Want to play a game for the game’s own sake…….. যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে,
পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।
অজ্ঞানের অন্ধকারে
আড়ালে ঢাকিছ যারে
তোমার মঙ্গল ঢাকি গড়িছে সে ঘোর ব্যবধান।
রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাটি-ই পড়ার সময় তার নিগূড় অর্থ বুঝতে না পারলেও এই কয়েক’টি লাইনে রবীঠাকুর কি বুঝাতে চেয়েছিলেন তার কিছুটা অনুধাবন করতে পেরেছি কিছুদিন আগে।
গিয়েছিলাম কুমিল্লার এক প্রত্যন্ত গ্রামে। ঢাকার বাইরে কখনো ভ্রমনের উদ্দেশ্য ব্যতিত পা বাড়ানো হয়নি।
তবে এবারের যাত্রা একটু ভিন্ন উদ্দেশ্যে। উদ্দেশ্য খুব বেশি মহৎ না হলেও অন্তত খাটো উদ্দেশ্যের তকমা থেকে নিস্তার দেয়া যায়। ঢাকা থেকে আমরা ছিলাম তিনজন। উদ্দেশ্য-ঐ গ্রামের শিক্ষাবঞ্চিত দরিদ্র শিশুদের কিছু শিক্ষার উপকরন পৌছে দেয়া।
সায়েদাবাদ থেকে সরাসরি রাত নয়টা তিরিশ এ কুমিল্লা বিশ্বরোড।
সেখান থেকে লোকাল বাসের কানেক্টিং ফ্লাইটে এক ঘন্টার পথ। তারপর শুরু করলাম হাটা। গ্রামের অন্ধকার পথের একপাশে বিস্তীর্ন ধান ক্ষেত আর এক পাশে শত শত জোনাকীদের রেখে মাঝ বরাবর পথ চলতে লাগলাম। রাস্তার পাশে বাশঁঝাড় আর সেই বাশঁঝাড়ের ফাকে ফাকে আকাশে লক্ষ তারার মেলা। আনুমানিক প্রায় চল্লিশ মিনিট হাটার পর স্থানীয় একটি বাজারে পৌছলাম।
সেখান থেকে রিক্সায় আমাদের গন্তব্যে। যাত্রার উপাখ্যান এখানেই শেষ।
পরেরদিন টি ছিল শুক্রবার। সকালে বের হলাম ঐ গ্রামে। আমাদের সাথে ছিল গ্রামেটির ই স্থানীয় আরো কয়েকজন।
গ্রামের এ পাড়া ও পাড়া ঘুরে ঘুরে শিক্ষার উপকরন পৌছে দিতে গিয়ে একটি জিনিস খুব ই অবাক করল, অর্থাভাবে নুয়ে পড়া ঘর গুলোর কয়েকটির পরপর ই বাংলো-সদৃশ প্রাসাদ। নিদারুন অন্নকষ্টের জীবন গুলোর পাশেই কি প্রাচুর্যের বসবাস। এই বাড়িগুলোর বেশির ভাগ বাড়িতেই মনে হল কেউ থাকেনা। খোজ নিয়ে জানলাম এই বাড়িরগুলোর মালিকরা বেশিরভাগ ই বিদেশে। বছরে বার কয়েক এসে ঘুরে যায়।
অনেকটা অতি শহুরের গ্রাম দেখা টাইপের। ঘটনাটা একটু মনোকষ্টের কারন হিসেবে আবির্ভুত হল। এদের পাশের ঘরেই স্কুলের ভর্তি ফি মাত্র বিশ টাকার অভাবে বাবা-মায়েরা তার সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করাতে পারছেনা আর এরা গড়ছে লক্ষ টাকার মনুষ্যবিহীন বাড়ি। আমাদের ই একজন বলে উঠল, এরা কখনোই এই সব দরিদ্রদের শিক্ষার প্রসারে সাহায্যের হাত বাড়াবে না তার কারন পাশের ঘরের এই দরিদ্র মানুষগুলোর শিক্ষিত হওয়াটা বাঁধা হয়ে দাড়াতে পারে তাকে শাসন করার সুযোগ লাভে।
খুব ছোটবেলায় বাংলা রচনা “জীবনের লক্ষ্য” পড়তে গিয়ে দেখেছিলাম ক্লাসের বেশিরভাগ শিশুরাই রচনায় লিখেছিল আমি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি ইত্যাদি হয়ে গ্রামে চলে আসব গ্রামের মানুষের সেবায়।
সেই সব ছাত্ররা বড় হয়ে কিছুদিনের জন্য গ্রামে ফিরে আসছে তবে সেটা গ্রামের দরিদ্র মানুষের সেবায় নয়, কিছুদিনের মনোতুষ্টির উদ্দেশ্যে।
তারপর ও গ্রামের এই অতি সাধারন মানুষগুলোর কারো প্রতি কোন অভিযোগ নেই। নেই কোন অভিমান। তাদের প্রত্যেকের ই আকুতি শুধু মাত্র মৌলিক অধিকারটা পাওয়ার, রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানটির যা নিশ্চিত করার কথা ছিল। ।
প্রত্যেকটা ঘরেই মায়েদের একটাই চাওয়া তার সন্তানদের জন্য তিন বেলার ভাত, শিক্ষার অধিকার চাওয়া তো স্পর্ধা।
বাংলাদেশে মোট গ্রামের সংখ্যা আটষট্টি হাজার। আর সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের সূত্র অনুসারে গত চার দশকে প্রায় ষাট হাজারের ওপরে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বা এনজিও নিবন্ধন নিয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে ২৫ হাজার সংস্থার এখন কোনো কাজ নেই বা নিষ্ক্রিয়। তার মানে তারপরও পয়ত্রিশ হাজারের মত এখনো কর্মতৎপর।
সে হিসেবে বাংলাদেশে প্রতি দু’টি গ্রামে একটি এনজিও কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এরপর ও মাত্র বিশ টাকার অভাবে কোন দরিদ্র ঘরের সন্তান যদি স্কুলে ভর্তি হতে না পারে তাহলে ধরে নিতে হবে হয়ত বা এটাই আমাদের নিয়তি। যাই হোক এইসব এনজিও দের ফিরিস্তি তুলে ধরে মোল্লা নাসির উদ্দিনের সেই বিড়ালের গল্পের সাথে বাংলাদেশে্র এইসব এনজিওদের কার্জক্রমকে মেলাতে যাবোনা। মিলিয়েই কি লাভ?
যাই হোক, গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে ঘুরতে ঘুরতে সব জায়গায় ই দেখলাম সব মা-বাবাদের ই অদম্য ইচ্ছা সন্তানদের লেখা-পড়ার সুযোগ দানে। কিন্তু সন্তানদের ক্ষুদাকাতর করুন মুখ গুলো এইসব বাবা-মায়েদের কাছে শিক্ষার চেয়ে বেশি আবেদনময়ী।
তাই প্রতিদিনের রোজগারের সবটাই চলে যায় ওই ক্ষুদার আবেদনে সাড়া দিতে। সন্তানের স্কুলের ফিস, বই-খাতার খরচ বিলাসিতা হিসেবে ভাবতে নিয়তি তাদের কে বাধ্য করেছে।
একযায়গায় এসে দেখি, ছোট্ট একটি মেয়ে, তার বাবা-মা কেউ নেই, নানীর কাছে থাকে। সে স্কুলে পড়ছে এবং ক্লাসে ও তার রোল এক। তার বাবা-মা নেই আর নেই অতিরিক্ত ভাই-বোন।
দু’জনের সংসার বলেই হয়ত নানী এ বাড়ি ও বাড়ি কাজ করে তার একটি নাতনির লেখা-পড়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। কাকৈরতলা গ্রামের একটি পাড়ায় দেখলাম সবচেয়ে দুরবস্থা, গ্রামে যৌতুক ছাড়া কোন বিয়ে হয় না। ওই গ্রামে মানুষ ও সবচেয়ে বেশি তাই ভোটের সময় এই পাড়াটিতেই প্রার্থীদের আনাগোনা সবচেয়ে বেশি । কারন এই পাড়ার মানুষগুলোই নির্ধারন করে কে হবে পরবর্তী চেয়ারম্যান। যদিও তাদের ভাগ্যের নির্ধারক অন্য কেউ।
শুনলাম ওই গ্রামে একজন মাত্র এসএসসি পাস তাও আবার গোল্ডেন এ প্লাস। তার বাড়ি গিয়ে দেখলাম ছোট্ট একটি ঘর তার ভেতর অনেকগুলো ভাই-বোন নিয়ে তাদের সংসার। একপাশে ছোট্ট একটা পড়ার টেবিল। ছেলেটি নিশ্চুপ। বাড়িতে বসার কোন জায়গা না থাকলেও তার মা বাড়িতে অতিথিদের বসার জন্য বার বার অনুরোধ করছে।
সেই অনুরোধটা গ্রিহীত হলে তা সম্পাদনে ব্যর্থতার পূর্ন আভাস তার মধ্যে এক ধরনের অপরাধবোধের ও জন্ম দিয়েছে।
শিক্ষাবঞ্চিত এ মানুষগুলোর অর্থাভাব তাদের শিক্ষা থেকে দূরে ঠেলে দিলেও মানবিক সৌজন্যতার বোধটি এখন ও তাদেরকে ছেড়ে যায় নি। এ শহরের অনেক উচ্চশিক্ষিত মানুষের ই যে বোধটি নেই। একজন অপরিচিত মানুষের সাথে কি ধরনের ব্যবহার করতে হয় ঢাকা শহরের অনেক মানুষের কাছেই যে তা অজানা তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম কিছুদিনপূর্বে ভাড়ার জন্য টু-লেট লাগানো বাসাগুলোতে গিয়ে। বুঝলাম, শিক্ষা এ শহরের মানুষগুলোকে অনেক কিছু দিলেও আবার কিছু জিনিস থেকে বঞ্চিত ও করেছে।
এ প্লাস পাওয়া ছেলেটির সাথে দেখা হওয়ার পর জানতে পারলাম সে দুবাই চলে যাবে কারন উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হওয়ার কিছুদিন পর সে বুঝে নিয়েছে পরিবার কে অভুক্ত রেখে পড়াশুনাটা পাপ। এতক্ষনে বুঝলাম কেন ছেলেটি নিশ্চুপ। যে ছেলেটি পরিবারের চাপ সামলে, নিজেকে অভুক্ত রেখে, অন্ধকার রাতে অভুক্ত ভাই-বোনের ক্ষুদার কান্নাকে পাশ কাটিয়ে সামান্য কুপির আলোয় পড়াশুনা করে গোল্ডেন এ প্লাস পেতে পারে, তার এ প্লাস টিকে অন্য এ প্লাসের সাথে তুলনা করা যে কত বড় ভুল তা ভেবে নিজেই শিউরে উঠলাম। এবার মাধ্যমিক শ্রেনী্তে আমার এ প্লাস টি কে আমার কাছে ভাঁড়ামো মনে হল।
উচ্চমাধ্যমিক শ্রেনীতে পরিসংখ্যান পড়তে গিয়ে ভারযুক্ত গড় নামক এক ধরনের গড়ের অংক করেছিলাম যেখানে প্রত্যেকটি চলকের সাথে তার নিজস্ব ভার যুক্ত করা হয়।
এখন মনে হচ্ছে ঐ ভারযুক্ত গড়ের সাথে ন্যায়-অন্যায়ের এক ধরনের সম্পর্ক আছে। আমার মনে হয় এই সমাজের সব কিছুকেই তার নিজস্ব ভার দিয়ে বিবেচনা করা উচিত। পরকালে স্রষ্টা ঠিক ই ভার দিয়ে সবকিছু হিসাব করবেন। যাকে যে ধরনের সুযোগ সুবিধা দেয়া হবে তার হিসাবটি ও সেরকম হবে। গ্রামের একটি ছেলের অন্নকষ্টের মাঝে পাওয়া এ প্লাস আর শহরের প্রাচুর্যের মাঝে থেকে পাওয়া এ প্লাস কখনো এক হতে পারে না।
যদি সমান ভাবে মূল্যায়ন করা হয় তবে এটি অবিচার।
যাই হোক, এবার শুরুর কথায় ফিরে আসি। রবীন্দ্রনাথ ঐ দুটি লাইনে প্রকৃতির এক অমোঘ বিধানকে ইঙ্গিত করেছেন। আপনি যাকে অজ্ঞানতার অন্ধকারে রেখে ভাবছেন আপনি অনেক উর্ধ্বে আরোহন করেছেন সে কিন্তু আপনাকে নীচে বেধে রাখছে। আপনি যতই আরো উচুতে উঠার চেষ্টা করছেন সে ততই আপনাকে পশ্চাতে টানছে।
এই অসম্ভব প্রতিযোগিতার যুগে আমরা আমাদের অবচেতন মনে ভাবা শুরু করেছি যে পৃথিবীতে আমি শুধু আমার ই জন্য। “আমার ব্যক্তিগত সফলতাই আমার কল্যানের জন্য যথেষ্ঠ”-আমরা যারা এই মন্ত্রে দীক্ষিত তাদের উদ্দেশ্যে বলছি- মানুষ যেহেতু সামাজিক প্রানী তাই সমাজের কোন একটি অংশে ক্ষত সৃষ্টি হলে সেই ক্ষত দ্বারা কম বেশি সবাই ক্ষতিগ্রস্থ হবে। অজ্ঞানতার অন্ধকার আপনার শিক্ষার আলোকে গ্রাস করতে চাইবে, দারিদ্র আপনাকে সংজ্ঞায়িত করবে তৃতীয় বিশ্বের নাগরিক হিসেবে,সাম্রাজ্যবাদীদের নিশানা হবে আপনার দেশ এবং আপনি, দারিদ্রের উপজাত হিসেবে সৃষ্ট অন্যান্য ব্যধি-সন্ত্রাস, ছিনতাই, দস্যুতা ইত্যাদি আপনাকে ও স্পর্শ করবে। সামগ্রিক ব্যর্থতার অভিশাপে আমাদের ব্যক্তিগত সফলতা ধুয়েমুছে যাবে এটি নিশ্চিত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।