অধ্যাপক দারা শামসুদ্দীনকে কোনোদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার বাইরে কোনো পদ-পদবী, রাজনীতি এগুলো সঙ্গে জড়াতে দেখিনি। তিনি ছিলেন শতভাগ শিক্ষক, শতভাগ জ্ঞানপিপাসু, পক্ষপাতবিহীন শতভাগ ছাত্র-ছাত্রীর কল্যাণকামী মানুষ। নিয়মানুবর্তিতা, সততা আর নির্লোভ মানুষের দুর্লভ উদাহরণ। বলাবাহুল্য এজন্যে তিনি আপোষবিহীনও ছিলেন। ভুজংভাজং দিয়ে তাঁকে অন্তত ভোলানো যেতো না।
ভূগোল বিভাগের উৎকৃষ্ট ছাত্র-ছাত্রীর কথা বলতে পারবোনা, তবে আমার মতো মাঝারীমাপের ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁকে যমের মতো ভয় করতাম! সেই ভয় যে এখনো কাটেনি, ঠকঠকিয়ে চলেছে, তা গত শনিবার উপায়ান্তরবিহীন হয়ে স্যারের দু’হাতের ব্যবধানে বসতে গিয়ে আবারো টের পেয়েছি!
পরিস্থিতি এক্কেবারে পানি বানিয়ে দিলেন মীজান ভাই। ভূগোল বিভাগের ১৪তম ব্যাচের ছাত্র। ময়না ভাই আর ছোট কাজল ভাইয়ের পীড়াপীড়িতে তিনি ভূগোল বিভাগে থাকাকালীন এক পরীক্ষায় পৃথিবীর ম্যাপ আঁকা নিয়ে এমন এক গোমর ফাঁস করে দিলেন, সবার হাসতে হাসতে পড়ে যাবার জোগাড়। দারা স্যারের চাপে সেদিন নাকি তিনি একটি প্রশ্নের উত্তর কেটে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। হাসির হুল্লোড় পড়ে যায় রুম জুড়ে।
ভিক্টর গোমেজও ছেড়ে দেবার পাত্র নন, সঙ্গে সঙ্গে ফোড়ন কাটেন,- স্যার, সেই নম্বরটা আজকে তারে ফিরাইয়া দেন প্লীজ!
স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে বারবারই স্যার বলে চলেছিলেন একটি কথা-‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা সবাই-ই শিক্ষার্থী ছিলাম, জীবনের এবং সময়ের। যতোটা না আনুষ্ঠানিক শিক্ষা, তার চাইতে অনেক বেশি অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা আমরা গ্রহণ করেছি প্রাকৃতিক পরিবেশসমৃদ্ধ এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ’ তিনি আরও বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি তাঁর কিছু দায়-দায়িত্বের কথা। তাঁর ভাষায়, ‘অনেক নিয়েছি এখান থেকে, এখন যদি সামর্থ্যের মধ্যে কিছু দিয়ে যেতে পারি!’ তিনি উল্লেখ করেন, জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবার কারণে কয়েকটি নির্দিষ্ট বিভাগে ভর্তি হওয়া দরিদ্র পরিবারের মেধাবী শিক্ষার্থীদের সাহায্যার্থে তিনি কিছু প্রবাসী ছাত্রের সহযোগিতাকে বাস্তবে রূপ দেবার চেষ্টা করছেন। আবেগে আপ্লুত হয়ে বারবার স্মৃতিতাড়িত হয়ে পড়েছিলাম আমরা সবাই।
দুটি ঘন্টার মধ্যে যেন পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটাই, জীবনের সবচেয়ে সোনালী সময়টাই ঘুরপাক খাচ্ছিলো চোখের সামনে।
আমাদের ছোট্ট সেই ঘরোয়া আয়োজনে কোনো বক্তৃতা ছিলো না। ক্ষণে ক্ষণে নানা টুকরো আলোচনা আর হাসির উচ্ছল পরিবেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রান্সক্রিপ্টসংক্রান্ত জটিলতার প্রসঙ্গ তুললেন মুকুল ভাই। বাচ্চু আপা প্রচণ্ড গরমের দিনে ছাত্রদের ‘ফুলস্লিভ’ শার্ট গায়ে চড়িয়ে পরীক্ষা দিতে আসার প্রসঙ্গ তোলেন, জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পুরোনো ‘লাভলেনে’র প্রসঙ্গ উঠতেই বাবুআপা-ময়না ভাইকে খোঁচালেন কেউ কেউ। কে কে জাহাঙ্গীরনগরের ‘জামাই’ আর কে কে ‘বউ’ (ফাহিম ভাইয়ের স্ত্রী) তার বাছাই হলো।
ভূগোলের এক জটিল প্রশ্ন করে বসলো শ্যামল মাহমুদ, ‘প্রতিপাদ স্থান কি?’ ভূগোলবিদদের হারিয়ে দিয়ে সহি উত্তর নিয়ে হাজির হলো পরিসংখ্যানের বিপ্লব। মিলি আপা স্যারকে ধরিয়ে দিলেন, স্যারের আবিষ্কৃত ‘প্রপঞ্চ’ নামক খটোমটো শব্দটাকে ছাত্রছাত্রীরা কি চোখে দেখতো! বিন্দু ক্যাম্পাসে স্যারের বাসায় টিভি দেখতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলো। আর ক্যাম্পাসের পোলা বিপ্লব নাকি সাইকেলে প্যাডেল মারা অবস্থায় স্যারকে রোজ ক্লাশ নিতে আসতে-যেতে দেখেই অবিকল লাল রঙের সাইকেল কিনে ফেললো ক্লাশ টেনে পড়ার সময়! লোটাস ভাই, আলমগীর ভাই, বড় কাজল ভাই, শাহানা আপা, রোজী আপা, হাসিনা আপার চোখে মুখেও যেন কতো কিছুই উকিঁঝুকি দিচ্ছিলো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।