আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কল্পলোকের গল্পকথা ও অন্যান্য কথাবার্তা

পার্থ প্রতিম আমি তখন ক্লাশ থ্রি ফোরে পড়ি। একবার বেশ বড় ঝড়ে আমাদের গ্রামে দীর্ঘদিন বিদ্যুৎ সংযোগ ছিলোনা। আর তার কারণে আমাদের দৈনন্দিন রুটিনের বড়সড় পরিবর্তন দেখা দিলো। সন্ধ্যা হতেই হারিকেন জ্বালিয়ে পড়া, রাত নয়টার আগেই ঘুমিয়ে পড়া, ভোরে ঘুম থেকে ওঠা প্রভৃতি। আর বিনোদনের জন্য টেলিভিশনের পরিবর্তে উঠোনে মাদুর বিছিয়ে গল্প শোনা।

আমাদের পাশের বাড়িতে দিদিমা স্থানীয় একজন ছিলেন, আমরা ডাকতাম সেজদি বলে, অপূর্ব কথক। এমন অভিনয় করে বলতেন যে ঐ কুপিবাতির ভূশাকালির আলোছায়ায় গল্পের চরিত্ররা আমার বালক মনে প্রাণ পেত সহজে। কতবার আপন মনে নিজেই হয়ে উঠেছি ব্যাঙ রাজপুত্র। কতবার নীলকমল লালকমল হয়ে কেটে এনেছি রাক্ষসের নাক। কতবার পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চেপে সাতসমুদ্র তের নদী পার হয়েছি চোখের পলকে তার লেখাজোকা নাই।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস নিজের যতটুকু কল্পনা শক্তি, যতটুকু ভাববার ক্ষমতা তার পুরোটুকু ঐ গল্পশোনা দিনের কাছে ঋণী। আমার দুটো ভাইপো-ভাইঝি, কাব্য আর কথা। ওদের ছেলেবেলা আমি খুব কাছ থেকে দেখি এখন। ডোরেমন, হাতড়ি, ছোটাভীম, ওগি- এইসব কার্টুন চরিত্র আর কম্পিউটারে ভিডিও গেম্স-এর জগতে ওদের বিচরণ। যার মধ্যে নিজের কল্পনাকে মিলিয়ে নেয়ার ফাঁকটুকু একেবারে বন্ধ।

গল্পের সবগুলো চরিত্র সেখানে কার্টুনিস্টের তৈরী করা চোখ কান নাক নিয়ে দিব্যি জ্যান্ত হয়ে বসে আছে। সেখানে ঘটনার খুঁটিনাটি, যুদ্ধ কিম্বা এ্যাডভেঞ্চার সবই স্ক্রিপ্টরাইটারের বাঁধা পথ ধরে চলে। সেখানে কাব্য-কথা কেবলই দর্শক। একবিন্দু অবকাশ নেই ভাবুক হবার। আর গেম্স তো কেবল হত্যা হত্যা খেলা।

সেখান থেকে মুখস্ত করছে অস্ত্র আর যুদ্ধযানের নাম। আয়ত্ব করছে অন্যকে খুন করে জয়ী হবার কৌশল। আমি মাঝে মধ্যে গল্প শোনাতে বসলে কিছু সময়ের জন্য আগ্রহী হয় বটে। কিন্তু তার থেকে বেশী টানে চারকোনা বাকশোর ছবি দেখানো যন্ত্র গুলো। কারণ পাখি আর প্রজাপতি চেনার আগেই কার্টুনের সবকটি চরিত্রের নাম শিখে ফেলেছে যে; পুতুলের সংসার পাতার আগে যে মাউস টিপে হত্যা করেছে শত্রু পক্ষের পুরো বাহিনীকে।

দোষ তো ওদের না। ওদের আমরা না দিতে পেরেছি মাঠ, না বাগান, না আকাশ; এমনকি গল্পবলা দাদু-দিদাদেরও আনতে পারিনি কাছে। ছোট পরিবারে একা মা কি বা করবে? এই চার দেয়ালের জগতে মায়েদের হাতের কাছে ছেলে-ভুলানোর কিচ্ছু তো নেই, ঐ টিভি আর কম্পিউটার ছাড়া। দেখুক টিভি। কিন্তু বিদেশী ভাষার কার্টুনের বাইরে কি দেখবে ওরা? আমাদের দেশের টিভি চ্যানেল গুলোতে তাদের বিনোদনের জন্য কতটুকু ব্যবস্থা আছে? মীনা ছাড়া দেশীয় চরিত্রের কোন কার্টুন নেই, সেটাও নিয়মিত না।

মোস্তফা মনোয়ার ‘মনের কথা’ তে মাপেট এনে একটা ব্যপক সাড়া ফেলেছিলেন বিটিভি তে। তারপর সিসিমপুর ছাড়া আর কোন প্রোগ্রামে মাপেট পাওয়া গেলনা। প্রায় সবগুলো চ্যানেলেই সেই এক ছকের অনুষ্ঠান- ২টা গান, ৪টা ছড়া, ৩টা নাচ অনুষ্ঠান শেষ। বড়দেরই দেখতে বিরক্ত লাগে ওরা ধৈর্য্যরে কোন পরীক্ষা দিতে সেখানে বসে থাকবে? তবে একটি প্রোগ্রামের কথা বলতে পারি যেটা এই ধারা থেকে সরে এসে, ফিরিয়ে দিতে চেয়েছে সেই গল্পবলা দাদু আর ঠাকুমার ঝুলি, ফিরিয়ে দিতে চেয়েছে কল্পনা করার সাতরঙা আকাশের বিস্তার। নিয়ে যেতে চেয়েছে রূপকথার মোহিনী রাজ্যে।

আমি এই অনুষ্ঠানটি দেখে এতোই মুগ্ধ হয়েছি এবং মনেমনে কৃতজ্ঞ হয়েছি, যার প্রেক্ষিতে এই লেখা। অনুষ্ঠানটির নাম কল্পলোকের গল্পকথা। দেশ টিভি’তে সুমনা সিদ্দিকীর প্রযোজনায় এই অনুষ্ঠানটি হয়। এর অধিকাংশ জুড়ে থাকে দেশী বিদেশী রূপকথা। কখনো শিশুদের মুখে কখনো বড়দের।

তার সাথে মাঝে মাঝে সঙ্গতিপূর্ণ অভিনয়। এছাড়া ছোটদের উপযোগী মানসম্মত নাটিকা, কবিতা, ছড়া। ছবির মতো করে সাজানো একটা সেটে, নানা রঙের আলো আঁধারিতে, লাইভ মিউজিকের মায়ায় গল্পকথার কল্পলোক সত্যিই সৃষ্টি হয় সকল বয়সী দর্শকমনে। দেখতে দেখতে আমি ফিরে পাই আমার হারানো শৈশব। আর মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখি, কাব্য-কথার চোখে রূপকথার শব্দজাল পেরিয়ে অন্যকোন কল্পলোকের গল্পকথার ঝিকিমিকি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।