লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ।
দীর্ঘদিন ধরে একটানা লিখে চলেছেন তিনি। একবারও থামেন নি।
ভাবেন নি, পেছনে ফিরে দেখার দরকার আছে। সত্যিই দরকার ছিল না।
লেখায় কমবেশি হয়েছে, “গুণ এবং মানের” উনিশ-বিশ হয়েছে; কিন্তু এমন একদিনও যায় নি, যেদিন তিনি কলম ধরেন নি, অন্তত এক ছত্র লেখেন নি। ভাত খাওয়া, ঘুমানো, প্রাতঃকৃত্য করার মতোই লেখালেখি তাঁর নিত্যদিনের কাজ। শখ নয়, কোন কিছুর তাগিদে নয়, লেখার জন্যই লেখা।
লেখাটা তাঁর কাছে অক্সিজেনের মতো, অজান্তেই যেটা নিয়ে যাচ্ছেন, যেটা না হলেই নয়; অথচ যেটা নিয়ে ভাবার দরকার হচ্ছে না।
তবে লেখার পেছনেও কিছু কথা আছে, যেটা আর কেউ না জানলেও তিনি জানেন।
তাঁর অনেক লেখাই মানুষ পড়েছে। বলেছে, এত সুন্দর কল্পনা তাঁর, এত সুন্দর করে ভাবতে পারেন তিনি! আর এত সুন্দর করে, এত সাবলীল বর্ণনায় একটা ঘটনা বলেন, যেন চোখের সামনেই দেখা যায় ব্যাপারটা। যেন পেন্সিলের একটা সাদামাটা স্কেচকে রংতুলির আঁচড়ে জীবন্ত করে আনা তাঁর কাছে ছেলেখেলা।
বিচিত্র সব বিষয় নিয়ে লিখেছেন তিনি। এমন সব বিষয়, যেটা নিয়ে মানুষ ভাবে, কিন্তু এটা নিয়ে গল্প হতে পারে, তা কেউ আশা করে না। তিনি সেটাই করেছেন, আর করেছেন এত দক্ষভাবে, তাঁর কল্পনাশক্তিকে বাহবা দিতে বাধ্য হয়েছে তারা।
বছরখানেক আগে “নিঃসঙ্গ” নামে একটা বড় গল্প লিখেছিলেন তিনি। একজন একা মানুষকে নিয়ে।
যে কীনা একা থাকতেই ভালোবাসে। তার চিন্তাভাবনা নিয়েই ছিল পুরোটা গল্প। পাঠকেরা বলেছে, একাকীত্ব নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে বটে, কিন্তু তিনি ব্যাপারটাকে নতুন করে তুলে আনতে পেরেছেন।
গল্পটার উৎস কিন্তু তাঁর মগজ নয়, উৎস পাশের বাড়ির নিঃসঙ্গ প্রতিবেশী ভদ্রলোক, যিনি বহুবছর ধরে একা থাকেন। গত আট বছর ধরে দিনের পর দিন তাঁকে দেখতে দেখতে লেখক জেনে গেছেন, তিনি কখন ছড়িটা নিয়ে হাঁটতে বেরুবেন, কখনই বা বাসায় ফিরবেন।
কেমন করে ভাবেন তিনি, তাঁর কর্মকাণ্ড দেখেই আন্দাজ করতে চেষ্টা করেছেন। বড় জানালাটা দিয়ে তিনি যে উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকতেন, তা গল্পের প্লট ভাবতে নয়, এই ভদ্রলোককে পর্যবেক্ষণ করতে। একটু অনধিকার চর্চা হয়েছে বটে, কিন্তু তৈরি হয়ে গেছে চমৎকার একটা গল্প “নিঃসঙ্গ”।
তাঁর “চৌষট্টি কোর্ট” গল্পটি অসাধারণ প্রতিভাবান একজন দাবাড়ুকে নিয়ে। দাবা খেলায় লাগে ধৈর্য, মনসংযোগ।
বুদ্ধিমত্তা যে লাগে, সেটা তো সবাই এক বাক্যে স্বীকার করে। কিন্তু দাবা খেলা নিয়ে গল্প লিখতে কী লাগে, সেটা তাঁর জন্য জানা একটু কঠিনই হতো, যদি না তাঁর দাবাড়ু বন্ধুটির সাথে অনেকগুলো সন্ধ্যা কাটাতেন। তিনি কি জানতেন, দিনের পর দিন তুখোড় বন্ধুটির কাছে হারতে হারতেই জন্ম নেবে “চৌষট্টি কোর্ট”?
তাঁর আরেকটা বড় গল্প আছে। নাম “সবুজ”। অতি সাদামাটা নামের এই গল্পটার ভাবনা তাঁর মাথায় এসেছিল অনেকদিন পর গ্রামে বেড়াতে গিয়ে।
পথে পথে হেঁটে, গাছপালার সত্যিকারের ছায়া কেমন নিজের চোখে দেখে, গায়ে ধুলোবালি মেখে, তাজা সবজির ক্ষেতে দাঁড়িয়ে থেকে, নদীর টলটলে জলে গা ধুয়ে, আমবাগানে তুমুল বৃষ্টিতে ভিজে - তবেই গল্পটা তাঁর কাছে ধরা দিয়েছিল। তিনি যদি কোনদিন গ্রামে না যেতেন, সবুজ না দেখতেন, সারাজীবন কেবল ঘুরে মরতেন শহরের নোংরা ফুটপাতে, তাহলে কী হতো? তাহলে গল্প লিখতেন ঠিকই, কিন্তু গল্পটার নাম হতো “কংক্রিট” অথবা “নর্দমা!”
“বাবার কাছে যাচ্ছি” নামের পিতৃস্নেহের জন্য আকুল একটা ছেলের গল্প তাঁর মাথায় এসেছিলো তখন, যখন তাঁর ছেলেকে লেখাপড়ার জন্য পাঠাতে হয়েছিল বিদেশে। এখনো ছেলেটা চিঠি দেয়, মেইল করে, নববর্ষে আর ঈদে গ্রিটিংস কার্ড পাঠায়, আর তাঁর মনে পড়ে গল্পটার কথা।
তাঁর অনেকদিনের বন্ধু শফিক মারা গেল এই তো সেদিন। তিনি গিয়েছিলেন।
জোয়ান বয়সে একসাথে কত বাঁদরামো করেছেন, আর বয়স ভারী হয়ে গেলে কত সন্ধ্যে গল্প করে কাটিয়েছেন। কত সুন্দর করে ভাবতো মানুষটা, সবকিছু নিয়ে কি পরিষ্কার করে নিজের মতামত জানিয়ে দিত। একদিন শোনা গেল সে আর নেই। তিনি কোনদিন ভাবেন নি যে বন্ধুর বাড়ি যাবেন, অথচ সে কোন সাড়া দেবে না; চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকবে খাটিয়ায়, তাকে কবরস্থ করতে কাঁধ দিতে হবে তাঁকেও।
সেদিন বাড়িতে ফিরে ভারী হৃদয় নিয়ে তিনি লিখেছিলেন “কফিন” গল্পটি।
পাঠক জেনেছে, “কফিন” গল্পটিতে “দুঃখ” ব্যাপারটিকে খুব আয়োজন করে দেখানো হয়েছে; কেউ তো দেখে নি, বন্ধুর স্মৃতিচারণ করতে করতে একজন গল্পটি লিখেছে, গল্পটির পাতায় পাতায় বন্ধুর জন্য বন্ধুর কষ্ট মিশে আছে।
তিনি লেখক হলেও মানুষ। তাঁর পরিবারেও অপ্রীতিকর ব্যাপারগুলো ঘটে। বিচ্ছেদ এবং পুনর্মিলন জাতীয় ব্যাপারগুলো তিনিও স্বচক্ষে দেখেছেন। সম্পত্তির ভাগাভাগি নিয়ে তিনিও কম ছোটাছুটি করেন নি।
কি লজ্জাই না লেগেছে, কি ছোটই না মনে হয়েছে নিজেকে, তারপরও করতে হয়েছে। অন্য কেউ হলে সম্পত্তি বুঝে নিয়েই চুপ থাকতো, কিন্তু তিনি তো লেখক, কাজেই “লেনদেন” নামে একটা গল্প দাঁড় করিয়ে ফেলেছিলেন। রিয়েল লাইফ জোকসের ব্যাপারটা কেউ ধরতে পারে নি। গল্পে তিনি বলেছেন, টাকাপয়সা অতি ভাল জিনিস, একমাত্র টাকার লেনদেনের সময়ই বোঝা যায় কে কেমন!
এক রাতে তিনি ছিলেন তাঁর সুপরিসর অ্যাপার্টমেন্টে একা, আর কেউ নেই। ভূতপ্রেত শহরে বাস করে না, তাদের বাস শ্যাওড়া-হিজল-অশ্বত্থ গাছে, যেসব পাণ্ডববর্জিত গাঁয়ে আজকাল খুঁজতে হয়।
কিন্তু সে রাতে দ্বিপ্রহর পার হবার পর-পরই তাঁর শীত করতে শুরু করলো, তিনি বোধ করলেন, তিনি একা নন, আর কেউ আছে তাঁর ঘরে। হালকা পায়ের আওয়াজ পেতে শুরু করলেন, বাথরুমে ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ার আওয়াজও ভীষণ ভয়ের মনে হল। দুয়েকবার কয়েকটা ছায়াকে জানালা থেকে সরে যেতেও দেখলেন (হয়তো চোখের ভুল)। সময় বুঝে অতৃপ্ত আত্মারা হয়তো হানা দিয়েছিলো লেখকের বাসাতেই।
সে রাতেই তিনি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে কাগজকলম টেনে নিলেন, এবং তৈরি করলেন তাঁর প্রথম ভৌতিক গল্প “নিশুতি”।
বললে কেউ বিশ্বাস করবে না, পুরোটা সময় তিনি বারবার পেছনে তাকিয়েছেন, কেউ তাঁর ঘাড়ের কাছে বিকট মূর্তি ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে কীনা দেখার জন্য। মুখে স্বীকার না করলেও মনে মনে ভূতেদের তিনি এক-আধটা ধন্যবাদ দেন, আজও। ভৌতিক গল্প লেখার সময় ভয়টা নিজেও পেয়েছেন, এমন লেখক বোধহয় খুব বেশী পাওয়া যাবে না। সবাই তো বলে পাঠক আনন্দ পেয়েছে, পাঠক পছন্দ করেছে - কিন্তু লেখকের অনুভূতিরও একটা দিক আছে বৈকি।
তালিকাটা আরও অনেক দীর্ঘ।
ছোট এবং তুচ্ছ কিছু ঘটতে দেখলেই তাঁর মনে হয়েছে, আরে, এটা নিয়ে তো একটা গল্প হয়ে যায়। সুন্দর গল্প। ছোট প্লট, ছিমছাম উপস্থাপনায় ছোট্ট একটা গল্প। কৃপণের মতো তিনি নোটবইতে লিখে রেখেছেন তক্ষুনি, পাছে পরে ভুলে যান। আর একের পর এক লিখে গেছেন গল্প।
নামগুলো সাদামাটা, গল্পগুলোও সাদামাটা, তবে বড় সুন্দর। ব্যক্তিত্বের সংঘাত, মানসিক দ্বন্দ্ব, প্রেম, বিপর্যয় – এ জাতীয় বড় বড় ব্যাপারগুলো তো আছেই, তিনি লিখেছেন কীটপতঙ্গ নিয়ে, একটা মানুষ একটা সামান্য বিষয় নিয়ে চিন্তা করে কীভাবে তা নিয়ে, একটা ছোট বিষয় কীভাবে অনেক বড় করে দেখানো যায় তা নিয়ে। লিখেছেন একটা চিঠি নিয়ে, অশ্রুসজল অপেক্ষা নিয়ে, টিন এজ ছেলেপুলেদের নিয়ে, একটা ছেঁড়া পাঁচ টাকার নোট নিয়ে, হুজুগ নিয়ে, অবসর নিয়ে, মৃত্যু নিয়ে; কখনো আবার জীবন নিয়ে। লোকাল বাসে চিঁড়েচ্যাপটা মানুষটি, কাঁচাবাজারে করল্লার দরদাম করা মানুষটি, নবদম্পতির আবেগ কিংবা প্রবীণের মৃত্যুচিন্তা, জানা এবং অজানা অনুভূতিগুলো – যা মনে এসেছে তার কিছুই বাদ রাখেন নি।
জীবনের বাইরে এবং সংসারের বাইরে যান নি, অথবা যেতে পারেন নি।
আশ্চর্য হয়ে দেখেছেন, তাঁর চিন্তাভাবনা চারপাশটাকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে।
বয়স হয়েছে তাঁর, অনেক অনেক লেখা হয়েছে। কিন্তু মনে হয়, অনেক কিছু নিয়েই লেখা হয় নি। সম্ভব নয়। তবুও তিনি যতটা পেরেছেন, করেছেন।
শুধু পাঠক কখনো জানতে পারলো না, তাঁর সবগুলো গল্পই দেখে লেখা, শুনে লেখা, “জীবন থেকে নেয়া”। কোন গল্পই কল্পনা থেকে তৈরি হয় নি, সবগুলো ঘটনাই তাঁর জীবনে, তাঁর চারপাশে ঘটেছে, তিনি শুধু একটু পালিশ করে, একটু সাজিয়ে-গুছিয়ে পাঠকের পাতে তুলে দিয়েছেন; যাতে করে মনে হয়, এগুলো বাস্তব নয়, গল্প। যাতে করে মনে হয়, তাঁর কল্পনাশক্তি খুব ভাল।
(২৮ জুলাই, ২০১৩)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।