সৃষ্টিশীল
একটু আগে বলছিলেন সাক্ষাৎকার দিতে আপনি পছন্দ করেন না। ঘটনাটি কী?
উইলিয়াম ফকনার : কিছুই না। সাক্ষাৎকার নেওয়ার নাম করে ব্যক্তিগত বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। এতে আমার ভয়াবহ রাগ ধরে। আমার সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দিই।
তা না করে, ব্যক্তিগত বিষয়ে কিছু জানতে চাইলে, মর্জি হলে উত্তর করি, নইলে না। আরেক কথা, নিজের ব্যাপারে কোনো প্রশ্নের জবাব দিলেও একই প্রশ্ন পরের দিন কেউ যদি আমাকে আবার জিজ্ঞেস করেন, তাহলে উত্তর কিন্তু পাল্টে যেতে পারে, অন্য কথা বলব তখন।
ঠিক আছে। একজন লেখক হিসেবে আপনি কেমন? না হয় এ বিষয়েই কথা চলুক।
উইলিয়াম ফকনার : আমার যদি অস্তিত্ব না থাকত, তাহলেও কিছু যেত আসত না, আমার হয়ে হেমিংওয়ে কিংবা দস্তয়েভস্কি লিখে যেতেন।
এখানে একটা নজির হাজির করি। শেক্সপিয়ারের নাটকগুলোর রচয়িতার দাবি তিনজন নাট্যকারের। শেক্সপিয়ার একজন কি তিনজন ছিলেন, এটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, হ্যামলেট, অ্যা মিডস্্ সামার নাইটস ড্রিমÑএগুলো কার রচনা বাদ দিই। কেউ একজন লিখেছেন। এই কেউ একজন কিন্তু কিছু নয়, বড় কথা হলো তাঁর সৃষ্টিকর্ম।
শেক্সপিয়ার, বালজাক, হোমারÑসবাই প্রায় একই বিষয় নিয়ে লিখেছেন। তাঁরা যদি এক হাজার কি দুই হাজার বছর বেঁচে থাকতেন, তাহলে প্রকাশকেরা আর কারও কোনো লেখা ছাপারই প্রয়োজন বোধ করতেন না।
এ বিষয়ে বলার খুব বেশি কিছু না থাকলেও লেখকের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য কি
খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়?
উইলিয়াম ফকনার : হ্যাঁ, লেখকের নিজের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের পরিচর্যা করা প্রত্যেক লেখকের জন্য বড় দায়। তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির মধ্য দিয়েই নিজেকে তুলে ধরা জরুরি।
আপনার সমসাময়িক সাহিত্য কর্মগুলো?
উইলিয়াম ফকনার : আমরা সবাই স্বপ্নের যথাযথ মিলনে ব্যর্থ মনোরথ। অতএব, অসম্ভবের পিছে ছুটতে গিয়ে আমাদের ব্যর্থতাকে তুল্যমূল্য ধরেই সবার রেট ঠিক করি। মনে হয়, আমি এ সময়ের মধ্যে যত সাহিত্য রচনা করেছি, সেগুলো আরেক দফা যদি লিখতে পারতাম, তাহলে উৎকর্ষ লাভ হতো, সেগুলো আরও উৎকৃষ্ট সাহিত্যকর্ম হতো, যা যে কোনো লেখকের জন্যই সুখকর। একজন লেখক তাঁর কলম চালিয়ে যান, বারবার লেখেন, এর কারণ তিনি সেই উত্তুঙ্গের সঙ্গ লাভের স্বপ্ন দেখেন। একজন লেখকের সব সময়ই মনে হয়, এবার উৎকৃষ্টতম লেখাটা ঝরাবে তাঁর কলম।
ফলে অতৃপ্তি রয়ে যায়। এই অতৃপ্তি কিন্তু লেখকের জন্য স্বাস্থ্যকর। কারণ একবার নিজের সৃষ্টিকর্ম নিয়ে তৃপ্ত হয়ে পড়লে, তাঁর স্বপ্নগুলো পূরণ হয়ে গেলে, সব শেষ; এ দশা গলাকেটে আত্মহত্যা করার মতো। আমি নিজে একজন ব্যর্থ কবি। হবে হয়তো, প্রত্যেক ঔপন্যাসিকই প্রথমে কবিতা লেখেন, এ কাজে ব্যর্থ হয়ে পরে গল্প লেখা শুরু করেন।
কবিতার পরই গল্পের স্থান। গল্প লিখতে গিয়ে ব্যর্থ হলে শেষমেশ তিনি উপন্যাস লিখতে বসেন।
ভালো ঔপন্যাসিক হওয়ার জন্য কোনো ফর্মুলা আছে কি?
উইলিয়াম ফকনার : নিরানব্বই ভাগ প্রতিভা, নিরানব্বই ভাগ নিয়মানুবর্তিতা...নিরানব্বই ভাগ নিরলস লিখে যাওয়া। একজন লেখক তাঁর সৃষ্টিকর্মে তুষ্ট হবেন না, এটাই নিশ্চিত। একজন লেখক যতটা ভালো করে লিখবেন বলে আশা করেন, তিনি ততটা সফল হবেন না।
যত দূর ভালো করা যায়, লেখকের স্বপ্ন, চাওয়া এর থেকে বহু দূর রয়ে যায়। আমি বলি কি, তোমার সমসাময়িক কিংবা পূর্ব প্রজন্মের লিখিয়েদের চেয়ে শ্রেয়তর লেখা লিখতে হবে এই নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো দরকার নেই। কারণ একজন লেখক কর্মদানবতাড়িত এক সত্ত্বা। তিনি নিজের কাজ নিয়েই সব সময় ব্যস্ত। অতএব, বিস্ময় প্রকাশের সময়ও তাঁর হাতে নেই।
নিজের সাহিত্যকর্ম চালিয়ে যাওয়ার জন্য চুরি, ডাকাতি, ভিক্ষাবৃত্তি, ঋণ করা কোনো কিছুকেই নীতিবিবর্জিত কাজ মনে করবেন না তিনি।
এর মানে আপনি বলছেন, একজন লেখক হয়ে উঠবেন একেবারে নির্মম?
উইলিয়াম ফকনার : একজন লেখক শুধু তাঁর শিল্পকর্মের কাছেই দায়বদ্ধ। তিনি যদি ভালো লেখক হন, তাহলে পুরোমাত্রায় নির্দয় হবেন। কারণ তাঁর আছে স্বপ্ন। আর এই স্বপ্ন তাঁকে এত বেশি মানসিক যন্ত্রণা দেয় যে এর হাত থেকে নিস্তার পেতে তিনি মরিয়া হয়ে ওঠেন।
এর আগমুহূর্ত পর্যন্ত শান্তি নেই তাঁর। সম্মান, গর্ব, নিরাপত্তা আর সুখ সবকিছুই আবর্তিত হয় তাঁর লেখাকে ঘিরে। যদি একজন লেখককে তাঁর মায়ের কাছ থেকে ডাকাতি করতে হয়, দ্বিধা করবেন না তিনি।
একজন লেখকের জন্য কোন পরিবেশ সবচেয়ে সহায়ক?
উইলিয়াম ফকনার : শিল্পচর্চার সঙ্গে পরিবেশের কোনো যোগসাজশ নেই, আমি এ ধরনের প্রশ্নকে পাত্তা দিই না। এ প্রশ্ন যদি আমাকেই করে থাক, তো বলি, আমার জন্য সবচেয়ে ভালো চাকরি হতো পতিতালয়ের ভূ-স্বামীর কাজ।
এখান থেকে আমি পেতাম, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা; এখানে আমি ভয় ও ক্ষুধা মুক্ত; আমার মাথার ওপর আছে ছাদ, দায়-দায়িত্ব বলতে খুব একটা নেই। কিছু অর্থ নেব মুঠিতে, মাসে একবার তা স্থানীয় পুলিশের পকেটে চালান করে দেব, ব্যস্। সকালে আমার রাজ্য নিরিবিলি। তখন সাহিত্যকর্মের জন্য দারুণ অনুকূল পরিবেশ। আমি চাইলে বিকেলে সামাজিকতার দৌড়ঝাঁপ করতে পারি, এতে সমাজে আমার জন্য একটা ইজ্জতদার পাটাতন তৈরি হবে।
আমার করার মতো খুব একটা কাজ নেই। আমার চারপাশে গিজগিজ করবে নারীরা। আমিই এখানে একমাত্র পুরুষ। আমাকে কেন্দ্র করেই ঘুরপাক খাবে সবাই; তারা আমাকে স্যার বলে সম্বোধন করবে। আর আমি কিনা পুলিশকে ডাকব ডাকনাম ধরে।
তাহলে ঘটনা দাঁড়াচ্ছে, যাকে বলে শান্তি, নির্জনতা আর চিত্তবিনোদন, এ সব পেতে খুব একটা কাঠখড় পোড়াতে হয় না। অন্যদিকে, প্রতিকূল পরিবেশে বেচারি লেখকের রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে, দুশ্চিন্তা তাঁর বেশির ভাগ সময়ই গ্রাস করতে পারে।
আমার অভিজ্ঞতা বলে, সাহিত্যসৃষ্টির জন্য চাই কাগজ, কলম, খাবার, তামাক আর সামান্য হুইস্কি।
আপনার চাই বাবান, তাই না?
উইলিয়াম ফকনার : না। এত কড়া হুইস্কি আমার লাগে না।
স্কচ্্ হলেই ভালো।
অর্থনৈতিক স্বাধীনতার কথা বলেছেন, একজন লেখকের জন্য এর দরকার আছে কি?
উইলিয়াম ফকনার : না, একজন লেখকের জন্য অর্থনৈতিক স্বাধীনতার আদৌ দরকার নেই। লেখকের চাই কাগজ আর কলম। অর্থবিত্ত কাউকে ভালো লেখা উপহার দিয়েছে বলে আমার অন্তত জানা নেই। মহৎ লেখকেরা কোনো স্থাপনা গড়ায় ব্যস্ত নন।
তাঁরা ব্যস্ত লেখা নিয়ে। সময় নেই, অর্থ নেই, এ সব দোহাই দিয়ে যে লেখক নিজেকে বোকা বানাতে চান, ধরে নিতে হবে তিনি প্রথম সারির লেখক নন। মহৎ লেখা উঠে আসতে পারে চৌর্যবৃত্তি থেকে, কর ফাঁকির কারবারি থেকে কিংবা ঘোড়াকে শপাং শপাং চাবুক মারার দৃশ্য থেকে। মানুষেরা সত্যি দুর্ভোগ আর দারিদ্র্যের মুখ দেখতে ভয় পায়। তাঁরা কতটা কষ্টসহিষ্ণু এই দৃশ্য দেখতে গিয়ে আঁতকে ওঠে।
একজন মহৎ লেখককে কোনো কিছুই ধ্বংস করতে পারে না। একমাত্র মৃত্যুই পারে তাঁকে স্তব্ধ করে দিতে। আর কিছুই না। সাফল্য লাভ কিংবা টাকা কামানোর চিন্তা করার মতো সময় কোনো মহৎ লেখকের থাকে না। সাফল্য লিঙ্গে স্ত্রীজাতীয়, সে রমণীর মতো; তুমি যদি তার সামনে যবুথবু হয়ে পড়, তাহলে সে তোমার ঘাড়ে চড়বে।
অতএব, তাকে তোমার হাতের উল্টো পিঠ দেখানোই যুক্তিযুক্ত। হতেও পারে, তখন সে হামাগুড়ি দিয়ে চলবে।
চলচ্চিত্রের জন্য কাজ করা কি আপনার লেখালেখিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে?
উইলিয়াম ফকনার : প্রথম সারির কোনো লেখককে কোনো কিছুই আহত কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে না। আর তিনি প্রথম সারির লেখক না হলে, কোনো কিছুই তাঁর খুব একটা কাজে আসে না। কারণ তিনি ইতিমধ্যেই তাঁর হৃদয় বিক্রি করে দিয়েছেন সুইমিংপুলে।
চলচ্চিত্রের জন্য লিখলে কি কোনো লেখক আপস করেন?
উইলিয়াম ফকনার : সব সময়ই, কারণ চলচ্চিত্রের চরিত্রটাই হচ্ছে সহযোগিতার আর সহযোগিতা মানেই আপসÑযাকে বলে গিভ অ্যান্ড টেক।
আপনি বলছেন চলচ্চিত্রে কাজ করতে গিয়ে লেখকদের কম্প্রমাইজ করা লাগে। একজন লেখকের লেখালেখি সম্পর্কে আপনার মত কী? পাঠকদের কাছে তাঁর কি কোনো দায়বদ্ধতা আছে?
উইলিয়াম ফকনার : লেখকের দায়বদ্ধতা তাঁর সাহিত্যকর্মের কাছে, সর্বোৎকৃষ্ট সাহিত্য সৃষ্টিই তাঁর দায়; এ কাজে তিনি নিজে যেভাবে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন সে পথই বেছে নেবেন। আমি নিজের কাজ নিয়ে এতটা ব্যস্ত থাকি যে, পাঠকদের সম্পর্কে মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ পাই না। কে আমার লেখা পড়ছে, না পড়ছে, এ ব্যাপারে মাথা ঘামানোর সময় আমার হাতে নেই।
আমার কিংবা অন্য কোনো লেখকের লেখা সম্পর্কে জন দো কী মন্তব্য করলেন, আমি গ্রাহ্যেই আনি না। আমার লেখার একটা স্ট্যান্ডার্ড আছে, আমি ওই উচ্চতায় লেখাটাকে নিয়ে যেতে সচেষ্ট হই; ওল্ড টেস্টামেন্ট পড়ার সময় আমার মনে যে অনুভূতি খেলা করে, আমার নিজের লেখাও ওইরকম প্রশান্তি বয়ে আনলে, আমি ধরে নিই আমার সাহিত্যকর্ম কাক্সিক্ষত স্ট্যান্ডার্ডে পৌঁছেছে। আর আমি ঠিক তখনই ভালো বোধ করি। প্রসন্ন চিত্ত হই। একটা পাখি দেখার যে আনন্দ, তা লাভ করি।
পুনর্জন্মে আমার আস্থা থাকত যদি, তাহলে কী হতে চাইতাম, জানো? বাজপাখি। প্রখর দৃষ্টির এই পাখিটিকে কেউ ঘৃণা কিংবা ঈর্ষা করে না, তাকে কেউ চায় না, কারও প্রয়োজন নেই। পাখিটিরও কাউকে নিয়ে মাথাব্যথা নেই। বিরক্ত উদ্বেগ করে না সে, বিপদগ্রস্তও নয়, খেতে পারে যখন যা ইচ্ছে।
আপনার লেখার স্ট্যান্ডার্ডে পৌঁছাতে আপনি কী ধরনের টেকনিক অবলম্বন করেন?
উইলিয়াম ফকনার : কোনো লেখকের লেখার কৌশল নিয়ে কেউ খুব আগ্রহী হয়ে উঠলে তাঁকে বরং অস্ত্রোপচার কিংবা ইটের গাঁথুনির কাজে লাগিয়ে দাও।
সাহিত্যসৃষ্টিতে কারিগরিবিদ্যার অবকাশ নেই, এ ক্ষেত্রে সোজা রাস্তা বলে কিছু নেই। একজন নবীন লেখক থিওরি অনুসরণ করতে গেলে, নিজেকে বোকা বানাবে। নবীন লেখককে শিক্ষা নিতে হবে নিজের ভুল থেকে; যেখানে ঠেকবে সেখান থেকেই শিখবে সে। লোকজন তা-ই করে। মহৎ কোনো লেখক বিশ্বাস করেন, তাঁকে উপদেশ দেওয়ার মতো এত ভালো ওস্তাদ কোথাও নেই।
তিনি নিজেই সর্বেসর্বা। তাঁর আগের প্রজন্মের ভালো লেখকদের প্রতি তাঁর যতই মুগ্ধতা থাকুক না কেন, তাঁদের কাজের প্রশংসা তিনি যতই করুন না কেন, তাঁদের টপকে যেতে চাইবেন তিনি, এটাই স্বাভাবিক।
তাই বলে রচনাকৌশলকে আপনি কি খারিজ করে দেবেন? এর কি কোনো গুরুত্বই নেই?
উইলিয়াম ফকনার : উপায় নেই। মাঝেমধ্যে হয় কি, টেকনিক লেখকের ঘাড়ে সওয়ার হয়, খবরদারি করে, অথচ বেচারা লেখকের তখনো হাত মশকো হয়নি। কোনো পূর্ণ সাহিত্যকর্ম মানেই হলো একের পর এক ইট বসিয়ে একটা ভবন নির্মাণ করার মতো ব্যাপার, লেখক তাঁর কোন শব্দের পর কোনটা বসাবেন, তা আগেভাগে জানেন না।
‘অ্যাজ আই লে ডায়িং’ উপন্যাসটি লিখতে গিয়ে এমন হয়েছে। কাজটা খুব শক্ত ছিল। অথচ কাজটা করার জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের মালমসলা ছিল আমার হাতের মুঠোয়।
আমি একদল লোককে কল্পনা করলামÑবন্যা আর অগ্নিকাণ্ডের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে তাঁদের নিত্য ওঠাবসা। এই প্রাকৃতিক পরিবেশে তাঁদের বেঁচে থাকার লড়াই চলে নিরন্তর।
এই যে চিন্তা করলাম, এখন টেকনিক বাধ না সাধলে, লেখা ঋজু ভঙ্গিতে এগিয়ে যাবে, সহজ হবে। কারণ আমার সঙ্গে সব সময়ই একটা বই থাকে, যাতে চরিত্রগুলো নিজেরাই বিকশিত হয় এবং পরিপূর্ণতা লাভের মধ্য দিয়ে কাজটা শেষ করে। ধরি, কোনো একটা বইয়ের ২৭৫ পৃষ্ঠা লিখলাম। আমি কিন্তু আগে থেকেই জানতাম না বইটাকে ২৭৪ পৃষ্ঠায় শেষ করে দিলে তাতে কী ঘটত। একজন বড় মাপের লেখকের সেই গুণ থাকা জরুরি, যা দিয়ে তিনি বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিকোণ থেকে নিজের কাজকে বিচার করবেন, নিজের লেখা নিয়ে গদগদভাব থাকবে না তাঁর।
এই সততা ও সাহস তাঁর অবশ্যই থাকা চাই। আমার কোনো সাহিত্যকর্ম আমার নিজস্ব স্ট্যান্ডার্ডে পৌঁছাল কি না, আমি এ বিচার করি ওই লেখাটি আমাকে মর্মপীড়া আর শোকগ্রস্ত করে কি না, তা থেকে। একজন মা কী করেন, তাঁর সাধু ছেলের চেয়ে চোর কিংবা খুনি ছেলেটাকেই বেশি ভালোবাসেন।
কোন উপন্যাসের কথা বলছেন?
উইলিয়াম ফকনার : ‘দ্য সাউন্ড অ্যান্ড দ্য ফিউরি’ উপন্যাসটি আমি পাঁচবার লিখেছি। আখ্যান বলার চেষ্টা করেছি।
তীব্র মানসিক কষ্টের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার স্বপ্ন পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমি অনবরত লিখে গিয়েছি। দুই নারীর হারিয়ে যাওয়ার বিয়োগান্তক আখ্যান : নিখোঁজ সেই দুই নারী হলো ক্যাডি ও তাঁর মেয়ে। ডিলসে আমার পছন্দের চরিত্রগুলোর একটি। কারণ সে খুব সাহসী, সৎ, উদার ও নম্র-ভদ্র। ও কিন্তু আমার চেয়েও সাহসী, সৎ ও উদার।
উপন্যাসটির শুরু হলো কীভাবে?
উইলিয়াম ফকনার : মানসিক একটা চিত্র ফুটিয়ে তোলার মধ্য দিয়ে উপন্যাসটির যাত্রা শুরু। তখন আমি বুঝতে পারিনি, ব্যাপারটা ছিল প্রতীকী। চিত্রটা এ রকম : একটা ছোট্ট মেয়ে নাশপাতিগাছের ডালে আস্তানা গেড়েছে, তার প্যান্ট কাদায় মাখানো। নাশপাতিগাছের ওই আশ্রয়স্থল থেকে সে পাতার ফাঁক দিয়ে দেখছে অদূরে পোড়ানো হচ্ছে তার ঠাকুরমাকে। ওইখান থেকে সে কান পেতে শোনে, নিচে মাটিতে তার ভাইদের কপালে কী জুটেছিল।
ততক্ষণে তাঁদের পরিচিতি তুলে ধরি। তাঁরা কী করছিল, সে বর্ণনা দিই। মেয়েটির প্যান্ট কী করে কাদায় মাখল, তা-ও বর্ণনা করি। আমার মনে হলো, এত সব ঘটনা একটা ছোট গল্পে ঠাঁই দেওয়া হবে অসম্ভব ব্যাপার। এ জন্য একটা আস্ত বই-ই লিখতে হবে আমাকে।
তখনই কর্দমাক্ত প্যান্টের প্রতীকী তাৎপর্য আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে ওঠে। পিতৃ-মাতৃহীন একটা মেয়ে, তার একমাত্র আশ্রয়স্থল থেকে যেখানে কেউ তাকে স্নেহ করত না, বুঝতে চাইত না, ভালোবাসত না, ড্রেনের পাইপ বেয়ে পালিয়ে এল। আমি ওই গল্পটা বলছিলাম ওই ঘর পালানো মেয়েটার দৃষ্টিকোণ থেকেই। আমার মনে হয়েছিল, ঘটনাগুলোর সে-ই ভুক্তভোগী; অতএব তার মুখ থেকে গল্পটা বেরোলে বিষয়টি হবে অনেক বেশি জীবন্ত ও হৃদয়স্পর্শী। আমি লক্ষ করলাম, সে সময় গল্পটা আর বলা হয়ে ওঠেনি।
পরে একই গল্প অন্য একটা ভাইয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে বলার চেষ্টা করি। তখনো তা হয়ে ওঠেনি। তৃতীয় দফায় অন্য ভাইয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনার বর্ণনা দিতে চেষ্টা করি। তখনো অসম্পূর্ণ ঠেকল। একপর্যায়ে তিন টুকরাকে একত্রে জোড়া দিই।
নিজে মুখপাত্রের দায়িত্ব নিয়ে ফাঁকফোকর ভরিয়ে তুলি। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, উপন্যাসটা প্রকাশের ১৫ বছর পরও আমার মনে হলো, যে গল্পটা বলতে চেয়েছিলাম, তা আজও বলা হয়নি। এরপর অন্য একটা উপন্যাসের নির্ঘণ্ট তৈরি করতে গিয়ে ওই গল্পটা বলার চিন্তা আবার আমার মাথায় চাগার দিয়ে ওঠে। মনের শান্তি ফিরিয়ে আনতেই কলম ধরি। তখন উপন্যাসটাকে অনুভব করি স্নেহের উৎকৃষ্টতম কোনো আখ্যান হিসেবে।
আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি, কঠোর পরিশ্রম গেছে। এর পরও মনে হয়, বলার মতো করে বলতে পারিনি, আবারও চেষ্টা করে দেখতে পারি, তখনো হয়তো ব্যর্থতা সার হবে।
একজন ছুতার যেমন হাতুড়ি ধার করতে পারে, একজন শিল্পীও তেমনি খ্রিষ্টীয় রূপককে শুধু একটা যন্ত্রের মতো তাঁর সাহিত্যকর্মে কাজে লাগাতে পারে, পারে না কি?
উইলিয়াম ফকনার : আমরা যে ছুতারের কথা বলছি, তাঁর কিন্তু হাতুড়ি ধার করতে হয় না। খ্রিষ্টানত্ব শব্দটার অর্থের দিক বিবেচনা করলে দেখা যায়, আমরা কেউ এর বাইরে নই। এটা কোনো ব্যক্তির একান্ত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ব্যবহারের কোড, যেটার সাহায্যে নিজেকে তিনি শ্রেষ্ঠতর করে তোলেন।
অথচ তাঁর প্রকৃতি হয়তো ভিন্ন। সেই প্রবণতা ও প্রকৃতিকে ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে জয় করেন তিনি। প্রতীক যাই হোক, ক্রস কিংবা অন্য কিছু, ওই প্রতীক তাঁকে মানুষের সমাজে তাঁর কর্তব্য সম্পর্কে মনে করিয়ে দেয়। এর বিভিন্ন রূপক তাঁকে ধরিয়ে দেয়, তিনি নিজেকে কী হিসেবে গণ্য করেন আর প্রকৃত অর্থে তিনি কীÑএই দুইয়ের মধ্যের ফারাক। এটা গণিতের পাঠ্যবইয়ের মতো নয় যে বলে দেবে, হে মানুষ, এভাবে ভালো হবে তুমি।
রূপক বরং নিজেকে আবিষ্কার করার পথ দেখিয়ে দেয়, তাঁর মধ্যে নৈতিক কোডের বিকাশ ঘটায়। এ সবই কিন্তু করে অগাণিতিক প্রক্রিয়ায়, দুঃখ-কষ্ট, ত্যাগ আর আশাবাদের অঙ্গীকারের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে। লেখকেরা সব সময়ই তাঁদের সাহিত্যকর্মে, গণিতহীন রূপকের ব্যবহার করে নৈতিক স্বজ্ঞানতার কথা বলে গেছেন, ভবিষ্যতেও লেখকেরা এমনটিই করে যেতে থাকবেন। রূপক কখনো অঙ্কের নিয়ম মেনে চলে না। চলবে না।
আপনার দ্য ওয়াইল্ড পামস উপন্যাসে দুটো পরস্পরবিরোধী থিমকে একত্রে উপস্থাপনা কি কোনো প্রতীকী তাৎপর্য বহন করার জন্য? কোনো কোনো সমালোচক বলেন, এ এক ধরনের সৌন্দর্যতত্ত্বের ঘুটমিশেল। নাকি বিশৃঙ্খলতাজনিত কারণে দুই থিমকে এভাবে একই উপন্যাসে ঠাঁই দেওয়া?
উইলিয়াম ফকনার : না না। ওটা একটাই উপাখ্যান। ক্যারলোতে রিতেন মিয়ের এবং হ্যারি উইলবার্নের প্রেমের গল্প। প্রেমের জন্য ওরা সব ত্যাগ করে অথচ একসময় প্রেমও তাদের ছেড়ে চলে যায়।
উপন্যাসটা লেখা শুরুর আগে আমি টেরই পাইনি, দুটি ভিন্ন উপাখ্যান সেখানে গলাগলি করে থাকতে পারে। দ্য ওয়াইল্ড পামস উপন্যাসের প্রথম অধ্যায় লিখলাম। হঠাৎ মনে হলো, কী যেন কী মিস করেছি। তখন সংগীতের সুর মিশ্রণের মতো এদেরও একসঙ্গে গাঁথার তাগিদ অনুভব করি।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ওপর কতটা ভিত্তি করে আপনি লিখেন?
উইলিয়াম ফকনার : বলতে পারব না।
বিষয়টা এভাবে আমি কখনো ভেবে দেখিনি। কারণ লেখালেখিতে অভিজ্ঞতা কতটা চালান হলো, তা বড় কথা নয়। একজন লিখিয়ের তিনটি বড় সম্পদ হলোÑঅভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ আর তাঁর কল্পনাশক্তি। এর যেকোনো দুটি, কখনো একটিÑঅন্য সব কিছুর শূন্যতাকে পূর্ণ করে দিতে পারে। আমার ক্ষেত্রে কোনো উপাখ্যান একটামাত্র আইডিয়া, স্মৃতিকথা কিংবা মানসচিত্র থেকে শুরু হয়।
গল্প লেখার ক্ষেত্রে কোন ঘটনা কখন ঘটল, কীভাবে এবং কোথায় ঘটল, এর ব্যাখ্যা দিলেই হয়। একজন লেখক তাঁর সর্বশক্তি দিয়ে ভাষায় সেই ঘটনাকে পাঠকের সামনে বিশ্বাসযোগ্য আকারে হাজির করেন। একজন লেখকের পরিপার্শ্ব, যে সম্পর্কে লেখক সম্যক জ্ঞান রাখেন, এ কাজে শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে কাজে দেয়। আমার মনে হয়, মানুষের ইতিহাস ও অভিজ্ঞতায় সর্ব প্রথম ধরা দেওয়ার পর থেকে সংগীতই ভাব প্রকাশের সবচেয়ে সহজতম উপায়। শব্দই আমার ব্রহ্ম, তাই আমি চাইব শব্দের যথাযথ ব্যবহার করে খাঁটি সংগীত যেরকম অনাবিল অনুভূতির জন্ম দেয়, সেরকম উৎকৃষ্টতম উপায়ে আমার ভাব প্রকাশ করতে।
সংগীত সহজে উত্তুঙ্গ ভাবের জন্ম দেয়, এ কথা সত্য, এর পরও আমি নিজেকে প্রকাশ করতে চাই শব্দরাশির মধ্য দিয়ে, আর সেই শব্দপুঞ্জকে সংগীতের মতো কানে শুনতে নয়, বরং আমি পড়তেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করি। শব্দের চেয়ে নৈঃশব্দ্যে আমার আস্থা বেশি। নৈঃশব্দ্যের মধ্য দিয়ে রাশি রাশি শব্দ কোনো ইমেজকে মূর্তিমান করে তোলে। গদ্যে নীরবে বজ্রবিদ্যুৎ হয় আর সংগীত সেখানে প্রাণ প্রতিষ্ঠা পায়।
কিছু পাঠক বলেন, তাঁরা আপনার লেখা বুঝতে পারেন না।
এমনকি দুই-তিনবার পড়েও না। তাঁদের উদ্দেশে আপনার কী কোনো পরামর্শ আছে?
উইলিয়াম ফকনার : চতুর্থবার পড়ে দেখুন।
অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ ও কল্পনাশক্তিকে আপনি লেখকদের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হিসেবে মনে করেন। অনুপ্রেরণাকে কি ওই তালিকায় যোগ করবেন?
উইলিয়াম ফকনার : অনুপ্রেরণা সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না, কারণ অনুপ্রেরণা কী বস্তু, তা বুঝি না। এ বিষয়ে শুনেছি বটে, কখনো নয়নে দেখিনি।
আপনাকে বলা হয় ‘সহিংসতায় আবিষ্ট’ লেখক।
উইলিয়াম ফকনার : এটা কোনো ছুতারকে তাঁর হাতুড়িতে আবিষ্ট বলার মতো শোনাচ্ছে। সহিংসতা বেচারি ছুতারের একটামাত্র যন্ত্রের ডাকনাম। ছুতার কিন্তু একটামাত্র যন্ত্রের ব্যবহার করে কোনো কিছু তৈরি করতে পারেন না, লেখকেরাও তাই।
আপনার লেখক হয়ে ওঠার গল্পটা বলবেন কি?
উইলিয়াম ফকনার : তখন আমি নিউ অরলিন্সে থাকতাম।
সামান্য আয়-রোজগারের জন্য মাঝেমধ্যে টুকটাক কাজ করতাম। একদিন শেরউড অ্যান্ডারসনের সঙ্গে দেখা। এর পর থেকে আমরা বিকেলে শহরে ইতস্তত ঘুরে বেড়াতাম। লোকজনের সঙ্গে কথা বলতাম। সন্ধ্যায় আবার দেখা হতো আমাদের।
দুজনে মিলে তখন এক কিংবা দুই বোতল গিলতাম। অ্যান্ডারসন নেশার ঘোরে কথা বলতেন। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর কথা শুনতাম। রাত একটু বাড়তেই উঠে পড়তেন তিনি। নির্জনে বসে লিখতেন।
পরের দিন আমরা ঠিক একই কাজ করতাম। একদিন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, এই যদি হয় লেখকের জীবনÑঘুরে বেড়াও, মদ পান কর, লোকজনের সঙ্গে কথা বল আর রাত নেমে এলে লেখার টেবিলে বস। তাহলে আমি লেখকই হব। আমার প্রথম বই লিখতে আরম্ভ করে দিলাম। একপর্যায়ে লেখালেখিতে মজা পেয়ে গেলাম এবং মজে গেলাম।
অ্যান্ডারসনের সঙ্গে তুমুল আড্ডা দেওয়ার কথাও তখন আমার মনে আসেনি। এভাবে তিন সপ্তাহ পার। একদিন আমার দরোজার সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি। এই প্রথমবারের মতো এত বড় লেখক শেরউড অ্যান্ডারসন আমার আস্তানায় হাজির। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার সমস্যাটা কী? আমার প্রতি ক্ষেপেছ?’ আমি বললাম, একটা বই লিখছি।
তখন তিনি বললেন, ‘মাই গড’। এই বলেই, ফিরতি মুখে হাঁটা দিলেন। আমি লিখে ফেললাম সোলজার্স পে নামের একটা উপন্যাস। এরপর একদিন পথে মিসেস অ্যান্ডারসনের সঙ্গে দেখা। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, শুনেছি বই লিখছ, তা কী খবর? শেষ করে ফেলেছি, জানালাম তাঁকে।
তিনি বললেন, শেরউড বলেছে, ও নিজে তোমার পাণ্ডুলিপিটা পড়বে। এ ছাড়া ওর প্রকাশককে বলে রাখবে, যাতে ওরা তোমার বইটা প্রকাশ করে। আমি বললাম, ‘লিখে ফেলেছি’। এ ভাবেই আমি লেখক হয়ে উঠি।
‘সামান্য আয়’-এর জন্য তখন আপনি কী ধরনের কাজ করতেন?
উইলিয়াম ফকনার : যাই জুটত।
আমি অনেক কাজ জানতাম, নৌকা চালানো, ঘর রং করা থেকে শুরু করে উড়োজাহাজ চালানো, সবই করতাম। খুব বেশি অর্থের প্রয়োজন ছিল না আমার। তখন নিউ অরলিন্সে সস্তায় জীবন যাপন করা যেত। আমার আহামরি কিছু চাওয়া ছিল না। ঘুমানোর মতো একটা জায়গা, খাবার, তামাক আর হুইস্কি।
তখনকার সময়ে দুই কি তিন দিন করার মতো বহু কাজ পাওয়া যেত। ওই কদিনই কাজ করতাম আমি। বাকি মাসটা এতেই চলে যেত। আমি স্বভাবে আজন্ম বাউণ্ডুলে, ভবঘুরের চূড়ান্ত। আমার খুব বেশি অর্থ চাই না কখনো।
আমার মতে, পৃথিবীতে এত কাজ করাটা লজ্জাকর। মানুষের জন্য বাজেতম ঘটনা হলো, দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ করা এবং দিনের পর দিন তা চালিয়ে যাওয়া। এত সময় ধরে তুমি আর কিছুই করতে পারবে না। রোজ তুমি একনাগাড়ে ৮ ঘণ্টা খেতে পারবে না। পান করতে পারবে না; কিন্তু কাজ করতে পারবে।
সব মানুষ নিজেকে কাজ করার জন্য গড়ে তোলে। আর সে কারণেই প্রত্যেকে এমন রহস্যময় ও অসুখী।
ব্যক্তি শেরউড অ্যান্ডারসনের কাছে আপনার অনেক ঋণ, কিন্তু লেখক হিসেবে তাঁর সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
উইলিয়াম ফকনার : তিনি আমার প্রজন্মের মার্কিন লেখকদের জনক। মার্কিন সাহিত্যের ঐতিহ্যেরও স্থপতি তিনি, যে ঐতিহ্য উত্তর প্রজন্ম ধারণ করবে। অথচ যথার্থ মূল্যায়ন তিনি পাননি কখনো।
ড্রেইজার তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আর মার্ক টোয়েন দু’জনেরই বাপ।
ওই সময়ের ইউরোপের লেখকদের সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
উইলিয়াম ফকনার : আমার প্রজন্মের দুই মহান লেখক হলেন টমাস মান ও জয়েস।
আপনার সমসাময়িক লেখকদের লেখা পড়েন কি?
উইলিয়াম ফকনার : না, যুবক বয়সে আমার যে বইগুলোর সঙ্গে পরিচয় ছিল, যেগুলো তখন ভালোবাসতাম, এখনো ওই বইগুলোই পড়ি। তোমরা পুরোনো বন্ধুর কাছে প্রত্যাবর্তন কর, আমি যাই ওই বইগুলোর কাছে : ওল্ড টেস্টামেন্ট, ডিকেন্স, কনরাড, ডন কুইক্সোটেÑপ্রতি বছর কয়েকবার করে পড়ি। কোনো কোনো লোক যেরকম বারবার বাইবেল পড়ে, সেরকম।
ফ্লবেয়ার, বালজাকÑতিনি অনবদ্য এক সাহিত্যজগৎ সৃষ্টি করেছেন, তাঁর লেখা কুড়িটি গ্রন্থের ভেতর দিয়ে রক্তস্রোত বয়ে যায়Ñদস্তয়েভস্কি, তলস্তয় ও শেক্সপিয়ার। মাঝেমধ্যে, মেলভিলের লেখা পড়ি, কবিদের মধ্যে পড়ি মার্লো, ক্যাম্পিয়ন, জনসন, হেরিক, ডান, কিটস ও শেলির কবিতা। হোসম্যানকে এখনো পড়ি। এঁদের লেখা এত বেশি পড়েছি যে এখন আর প্রথম পাতা থেকে শুরু করে টানা শেষ পর্যন্ত পড়ি না। কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে কয়েক মুহূর্তের কথা বলার মতো, আমি কোনো বইয়ের বিশেষ বিশেষ অংশ পড়ি।
ফ্রয়েড?
উইলিয়াম ফকনার : তখন অরলিন্সে থাকতাম। সবাই ফ্রয়েডের কথা খুব বলত। কিন্তু আমি কখনোই ফ্রয়েড পড়িনি।
রহস্য সিরিজ পড়েন?
উইলিয়াম ফকনার : সিমেননের লেখা পড়ি, পড়তে পড়তে চেখভের কথা মনে পড়ে।
আপনার প্রিয় চরিত্র কোনগুলো?
উইলিয়াম ফকনার : আমার পছন্দের চরিত্রগুলো হলো সারা গ্যাম্পÑনিষ্ঠুর, নির্দয় এক নারী।
মদ্যপ, সুবিধাবাদী, আস্থাহীন, তাঁর চরিত্রের অধিকাংশ দিকই বাজে, এর পরও একটা চরিত্র তো বটে; মিসেস হ্যারিস, ফলস্টাফ, প্রিন্স হল, ডন কুইক্সোটে, আর স্যাঙ্কো তো অবশ্যই। লেডি ম্যাকবেথকে আমি বরাবরই স্বাগত জানাই। পছন্দ করি বাটম, অফেলিয়া এবং মেরকুতিওকে। হাক কিন ও জিমকে নিশ্চয়ই। টম সায়ারকে আমার খুব একটা পছন্দ নয়।
আমি পছন্দ করি সাত লাভিং উড চরিত্রটিকে। নিজের প্রতি এই চরিত্রটির কোনো মোহ নেই, সে জানত যে সে একটা কাপুরুষ; কিন্তু এ নিয়ে তার লজ্জাবোধ ছিল না, তার দুর্ভাগ্যের জন্য কাউকে দায়ী করত না সে। ঈশ্বরকে অভিসম্পাত করত না কখনো।
উপন্যাসের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করবেন কি?
উইলিয়াম ফকনার : আমি কল্পনা করি, লোকজন যত দিন উপন্যাস পড়া অব্যাহত রাখবে, তত দিন এ শাখায় লিখিয়েরাও তাঁদের কলম সচল রাখবেন; যদি না ছবিপ্রধান ম্যাগাজিন আর কমিক ট্রিপস মানুষের পড়ার ক্ষমতাকে বিনষ্ট করে দেয়, সাহিত্যকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় চিত্র দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করার সেই নিয়ান্ডার্থাল যুগের গুহাবাসের দিনগুলোতে।
সমালোচকদের ভূমিকা সম্পর্কে কিছু বলবেন?
উইলিয়াম ফকনার : সমালোচকদের কথা শোনার মতো অবসর একজন শিল্পীর নেই।
যিনি লেখক হতে চান, তিনি সমালোচনা পড়েন; আর যিনি লিখতে চান, তিনি কিন্তু ওই পথ মাড়ান না। সমালোচনা কোনো লেখককে স্পর্শ নাও করতে পারে। লেখকেরা সমালোচকদের ধরা-ছোঁয়ার ঊর্ধ্বে থাকেন। কিন্তু বেচারি সমালোচককেই কিনা লেখকদের দিকে মুখিয়ে থাকতে হয়। লেখকেরা কিছু সৃষ্টি করেন, তো সমালোচক মহাশয় আলোড়িত হন।
সমালোচকের কোনো লেখা হয়তো সবাইকে তাতায়, কিন্তু লেখককে নয়।
আপনার লেখা নিয়ে কারও সঙ্গে আলোচনা করার প্রয়োজন বোধ করেন না কখনো?
উইলিয়াম ফকনার : না, আমি নিজের লেখা নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকি। লেখা হয়ে উঠলে আমার মনে প্রসন্ন ভাব জেগে ওঠে। তাই নিজের লেখা নিয়ে কারও সঙ্গে কখনো আলাপ-সালাপ করার প্রয়োজন বোধ করি না। লেখার পর ভালো না লাগলে, এ ব্যাপারে অন্যের মতামত নিয়ে কোনো কাজ হয় না, এ ভাবে লেখার উৎকর্ষ সম্ভব নয়, বরং নিজেকেই ঘষামাজা করে তা ঠিক করতে হয়।
আমি সাহিত্যিক-টাহিত্যিক নই, সামান্য এক লিখিয়ে।
আপনার উপন্যাসগুলোর কেন্দ্রীয় চরিত্রে রক্তের সম্পর্কীয়েরা রয়েছে বলে সমালোচকেরা দাবি করেন।
উইলিয়াম ফকনার : এই মত নিতান্তই সমালোচকদের, আর বলেছি তো আমি সমালোচনা পড়ি না। আমার সন্দেহ হয়, একজন লেখক গল্পের প্রয়োজন ছাড়া কারও নাকের গড়নের ওপর জোর না দিয়ে রক্তের সম্পর্কের চরিত্রসৃষ্টির কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠবেন। একজন লেখককে মনোযোগী হতে হয় সত্য ও মানুষের হৃদয়ের বিষয়ে।
এর বাইরে আর কোনো কিছুর প্রতি আগ্রহী হওয়ার মতো এত বেহুদা সময় তাঁর থাকে না। সত্যের সঙ্গে আইডিয়া কিংবা বিষয়বস্তুর অতি সামান্যই যোগ রয়েছেÑএ সত্য মেনে নিয়েই বলছি, আইডিয়া কিংবা বিষয়বস্তু এসব নাকের গড়ন কিংবা রক্তের সম্পর্ক ধরনের।
সমালোচকেরা এও বলেন, আপনার সৃষ্ট চরিত্রগুলো কখনো সজ্ঞানে ভালোমন্দের বিচার করে না।
উইলিয়াম ফকনার : ডন কুইক্সোটে সব সময় ভালো আর মন্দের বিচারে ব্যস্ত থাকতেন। কারণ তিনি তখন স্বপ্নের এক রাজ্যে বাস করতেন।
মাথা তাঁর বিগড়ানো থাকত। যখন মানুষের সঙ্গে তাঁকে বুঝতে হতো, তিনি বাস্তব জগতে ফিরে আসতেন। মানুষ মোকাবিলা করতে গিয়ে ভালোমন্দের ফাঁকফোকর খুঁজে বেড়ানোর মতো সময় আর তাঁর থাকল না। মানুষ শুধু জীবদ্দশাতেই বেঁচে থাকে, নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে সবটুকু সময় তাঁকে উৎসর্গ করতে হয়। আর জীবন এক চলমান প্রক্রিয়া, যা মানুষকে চলৎশক্তি সরবরাহ করে।
দেয় উচ্চাকাক্সক্ষা, ক্ষমতা ও আনন্দ। যখন একজন মানুষ নৈতিকতার প্রতি নিবেদিত হয়, তখন চলমান ওই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধস্রোতে তাঁকে বল প্রয়োগ করতে হয়। আজ হোক, কাল হোক, ভালো কি মন্দের একটা পথ বেছে নিতে সে বাধ্য; কারণ আগামীকাল সে নিজেকে জীবিত দেখতে চায়। তাঁর নীতিচেতনা দেবীদের কাছ থেকে পাওয়া এক অভিশাপ। এই চেতনা দিয়ে তাকে সঠিক স্বপ্ন জয় করতে হয়।
শিল্পীর সঙ্গে চলৎশক্তির যোগসাজশের ব্যাপারটা যদি আরেকটু ব্যাখ্যা করতেন।
উইলিয়াম ফকনার : প্রত্যেক শিল্পীর লক্ষ্য হলো গতিশীলতাকে বন্দী করা; এটাই জীবন, কৃত্রিম উপায়ে একে স্থির করে রাখ, যাতে একশো বছর পরে কোনো আগন্তুক এর দিকে তাকালে তা আবার চলতে শুরু করে। মানুষ মরণশীল, তাই তাকে এমন কর্ম করে যেতে হবে, যা তাকে এনে দেবে অমরত্বের আস্বাদ।
ম্যালকম কাউলি বলেছেন, আপনার সৃষ্ট চরিত্রগুলো ভাগ্যের ওপর সমর্পিত।
উইলিয়াম ফকনার : এটা নিতান্তই তাঁর মত।
আমি বলব, আর দশজনের সৃষ্ট চরিত্রের মতোই আমার চরিত্রগুলোর কতগুলো ভাগ্যের ওপর আস্থা রাখে, কতগুলো রাখে না। লাইট ইন অগাস্ট উপন্যাসের লিনা গ্রোভের কথাই ধর না কেন। সে নিজের সঙ্গে নিজেই লড়ে। লুকাস বার্চ তার স্বামী হবে না অন্য কেউÑএ ব্যাপারে পাত্তাই দেয়নি। সে বুঝেছিল তার জীবনে চাই স্বামী, সন্তান।
এ লক্ষ্যে পৌঁছাতে সে কখনো কারও সাহায্য প্রার্থনা করেনি। সে নিজেই তার আত্মার সরদার ছিল। বায়রন বানচ তাকে ধর্ষণ করতে উদ্ধত হলো, সে শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, এ কাজ করে তুমি কি লজ্জিত হবে না? তার কণ্ঠস্বর ছিল দৃপ্ত ও ভয় শূন্য। মুহূর্তের জন্যও কেঁপে ওঠেনি সে, তার মনে দেখা দেয়নি এতটুকু দ্বিধা। কাকুতি-মিনতি করার কথা ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি সে।
অ্যাজ আই লে ডায়িং উপন্যাসের বানড্রেন পরিবারের কথাও বলা যায়। মা মরে যাওয়ার পর বাবা আবার বিয়ের চেষ্টা করছেন। অনিবার্য এক সত্যের মুখে ভদ্রলোক কাজের বুয়াকে বদলালেন। সন্তানদের অবসর বিনোদনের জন্য কিনে আনলেন একটা গ্রামোফোন। অন্তঃসত্ত্বা তারই এক মেয়ের শরীরের অবস্থা তখন খুব খারাপ, তাকেও সাহস দেওয়া হলো।
অবশেষে একটা শিশুর জন্ম দিল সে।
কাউলি আরও বলেছেন, ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সী দরদি চরিত্রগুলো সৃষ্টি করতে আপনার কাছে দুরূহ ঠেকেছে।
উইলিয়াম ফকনার : বিশ থেকে চলি¬শ বছর বয়সী লোকজন দরদি হয় না। একটা শিশুর কোনো কিছু করার ক্ষমতা আছে, এই সত্য সে জানে না। সে তার ক্ষমতা সম্পর্কে যখন জানতে পারে, তখন আর করার কিছুই থাকে না চলি¬শের পরে।
বিশ থেকে চলি¬শ বছর বয়সের মধ্যে শিশুটির বলশালী হয়ে ওঠার ইচ্ছা চাগার দিয়ে ওঠে, বিপজ্জনক রূপ নেয়, শিশুটি কিন্তু তখনো কিছু শিখতে শুরু করেনি। কুড়ি থেকে চলি¬শ বছর বয়সী লোকজনই পৃথিবীতে দুর্ভোগ ডেকে আনে। আমার চারপাশের লোকজন যারা বর্ণে বর্ণে সংঘাত বাধায়Ñমিলামস এবং বায়ান্ট (এমিতটিলের খুনের সঙ্গে জড়িত) এবং নিগ্রোদের ওই গ্যাং, যেটা প্রতিশোধ নিতে একটা শ্বেতাঙ্গিনীর ওপর চড়াও হয়, ধর্ষণ করে তাকে। হিটলার, নেপোলিয়ন, লেনিনÑএ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।