আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশের কবিতা : দমকা হাওয়ায় দুলে দুলে ওঠা প্রস্তরনির্মিত সৌধ...

বাংলাদেশের কবিতা : দমকা হাওয়ায় দুলে দুলে ওঠা প্রস্তরনির্মিত সৌধ... ওবায়েদ আকাশ বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির প্রাণস্পন্দনে যে কবিতার অস্তিত্ব অনুভূত হয়Ñ কখনো গীতল, সহজিয়া-মরমিয়া, কখনো আধুনিক কিংবা আধুনিক-উত্তর জটিল জঙ্গমে বিচিত্র পথপরিক্রমায়- সে কবিতা শাশ্বত বাঙালির প্রাণস্পন্দনের মতো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের ধারাবাহিকতায় রূপশালী, মহিমাময়। তাকে সভ্যতার নানান চড়াই-উতরাই থেকে অসংখ্য সমুদ্রের ঢেউ, নদীভাঙনের আগ্রাসী চাঙড়, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো নানা আগ্রাসন, প্রতিবন্ধকতার ভেতর দিয়ে অক্ষত ও পরিবর্তিত শাণিত চেহারায় টিকে থাকতে হয়েছে। পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম ভাষা ‘বাংলা’য় কবিতা লিখে যে সকল কবি মহিমান্বিত হলেন, বিগলিত, চিরঅম্লান হলেন- তাঁদের ধারাবাহিক গল্পগাথা আমাদের যেমন শিহরিত করে, তেমনি তাঁদের সৃষ্টিসম্ভারকে সামনে করে আমরা পৃথিবীর যে কোনো ভাষার কাব্যভূমিকে সমান্তরালে নিয়ে আসার সাহস সঞ্চার করি নির্দ্বিধায়। আর এসব কিছুর ধারাবাহিকতার কনিষ্ঠ সন্তান বাংলাদেশের কবিতা। হিসাবযন্ত্রের সাদা পৃষ্ঠায় বাংলা কবিতার বয়স যেমন হাজার বছর, সে হিসেবে বাংলাদেশের কবিতার বয়স মাত্র চল্লিশ বছর।

বাংলা কবিতার হাজার বছরের আজকের গৌরবময় ইতিহাস সৃষ্টির পেছনে যেমন আরো আত্মক্ষরিত হাজারো বছরের পটভূমি রয়েছে; ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতির চরম ও পরম পরিণতির ছায়াচিহ্ন-অগ্নিভস্ম রয়েছে, সেভাবে হিসাব করলে বাংলাদেশের মাত্র চল্লিশ বছরের কবিতার পশ্চাৎভূমি ঐ একইভাবে বিবেচ্য। তার প্রাচীনতর লোকসংস্কৃতি ও রক্তাক্ত রণবেদনার স্মৃতিচিহ্ন বুকে বয়ে বেড়ানোর মহাইতিহাস। সাতচল্লিশের দেশভাগের সূত্র ধরে অখ- বাংলার পেটে অসি চালনার কীর্তি কিংবা অকীর্তিগাথার মহাপরিণতি আজকের বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গ। বৃহত্তর ভারতভূখ- ও সুবিশাল ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিম-ল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পূর্ববঙ্গের মানুষ কিংবা কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের মনে যে অজানা নতুন স্বপ্ন সঞ্চারণের সুবাতাস বয়ে চলেছিল, অচিরেই পশ্চিম পাকিস্তানের অসাধু মনোবৃত্তি ও সুদূরপ্রসারি মহাপরিকল্পনার ছলনাজালে তা ভেস্তে যেতে শুরু করল। শুরু হলো এই ভূখ-ের মানুষের আত্মানুসন্ধান, আত্মপরিচয় ও অস্তিত্ব সংকটের প্রশ্নে নতুন বিবেচনা।

তাই তাদের প্রথম আঘাতের জবাব দিতে হয় ভাষার প্রশ্নে। প্রাকৃতিক পরিবেশ, জলবায়ু ও অবস্থানগত কারণে আগেও যেমন ছিল, তেমনি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলা ভাষার শ্রী-চেহারা ও ধ্বনি-ব্যঞ্জনায় স্পষ্ট পার্থক্য লক্ষ্যিত হলো এ ভূখন্ডের বাংলা ভাষার, এবং সাহিত্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার প্রয়োগের। আর এ স্পষ্ট পরিবর্তন যাদের হাতে শুরু হলো তারাই আমাদের বাংলাদেশের কবি। সীমিতার্থে এটুকু স্বীকার করে নিলেও, বৃহদার্থে এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, যে কোনো শাসক-শোষক কিংবা রাজরাজড়ার অধীনেই হোক না কেন, এই ভূখ-ের আলো-হাওয়া নিসর্গ-সবুজে মোহিত হয়ে কিংবা শোষকের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে হাজার বছর ধরে যারা লিখেই চলেছেন কবিতা, তারাও আমাদের বাংলাদেশের কবি। সে যদি হয় প্রাচীন, মধ্য কিংবা আধুনিক কালেরÑ তবু তিনি বাংলাদেশের কবি।

বাংলাদেশের কবিতা অকপটেই তাদের ধারাবাহিক ফসলের রূপসম্ভার। আজকের বাংলাদেশের কবিতা তাই হঠাৎ পড়ে পাওয়া কিংবা আকাশ থেকে খসেপড়া নক্ষত্রের সমষ্টিমাত্র নয়। একটি রাষ্ট্রের জন্ম, জন্মের তাৎপর্যবাহী ইতিহাস, পূর্বাপর ঘটনাপরম্পরার অনিবার্যতা, অনিশ্চিত দোদুল্যমানতা কিংবা ঘটনার ধারাবাহিকতার চারিত্র্য দূর থেকে দেখলে আমাদেরকে বিশেষভাবে দিকনির্দেশিত করে। সে কারণে আলোচনার সুবিধার্থে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির জন্মসূত্রের অনিবার্যতায় ঘটে যাওয়া ঘটনাসমূহের সময়কালকে নির্দেশনাসূচক ধরে বাংলাদেশের কবিতার ইতিবৃত্তান্ত বিবেচিত হওয়াই কাম্য। যুগসন্ধিক্ষণের গুমোট সময়টি নানা অস্থিরতায় কাটিয়ে মধ্যযুগের কাব্যের সোনালি সময়ের সুদূর প্রান্তিকে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত যে নতুন কব্যভাষা নির্মাণ করে সাড়া ফেলেছিলেন, কিংবা কিছুটা রঙ্গলাল সেনÑ আমরা মেনে নিয়েছি যে, সেটাই ছিল আমাদের আধুনিকতার প্রথম স্বরক্ষেপন।

তারপর কবিতার বিশাল মহীরুহ হিসেবে রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব আধুনিক-অনাধুনিকতার দ্বন্দ্বে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হলেও একথা সর্বজনগ্রাহ্য হয়েছে যে, তাঁর মতো এমন চিরআধুনিক কবি পৃথিবীতে আর ক’জনকেই বা খুঁজে পাওয়া যায়! কী কবিতা কী গান কী উপন্যাস-ছোটগল্পে রবীন্দ্রনাথের আধুনিকতা আজ যেন শাশ্বতকালের আজ্ঞাবাহী। সম্প্রতি একটি বেসরকারী টেলিভিশন সাক্ষাতকারে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ের প্রভাবশালী ও সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক সেই পুরনো কথাটাকেই নতুন করে মর্মে ঢুকিয়ে দিলেন যে, রবীন্দ্রনাথ যদি এই বাংলাদেশে বারবার না আসতেন, এই বাংলার নিসর্গ-প্রকৃতিতে বিমুগ্ধ হয়ে দীর্ঘদিন অবস্থান না করতেন, তাহলে তিনি কখনোই আজকের রবীন্দ্রনাথ হতে পারতেন না। এই পদ্মা এই লালন তাঁকে আজকের রবীন্দ্রনাথ করে তুলেছে। একই কথা প্রযোজ্য কবি মাইকেল মধুসূদনের বেলায়। সুতরাং হাজার বছরের বাংলা কবিতার একান্ত প্রাণসম্পদে, হৃৎপি-ের ওঠানামায় এই বাংলাদেশ ভূখ-ের ভূমিকা প্রিয় জননীর স্নেহাশ্রয়ের মতো অনিবার্য সত্য।

এই বাংলাদেশকে একান্ত নিজের মতো করে বুকের কাছে, শিয়রের পাশে, নিঃশ্বাসের পাশে পেতে কত নদী সরোবরে কতভাবেই না বাংলা কবিতাকে সাম্পান চালাতে হয়েছে। কত রক্ত কত সম্মান কত দীর্ঘশ্বাসের ইতিহাস রচনা করতে হয়েছে। ‘বাংলাদেশের কবিতা মানেই বাংলা কবিতা’, এই আত্মপরিচয়টুকু দেবারও অবকাশ ছিল না এই ভূখ-ের কবিতার। একাত্তরের রক্তাক্ত বিজয়ের পরই বাংলাদেশের কবিতা তার সত্যিকারের আইডেন্টিটি খুঁজে পেয়েছে। আজ ভৌগোলিক বিচারে বাংলাভাষী ব্যাপক অংশের বাংলা কবিতাই বাংলাদেশের কবিতা বলে মহিমান্বিত হয়, সম্মানিত হয়, আত্মপরিচয় খুঁজে পেয়ে গৌরবান্বিত হয়।

হাজার বছরেরও আগে থেকে বাঙালি কবি-সাহিত্যিক-সংস্কৃতিপিপাসু সবাই আমরা অখ- বাংলার দাবিতে সোচ্চার রয়েছি। তারই ধারাবাহিকতায় দেখতে চেয়েছি বাঙালির একটিই ‘দেশ’। বংলা ভাষাকে যেমন খ- বিখ- করা যায় না, তেমনি বাংলাভাষী কাউকেই আমরা সীমান্তের কাঁটাতার দিয়ে বিভাজিত দেখতে চাইনি। এক দেশ এক ভাষা এক সংস্কৃতির বাসিন্দা হবার দাবি আমাদের আজো বহমান। আজো আমরা সেদিনের প্রতীক্ষায় আছি যে, আমরা একদিন প্রাণভরে বলতে পারবো যে “বাংলা কবিতা মানেই বাংলাদেশের কবিতা”।

একই দেশের একই ভাষার কবিতা হবে ‘বাংলা’-কবিতা, ‘বাংলা’-দেশের কবিতাÑ এ স্বপ্ন আমাদের চিরজাগরূক। যেভাবে ভাগ হয়নি নজরুল কিংবা রবীন্দ্রনাথÑ সেভাবে বাংলাকেও আমরা ভাগ না-হওয়াদের পক্ষে দেখতে চেয়েছি। রবীন্দ্রনাথ যেমন দুই বাংলার সমন্বয়ে রবীন্দ্রনাথ, যেভাবে আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের কবি; নজরুল যেমন পশ্চিমবঙ্গে জন্মগ্রহণ করেও আমাদের জাতীয় কবি, আমাদের বিদ্রোহের কবি, আমাদের তারুণ্যের কবিÑ তেমনি আজকের বাংলা কবিতা হবে অখ- ‘বাংলা’-দেশের কবিতাÑ এতটুকু দাবি বাঙালির খুব বেশি নয়। দেশভাগোত্তর এই ভূ-খন্ডের কবি সাহিত্যিক শিল্পী বুদ্ধিজীবী রাজনীতিক পেশাজীবীসহ সকল দেশপ্রেমিক জনগণ যখন আশা ও স্বপ্নভঙ্গের মহাবিবরে নিপতিত, এবং দেশভাগের মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় ভাষা আন্দোলনের মতো একটি রক্তাক্ত যুদ্ধের মুখোমুখি হতে হলো, তখনই প্রথম পূর্ব পাকিস্তানের অসাম্প্রদায়িক বাঙালি সমাজ নিজেদের অধিকার আদায় ও রক্ষার্থে সোচ্চার হতে শুরু করে। জান মান মাল সবকিছুকেই তারা স্বকীয় তাৎপর্যের মূল্যে মূল্যায়িত করতে শুরু করে।

আর সেই টালমাটাল কিংবা উন্মাতাল আশাভঙ্গের ষড়যন্ত্র ও পাকিস্তানের পরিষ্কার ছলনাজাল বাঙালি কবিদের বিশেষভাবে সোচ্চার করেছিল। এবং দেশ ভাগ ও দেশভাগোত্তর ভাষা আন্দোলনের সুদূরপ্রসারি পেক্ষাপটে আলোড়িত হয়ে এই ভূ-খন্ডের কবিরা নির্মাণ করেন তাদের স্ব স্ব স্বরভাষা। শুরুতেই এমনসব ভয়াবহ ঘটনাপরম্পরায় কবিরা তাঁদের সূক্ষ্ম ও সংবেদনশীল মন আর স্থির রাখতে না পেরে অনুপ্রবেশ করেন ঘটনার গভীর থেকে গভীরে। আর তারই সব সহযাত্রী বাংলাদেশের চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের কবিরা। এক দশক আগের ও পরিণত ভাষার কবি বলে চল্লিশের দশকের কবিদের কাছে প্রত্যাশা বেশি থাকলেও আহসান হাবীব, জসীম উদ্দীন, সৈয়দ আলী আহসান, আবুল হোসেন, ফররুখ আহমদ প্রমুখ কবি বাঙালির তাৎক্ষণিক প্রত্যাশা সঠিকভাবে পূরণ করতে পারেননি।

উপরন্তু সৈয়দ আলী আহসান, ফররুখ আহমদের চেতনায় পাকিস্তান ও পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদে প্রেম-সমর্থনে কবিদের কাছ থেকেও বাঙালিকে প্রবঞ্চিত হতে হয়। তাই পঞ্চাশের কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীকেই লিখতে হলো ভাষা আন্দোলনের প্রথম কবিতা, “কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি” কিংবা কিংবদন্তির কথা বলতে হলো পঞ্চাশের কবি আবু জাফর ওয়ায়দুল্লাহকে। তবে চল্লিশের দশকের এসব কবির কাব্যশক্তি কিংবা কবিপ্রতিভাকে হেলায় তুচ্ছ করার কোনোই সুযোগ ছিল না। জসীম উদ্দীন গ্রাম-বাংলার সহজ-সরল মানুষের নিজস্ব মাঠঘাটপ্রকৃতিকে অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় কণ্ঠে তুলে দিয়ে, কিংবা বাঙালি সংস্কৃতির পালাপার্বণ, আখ্যান, বিচ্ছেদ-বিরহ-প্রেমকে কবিতায় ধারণ করে হয়ে যান পল্লী-বিস্তৃত বাংলার একমাত্র ‘পল্লী কবি’। খ্যাতি পান রাখাল বালক থেকে পল্লী বালা, পল্লী বধূর প্রাণের কবি হিসেবে।

আবার আবুল হোসেন, আহসান হাবীব প্রমুখ কবি কলকাতাকেন্দ্রিক তিরিশীয় কাব্যান্দোলনে প্রভাবিত হয়ে কবিতায় রবীন্দ্রোত্তর আধুনিকতার সুর ঝংকৃত করতে প্রয়াসী হন। সৈয়দ আলী আহসানও কবিতায় নতুন ফর্ম, নতুন বিন্যাস, প্রচলিত ছন্দকে ভেঙে কবিতায় গদ্য ফর্ম উপস্থাপনের কাজটির পাশাপাশি বাঙালিকে অনেক বিদেশী কবির কবিতার আস্বাদ দেন অসংখ্য অনুবাদকর্মের মাধ্যমে। ফররুফ আহমদের রোমান্টিক চেতনায়ও আপ্লুত হয়েছেন সমঝদার পাঠক। চল্লিশের কবিদের মধ্যে বর্তমানে একমাত্র জীবিত কবি আবুল হোসেন তাঁর সময়ের থেকে অগ্রসর ভাষায় কবিতা লিখে চলেছেন এখনো। তাঁদের এই অর্জন-বিসর্জনের পাল্লা ভারি কিংবা হাল্কা যাই ধরা হোক না কেন, পঞ্চাশের দশকের একঝাঁক শক্তিমান কবি ভাষা অন্দোলনপরবর্তী বাংলাদেশের কবিতাকে বহুদূর পৌঁছে দেবার মানসেই যে প্রস্তুতি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন তা তাঁদের যাত্রারম্ভেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

একদিকে তাঁদের কৈশোর থেকে যৌবনের আরম্ভেই ছুঁয়ে যাওয়া ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের অন্তিম হাওয়ার ঝাপট, দেশভাগ ও ভাষা আন্দোলনের মতো ঐতিহাসিক ঘটনা পরম্পরা তপ্ত হৃদয়ে হানে তীব্র অভিঘাত, অন্যদিকে প্রকৃত কবিতার দাবি পূরণে তিরিশীয় কাব্যান্দোলনের ব্যাপক ওলটপালটে আধুনিকতার দৌর্দ- দাপট তরুণ কবিমনে ব্যাপক ভাঙচুর থেকে নতুনতর স্বপ্নে বিভোর করে তোলে। আবার একদিকে তিরিশীয় ‘বিশ্বমন্দা’ থেকে বিশ্বকবিতায় হতাশা, বিষাদ ও আত্মধ্বংসী প্রবণতাগুলো তাঁদের কলমে মৃদু-তীব্র শিলাখ-ের মতো বর্ষিত হতে দেখা যায়। এ সময়ে কবিতা লিখতে শুরু করেনÑ জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, কায়সুল হক, সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদ, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, মাহবুব উল আলম চৌধুরী, আবুবকর সিদ্দিক, বেলাল চৌধুরী, শহীদ কাদরী প্রমুখ কবি। এই সময়ের কবিদের প্রায় সবাই রবীন্দ্রপরবর্তী আধুনিকতা কিংবা পঞ্চপা-বের (জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সুধীনন্দ্রনাথ দত্ত, অমীয় চক্রবর্তী) বিশেষ করে জীবনান্দীয় কাব্যভাষায় বিকশিত হতে সচেষ্ট হন। কেউ কেউ অবশ্য কাজী নজরুল ইসলামের বাঁধভাঙা তারুণ্যের উচ্চারণেও প্রকম্পিত হয়েছেন।

এ যাত্রায় একসঙ্গে অনেকের পদধ্বনি স্পষ্ট হলেও শেষাবধি কবি শামসুর রাহমন ও সৈয়দ শামসুল হক অতিদ্রুতই বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ কবি হয়ে ওঠেন। তাদের কবিতার বৈচিত্র্য, ভাষা ও বক্তব্যে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, মুক্তচিন্তা তথা প্রগতিশীল চিন্তাচেতনা, ভাষার স্বকীয়তা, শক্তিমত্ততা ও পরবর্তীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক ব্যাপক লেখালেখি তাদেরকে বাঙালির খুব কাছের কবি করে তোলে। আর একজন নিজস্ব ভাষার কবি বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর শুরু থেকেই সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও এক অগ্রসর ভাষায় কবিতা লিখে চলেছেন। এখনো পর্যন্ত তাঁর কবিতা ভাষা ও উপস্থাপনার তারুণ্যে সমকালীন যে কোনো প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ কবিকেও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। জীবনের এই পড়ন্ত সময়ে এসেও এমন অসামান্য ও অপ্রতিদ্বন্দ্বি কাব্যভাষায় কবিতা লিখবার ক্ষমতা নিঃসন্দেহে যে কারো জন্যই ঈর্ষণীয়।

অন্যদিকে আরেক শক্তিমান কবি আল মাহমুদ লোকজ ভাষা, লোকঐতিহ্য ও বাংলার গ্রামগ্রামান্তরের লোকমিথ, লোক-আচার-রীতি তথা ব্যাপক লোক-উপাদানের ব্যবহারে বাংলা কবিতায় মৌলিক ও নতুনতর মাত্রা সংযোজন করে ব্যাপক নন্দিত হলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তিনি স্বাধীনতার শত্রু, তথা দেশদ্রোহী, পাকিস্তানী দালাল, আলবদর রাজাকারদের সঙ্গে সহমত পোষণ করে ভয়ঙ্কর বিভ্রান্তি ছড়িয়ে বিতর্কিত হন। এতবড় কাব্যপ্রতিভাকে প্রতিক্রিয়াশীলতার দুর্গন্ধ শিবিরে আশ্রয় দিয়ে তার ব্যাপক পাঠক সমাজে হতাশার বীজ ছড়িয়ে দেন। এখনো পর্যন্ত তার এই বিতর্কিত অবস্থান তার কবিতা তথা অসংখ্য রচনায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একজন কবি যখন তার দেশপ্রেমের বিপরীতে দেশদ্রোহী দালালদের সঙ্গে রাজনৈতিক ঐকমত্য পোষণ করে জীবন কাটিয়ে দেন এবং তার এমন পরিণতির জন্য তার অর্থনৈতিক অবস্থার মতো তুচ্ছ বিষয়কে দায়ী করে আত্মপক্ষ সমর্থন করেন, এবং তার অর্থনৈতিক স্বাবলম্বনের দিনেও ঐ পথ থেকে এতটুকু বিচ্যুত হন না, তখন কবিতায় তার দেশপ্রেম-প্রকৃতিপ্রেম-লোকপ্রেম এক ধরনের রসিকতা ছাড়া অন্য কোনো কিছুই ভাবার কোনো অবকাশ থাকে না। বর্তমান বাংলাদেশে স্বাধীনতার সেইসব পরাজিত শক্তি ও প্রগতিশীলতার মুখোশপরিহিত সমাজে আল মাহমুদকে নিয়ে টানাহেঁচড়ার নির্লজ্জ ধরনে কেবলই লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে আসে।

পঞ্চাশের কবি জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, বেলাল চৌধুরীসহ অন্যরা তাঁদের স্ব স্ব কাব্যভাষায় এখনো কমবেশি কবিতা লেখার পাশাপাশি রাজনৈতিক কলাম ও জার্নাল লেখালেখিতেই বেশি মনোযোগী। কেউ কেউ তো লিখছেন সরবেই। এরা প্রত্যেকেই দেশপ্রেম, মুক্তচিন্তা, অসাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনায় তাঁদের কবিসত্তাকে অবিচল রেখে ব্যাপৃত হয়েছেন সাহিত্যের আরো নানান শাখায়। আরেক কবি শহীদ কাদরী তাঁর প্রথম তিনটি কাব্যগ্রন্থে কবিতার অপার শক্তিমত্তা প্রদর্শন শেষে এখন মার্কিন মুল্লুকে বসে অসুস্থ জীবনযাপন করছেন। বুকভরা দেশপ্রেম আর বাংলাদেশের প্রতি প্রবল আকুতি তাঁর রোগশয্যায় ছটফট করে।

মাঝেসাঝে লিখেও ফেলেন দু’চার পঙ্ক্তি কিংবা সম্পূর্ণ কবিতাও। এই করে করে তিন দশক পেরিয়ে সম্প্রতি একটি কাব্যগ্রন্থও প্রকাশ করেছেন। সদ্য বিভাজিত দেশে, সারকথা সুদূর প্রসারী কোনো পরিকল্পনার ফলস্বরূপ হিন্দু মুসলমানের বিভক্তির ফলে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু আর পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের যখন নতুন স্বপ্নে বিভোর হবার ক্ষণÑ তখনই পাকিস্তানের অভ্যন্তরে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছেÑ শুরু হলো আত্মপরিচয় অনুসন্ধানের প্রথম অধ্যায়। ভাষা আন্দোলনেই স্পষ্ট হয়ে গেল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অসম ও সম্পূর্ণ বিপরীত আদর্শের রূপরেখা। ষাটের দশকের কবিদের শৈশব ও কৈশোরে দেখা অভিজ্ঞতাকে মর্মে নিয়ে একদিন মনের অজান্তে ঢুকে পড়তে দেখা যায় কবিতার শাশ্বত সৌন্দর্য সাধনায়।

তাদের প্রথমেই আত্মসচেতন হতে হয় শৈশব-কৈশোরের অভিজ্ঞতায় ঝলসানো শব্দভান্ডারে । কেন দেশ ভাগ, কেন গোপন ষড়যন্ত্রের জাঁতাকলে ভাগ্যবিড়ম্বিত বাঙালির ভবিতব্য, কেনইবা দুই হাজার মাইল দূরত্বের দুই পাকিস্তানকে এক করবার অপপ্রয়াস, পূর্বপাকিস্তানের ভবিষ্যৎ জুড়ে কেন এই অনিশ্চয়তার ফাঁকা ধ্বনি, এখন কী-ইবা করণীয় বাঙালি অধ্যুষিত এই ভূ-খন্ডের মানুষের, কেন নায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে এত বাধা-বিড়ম্বনার শিকার হতে হচ্ছেÑ এই সব অনিবার্য প্রশ্ন সমুচ্চয় যারপরনাই খামচে ধরে ষাটের দশকে কবিতা লিখতে আসা একঝাঁক মেধাবী তরুণকে। তাঁরা প্রথমেই এমন সব প্রশ্নের মুখোমুখি হন যে, তাঁরা কেন, জাতি হিসাবে কী হবে তাঁদের প্রকৃত পরিচয়, স্বজাতির মধ্যেই কেন বিভেদ বৈষম্যের চোরাজাল, তাঁদের আত্মপরিচয়ের সঠিক সংজ্ঞা নিরূপণে কেনইবা এত আলোছায়া, মেঘরৌদ্রের লুকোচুরি খেলা! এবং এসব জিজ্ঞাসা থেকেই ষাটের কবিরা আত্মআবিষ্কার ও আত্মসম্মানবোধ নিয়ে নিজেদের সঠিক পরিচয় রচনা করতে শেখেন। শেখেন কবিতায়, রাজপথে, বিবৃতিতে, ঘরে-বাইরে, অন্তরে। এ সময়ে কবিতা লিখে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টিকারী কবিদের মধ্যে অন্যতমÑ কবি রফিক আজাদ, হুমায়ুন আজাদ, আবুল হাসান, মহাদেব সাহা, আবদুল মান্নান সৈয়দ, মোহাম্মদ রফিক, সিকদার আমিনুল হক, মুহম্মদ নূরুল হুদা, নির্মলেন্দু গুণ, আবু কায়সার, আলতাফ হোসেন, রুবী রহমান, রবিউল হুসাইন, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, অরুণাভ সরকার, অসীম সাহা প্রমুখ।

এঁদের মধ্যে কবি রফিক আজাদ, আবুল হাসান, আবদুল মান্নান সৈয়দ, সিকদার আমিনুল হক, মোহাম্মদ রফিক, আবু কায়সারসহ অনেকেই প্রকৃত বা বিশুদ্ধ কবিতার ভূমিতে স্বকীয় অবস্থান নির্মাণে স্থিত হন। নির্মলেন্দু গুণ বক্তৃতা-বিবৃতি-স্লোগানধর্মিতায় তাঁর কবিতার স্বভূমি নির্মাণ করে আলোচিত হন। মহাদেব সাহা প্রেম-প্রকৃতি ও ভাষার সারল্যে অনেক বেশি আমজনতার কবি হয়ে ওঠেন। কলকাতাকেন্দ্রিক তিরিশের দশকের কাব্যান্দোলন যেমন বাংলা কবিতার অঙ্গনে একটি যুগান্তকারী সংযোজন, কিংবা আধুনিক কাব্যান্দোলনের সবচেয়ে গতিময় প্রবাহ সৃষ্টিকারী দুর্দান্ত প্রয়াস, তেমনি বাংলাদেশের ষাটের দশকের কাব্যান্দোলন ছিল তিরিশীয় ধারাবাহিকতার একটি ছায়াসদৃশ কাব্যান্দোলনের ব্যাপক উন্মাদনা সৃষ্টিকারী উল্লম্ফন। এসময়ের কবিতা তাই একদিকে যেমন অনেক বেশি বোহেমীয় কিংবা ব্রাত্য জীবনধারার পরিণামদর্শী, অন্যদিকে অবক্ষয়, আত্মবিনাশী, অসরলীকৃত জীবনযাপনের ভেতর থেকে তুলে আনা বিষাদ, বিগ্রহ ও আত্মপ্রবঞ্চনার ভাষ্যরূপ।

ঊনসত্তরের গণআন্দোলন ও একাত্তরের রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পূর্বাপর তাৎপর্যবাহী ঘটনাসমূহ পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের কবিচৈতন্যকে অবিশ্বাস্য রকম আন্দোলিত করে। তাই এসকল আন্দোলন-সংগ্রামকে কেন্দ্র করে সমগ্র সত্তরের দশক জুড়েই তাদের কবিতার অন্যতম বিষয় হয়ে যায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ তথা নতুন দেশ, নতুন স্বপ্নের বাস্তবায়নের অনন্য অভিজ্ঞতা । এবং তা স্থিত হতে না হতেই পঁচাত্তরে স্বাধীনতার রূপকার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকা- ও দেশদ্রোহী অপশক্তির হাতে ক্ষমতা চলে যাওয়ায়, আবার স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, এবং সুযোগে একের পর এক সেনাশাসন ও স্বৈরশাসনে ক্ষতবিক্ষত সদ্যস্বাধীন দেশে সৃষ্টি হয় সীমাহীন শূন্যতার। যে শূন্যতা আবারও খামচে দেয় পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের কবিচিত্ত। উসকে দেয় সেসময়ের সক্রিয় যে কোনো কবিচৈতন্য।

তাঁরা রচনা করেন অসংখ্য কবিতা-উপন্যাস-নাটক। এইসব অগ্রজ অভিজ্ঞতার নির্যাস নিয়ে সত্তরের দশকে আবির্ভূত তরুণ ও অপরিণত কবিহৃদয় একদিকে যেমন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, অন্যদিকে দেশ গঠন ও দেশের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি, সামরিক ও স্বৈরশাসনের ষড়যন্ত্রের শিকার স্বাধীন ভূমিকে বাঁচানোর অভিপ্রায়ে হয়ে ওঠে সোচ্চারকণ্ঠ। সে বিবেচনায় সত্তরে এসে পূর্ববর্তী দশকেরও কবিকণ্ঠ সমকালীন কবিদের সঙ্গে স্বর মিলিয়ে হয়ে ওঠে প্রতিবাদী ও স্লোগান-বিবৃতিধর্মী। সত্তরের সদ্য তরুণ কবিরা তখন “আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই”-এর মতো চেতনায় শাণিত হয়ে অব্যাহত রাখেন তাঁদের দুর্মর সৃষ্টিশীলতা। এসময়ের কবিদের কবিতায় বিশুদ্ধ কবিতা কিংবা প্রকৃত কবিতার আস্বাদ খোঁজা তাই বাতুলতা মাত্র।

তবে তাঁদের অনেক কবিই আশির দশকে এসে বহুবিচিত্র অভিজ্ঞতা ও স্বকীয় ভাষার শিল্পকুশলতা কবিতায় ফুটিতে তুলতে সচেষ্ট হন। এ সময়ের উল্লেখযোগ্য কবিরা হলেনÑ ময়ুখ চৌধুরী, মাসুদুজ্জামান, মোহাম্মদ আবদুল আওয়াল, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, নুরুন্নাহার শিরীন, দাউদ হায়দার, শিহাব সরকার, কামাল চৌধুরী, ফারুক মাহমুদ, আবু হাসান শাহরিয়ার, আবিদ আনোয়ার, মুহম্মদ সবুর, মুজিবুল হক কবির, মিনার মনসুর, আবিদ আজাদ, জাহিদ হায়দার, আবদুর রাজ্জাক, তসলিমা নাসরিন, ইকবাল হাসান, ত্রিদিব দস্তিদার, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, শামীম আজাদ, হাসান হাফিজ, অঞ্জনা সাহা প্রমুখ। সময়ান্তরে এঁদের বেশিরভাগ কবির কবিতা স্লোগান ও বিবৃতিধর্মিতা কাটিয়ে প্রকৃত ও বিশুদ্ধ কবিতার নিভৃত ভাষায় অনুরণন সৃষ্টিতে সমর্থ হয়। এ সময়ের কবিদের মধ্যে এখনো পর্যন্ত যারা তাঁদের লেখনী সচল রেখেছেন, কিংবা লিখছেন অল্প-বিস্তর তাঁদের মধ্যে খুব কমসংখ্যক কবিই নিজের সময়কে অতিক্রম করে কিংবা নিজেকে, সমকালীন কাব্যভাষার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে আছেন। তবে এ সময়ের কবিদের অর্জন-বিসর্জন যাই হোক না কেন, নতুন দেশের কিংবা ‘বাংলাদেশের’ প্রারম্ভ দশকের বা প্রথম দশকের কবি হিসেবে তাঁদের আবির্ভাব ও কাব্যানুশীলন অবশ্যই পূর্ববর্তী অন্যান্য দশকের চেয়ে তাৎপর্যবাহী।

ৎ মুষ্টিমেয় কেউ কেউ বলেন কলকাতায় যেমন তিরিশের দশক তেমনি বাংলাদেশে ষাটের দশকের উন্মাতাল সময় পেরিয়ে আশির দশকে এসে বাংলাদেশের কবিতা তার নিজস্ব আইডেন্টিটি আবিষ্কারে সচেষ্ট হয়। এ সময়ের বাংলাদেশের কবিতা অনেক বেশি নিজস্ব কিংবা স্বতন্ত্র বা নতুনত্ব নিয়ে, কিংবা কবিতায় নতুন ভাষা, নতুন বোধ, নতুন অহং সৃষ্টিতে পারদর্শী হয়। কিন্তু ট্যোটাল বিশ শতকের বাংলা কবিতার ধারাবাহিকতায় নিবিষ্টচিত্ত হলে কিংবা নিবিড় পাঠে মগ্ন কোনো কবি বা সমালোচক বা কবিতা-বোদ্ধার এ কথা মেনে নেবার কোনো যৌক্তিকতা দেখি না। এ দশকের কবিতাকে নিছক তিরিশ পঞ্চাশ কিংবা ষাট সত্তরেরই ধারাবাহিকতা ভিন্ন অন্য কিছুই যে স্বীকার করে নেয়া দুরূহ, এমন বক্তব্যকে আশির কবিরা কোন শক্তিমত্তা দিয়ে খ-ন করবেনÑ ভেবে দেখবার বিষয়। কারণ আশির দশকের যে কাব্যভাষা তার চর্চা ষাট ও সত্তরের দশকের কোনো কোনো কবি ব্যাপকভাবেই করেছেন।

আঙ্গিক, বোধ ও প্রকরণে যতটুকু সূক্ষ্ম ব্যবধান খুঁজে পাওয়া যাবে তা সময়ান্তরে ঘটে না যাওয়াটাই বরং অস্বাভাবিক। একটু পেছনে ফিরে তাকালেই কি আমাদের ভাবনায় ফেলে দেয় না যে ষাটের দশকের সিকদার আমিনুল হক, রফিক আজাদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আবুল হাসান কিংবা আরো কেউ কেউ যে ভাষায় ও বিন্যাসে অনুশীলন করেছেনÑ আশির দশকের অনেক কবিই তাঁদের কাব্যচিন্তার স্তরকে ততটুকু গভীরে পৌঁছাতেই পারেননি। কিংবা সত্তরের দশকের অনেক কবির কবিতাকেও সে স্তরে এনে একই কথা বলা যেতে পারে। তবে আশির দশকের নিরন্তর স্বৈর ও শামরিক শাসন, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির আস্ফালন, অসাম্প্রদায়িক ও স্বাধীনতার চেতনায় রচিত বাংলাদেশের সংবিধানে কাঁচিচালনা, স্বাধীনতার পরাজিত শক্তির আস্ফালন, অধিক মাত্রায় ধর্ম ও মৌলবাদী রাজনীতির চর্চায় অতিষ্ঠ এ সময়ের কবিরা খুব দৃপ্ত পদচারণায়ই তাঁদের আবির্ভাবকে জানান দিয়েছিলেন। অসংখ্য মেধাবী তরুণ এ সময়ে কাব্যচর্চা শুরু করেন।

তাঁদের সবচেয়ে বড় অর্জনের কথা বলতে গেলেÑ লিটলম্যাগকেন্দ্রিক কাব্যচর্চাই ছিল তাঁদের কমিটমেন্ট রক্ষার মূল প্রতিপাদ্য। সাহিত্যকে পণ্য করে তোলার বিপরীতে, বাজারী সাহিত্য, জনপ্রিয় সাহিত্য, পাঠক নন্দিত সাহিত্যস্রোতের বিপরীতে, কিংবা সকল প্রকার প্রাতিষ্ঠানিকতার বিপরীতে লিটল ম্যাগাজিনকে মুখপত্র করে বলিষ্ঠ কমিটমেন্ট থেকেই সাহিত্যচর্চা শুরু করেছিলেনÑ যা পূর্ববর্তী দশকগুলোতে এভাবে দৃশ্যমান ছিল না এবং পূর্ববর্তী দশকগুলোতে এতটা জোরালো হয়ে সাড়া ফেলতে পারেনি। বাণিজ্যিক মিডিয়া বা বাণিজ্যিক প্রচারপ্রচারণা-নির্ভরতাকে তাঁরা সদম্ভে অস্বীকার করে কেবলমাত্র কবিতার শক্তিতে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে ছিলেন দৃঢ়সংকল্প। আবার তা শুধুই ঢাকাকেন্দ্রিক নয়, এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল প্রত্যন্ত অঞ্চলেও। একাধিক লিটল ম্যাগাজিন কেন্দ্রিক কয়েকটি গোষ্ঠির হাতে পড়ে এ আন্দোলন বাংলাদেশের কবিতায় অবশ্য-তাৎপর্যবাহী।

পশ্চিম থেকে উঠে আসা সাহিত্যতত্ত্ব, সমালোচনা সাহিত্য, সাহিত্য তাত্ত্বিক, সাহিত্য সমালোচনার রীতিকৌশলÑ তাঁদের লিটলম্যাগ চর্চায় ব্যতিক্রম ধারা সৃষ্টিতে প্রাণিত করে। বিশেষ করে পোস্টমডার্নিজম ও পোস্টকলোনিয়ালিজম, ফিউচারিজম, ইমেজিজমের নতুন চিন্তাচ্ছটা তাঁদের কাব্যবোধ ও কাব্যভাষাকে নতুন করে নির্মাণে উৎসাহিত করে। শেকড়ের টান, ঐতিহ্যলগ্নতা, বিজ্ঞানচেতনা, নতুন নতুন দর্শনভাবালুতা তাঁদের কবিতাকে বাঁকের পথ দেখায়। কিন্তু অতিমাত্রায় এককেন্দ্রিকতা, অতিমাত্রায় প্রচারবিমুখতা, অতিমাত্রায় নিরীক্ষাধর্মিতা, অতিমাত্রায় অহংবোধেই কিনা জানি না, তাঁদের এ আন্দোলনের ফসল চোখে পড়ার মতো গোলায় ওঠেনি। সোজা কথায়, যতটা গর্জেছিল ততটা বর্ষেনি মোটেই।

তার ওপর আশির দশকের কয়েকজন মেধাবী কবির অকালেই মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়া কিংবা মানসিক ভারসাম্য হারানোর মতো ব্যাপারগুলো এ দশকের কাব্যফসলের ভা-ার প্রসারণে মোটেই অনুকূলে ছিল না। এর বাইরে কয়েকজন কবির অত্যন্ত বোহেমীয় জীবনযাপনে অভ্যস্ততা, কিংবা অত্যন্ত আত্মাভিমানহেতু লেখালেখি ও কাব্যগ্রন্থ প্রকাশে অনীহাÑ এ সময়ের কবিদের আরেক প্রতিকূল পরিণতির নাম। এসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে, এবং লিটলম্যাগকেন্দ্রিক কাব্যান্দোলন এবং তার বাইরে থেকে যারা এ সময়ের কবিতাচর্চায় আত্মপ্রত্যয়ী, তাঁরা হলেনÑ রাজা হাসান, অসীম কুমার দাস, হাফিজ রশিদ খান, দারা মাহমুদ, বিষ্ণু বিশ্বাস, খোন্দকার আশরাফ হোসেন, বদরুল হায়দার, সরকার মাসুদ, মাসুদ খান, গোলাম কিবরিয়া পিনু, খালেদ হোসাইন, সোহরাব পাশা, কামরুল হাসান, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, নাসিমা সুলতানা, ফরিদ কবির, মারুফ রায়হান, শামসেত তাবরেজী, রেজাউদ্দিন স্টালিন, মহীবুল আজিজ, কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার, রিফাত চৌধুরী, জুয়েল মাজহার, ওমর কায়সার, সাজ্জাদ শরিফ, শোয়েব শাদাব, আমিনুর রহমান সুলতান, ব্রাত্য রাইসু, খালেদ হামিদী, শিহাব শাহরিয়ার, হোসেন দেলওয়ার, ফেরদৌস নাহার, সুহিতা সুলতানা প্রমুখ। এঁদের মধ্যে রাজা হাসান লেখালেখিতে সক্রিয় হলেও এখন পর্যন্ত তাঁর কোনো কাব্যগ্রন্থই প্রকাশিত হয়নি। ‘ভোরের মন্দির’ নামে প্রথম জীবনে একটিমাত্র কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে বিষ্ণু বিশ্বাস নিখোঁজ হয়ে যান।

দীর্ঘ ১৮ বছর পর সপ্তাহ দুয়েক আগে পশ্চিমবঙ্গে অসুস্থ অবস্থায় তাঁর খোঁজ মিলেছে বলে শোনা যাচ্ছে। শোয়েব শাদাবও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে মাঝে মাঝে গ্রামের বাড়িতে শেকলবন্দি থাকেন বলে জানা গেছে। সম্প্রতি তাঁর বন্ধুরা মিলে তাঁর লেখাগুলো একত্রিত করে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছেন। কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার এলোমেলো জীবনযাপন করতে করতে শেষ জীবনে এসে আল্লাখোদার দূত হয়ে ওঠেন। মানা যান সিজোফ্রেনিয়ায়।

সে সময়ের কবিদের মধ্যে সাজ্জাদ শরিফই বোধকরি সবচেয়ে কম সংখ্যক কবিতার কবি। তাঁর সারা জীবনে বিশেষ করে প্রথম জীবনে লেখা ২০/২৫টি কবিতা দিয়ে বছর চারেক আগে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছেন। এর বাইরে তাঁর যৎসামান্য অনুবাদকর্ম ছাড়া লেখালেখির কোনো সন্ধানও মেলে না। বাকিরা লেখালেখিতে সক্রিয় আছেন, কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে, পত্রপত্রিকায় প্রকাশিতও হচ্ছে প্রচুর পরিমাণেই, কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি বাস্তবিকই নাড়া দেবার মতো কিংবা গভীরভাবে স্পর্শ করে যাবার মতো কোনো কাব্যভাষা একান্ত নিজের মতো করে কেউ আমাদের উপহার দিতে পারেননি। এক্ষেত্রে আমি আমার নিজের মত প্রকাশ করছি মাত্র।

অন্যদিকে নানাজনের নানান মতকেও আমি অশ্রদ্ধা করছি না। বাংলা কবিতার ধারাবাহিকতা, পূর্ববর্তী দশকগুলোর রাজনৈতিক উন্মাদনার কেবলমাত্র পঠিত অভিজ্ঞতা, লিটলম্যাগকেন্দ্রিক ও একটি অংশের বাণিজ্যিক মিডিয়াকেন্দ্রিক কবিতার চর্চা, বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার সাহিত্যে লোকালাইজেশনের ইতিবাচক প্রভাব, প্রায় দেড় দশক পর দেশে গণতন্ত্রের পূর্বাভাস, আশির দশকে সোভিয়েত রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের পতনের প্রায় সাথে সাথেই বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের ভয়ঙ্কর উন্মত্ততার টালমাটাল সময়ে বাংলাদেশের নব্বইয়ের দশকের কবিরা কবিতা লিখতে আরম্ভ করে। শতাধিক মেধাবী তরুণের পদচারণায় এ দশকের কবিতাঙ্গন ভারি হয়ে ওঠে। তাদের হাতেই ভাষা পায় বাংলা কবিতায় নতুন দর্শনের মগ্নধ্বনিময়তা। ভাষা, বোধ, উচ্চারণ ও আঙ্গিক-প্রকরণে এ সময়ের কবিতা অনেক বেশি নিজস্ব ও স্বতন্ত্র বোধের জন্ম দেয়।

অতিমাত্রায় মগ্নতা, অন্তর্মুখিনতা, উচ্চারণের মৌনতা ও স্নিগ্ধতায় সিক্ত নব্বইয়ের দশকের কাব্যভাষা অত্যন্ত দৃঢ় ও স্বাবলম্বীতার স্বাক্ষরবাহী। সুফি, বাউল, মরমীবোধ, কিংবা অধ্যাত্মচেতনায় তাড়িত এসময়ের একদল কবি তাদের হারানো শৈশব, ফেলে আসা গ্রাম প্রকৃতির গভীর থেকে গভীরে গিয়ে তুলে আনা সেইসব ঐতিহ্যিক উৎসব-পালাপার্বণ থেকে শুরু করে পীর, ফকির, দরবেশ, বাউল, সাধক, তান্ত্রিক, আধ্যাত্মিক শক্তিতে বলীয়ান মানুষের চিন্তাদর্শনে মোহিত হয়ে নির্মাণ করে তাদের কবিতা ও কাব্যচিন্তার বিস্তৃত এলাকা। আরেক দল যারা স্বতন্ত্রভাবে কেউ কেউ মিশেল ফুকো, জাক দারিদা, জাক লাকাঁ, জাঁ পল সার্ত্র, এডওয়ার্ড সাইদ, গ্রামসি, নীৎসে, কিয়ের্কেগার্দ, হ্বিটগেনস্টাই, ফ্রয়েড প্রমুখ দার্শনিক-চিন্তক-তাত্ত্বিক দ্বারা প্রভাবিত ও আদর্শায়িত হয়ে তাদের কবিতার স্বতন্ত্র ও পরদেশী ধরনে দেশীয় অনুপ্রবেশনায় ঝুঁকে পড়ে। আরেকদল যারা অতিমাত্রায় বিজ্ঞানমনস্কতায় তাড়িত হয়। আরেকদল স্যুররিয়ালিজম ও ম্যাজিক রিয়ালিজমের মিশেলে রচনা করে তাদের কবিতার স্বকীয় ভূমি।

অত্যন্ত সফল ও শক্তিমান ধারায় যারা কাজ করে চলেছেÑ তাদের চিন্তার এলাকা মূলত দেশপ্রেম, নিজস্ব ভূমি, নিজস্ব প্রকৃতি, নস্টালজিয়া, হারানো ঐতিহ্য, মিথ, ইতিহাস ও বিশ্বকবিতার গতিপ্রকৃতিতে অধিক অনুসন্ধানী প্রবণতায় প্রবাহিত। স্যাটায়ার ও একটি বিশেষ শহরের ভাষাকে কেন্দ্র করেও এসময়ের একদল কবিকে তাদের কাব্যভাষা দাঁড় করাতে উদ্যমী দেখা যায়। মূলত নব্বইয়ের দশকের কবিরা এতগুলো বিচিত্র শাখায় পরিভ্রমণ করে তাদের কাব্যভাষা ও তার ঐক্যসুর নির্মাণ করেছে। এই ঐক্য নির্মাণে প্রধান ভূমিকাটি রেখেছে লিটলম্যাগকেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চার প্রবণতা। দশকের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বেশ কিছু লিটল ম্যাগাজিন এসময়ের স্রোত ও কবিদের মুখপত্র হয়ে ওঠে।

তারা এ কথাটি খুব স্পষ্ট করেই বুঝে ফেলে যে, সকল প্রকার বাণিজ্যিক প্রলোভনহীন কিংবা সত্যিকারের স্বাধীন সাহিত্যচর্চার অন্যতম আশ্রয়ই লিটল ম্যাগাজিন। একমাত্র লিটল ম্যাগজিন ব্যতীত কখনো সাহিত্যের নতুন কণ্ঠস্বর নির্মাণ করা যায় না। তবে দু’একটি ব্যতিক্রম থাকতেই পারে। তৎসত্ত্বেও বাণিজ্যিক প্রচার প্রচারণার প্রলোভন যাদের পেয়ে বসেছিল, তারাও শেষ পর্যন্ত অনুধাবনে সক্ষম হয়েছিল যে, বাণিজ্যিক মিডিয়াগুলো সাহিত্য ও সাহিত্যিকক।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.