সারারাত বিছানায় গড়াগড়ি করার পর যখন ঘুম নামানোর যুদ্ধে পরাজিত হলাম তখন রাত পাঁচটার দিকে নিয়ে বসলাম হুমায়ুন আহমেদ এর “শ্রাবণ মেঘের দিন” । সাদামাটা আবরণে আবৃত অসাধারণ একটি গল্পের স্রোতে এতটাই মজে গেলাম যে কখন ঘন অন্ধকার রাত কাক-ডাকা ভোর পার হয়ে রোদেলা সকালে পরিণত হয়েছে নিজেও বুঝিনি । অনেকদিন পর আবার সেই বইপড়ার অন্তর্নিহিত আনন্দটা টের পেলাম । শেষরাতের ঘন অন্ধকারের আড়ালে লুকানো সুনসান নীরবতায় গল্পের মাঝে ডুব দেয়ার আনন্দই অন্যরকম ।
বইটা পড়ে অনেকদিন পর একটু লিখার জন্য হাতটা নিশপিশ করছে ।
তাই আজ প্রায় ছয় মাস পর লিখতে বসলাম । জানিনা আগের মতো দিতে পারবো কি না । কথায় আছে অনভ্যাসে বিদ্যা হ্রাস । তাও চেষ্টা করতে দোষের কি ?
একজন লেখক সময়ের সাথে পরিণত হতে থাকেন , তার লেখনী গুছানো ও সাবলীল হতে থাকে । এটাই চলমান সাধারণ নিয়ম ।
কিন্তু হুমায়ুন আহমেদ হেঁটেছেন ঠিক তার উল্টাপথে । তার প্রথমদিকের লেখাগুলি অসাধারণ রকমের সুন্দর ও ঈর্ষনীয় পর্যায়ের গুছানো । তার শঙ্খনীল কারাগার , নন্দিত নরকে এই বইগুলি যারা পড়েছেন , তারা আমার সাথে একমত হবেন । আজ শ্রাবণ মেঘের দিন পড়ে আমার ধারণাটা নতুন করে পাকাপোক্তও হয়েছে । এই বইগুলি পড়লে আমরা খুঁজে পাই তার সত্যিকার লেখক সত্তাকে যা কিনা প্রায় অনুপস্থিত তার শেষদিকের লেখনীতে ।
হুমায়ূন আহমেদের লেখা আমি প্রায় পড়া ছেড়েই দিয়েছিলাম , কারণ তার শেষের দিকের লেখাগুলি আমার কাছে ছিলো শুধুমাত্র কিছু কথাবার্তার সমষ্টি, অগোছালো । যদিয়ও লেখনী ও উপস্থাপন অসাধারণ হওয়ায় পড়তে ভালোই লাগে , সময় বেশ কেটে যায় । কিন্তু সেই লেখা পাঠকের মনে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলতে অক্ষম , পাঠকের চিন্তাধারায় পরিবর্তন আনতে অক্ষম , সারবস্তু বিচারে নিষ্ফল । কিন্তু তার প্রথমদিকের লেখাগুলি পড়লে আমার অবাক লাগে । কিভাবে তিনি অসাধারণ নিপুণতায় পাঠকের আবেগ নিয়ে খেলা করতেন , মানব মনের গহীনের কলকাঠিকে নাড়া দিতেন ।
মনের ভেতর একটি প্রশ্ন খেলা করে । তার লেখার এই আমূল পরিবর্তনের পিছনে দায়ী কে বা কি ? তার ব্যস্ততা কি তবে তার অখণ্ড মনোযোগকে বাধাগ্রস্ত করেছিলো , নাকি ব্যক্তিগত অশান্তি ? আমার ধারনা ব্যস্ততাই মূল , ব্যক্তিগত সমস্যা অণুঘটক হিসাবে হয়তো কাজ করেছে । সময়ের সাথে তার লেখায় মূল পরিবর্তন ছিলও লেখাগুলির শুরু আর শেষের সুরের ভিন্নতায় । এটা তখনই ঘটে যখন লেখক শুধু একটানা লিখতে থাকেন কল্পনার সুসংবদ্ধ সংমিশ্রণ ছাড়াই । একসাথে অনেকগুলি কল্পনা যদি মাথার ভেতর খেলা করে তবে তা দিয়ে আলাদাভাবে কয়েকটি ছোটগল্পের সৃষ্টি সম্ভব , উপন্যাস না ।
উপন্যাসের জন্য লেখককে এর ভেতরে প্রবেশ করতে হয় , কল্পনায় চরিত্রগুলির সাথে দিনরাত খেলা করতে হয় । এর থেকেই সময়ের সাথে তিলে তিলে সৃষ্টি হয় একটি উপন্যাস । এই জন্য দরকার অখণ্ড মনোযোগ , সুতীব্র বাসনা , সৃষ্টিশীল কল্পনা । ব্যস্ততা হয়তো এর প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিলো ।
তার পরেও বলতে আমরা সবাই বাধ্য যে হুমায়ূন আহমেদ আমাদের বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছেন দুহাত ভরে ।
তার লেখনী নতুন ধারার সৃষ্টি করেছে । আমরা পেয়েছি অনেক অমূল্য লেখা , যা আমাদের হাসায় , কাঁদায় , আবেগময় করে তোলে । অসাধারণ কিছু চরিত্র , যারা আমাদের মতো পাঠকদের কল্পনায় খেলা করে । এই অসাধারণ লেখককে তাই অন্তর থেকে জানাই অনেক অনেক ভালোবাসা । ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।