আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম

মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো-চেতনাগত ও সংস্কৃতিগত।

অধ্যাপক রফিকুল ইসলামঃ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের এক লড়াকু যোদ্ধা চন্দ্রদ্বীপ। বরিশালের পূর্বনাম। এটি ছিল তৎকালীন বঙ্গ-প্রদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী অঞ্চল। অগ্নিযুগের সশস্ত্র ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন-সংগ্রামে বরিশালের অবদান নানাদিক দিয়ে শ্রেষ্টতম।

বরিশালের বানরীপাড়াই ছিল সশস্ত্র বিপ্লববাদীদের তীর্থস্থান। বানরীপাড়ার পরে স্বরূপকাঠীর অবস্থান। স্বরূপকাঠী ছিল বিপ্লবীদের তৃতীয় ঘাটি। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে প্রায় সকল লড়াই-সংগ্রামে বরিশালের বানরীপাড়ার বিপ্লবীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যার নেতৃত্বে ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী কমিউনিষ্টরা।

তাঁদের মধ্যে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম অন্যতম। যার নাম সর্বজন স্বীকৃত। বানরীপাড়া-স্বরূপকাঠীর বুক চিঁড়ে বয়ে গেছে বিখ্যাত সন্ধ্যা নদী। মিলেছে বঙ্গোপসাগরে। নদীর দুই কূল ঘেঁষে রয়েছে অসংখ্য গ্রাম।

বলহারকাঠী তার মধ্যে একটি। বানরীপাড়া থানার চাখার ইউনিয়নে এর অবস্থান। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন-সংগ্রামের বহু নেতা-কর্মী ও সংগঠকের জন্ম এ ইউনিয়নে। এখানে শেরে বাংলা ফজলুল হকেরও জন্ম। তৎকালীন সময়ে এটা দেশপ্রেমিকদের তীর্থস্থান বলে বিবেচিত হত।

অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের জন্ম ১৯২০ সালের ১ জানুয়ারী। পিরোজপুর (বর্তমান বরিশাল) জেলার বানরীপাড়া থানার চাখার ইউনিয়নের বলহারকাঠী গ্রামে। বাবা মৌলভী আব্দুল ওয়াজেদ (মানিক মিয়া)। তিনি ছিলেন একজন ঊদারমনা ও প্রগতিবাদী আদর্শবান মানুষ। আদর্শ ও সততা ছিল তার জীবন-দর্শন।

আর্থিক অবস্থা ভালই ছিল। যে কারণে তিনি মানুষের সেবা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি শিক্ষা বিভাগে স্কুল ইন্সপেক্টর হিসেবে চাকুরী করতেন। মা সৈয়দা মজিবুন্নেসা। তিনি শেরে বাংলা ফজলুল হকের ফুফাত বোন।

পরোপকারী স্বভাবের মানুষ। মমতাময়ী আদর্শবাদী মা অসহায় মানুষকে নানাভাবে সহযোগিতা করতেন। পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। তারপর পাঠশালা। প্রাইমারী পড়াশুনা খালিশাকোটা স্কুলে।

তারপর ভর্তি হন বরিশাল জেলা স্কুলে। পাঠ্যবই পড়াশুনার পাশাপাশি প্রচুর অন্যান্য বই পড়তেন। সেই অল্প বয়সেই পড়ে ছিলেন মার্ক্সবাদী বই। সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গণে তাঁর পদচারণা ছিল সমান। খেলাধুলায়ও পারদর্শী ছিলেন।

এছাড়া তিনি গান, কবিতা আবৃত্তি ও অভিনয়েও ছিলেন পটু। সহপাঠীদের নিয়ে নানারকম গল্প, উপন্যাস ও কবিতা আবৃত্তির আড্ডা জমাতেন। স্কুলের সকল ছাত্র তাঁকে পছন্দ করতো। নানাগুণের কারণে শিক্ষকরা তাকে খুব পছন্দ করতেন। ১০ম শ্রেনীতে পড়াশুনাকালে ১৯৩৫ সালে তাঁকে ব্রিটিশ সরকার গ্রেফতার করে।

তার অপরাধ ছিল তিনি ছাত্র ফেডারেশনের এক জন কর্মী এবং তিনি ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজকে ক্ষেপিয়ে তুলছেন। আসলেই ১৬ বছরের এই তরুণ সেদিন ব্রিটিশ পুলিশের নজর কাটতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই স্কুল থেকে ১৯৩৬ সালে প্রথম বিভাগ অর্জন করে এন্ট্রান্স পাশের স্বীকৃতি অর্জন করেন। এ সময় ছাত্রদের মধ্যে যে কমিউনিষ্ট বলয় তৈরি হয়, তার সাথে যুক্ত ছিলেন রফিকুল ইসলাম। এরপর ভর্তি হন বিএম কলেজে।

এই কলেজ ছাত্র ফেডারেশনের শক্তিশালী ভিত্তি করে গড়ে তোলার দায়িত্ব নিলেন। অল্পদিনের মধ্যে তিনি তার সাংগঠিক দক্ষতা দিয়ে সংগঠনকের শক্তি বহুগুওণে বৃদ্ধি করতে সক্ষম হন। ১৯৩৭ সালে তিনি পুরনো কংগ্রেস কর্মী গফুর মিয়া কৃষদের সংগঠন গড়ে তোলার জন্য সরিকলে তরুণ কমিউনিষ্টদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তখন অনিলদাশ গুপ্ত ও রফিকুল ইসলাম সরিকলে যান। ওই সভায় জগবন্ধু মণ্ডল সভাপতিত্ব করেন।

বিএম কলেজে থেকে ১৯৩৮ সালে প্রথম বিভাগে আইএসসি পাশের স্বীকৃতি অর্জন করেন। আইএসসি পাশের পর পিতা মৌলভী আব্দুল ওয়াজেদ মিয়া তাঁকে উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতায় নিয়ে যান। ভর্তি হন কলকাতায় মেডিকেল কলেজে। এই মেডিলেল কলেজে ডাক্তারী পড়াকালে ছাত্র ফেডারেশনের কাজসহ কমিউনিষ্ট পার্টির কাজে যুক্ত হতে থাকেন। এ সময় তিনি কমিউনিষ্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ_ কমরেড দাঙ্গে, কমরেড মুজাফফর আহমদ, কমরেড আব্দুল হালিম, কমরেড ইসমাইল, কমরেড বঙ্কিম চ্যাটার্জীর সাথে সার্বক্ষণিকভাবে কাজ করেন।

পার্টির কাজে সময় দিতে গিয়ে ডাক্তারী পড়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। চেতনায় নির্মাণ করেন দেশপ্রেম ও শোষণমুক্তির মন্ত্র। একপর্যায়ে ডাক্তারী পড়া বাদ দিয়ে পার্টি কমরেডদের অনুমতি নিয়ে বরিশালে চলে আসেন। ১৯৪০ সালে তিনি পুনরায় বরিশাল বিএম কলেজে বিএ ভর্তি হন। আবারো ছাত্র ফেডারেশন ও পার্টির কাজে নিজেকে নিযুক্ত করেন।

পার্টির কাজে তিনি কখনো অনীহা প্রকাশ করতে না, বরং খুব আগ্রহ ও আন্তরিকতা দিয়ে সকল কাজ সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম ছিলেন। ১৯৪২ সালে ডিস্টিংকশনসহ বিএ পাশের স্বীকৃতি অর্জন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হয়ে, সরকারী চাকুরী না নিয়ে বরিশালেই থেকে যান। কারণ পার্টি’কে গড়ে তোলার জন্য, লড়াই-সংগ্রামকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য। পরে দর্শন ও বাংলা নিয়ে বিএম কলেজে এম এ ভর্তি হন।

এ সময় তার রাজনৈতিক সহকর্মী ছিলেন_ অমিয় দাশগুপ্ত, অরুণ রায় চৌধুরী, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, আবুল কালাম সামছুদ্দিন, মোজাম্মেল হক, শাহ-আলম চৌধুরী, এবিএম জাহিদ, মজিবুর রহমান চৌধুরী, সুধীর সেন, দেবেন ঘোষ, আজিজ তালুকদার, মোশারফ হোসেন, মনা ঘোষ, মুকুল সেন, হিরালাল দাশগুপ্ত, অমৃতলাল দে, আজিজুল হক শাজাহান, বেলায়েত হোসেন, কাজী মহিউদ্দিন, সরদার ফজলুল করিম, স্বদেশ বোস, হীরালাল মুখার্জী, চিত্তরঞ্জন সুতার, নুরুল ইসলাম খান, আরজ আলী, নুরুল ইসলাম উকিল, হেলাল মুন্সী, সুনীল গুপ্ত, নুরুল ইসলাম মুন্সী, মনোরমা বসু মাসিমা, রানী রায়, মোশারফ হোসেন, আব্দুল করিম, আব্দুল মোতালেব, সিদ্দিক হোসেন, সিরাজুল ইসলাম, নিরোদ নাগ, জগদীশ আইচ সরকার, আব্দুস সাত্তার, আইয়ুব আলী মাস্টার, ধীরেন ভট্টাচার্য, নিখিল সেন, নলিনী দাস, মোহাম্মদ এমাদুল্লাহ, আবদুশ শহীদ, আজাদ সুলতান, ও সতীন সেন প্রমুখ। ১৯৪২ সালে তিনি কমিঊনিষ্ট পার্টির সদস্য পদ পান। বরিশালের নেতৃত্ব তাকে পার্টি গড়ার কাজের দায়িত্ব দেন। তিনি এ দায়িত্ব যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করেছিলেন। যার কারণে কিছুদিন পরে পার্টি তাকে তত্ত্ব ও শিক্ষা বিষয়ে কাজ করার অনুমতি দেন।

ওই সময় বরিশালে তাঁর সাংগঠিক দক্ষতার কারণে ছাত্র ফেডারেশন ও কৃষক সমিতির সংগঠন বেশ শক্তিশালী হয়েছিল। এই বছর তিনি ভারুকাঠীর আলী নজির খোন্দকারের মেয়ে মাহমুদাকে সহধর্মিনী করেন। ১৯৪৩-৪৬ সাল পর্যন্ত পার্টি থেকে দায়িত্ব নিয়ে তিনি কৃষক সংগঠনে কাজ করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি শেরেবাংলার নির্বাচনী সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৪৭ সালে তিনি বরিশাল জেলা পার্টির সদস্য ও সংগঠক নির্বাচিত হন।

১৯৪৮ সালে ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই দাবিতে সারাদেশে বিক্ষোভ সমাবেশ ও হরতাল পালিত হয়। এই কর্মসূচির অন্যতম নর্মাতা ছিলেন তিনি। পার্টি থেকে এ সময়ে তাঁর কাজ ছিল_গাজিউল হক, আব্দুল মতিন, শেখ মুজিবুর রহমান, তোহা, ফয়েজসহ বিভিন্ন নেতৃত্বের সাথে যোগাযোগ রাখা ও সমন্বয় সাধন করা। এ কাজ যথাযথভাবে করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। ওই বছর পাকিস্তান সরকার কমিউনিষ্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করে।

এ সময় তিনি আত্মগোপনে যান। সে অবস্থায় পার্টির কাজ চালিয়ে যান। ওই বছর শেষের দিকে তাঁর সাথে পার্টির লাইন পরিবর্তন নিয়ে মনোমালিন্য হয়। অবশ্য পরে তা ঠিক হয়ে যায়। বরিশালে ভাষা আন্দোলনের অগ্রগতিতে তাঁর অবদান অকল্পনীয়।

যা একজন খাঁটি বিপ্লবীর পক্ষে সম্ভব ছিল। ১৯৪৯ সালে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী বরিশালে আওয়ামী মুসলীম লীগ গঠনের জন্য রফিকুল ইসলামের সহযোগীতা নেন। ১৯৫০ সালে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধায়। দাঙ্গা বিরোধী প্রতিরোধ গড়ে তুললো কমিউনিষ্ট পার্টি। এ সময় বরিশালের প্রায় সকল কমিউনিষ্ট নেতাকে সরকার গ্রেফতার করে।

এই দাঙ্গা প্রতিরোধে তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকা অবিস্মরণীয়। ১৯৫১ সালে চাখার ফজলুল হক কলেজে বাংলার অধ্যাপক হিসেবে যুক্ত হন। ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনে তিনি বরিশালে প্রধান সংগঠক হিসেবে নেতৃত্ব দেন। ১৯৫৩ সালে বামপন্থী দল গণতন্ত্রী পার্টি গঠনেও তিনি অবদান রাখেন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে পার্টি মনোনিত প্রার্থীর পক্ষে শত শত ছাত্র ইউনিয়ন নেতাকর্মীকে নিয়ে কাজ করেন।

বরিশালের ৩ টি আসনের পার্থীদের পক্ষে তিনি অক্লান্ত শ্রম দেন। যা শুধু একমাত্র তাঁর পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল। ১৯৫৫ সালে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে পার্টি তাকে মনোনিত করে। তখন সরদার ফজলুল করিম কারাগারে বন্দী ছিলেন। সরদার ফজলুল করিম এমএনএ নির্বাচিত হতে পারলে মুক্তি পাবেন।

তাই রফিকুল ইসলাম নিজে নির্বাচিত না হয়ে সরদারকে নির্বাচিত করালেন। রাজনীতিতে এত বড় ত্যাগ একজন সত্যিকারের কমিউনিষ্টের পক্ষে সম্ভব। ১৯৫৬ সালে বিএম কলেজের অধ্যাপক শ্রী বি.বি ঘোষ অবসর গ্রহণ করলে তার স্থলে রফিকুল ইসলাম অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ১৯৫৭ সালে জাতীয় আদমী পার্টি গঠিত হলে তাকে বরিশাল জেলার সহ-সভাপতি কারা হয়। অবশ্য এতে কাজ করার মত সময় তখন তার ছিল না।

১৯৫৬-৬৮ পর্যন্ত তিনি বৃহত্তর বরিশালে কমিউনিষ্ট পার্টি এবং মেহনতি মানূষের আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। অবশ্য এ কাজে তাঁকে মুকুল সেন, খোকা রায়, নলিনী দাস, নূরুল ইসলাম মুন্সিসহ আরো অনেকে সহয়তা করেন। আইয়ুব শাসনের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন ওই অঞ্চলের স্ফুলিঙ্গ। ১৯৬২ সালে ৬ ফেব্রুয়ারী তার নেতৃত্বে আইয়ুব খান টাউন হলের নামফলক ভেঙ্গে অশ্বিনী কুমার দত্তের নাম স্থাপন করা হয়। ওই বছর শিক্ষা আন্দোলনে তিনি বরিশালের ছাত্রদেরকে সংগঠিত করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

এ সময় পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠি তাকে গ্রেফতার করে। ১৯৬৪ সালে তিনি ন্যাপে কাজ করার সিদান্ত নেন। ১৯৬৫ সালে বিএম কলেজ সরকারী হলে তিনি চাকুরী ছেড়ে দিয়ে আইন পেশায় যুক্ত হন। ১৯৬৬ সালে তিনি মাওলানা ভাসানীর ন্যাপের কাজে আরো সক্রিয় হন। সর্বহারাদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি বরিশালের ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করে তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলেন।

এই আজীবন সংগ্রামী মানুষটি ১৯৬৮ সালের ১ জুলাই মারা যান।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.