-নাকীর।
যখন পৃথিবীতে ছিলাম- ওই তিনটা প্রশ্নোত্তর টোঠস্থ করে ফেলেছিলাম। কিন্তু কি কপাল আমার! এখন যে কিছুই মনে আসছে না।
ভাবছেন, হয়তো ফেল্টু মারকা স্টুডেন্ট ছিলাম। তাই মুখস্থ করে রাখা জিনিসটা ভুলে গেছি। কিন্তু এমনটা তো হবার কথা না।
আমিতো নামকরা এক ভার্সিটির ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র।
এখন লিশ্চয়ই মনে মনে বলা শুরু করেছেন- “ব্যাটা, বকবক বন্ধ করে আগে বল যে, মরণের পর তুই লিখছিস কেমন করে? গুল মারার আর জায়গা পাস না!!”
আসলে আমি একদিন খুব খুব খুবই একটা ভাল কাজ করে ফেলেছিলাম, আর তারই পুরষ্কার স্বরুপ আমার মনের একটা ইচ্ছা পূরণের বর দেয়া হয়। হঠাৎ কি মনে করে বলে বসলাম যে, আমার মৃত্যুর পর আমায় যেন কিছু সময় দেয়া হয় যাতে আমার চারপাশের আপনজন কে কি করছে তা আমি উপলব্ধি করতে পারি, সবার সাথে শেয়ার করতে পারি।
হয়তো আরো ভাল কিছু চাইতে পারতাম। হয়তো সামনে হতে যাওয়া টার্ম পরীক্ষায় সর্বোচ্চ জি.পি.এ. চাইতে পারতাম।
বা আমার ছোটো ভাইটা যাতে এ বছর ঢাকা মেডিকেলে চান্স পায় সেটা নিশ্চিত করে ফেলতে পারতাম। কিন্তু কি মনে করে যেন এই উদ্ভট বরটা চেয়ে বসলাম।
আমার মৃত্যু হয় আজ সকাল দশটায়। আজিমপুর বাসস্ট্যান্ডে জাস্ট রিকশা থেকে নেমে ভাড়া দিচ্ছি আর ওমনি কোত্থেকে যেন একটা মটর বাইক আসে। ওটাকে সাইড দিতে গিয়ে আমি সরে যাই বা’দিকে আর ঠিক তখনি দ্রুত গতিতে আসা মিরপুর রোডের লোকাল বাসটা আমার উপর দিয়ে নির্দয়ভাবে চালিয়ে চলে যায়।
হয়তোবা ড্রাইভার খেয়াল করেনি। ‘কিন্তু তোরা কি আরেকটু সাবধানে চালাতে পারিস না? কিসের এতো তাড়া তোদের? কেনো মেরে ফেললি আমায়? কেনো ভেঙ্গে দিলি আমার ২২ বছর ধরে দেখা স্বপ্ন?’
এরপর আমার রক্তমাখা নিথর দেহ ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করা হয়। আজিমপুর মোড় থেকে ঢাকা মেডিকেল বেশি দূরে না। আমায় নিতে যেতে বেশী দেরী হয় না। নেয়ার সাথেই আমি চলে যাই ইমারজেন্সি ইউনিটে।
আমার ট্রলি নিয়ে ছুটে চলে একঝাক অচেনা মানুষ। আমি তাদের আত্নীয় না, বন্ধুও না, চেনা-পরিচিত কেও না। কিন্তু হায়! বুকভরা ভালোবাসায় নিথর একটা দেহ নিয়ে দৌড়াতে থাকে মহৎপ্রাণ আলোকিতো কিছু মানুষ।
সাথে সাথেই ছুটে আসেন ডিউটিরত ডাক্তার। পালস দেখে, বুকে চাপ দেয়, অক্সিজেন মাস্ক লাগায়।
সাধ্যমত চেষ্টা চলে। কিন্তু মৃতদেহে প্রাণ ফিরিয়ে দেবার ক্ষমতা তো বিধাতা আর তাদের দেননি। অবশেষে আধাঘন্টা পরে নার্স আমাকে সাদা কাপড়ে জড়িয়ে দেয়। ডাক্তার আমায় অফিসিয়াল্যি ঘোষনা করে-“হি ইজ অলরেডি ডেড” হঠাত কে যেন কোনার দিক থেকে মুখচেপে কেদে ওঠে- মেয়েলী কান্না।
‘আরে উনি কাঁদে ক্যান!!’
‘উনারেতো আমি চিনি না।
’
পরে মনে মনে ভাবি হয়তো আমার থেতলে যাওয়া দেহের বীভতসতা উনি সহ্য করতে পারছেন না।
হঠাত একজন এগিয়ে এসে আমার মানিব্যাগটা বের করে।
‘আরে, আশ্চর্য তো, মানিব্যাগ নেয় ক্যান! ওখানে তো এক্সট্রা তিনশ টাকা রাখা। আগামী সপ্তাহেই আমাদের ডিপাটমেন্টাল পিকনিক। ওখানে চাঁদা দিতে হবে যে।
’
লোকটা ব্যাগের ভেতর কি যেন খুঁজে বেড়ায়। পরে বুঝি, উনি হয়তো আমার ঠিকানা খুঁজছে।
‘হমম, ঠিকই তো। আমার বাবা-মাকে খবর দিতে হবে না! তা’নাহলে আমার লাশ কে বুঝে নেবে। ’
লোকটা আমার আই.ডি. কার্ডটা বের করে।
ওখানে আমার বাসার টি.এন্ড.টি. নাম্বার দেয়া আছে। এরপর তার মোবাইলে দ্রুত হাতে নাম্বার টিপতে থাকে। এরই মাঝে আমার লাশ রাখা ট্রলি ঘিরে শত শত লোক ভীড় জমিয়ে ফেলসে। হঠাত এক পুলিশ অফিসারকেও চোখে পড়ল। –ওয়াকিটকি দিয়ে এক বেওয়ারিশ লাশ সম্পর্কে কি যেন বলছে।
এদিকে শুনি লোকটা ফোনে কথা বলা শুরু করেছে। হয়তো ওপাশে মা ফোন ধরেছে, সাগর ও ধরতে পারে। ওরতো আজ কলেজ বন্ধ।
লোকটা বলছে-“আপনাদের একজন রাস্তায় একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছে, এখন ঢাকা মেডিকেলে আছে। আপানারা চলে আসুন।
”
হায়রে!! কি মিছা কথা!! আমি নাকি একটু অসুস্থ! একঘন্টা আগের মৃত শরীরে আবার কিসের অসুস্থতা! আমি তো এখন রোগ-শোক, আবেগ-ভালোবাসা সব কিছু থেকে অনেক অনেক উপরে….
প্রায় দেড়ঘন্টা হতে চলল। আমাকে লাশ কাটা ঘড়ে ট্রান্সফার করা হয়েছে। আগে মর্গের নাম শুনলেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠতো। অথচ সেই আমিই দিব্যি শুয়ে আছি মগের টাইলস বাধানো একটা বেদীর উপর। শুরু হল আমাকে ছিন্ন ভিন্ন করার পালা।
কত যে সিস্টেমে কাটা হলো আমায়,,,,নেয়া হলো বিভিন্ন নমুনা। কিন্তু আশ্চর্য! একটুও ব্যাথা লাগলো না। আর লাগবেই বা কেনো??
আমি তো এখন মৃত।
আধাঘন্টা পর আমি বের হয়ে আসি সেখান থেকে। বেরিয়েই চমকে যাই।
দেখি, আমার ছোট চাচা আর তার এলাকার বন্ধুরা কাদের সাথে যেন কথা বলছে। আমি বের হয়ে আসতেই দৌড়ে আসে আমার দিকে। প্রথমে আসে আরিফ ভাইয়া। চাচার বন্ধু হলেও আমি তাকে আরিফ ভাইয়া বলেই ডাকি। সে এসেই আমায় ঢাকা সাদা কাপড় উচু করে, একপলক দেখেই মুখ সরিয়ে নেয়।
সাথে সাথেই আসে ছোটো চাচা। চাচার রিএ্যাকশনটা ঠিক বোঝা গেলো না। হঠাত যেন সে বোবা হয়ে গেলো। সব আড্ডার মধ্যমণি কৌতুক প্রিয় চাচার এ মূতিরূপ আমি কখনোই দেখিনি।
একটু পরেই দেখি সেজচাচার সাদা টয়োটা।
চাচাই ড্রাইভ করছে। পাশে বসা আমার বাবা। পেছনের সীটে চাচার বন্ধু জামাল আর ফারুক আঙ্কেল। কিন্তু কী আশ্চর্য!
‘আব্বুর চোখের চশমাটা কই?’
‘আব্বুতো কখনোই চশমা ছাড়া বাইরে বের হয় না। ’
গাড়ীর স্টার্ট বন্ধ না করেই চাচা দৌড়ে নেমে যায়।
আব্বু দৌড়ে এসে দাঁড়ায় ছোটো চাচার পাশে।
‘আরে, আমিতো এখানে। ’
‘তোমরা আমার কাছে আসো। ’
কিন্তু কে শোনে আমার কথা। হঠাত আমার হাতে সেজ চাচার ছোঁয়া পাই।
এই আমার সেই সেজ চাচা-যাকে আমরা সবাই মানে চাচাতো ভাই বোনেরা বাঘের চেয়েও বেশী ভয় করি। যেই মানুষটার ছায়া দেখার সাথে সাথেই আমরা ক,খ পর্যন্ত ভুলে যাই, আর সেইচাচাই আজ আমার হাত ধরে আছে।
‘আজিব তো!’
হঠাত দেখি চাচা তাকিয়ে আছে আমার হাতে পড়ে থাকা সাদা ডায়াস আর কালো বেল্টের ‘গুচি’ ঘড়িটার দিকে। এত দামী ঘড়ি পড়বার সাধ্য আমার নাই। চাচাই গতবার হজ্জ থেকে এনে দিসিলো এটা।
আমি ইলেক্ট্রিক্যালে চান্স পাওয়াতে চাচা ছিলো যারপরনাই খুশি। আর এই ঘড়িটা ছিলো তার পুরস্কার। সারাজীবন কঠিনরূপে দেখে আসা চাচার আজ এ কী রূপ! ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আমার রক্তভেজা শরীরের দিকে।
আব্বু আসছে আমার দিকে। পাশে আরিফ ভাইয়া।
আব্বু এসে আমার ডানে দাড়ায়। আরিফ ভাইয়া ধীরে ধীরে মাথার কাপড় ওঠানো শুরু করে।
‘ধূর, আরিফ ভাইয়া এটা কী করতেসে!’
‘আমাকে এইভাবে দেখানোর মানে কী!’
‘আব্বুর তো হার্টের অসুখ, সকালে প্রেসারের ওসুধটা খেয়েছে কিনা কে জানে। ’
আস্তে আস্তে আমার মাথার অংশ পুরোপুরি অনাবৃত করে ফেলা হয়। আমি চোখ বন্ধ করে থাকি।
‘আল্লাহই জানে এখন আব্বুর কী হবে!’
কিন্তু আব্বুর অভিব্যক্তি দেখার প্রচন্ড ইচ্ছা জাগে। সাথে সাথে চোখ মেলে তাকাই এবং সম্পূর্ণ নতুন একটা জিনিস আবিষ্কার করি।
জীবনে এই প্রথম আমার বাবার চোখে পানি দেখতে পাই। কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য!!
সব সময়ই আপন জগতে থাকা বাবার আদর থেকে আমি কখনো এতটুকুও বঞ্ছিত হইনি। এখনো মনে পড়ে প্রতিদিন অফিসে যাবার সময় আব্বুর কাছে করা সেই চকলেটের আবদার।
এখনো মনে পড়ে প্রতি রাতেই আমার জন্য খেলনা নিয়ে বাবার ঘড়ে ফেরা। আব্বু আমার জীবনে কোন ইচ্ছাই অপূর্ণ রাখেনি। সবই পেয়েছি। শুধু এই একটা জিনিসই হয়তোবা দেখা বাকি ছিলো- আব্বুর চোখের পানি। কিন্তু হায়! আজকে আমি তো মহা ফ্যাসাদে।
আজ তো আমার উঠে দাড়াবার শক্তি নেই। আমি তো আব্বুর চোখের জল মুছে দেবার জন্য ট্রলি থেকে উঠতে পারছি না।
১২টা প্রায় বাজে। সূ্য এখন ঠিক মাথার উপরে। ছোট চাচার বন্ধুরা কী সব কাগজ নিয়ে যেন দৌড়াদৌড়ি করছে।
হয়তোবা অফিসিয়াল ডেডবডি ভেরিফিকেশনের কাগজপত্র। হায়রে! কক্ত কক্ত নিয়মকানুন। এদিকে আমার শরীরের রক্ত শুকিয়ে চটচট করছে। আমার মাথায় তখন শুধু একটাই চিন্তা- কখন বাসায় যাব।
দুপুর ঠিক পৌনে একটা।
সাইরেন বাজাতে বাজাতে এ্যাম্বুলেন্সটা থামে ঠিক আমাদের বাড়ির সামনে। কিন্তু এখানে এত ভীড় ক্যান! ব্যাপারটা কি! এলাকায় কি কোন মিটিং হবার কথা নাকি! কই, সকালে বাসা থেকে বের হবার সময় তো কিছু শুনিনি, কোথাও তো মিটিংয়ের আয়োজন দেখিনি। নাহ, কোন কিছুই তো আজ মিলছে না। সব কিছুই উল্টাপাল্টা লেগে যাচ্ছে।
ধীরে ধীরে আমি ঢুকি আমার বাসার ভেতর।
ড্রয়িংরুমের ভেতর ঠিক মাঝখানটায় নেয়া হয় আমাকে। সিলিং ফ্যানটার ঠিক নিচে। চারপাশে সব পরিচিত মুখ। কয়েকজনকে তো প্রায় আট-দশ বছর পর দেখছি। সবাই আমাকে ঘিরে রয়েছে।
আমারতো ‘নিজভূমে পরবাসী’র মত অবস্থা।
‘আরে, আপনারা সবাই এমন করতেসেন ক্যান? আজব তো!’
সবাই দেখি রোল উঠিয়ে কাঁদতেসে। মনে মনে ভাবি, যার যা ইচ্ছা হয় করুক। আমার দৃষ্টি শুধু একটি মুখ খুজে বেড়ায়- আমার মা।
প্রতিদিনতো ভার্সিটি থেকে আসলে আম্মুই দরজা খুলে দেয়।
টেবিলে ভাত বেড়ে না খেয়ে বসে থাকে সেই বিকাল পর্যন্ত। কিন্তু আজকে এত দেরি করছে কেনো! আমার তো আর দেরি সহ্য হচ্ছে না। আম্মুর কথা ভান্তে ভাবতেই দরজার পাশে দেখি আম্মুর মুখ। একেই হয়তো বলে নাড়ীর টান। আর আম্মুতো শুধু আমার মা’ই না।
আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধুও। পরীক্ষার আগে যখন রাত জেগে পড়তাম তখন মা এসে আমার পাশে বসে থাকত। আমি যে কত বলতাম-‘মামণি তুমি যাও, ঘুমাও। ’ কিন্তু আম্মুতো নাছোড়বান্দা। ছেলের কখন কি লাগে- এই ভেবে আমার সাথে যে কতো নিঘুম রাত কাটিয়ে দিসে তার কোন হিসেব নাই।
আম্মু এসে দৌড়ে আমার পাশে বসে। সাথে ছুটে আসে আমার সেজচাচী, ছোটচাচী আরো অনেকে। আম্মু এসেই আমার কপালে হাত বুলাতে শুরু করলো। আমার জর হলে যেভাবে মাথায় পানি মুছে দিত ঠিক সেভাবে। সে যে কী স্বর্গীয় অনুভূতি তা বলে বোঝানো যাবে না।
সগে যাব কি না তার কোন ঠিক নেই। কিন্তু আমি নিশ্চিত মায়ের আদরলাগা ছোয়ার স্থান নরকের যন্ত্রনা কোনদিন স্পর্শ করবে না। হঠাত আম্মু বলতে শুরু করল, “এ্যাই, তুমি কোথায় গেলা? দেখো না, ছেলেটা ক্যামনে ফ্লোরে ঘুমায়ে পড়সে। ওকে ধরে তোলো। ওর রুমে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেই।
আরাম করে ঘুমাতে পারবে। তাড়াতাড়ি আসো। ” আমি তাকাই আব্বুর দিকে। আবার দেখি চশমাহীন সেই হতবিহবল চেহারা। আবার দেখি আমার হঠাত আবিষ্কার করা আব্বুর চোখের পানি।
আব্বু অঝোরে কাঁদছে। কিন্তু কোন শব্দ নেই। একটা মানুষের চোখে এত পানি থাকতে পারে তা আমার জানা ছিলো না। তবে কি বাবার শরীরের রক্ত পানি হয়ে চোখ দিয়ে ঝরছে! ওফফফ!!! হঠাত যন্ত্রনায় দেহের মধ্যে কেমন এক অজানা অনুভূতি জাগে।
আমি আবার চারপাশে তাকাই।
সাগর ’কে খুজি। ও আমার ছোট ভাই। ফিজিক্স আর ম্যাথ পড়াতে যেয়ে যে ওরে কক্ত বকাঝকা করসি তার কি কোন হিসেব আছে! ওকি তবে রাগ করে সামনে আসছে না।
‘আরে গাধা তোরে কি আমি কোনদিন মন থেকে বকা দিসি?’
তুই যাতে ইন্টারে গোল্ডেন প্লাস পাস সে জন্যই তো আমি একটু রাগ দেখাতাম। কিন্তু তুই যে ছিলি আমার পৃথিবীর সেরা ভাই।
– একথাটা মুখ ফুটে বলিনি কখনো, তোকে সামনের বছর মোবাইল কিনে দেব বলে স্কলারশিপের টাকাটা আমি রেখে দিসি আমার ড্রয়ারে- খয়েরী খামটার ভেতর। কিন্তু এ কথাটা তো তোকে আমার বলা হলো না, আমি তো তোকে মোবাইলটা কিনে দিতে পারলাম না। এখন আফসোস হচ্ছে- কেনো আগেই বললাম না! কেনো আগেই কিনে দিলাম না! ওফফ!! কষ্টটা আরেকটু বাড়ে।
বেলা বাজে প্রায় দুইটা। আত্তীয় সজন, পাড়া-প্রতিবেশী, চেনা-অচেনা সবাইরে দেখি।
কিন্তু আমার প্রতিদিনের আড্ডাবাজী গ্রুপের পোলাপানগুলিরে চোখে পড়ে না। কে জানে। ওরা খবর পেলো কিনা। আর ওদের যা সময়জ্জান তাতে টাইমলি আসবে কিনা তাই বা কে জানে!
‘আরে ব্যাটারা, আজকের দিনেও তোদের লেট করা লাগে?’
‘দেখিস না আমার আর বেশী সময় নাই। ’
চারপাশে গোল করে বসে মাদ্রাসার ছেলেমেয়েগুলি সুর করে কোরান পড়ছে।
বাকিদের হাতে তসবি।
‘আর কিছুক্ষণ পরেই তো আমার জানাজা। তোরা আসবি কখন?’
হঠাত সিঁড়িতে জুতা পরে খুব দ্রুত কারো উঠার শব্দ শুনতে পাই। ‘টক,,টক,,টক,,,’
শুনেই বুঝতে পারি শিশির ভাইয়া আসছে। আমার সব কাজের সাপোর্টার কাম পেট্রনাইজার মাল্টিন্যশনাল কোম্পানিতে চাকরীরত এক্সিকিউটিব শিশির।
আমার কম্পিউটার জ্ঞানের হাতেখড়ি তো শিশির ভাইয়ার কাছেই। কি সুন্দর ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিতো সবকিছু। একটা প্রশ্ন দশবার করলেও কিছুই মনে করতো না। কিন্তু ফ্যাশনেবল হাসিখুশি শিশির ভাইয়ার চেহারার আজকের এই গাম্ভী্র্য তো আমার পুরোপুরি অচেনা। শিশির ভাইয়ার সাথে সাথেই ঢোকে হিমেল।
শিশির ভাইয়ার ভাই- আমার কাজিন। আমার চেয়ে বয়সে দুই বছরের সিনিয়র। কিন্তু সম্পর্ক ঠিক বন্ধুর মতো। আমার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার স্বপ্ন তো তার কাছ থেকেই পাওয়া। দেখা হলেই হাসিমুখে বলতো- “কিরে, কোন সমস্যা নাই তো? এবারের সাবজেক্টগুলি কেমন রে?”
শিশির ভাইয়াকে পাশ কাটিয়ে হিমেল দৌড়ে এসে আমার পাশে বসে।
ক্ষাণিক পরেই মাথা টলে অজ্জান হয়ে পড়ে যায় আমার খাটিয়ার পাশে। হায়রে! ধীরে ধীরে কষ্ট তো বাড়ছেই। চিন্তা করি, কখন দ্যাখা শ্যাষ হইব এইসব।
বাজে প্রায় তিনটা। হঠাত করেই আসা শুরু করলো আমার সব জিগরি দোস্তোরা।
‘কিরে ভাই, তোগোর সবার মুখ এমন ক্যান? কি হইসে তোগোর? আমারে ক’
চমকে ভাবি- না না, কারো প্রবলেম সলভ করার ক্ষমতা আমার আর নেই।
কাওসারকে আমার আর কোনোদিন টাকা ধার দিতে হবে না। মেহেদীর পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর চুরি করা হবে না। জাহীদের সাথে তর্ক হবে না আর কোনোদিন। সামী আমার উপর হঠাত হঠাত রেগে যাবে না আর কখনোও।
সুমনকে বাটপার বলে দৌড় দিব না আর কোনদিন। বিকেল হলেই নাজমুলের সাথে চুপি চুপি সিগারেট খেতে যাব না আর ব্রিজের ধারে। সামনের মাসের ছুটিতে সিলেটে তোরা হয়তো অনেক মজা করবি, অনেক ছবে তুলবি, ফেসবুকে দিবি মজার মজার সব স্ট্যাটাস। কিন্তু আমি আর তোদের কোন কিছুরই অংশ হতে পারব নারে।
হয়তো ওপর থেকে দেখব সবকিছু।
মেঘ হয়ে ভেসে বেড়াব, বাতাস হয়ে ছুঁয়ে যাব। কিন্তু তোরা আমায় পাবি না আর কোনদিন।
হঠাত চিৎকার শুনি। বারান্দার দিকে ঘুরে তাকাতেই দেখতে পাই একটা জটলা। গলার স্বর শুনে আমার বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এবার গলা ফাটিয়ে কাঁদছে মেহেদী।
আরে কী আশ্চর্য! বারান্দার ওই কোনার দিকের চেয়ারে ওটা কে! অপুর মত লাগছে দেখতে। হ্যাঁ হ্যাঁ, অপুই তো। ও মুখে রুমাল চেপে বসে আসে ক্যান? বিশালদেহী এই অপুর মাঝে কোনদিনও আবেগ ছিলো বলে তো মনে পড়ে না। ওতো সবকিছুই ঠাট্টা মনে করে উড়িয়ে দেয়। অথচ সেই অপুর চোখেও পানি।
অন্তরের সব কঠিন আবেগ যেন চোখ বেয়ে গলে গলে পড়ছে। এত ভালোবাসতি তোরা আমাকে! এত!! এত!!! কই, কোনদিন তো কিছু বলস নি! কোনোদিন তো দেখাস নি। আমিও তোদের অনেক ভালোবাসতাম রে। অনেক, অনেক। কিন্তু কোনদিন তোদের বলিনি।
তোরা সবসমই আমার চারপাশ আলোকিত করে থাকতি। আমার এই ক্ষুদ্র জীবন তোদের মত বন্ধু পেয়ে ধন্য।
হায়রে! এত ভালোবাসার কোন প্রতিদান না দিয়েই কী সাথপরের মত চলে এলাম পৃথিবী থেকে। কষ্টটা আরো বাড়ে।
বিকেল সাড়ে চারটা।
আমায় গোসল করানো শেষ। আসরের নামাযের পর জানাযা। মা এখনো আমার মুখে শীতল পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে।
‘দাও মা, দাও। আর একটু পরই তো আমি চলে যাব।
তোমার এই পরশ তো আর পাব না। ’
‘মা, কাল না আমাদের সবাই মিলে ছোট খালার জন্য বনানীতে পাত্র দেখতে যাবার কথা? তুমি কি ভুলে গেছো? তোমার তো ভুললে চলবে না। তুমিতো তোমার ফ্যামিলির সবচেয়ে বড় মেয়ে। তোমার এই খামখেয়ালী তো আগে আমি কখনো দেখিনি মা। ’
“দেখসো বৃষ্টি, ছেলেটা যত বড় হচ্ছে ততই মনভোলা হয়ে যাচ্ছে।
কাল যে ওর ক্লাসটেস্ট আছে। ও মনে হয় ভুলেই গেসে। সেই কখন থেকে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে”-আম্মুর এই কথা শুনে ছোট চাচী আর শম্পা খালা আবার চিৎকার করে কান্না শুরু করে। মা এখনো কিছু বুঝতে পারে না। আমার সারা শরীরে নিরন্তর হাত বুলিয়ে চলে।
বিকেল পাঁচটা। ছোটো চাচার বন্ধুরা এগিয়ে আসে আমার খাটিয়ার দিকে। আমি বুঝতে পারি আমার এ বাসায় আর আমি আসতে পারব না। প্রতি মাসের এক তারিখে ক্যালেন্ডারের পাতা আর চেঞ্জ করে দেয়া হবে না। আগামী মাসে আব্বু-আম্মুর ম্যারেজডেতে সারপ্রাইজ গিফটা আর দেয়া হলো না।
আমার ছোট্ট বারান্দায় বসে গভীর রাতে আর জোৎস্নাগোসল করা হবে না। নাস্তার টেবিলে বসে দেয়ালে টানানো ওয়ালম্যাটটার দিকে আর আমি চেয়ে থাকব না। হঠাত করেই যেন চেঞ্জ হয়ে গেলো সবকিছু।
ধীরে ধীরে আমায় নিয়ে আসা হয় গেটের বাইরে। বের হতে হতে দেখি পাশের বাসার রুনা আন্টি, শিলা আন্টি, কবিতা আপু, পিচ্চি আরিয়ান আরো কতো কতো মানুষ তার ইয়ত্তা নেই।
সবাই আজ এসেছে আমাদের এই ছোট্ট বাড়িটায়।
‘তোমারা আজ সবাই একসাথে এসেছো কেনো!’
‘আম্মুতো তোমাদের কাউকেই না খাইয়ে ছাড়বে না। আম্মুটা যে পাগলের পাগল। মেহমান দেখলেই দৌড়ে যায় রান্নাঘরের দিকে। বুঝেছি, আজ আম্মুর উপর আনেক ধকল যাবে’
আমায় নিয়ে আসা হয় বাসার পাশের তেলীপাড়া জামে মসজিদে।
কি সুন্দর চকচকে টাইলস লাগানো চারপাশের দেয়ালে। মনে পড়ে যায় এই মসজিদেই আমার দাদার জানাযা হয়েছিলো। আমি তখন এক্কেবারে ছোট। নামাজ পড়তে পারতাম না। কিন্তু তবুও আব্বুর হাত ধরে এসেছিলাম।
অথচ আজ আমারি জানাযায় সবাই এসেছে। এলাকার সবচেয়ে পুরনো মসজিদে আজ হাজারো মানুষের ঢল।
নামাজ শেষ হয়। জানাজা শেষ হয়। শিশির ভাইয়া আমার পক্ষ থেকে সবার কাছে কান্নাজড়ানো কন্ঠে ক্ষমা প্রাথনা করে।
ইমাম সাহেবও মোনাজাতের সময় হু হু করে কেঁদে ওঠেন। মসজিদে সবার মাঝে নীরব কান্নার রোল ওঠে। নামাজ শেষে সোনালি সবুজ কারুকাজ করা চাদরে ঢেকে দেয়া হয় আমার খাটিয়া।
মসজিদ থেকে ধীরে ধীরে বের হতে থাকি আমি। গেটের সামনে এসে দেখি বৃষ্টি পড়ছে।
‘আরে আজব তো! এতগুলি মানুষ কি আমার জন্য বৃষ্টিতে ভিজবে নাকি? কারো কাছেই তো ছাতা নেই, রেইনকোট নেই। ‘
কিন্তু না, কেউই আর বাকি থাকে না। সবাই আমার খাটিয়া নিয়ে বের হয়ে আসে বৃষ্টির মাঝেই। হয়তো এটাই নিয়ম। মৃতের প্রতি অন্তিম শ্রদ্ধা হয়তো এভাবেই জানাতে হয়।
আমি আবার আসি বাসার সামনে। আজিমপুরে যেতে হলে এ রাস্তা দিয়েই যেতে হয়। গেটের সামনে সব মহিলাদের ভীড়। বৃষ্টি উপেক্ষা করেই বারান্দা থেকে নেমে এসেছে সামনের খালি মত জায়গাটাতে। আমার দৃষ্টি খুজে বেড়ায় আম্মুকে দেখার জন্য।
‘আম্মু তুমি কই? তুমিকি এখনো বুঝছো না যে তোমার ছেলে চলে যাচ্ছে অন্য এক জগতে। তুমি কি এখনো ভাবছো আমি সন্ধ্যার পরই ফিরে আসবো বাড়িতে। আবার গিয়ে বসব আমার পড়ার টেবিলে। ’
হায়রে! এই পাগল মা’টারে কে যে বুঝাবে এই সত্যি কথাটা কে জানে!
‘আল্লাহ তুমি আমার মায়ের মনটা একটু শক্ত করে দাও। প্লিজ আল্লাহ, প্লিজ’
আঝোরে বৃষ্টি পড়ছে।
ধীরে ধীরে আমি ছাড়িয়ে যাচ্ছি আমার বাড়ির সীমানা। হঠাত চোখ যায় বাসার ছাদের দিকে।
‘আরে ছাদে ওটা কে!’
অবণির মত লাগছে দেখতে।
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই তো। বৃষ্টির মধ্যে একা ছাদে দাঁড়িয়ে এদিকে তাকিয়ে আছে কেনো?’
ফিজিক্সের ফাস্ট ইয়ারে পড়া ব্রিলিয়ান্ট অবণির তো এভাবে বৃষ্টিতে ভেজার কথা না।
‘আজ ওর চোখের গোল গোল চশমাটা কই’
কী অপূব সুন্দর একটা মেয়ে, অথচ নিষ্পাপ চোখ দুটি সব সময় কালো ফ্রেমে বন্দী করে রাখতো। বিকেলে ছাদে উঠলে মাঝে মাঝে কথা হত। কিন্তু কখনোই বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে নয়। আর সেই অবণিই আজ এলোমেলো বৃষ্টিতে একা দাঁড়িয়ে আছে ছাদে। কী অপূর্ব লাগছে দেখতে ওকে।
ওর এই স্বর্গীয় অবয়ব তো আজকেই আমার প্রথম দেখা।
‘ও কি কাঁদছে?’
‘না, না ও কাঁদবে কেনো। ও তো আমার রক্তের সম্পর্কের কেও না। তবে কি রক্তের বাধনের চেয়ে আত্তার বাঁধন বড়?’ তাই হবে হয়তো।
অঝোর বৃষ্টি ওর গাল বেয়ে নিচে নেমে আসছে।
চোখের জল মিশে বৃষ্টির অঝোর ধারার সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে। আশ্চর্য! একটা অপরিচিত মানুষের জন্য কারো মায়া থাকতে পারে! আমার জানা ছিলো না। নিথর দেহে যেন একটা শিহরণ খেলে যায়। মনে হতে থাকে ভালই তো ছিলাম এই পৃথিবীতে অজানা সব মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে। কেনো যে চলে যাচ্ছি।
পরক্ষনেই মনে হয়, আমি চলে না গেলে তো জানতাম না আমার প্রতি সবার এই ভালোবাসার কথা। বুঝতাম না অদৃশ্য এই মায়ার টান কতটা প্রবল, কতটা স্বর্গীয়।
আজিমপুর গোরস্তানে আমি পৌছাই সন্ধ্যা ৬’টায়। আগে থেকেই খোদাই করে রাখা কবরটায় বৃষ্টির কারণে সামান্য পানি জমেছে। ওটাই এখন সেচে ফেলা হচ্ছে।
আমার খাটিয়া সামনে ধরে আছে আব্বু আর সাগর , পেছনে শিশির ভাইয়া আর তার বন্ধুরা। আমি আব্বুকে চিতকার করে বলি- ‘আব্বু আমায় নিচে নামিয়ে রাখো। সন্তানের লাশের ভার তো পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারী। কেমন করে বইছ এই বোঝা!’
কিন্তু আমি তো আজ বোবা। যতই চেচাই না কেন, এই জাগতিক পৃথিবীতে কেউ আজ আমার কথা শুনবে না, কেউ আমার কথার জবাব দেবে না।
ধীরে ধীরে আমার দেহ নামিয়ে দেয়া হয় সাড়ে তিন হাতের অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে গতটাতে। চাটাই দিয়ে ঢেকে দেয়ার পর সবাই মাটির ঢেলা তুলে নেয়। আমি ঢাকা পড়ি মাটির স্তুপের আড়ালে। লাগানো হয় ঘাস, দেয়া হয় ফুল। এই ঝুম বৃষ্টির মাঝে কারো যেন কোন তাড়া নেই।
সবাই মোনাজাত ধরে। কী সুন্দর করে কোরান পাঠ করেন ইমাম সাহেব। আত্তার মাগফিরাতের জন্য পরওয়ারদিগারের দরবারে জানানো হয় অন্তিম ফরিয়াদ।
দূর মসজিদ থেকে আযানের ধনি ভেসে আসে। চারিদিকে ধীরে ধীরে নেমে আসতে থাকে অন্ধকার।
কেমন যেন কাঁপনলাগা শীতল অনূভুতি। আস্তে আস্তে জটলা কাটতে থাকে। একজন দুজন করে পা বাড়ায় বাড়ির পথে, কেউবা মসজিদ পানে। হঠাত কারো কান্নার আওয়াজ পাই।
‘আরে, সবকিছু তো করা শেষ।
এখন আবার কাঁদে কে!’
কান পেতে থাকি ওই কান্নাশব্দ পানে। বুঝতে পারি, এ যে আমার বাবার কন্ঠ। এবার আর বাবা নিঃশব্দে কাঁদছে না। হাউমাউ করে একেবারে শিশুর মতো কাঁদছে। এলোমেলো ভাবে কতো কিছুই না বলে যাচ্ছে।
হয়তো পুত্রের অকাল প্রস্থানে পিতৃহদয় সৃষ্টিকর্তার আরশে আবারো ফিরে পাবার আকূল আবেদন জানাচ্ছে।
‘কিন্তু বাবা, এতো আর হবার নয়। এ যে বিধাতার বিধানে নেই। তুমি কেঁদো না বাবা, আমার কষ্ট লাগছে’
চাচার কাঁধে ভর দিয়ে বাবাও বাড়ির পথে পা বাড়ায়।
‘যাক, বাঁচা গেলো।
সারাদিন সবার চোখের পানি দেখতে দেখতে আমি এখন বড্ড ক্লান্ত। কেমন যেন ঝিমুনি আসছে। আমি এখন ঘুমাবো। অনন্তকালের সেই ঘুম যে কবে ভাংবে কেউ জানে না। ’
আশেপাশে দেখে নেই, কেউ নেই তো আবার।
আরে!!!
আমার দুটা কবর পরে কিনারায় দাঁড়ানো আবছা ছায়াটা কার?
ভালো করে খেয়াল করতেই দেখি ওখানে দাঁড়িয়ে আছে সাগর । অঝোর বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে আমার আদরের ছোট্ট ভাইটা।
‘ভাইরে, তুই বাড়ি যা। এভাবে ভিজিস না। তোর যে ঠান্ডা লেগে যাবে রে।
আব্বু আম্মুর কতো সপ্ন ছিলো- বড় ছেলে ইঞ্জিনিয়ার আর ছোটো ছেলে হবে ডাক্তার। আমি তো সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পারলাম নারে। কিন্তু তোকে যে পারতেই হবে। তুই এভাবে ভেংগে পড়লে আব্বু আম্মুকে দেখবে কে! তুই বাড়ি যা, প্লিজ। ’
আমার কথা বুঝি ওর কানে পৌছে।
মাথা নিচু করে বেরিয়ে যেতে থাকে মেইনগেট ধরে।
আহ, কি শান্তি। আজ থেকে আমার আর কোন কাজ নেই। সন্ধ্যার পর পড়তে বসার তাড়া নেই। আড্ডা দেবার আকূলতা নেই।
আমার প্রতি কারো আর কোন দাবি নেই। কারো প্রতি আমার আর কোন অধিকার নেই। কিন্তু এই মুক্তি নিতে যে আমি হারিয়ে ফেললাম আমার চারপাশের জগতটাকে। নিদয়ভাবে ছিন্ন করলাম সব মায়ার বাঁধন। বঞ্চিত হলাম বাবার স্নেহ আর মায়ের মমতার পরশ থেকে।
হারিয়ে ফেললাম ভাইয়ের হাসিমাখা মুখটা দেখার সুযোগ। এই মুক্তি যে জোয়ারের টানে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো আমার আড্ডার আসর, আমার আপন খেলাঘর। তবে কি আমি ঠকে গেলাম!!
‘না, আর কিছুই চিন্তা করতে পারছি না। আমার এখন একটু ঘুমের দরকার। আমি এখন ঘুমোবো।
’
উৎসর্গঃ খন্দকার খান জাহান সম্রাট। বুয়েটের মেকানিক্যাল ডিপাটমেন্টের টগবগে এই তরুণের মৃত্যু হয় ২০১০ সালের ২৭ শে মে। আজিমপুর বাসস্ট্যান্ডে ঘাতক বাসের চাকায় সম্রাট পিষ্ট হয় সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে। ৮টা ৪০ মিনিটে ঢাকা মেডিকেলের কর্তব্যরত চিকিতসক তাকে মৃত ঘোষনা করে। এভাবেই বড় অসময়ে চলে যায় স্বপ্নের জাল বুনতে থাকা এক তরুণ শিল্পী।
পরিশিষ্টঃ বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৪০০০ প্রাণ সড়ক দূঘটনার নির্মম বলিদানের শিকার। অধিকাংশ দূর্ঘটনাই ঘটছে চালকদের ট্রাফিক আইন মেনে চলার ব্যাপারে অনীহা আর সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাবে।
আমরা রাস্তা পারাপারের সময় ফুটওভার ব্রীজ ব্যবহার করি না। গাড়ী ড্রাইভ করার সময় লালবাতি যেন আমাদের চোখেই পড়ে না। বাস ড্রাইভার স্পীড লিমিট ক্রস করলে মনে মনে খুশি হয়ে বলি- “বাহ, ড্রাইভারটাতো বেশ ভালো।
” আর আমাদের এই মনোভাবই কেড়ে নিচ্ছে ৪০০০ প্রাণ। আমরাই এই ৪০০০ সত্তার হত্যাকারী। এ হত্যার দায় আমাদেরই।
আসুন, একটু বদলাই। আর তা’নাহলে প্রস্তুত হই সড়ক দূ্র্ঘটনায় মৃত স্নেহময়ী মা, আদর্শবান বাবা বা ফুটফুটে ছোট বোনটাকে কাঁধে করে অনন্তকালের ঘুমের রাজ্যে পৌছে দেবার জন্য।
স্বপ্নহত্যার কোন ক্ষমা নেই। তবুও সম্রাটের আত্মার মাগফিরাত আর তার পরিবারের কাছে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া বোধহয় আমাদের আর কিছুই করার নেই .। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।