ক্লাসের সমস্ত নিরাবতা ভেঙ্গে হঠাৎ করেই আমাদের সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক এর ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক ডেভিড আমার নাম উচ্চারণ করলেন! ”আদনান নোবেল পেয়েছে, চলো আমরা সবাই তাকে অভিবাদন জানাই”। ডেভিডের মুখে এইরকম ইয়ার্কি মার্কা কথা শুনে ক্লাসের সবাই আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেটে পরে আর কি! আমারও মনে মনে ডেভিডের দিকে খুব রাগ হচ্ছিল। ” বেটা ইয়ার্কি মারার আর জায়গা পেলি না?”। কিন্তু ডেভিড নাছোড় বান্দা। তিনি এবার সরাসরি শিক্ষকের মঞ্চে তার পাশে যেয়ে দাড়াবার জন্য আমাকে অনুরোধ করলেন।
সব দেখেশুনে আমারত আত্বারাম খাচাছাড় হয় আর কি! শুধু মনে মনে ভাবছিলাম এই পাগলাটার আজ হল কি? (এখানে উল্লেখ্য যে ইংরেজি শিক্ষক ডেভিড ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে পাগলা এবং ক্ষেপা হিশেবে বেশ নাম কুড়িয়েছিল)। আমি মঞ্চে তার সামনে আসতেই এবার ডেভিড তার আসল কথায় এলেন। ”আদনানের দেশের একজন মানুষ নাম মুহাম্মদ ইউনুস আর তার গ্রামীন ব্যাংক শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এই গর্ব আমাদের সবার। চলো এর জন্য আমরা সবাই দাড়িয়ে আদনানকে অভিবাদন জানাই।
” সেটা ছিল ২০০৬ সালের কথা। সত্যি বলতে সেদিন আমি আমার চোখের আনন্দ অশ্রু ধরে রাখতে পারিনি। যখন আমরা দূর প্রবাসে বসে প্রতিনিয়ত দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, দূর্নিতী, অনিয়ম, হত্যা, গুম,খুন ইত্যাদি শুনতে শুনতে অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছিলাম ঠিক সেই সময়ে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নোবেল প্রাপ্তিটা ছিল আমার মত হাজার হাজার বাংলাদেশিদের জন্য মরুভুমিতে এক পশলা বৃষ্টির মতই। স্পষ্ট মনে আছে, গ্রামীন ব্যাংক এবং অধ্যাপক ইউনুস শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভুষিত হয়েছেন খবরটা যখন আমাদের নিউইয়র্কবাসী প্রবাসীদের কানে এল তখন নিউইয়র্কের বাঙালি পাড়া জ্যাকসন হাইটস এ মিষ্টি খাওয়ার ধুম পরে গিয়েছিল। এই গর্বে সেদিন আমাদের বুকের ছাতি যেন দশ ফুট চওড়া হয়ে গিয়েছিল।
অধ্যাপক ইউনূস গত বুধবার ১৭ মে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসরকারি সম্মামনা ’কংগ্রেশনাল স্বর্ণপদক’ এ ভুষিত হয়েছেন। আবারো তাকে অভিনন্দন! মার্কিন পরিষদের স্পিকার জন বোয়েনার আনুষ্ঠানিকভাকে যখন তার হাতে এই পদক তুলে দিচ্ছিলেন তখন সে দৃশ্য দেখে দ্বিতীয় দফায় আবারো আনন্দ অশ্রু বর্ষণ করলাম। ১৭৭৬ সালে জর্জ ওয়াশিংটনকে দিয়ে যে পদকের যাত্রা শুরু হয়েছিল সেই পদকটি যে খুবই ভাড়ি এবং অহংকার করার মত একটা বস্তু তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। জেনারেল কলিন পাওয়েল, ফ্রান্ক সিনাত্রা, মাদাম তারেসা, রোসা পার্ক, পপ জন পল, মার্টিন লুথার কিং সহ অনেক দেশবরেণ্যরা এই পদকে ইতিমধ্যেই ভুষিত হয়েছেন। মুহাম্মদ ইউনূস নামটিও এখন এই পদক তালিকায় যোগ হল।
এই গর্ব শুধু অধ্যাপক ইউনূসের নয় বরং এই গর্ব গোটা বাংলাদেশের।
”আমরা দারিদ্র্যকে যাদুঘরে পাঠাবো”মুহাম্মদ ইউনূসের এই মন্ত্রে উদ্দিপ্ত হয়ে গোটা পৃথিবীর মানুষ যখন আনন্দে সোচ্চার তখন অবাক হয়ে লক্ষ্য করি খোদ নিজ ভুমিতেই এই মানব প্রেমিক নির্গিহিত হয়ে আছেন। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাদেরই দাবি যে ইউনূস এর পরিবর্তে দলটির প্রধান এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারই এই নোবেল পাওয়া উচিৎ ছিল। বাংলাদেশের এটর্নি জেনারেল থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের নেতা হানিফ, বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল মুহিত, দলটির সাধারণ সম্পাদক এরা সবাই মুহাম্মদ ইউনূসের কাজকে প্রকাশ্যে সমালোচনা করার জন্য যেন মাঠে নেমেছেন। হয়তো সে কারনেই অধ্যাপক ইউনূসের এই ’কংগ্রেশনাল স্বর্ণপদক’ প্রাপ্তিতে বাংলাদেশের সরকারি পর্যায়ে কোথাও কোন আলোড়ন চোখে পরল না।
তবে বিরোধীদলের নেতা খালোদা জিয়া তাকে অভিনন্দন জানালেও সরকারি পর্যায়ে এই ”এড়িয়ে যাওয়া নীতি” প্রকারান্তরে আমাদের হীনমন্যতারই যে পরিচয় চরম বহিপ্রকাশ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
আবারো পুরনো একট স্মৃতিতে ফিরে যাই। নোবেল প্রাপ্তির পর মুহাম্মদ ইউনূস নিউইয়র্ক এলেন। যুক্তরাষ্ট্র বসবাসরত আমরা প্রবাসী বাঙালীরা কুইন্স কলেজের কোলডেন হলে দলমত নির্বিশেষ তাকে এক নাগরিক সম্ভর্ধনা দিয়েছিলাম। পিন পতন নিরাবতায় ড. ইউনূস সেদিন আমাদের শুনিয়েছিলেন গ্রামীন ব্যাংকের সাফল্যের কথা, বলেছিলেন কীভাবে এই দারিদ্রতাকে বাংলাদেশ তথা গোট বিশ্ব থেকেই চিরতরে দূর করে দিতে চান তিনি।
হঠাত লক্ষ্য করছিলাম আমার ডান পাশের চেয়ারে বসা এক বাঙালী ভদ্রলোক আনন্দে উত্তেজনায় তার কথায় উদবুদ্ধ হয়ে হাত তালি দিতে দিতে প্রায় দাঁড়িয়ে পরছিলেন আর বিড় বিড় করে মাথা ঝাঁকিয়ে কীসব যেন আপনমনেই বলছিলেন। আমার চোখাচোখি হতেই তিনি বললেন, ’’আরে বুজলেন ভাই, ইউনুসের মত আর দুইটা লোক হইলেই আমাদের হইয়া যাইতো! আর যাই হোক আমাদের আর এই বিদেশের মাটিতে পইচচা মরতে হইতো না’’। আমি কাঁধ ঝাকিয়ে তখন তার কথার প্রতি আমার সমর্থন জানিয়েছিলাম।
কোন ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানই সমালোচনার উর্ধে নয়। যে কোন গঠনমূলক সমালোচনায় একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান পরিশুদ্ধ হতে বাধ্য।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বা তার প্রতিষ্ঠান গ্রামীন ব্যংক নিশ্চয়ই সমালোচনার উর্ধ্বে হতে পারে না। ইউনূস অথবা তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামিন ব্যংকের গঠনমুলক সমালোচনা অবশ্যই করা যেতে পারে। কিন্তু সমালোচনার নামে প্রতিনিয়ত ব্যক্তি ইউনূসের প্রতি বিষ বাক্য ছড়িয়ে সরকার নিজেই যে নিজেকে অনেক ছোট করে ফেলছেন সে কথা সরকারকে কে বুঝাবে? শেষ কথা হল মুহাম্মদ ইউনূস গোটা বিশ্বেই একজন সম্বানিত ব্যাক্তিত্ব। এই নোবেল পাওয়া মানুষটাকে কি আমরা আমাদের নোংরা রাজনীতির বাইরে রাখতে পারি না?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।