আমি সত্য জানতে চাই
(বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও সমাজকর্মী নীলিমা ইব্রাহিম)
নীলিমা রায় চৌধুরী, আমরা যাঁকে চিনি নীলিমা ইব্রাহিম নামে৷ বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও সমাজকর্মী। নীলিমা ইব্রাহিম নানা পরিচয়ে বিধৃত—শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, সমাজসেবী, সংস্কৃতিবিদ, সংস্কৃতিসেবী, নারী সংগঠক ও মুক্তবুদ্ধির চিন্তক। কোন পরিচয়ের চেয়ে কোন পরিচয় বড়, সেটা নির্ণয় করা খুবই কঠিন। তাঁর অপরাধ ছিল, তিনি অনেককে পেছনে ফেলে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলেন ব্যক্তিগত জ্ঞান ও প্রজ্ঞাকে সম্বল করে। সত্য ও ন্যায়ের প্রতি স্থির, অবিচল এ মানুষটি দেশ, জাতি, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি ইত্যাদি যাবতীয় ধারণাকে নিজের মতো করে বিশ্লেষণ করেছিলেন।
নিজের কণ্ঠকে উচ্চারিত করেছিলেন স্বতন্ত্রভাবে। এই মহীয়সী নারী ২০০২ সালের ১৮ জুন ঢাকায় নিজ বাস-ভবনে মৃত্যু বরণ করেন। মৃত্যুদিনে তাঁকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়।
(ড.নীলিমা ইব্রাহিমের পিতা প্রফুল্লকুমার রায় চৌধুরী)
১৯২১ সালের ১১ অক্টোবর বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলার মূলঘর গ্রামের এক জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করে ছিলেন নীলিমা রায় চৌধুরী। তাঁর পিতা প্রফুল্লকুমার রায় চৌধুরী এবং মাতা কুসুমকুমারী দেবী।
(মা কুসুমকুমারী দেবী, বোন ইলা, পূর্ণিমা, শান্তা ও মনীষার সাথে নীলিমা)
শৈশবে খুব দুরন্ত প্রকৃতির হলেও বরাবরই একজন মেধাবী ছাত্রী ছিলেন নীলিমা রায় চৌধুরী। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব পরীক্ষাতেই তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দেন। তিনি খুলনা করোনেশন বালিকা বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা (১৯৩৫), কলকাতা ভিক্টোরিয়া ইন্সটিটিউশন থেকে আইএ (১৯৩৭) এবং স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বিএবিটি (১৯৩৯) পাস করেন। (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে তিনি বাংলা বিষয়ে এমএ (১৯৪৩) পাস করেন। ১৯৪৫ সালে তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম ‘বিহারীলাল মিত্র গবেষণা’ বৃত্তি লাভ করেন।
(মোহাম্মদ ইব্রাহিমের সঙ্গে ড.নীলিমা ইব্রাহিম)
১৯৪৫ সালে তিনি ইন্ডিয়ান আর্মি মেডিক্যাল কোরের ক্যাপ্টেন ডাক্তার মোহাম্মদ ইব্রাহিমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। বিয়ের পর নীলিমা রায় চৌধুরী হয়ে যান নীলিমা ইব্রাহিম৷ ১৯৪৬-১৯৫৪ সাল পর্যন্ত নয়টি বছর তিনি পুরোপুরি সংসারী হয়ে পড়েন৷ বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ী গেন্ডারিয়ায় থাকতে শুরু করেন৷ তাঁর প্রথম সন্তান খুকুর জন্ম হয়েছে এখানেই৷ স্বামীর বদলির চাকরির কারণে এরপর স্বামীর সাথে গিয়েছেন পিরোজপুর, যশোর, বরিশাল, খুলনায়৷ পরে তাঁর আরও চার মেয়ে ডলি, পলি, বাবলি ও ইতির জন্ম হয়৷
(পঞ্চ কন্যার সাথে ড.নীলিমা ইব্রাহীম ও মোঃ ইব্রাহিম)
দীর্ঘকাল পরে ১৯৫৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল ‘সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমিকায় ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা নাটক। ’ একই বছর তিনি ঢাকার আলিয়ঁস ফ্রঁসেস থেকে ইন্টারমিডিয়েট ইন ফ্রেঞ্চে ডিপ্লোমা লাভ করেন।
কর্মজীবনের শুরুতে নীলিমা ইব্রাহিম কলকাতার লরেটো হাউসে লেকচারার (১৯৪৩-৪৪) হিসেবে চাকরি করেন।
তারপর দু’বছর (১৯৪৪-৪৫) তিনি ভিক্টোরিয়া ইন্সটিটিউশনের লেকচারার ছিলেন। ১৯৫৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগে যোগদান করেন এবং ১৯৭২ সালে প্রফেসর পদে উন্নীত হন। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু তাঁকে বাংলা একাডেমির দায়িত্ব নেওয়ার জন্য সরাসরি প্রস্তাব দিলেন। এর আগে একবার বঙ্গবন্ধুর দেওয়া মন্ত্রীত্বের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৭৪ সালের শেষার্ধে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তাঁকে সরাসরি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘রাজনীতি করবেন?’ তিনি স্পষ্ট জবাব দিয়েছিলেন, ‘না।
’ ‘কেন?’ ‘বুঝি না, আমি মাস্টার, হ্যাঁ বললে হ্যাঁ আর না বললে না বুঝি। আমার পক্ষে রাজনীতি করা সম্ভব নয়। ’ বঙ্গবন্ধু গম্ভীর হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, অনুরোধ করেছিলেন শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে। কিন্তু তিনি সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করলে অবশেষে তাঁকে বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক পদে জোর করে নিয়োগ দেয়া হয়। একই সাথে তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ এর দায়িত্বও পালন করেন।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাঁকে নানাভাবে হয়রানি করেছে এবং নানাভাবে নির্যাতিতও হয়েছেন তিনি। যেখানেই যেতেন বুঝতে পারতেন- তিনি নজরদারিতে রয়েছেন। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে জাপানের এক মন্ত্রীর সাথে পূর্ব বন্ধুত্বের সূত্রে ছোট্ট উপহারকে কেন্দ্র করে এনএসআই-এর রোষানলে পড়েন তিনি। তাই অবসর গ্রগণের বৈধ সময়ের আগেই তাঁকে বাধ্যতামূলক এলপিআর দেয়া হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি অধ্যাপক নুরুল মোমেন, আসকার ইবনে শাইখ, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার সঙ্গে নীলিমা ইব্রাহীম যুক্ত হয়ে পড়েন নাট্যচর্চায়।
এই নাট্যচর্চার ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে নবগঠিত বুলবুল একাডেমীতে ক্লাশ নিয়েছেন নাটকের উপর। এক সময় নাটক লিখেছেন তিনি। তঁর লেখা প্রথম নাটক ‘মনোনীতা’ মঞ্চস্থ হয় বুলবুল একাডেমীর ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে। তিনি ১৯৬২-৬৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘রঙ্গম’ নামের একটি নাট্য সংস্থা। তাঁর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মুনীর চৌধুরী, রণেন কুশারী, কবি হাবিবুর রহমানসহ আরো অনেকে।
তাঁর নিজের দলের জন্য তিনি শরৎচন্দ্রের ‘চরিত্রহীন’ নাটকের নাট্যরূপ দেন। এ দলটি অবশ্য পরে ভেঙ্গে যায়৷ এ সময় তিনি রেডিও টেলিভিশনের জন্য প্রচুর নাটক লিখেছেন।
(জাপান সফরে ড. নীলিমা ইব্রাহিম, সাথে আইভি রহমান ও সাহারা খাতুন)
নীলিমা ইব্রাহিম বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমাজকল্যাণ ও নারী উন্নয়ন সংস্থা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি বাংলা একাডেমীর ফেলো এবং বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতি, বাংলাদেশ রেড ক্রস সমিতি ও বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতির আজীবন সদস্য ছিলেন। এছাড়া বাংলাদেশ মহিলা সমিতির সভানেত্রী এবং কনসার্নড উইমেন ফর ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ের বোর্ড অফ গভর্নরসের চেয়ারপারসন হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ইন্টারন্যাশনাল অ্যালায়েন্স অফ উইমেনের সভানেত্রী এবং অ্যাসোসিয়েটেড কান্ট্রি উইমেন অফ দি ওয়ার্লাল্ড-এর সাউথ ও সেন্ট্রাল এশিয়ার এরিয়া প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৯৬৮ সালে তিনি বার্লিন, মিউনিখ ও ফ্রাংফুর্টে অনুষ্ঠিত ‘আন্তর্জাতিক বিশ্ব সমবায় সম্মেলন’-এ পূর্ব পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন এবং ১৯৭৩-এ নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত ‘আন্তর্জাতিক ওয়ান এশীয় সম্মেলন’-এ অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৪-এ তিনি মস্কোয় অনুষ্ঠিত ‘বিশ্বশান্তি কংগ্রেস’, হাঙ্গেরিতে অনুষ্ঠিত ‘বিশ্বনারী বর্ষ’ এবং ১৯৭৫-এ মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত ‘বিশ্বনারী সম্মেলন’-এ যোগ দেন।
(প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে ড.নীলিমা ইব্রাহীম)
জীবনের একবারে শেষ প্রান্তে এসে জাতীয় দৈনিকে উপ-সম্পাদকীয় লিখে অসামান্য খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৯৬ সালে আজকের কাগজে ‘মাগো আমি কোইত যাবো’ শীর্ষক উপ-সম্পাদকীয় লিখে তৎকালীন সরকারের মসনদ কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন।
এ জন্য তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা রুজু করা হয়। অসুস্থ শরীরে কন্যার বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে পুলিশের গ্রেপ্তারের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। পালিয়ে থাকা অবস্থায় হাইকোর্টে সশরীরে উপস্থিত হয়ে তিনি জামিনের আবেদন করেন। মামলাটি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন ভাষা সৈনিক এডভোকেট গাজিউল হক। কিন্তু প্রত্যাখ্যাত হন।
তাৎক্ষণিকভাবে তিনি নিম্ন আদালতে হাজির হলে নিম্ন আদালতের হাজার হাজার আইনজীবী আদালত কক্ষে জমায়েত হন এবং তাঁকে জামিন দেয়া না হলে তাঁরা আদালত কক্ষ ত্যাগ করবেন না বলে জানান। শেষ পর্যন্ত নিম্ন আদালত তাঁকে জামিন দিতে বাধ্য হয়।
(কীর্তিতে ভাস্বর দুই বাঙালি নারী - সুফিয়া কামাল ও নীলিমা ইব্রাহিম)
নীলিমা ইব্রাহিম বেশকিছু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তার গ্রন্থবদ্ধ রচনাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : গবেষণা শরৎ-প্রতিভা (১৯৬০), বাংলার কবি মধুসূদন (১৯৬১), ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি সমাজ ও বাংলা নাটক (১৯৬৪), বাংলা নাটক : উৎস ও ধারা (১৯৭২), বেগম রোকেয়া (১৯৭৪), বাঙ্গালীমানস ও বাংলা সাহিত্য (১৯৮৭), সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা প্রসঙ্গ (১৯৯১); ছোটগল্প রমনা পার্কে (১৯৬৪); উপন্যাস বিশ শতকের মেয়ে (১৯৫৮), এক পথ দুই বাঁক (১৯৫৮), কেয়াবন সঞ্চারিণী (১৯৬২), বহ্নিবলয় (১৯৮৫); নাটক দুয়ে দুয়ে চার (১৯৬৪), যে অরণ্যে আলো নেই (১৯৭৪), রোদ জ্বলা বিকেল (১৯৭৪), সূর্যাস্তের পর (১৯৭৪); কথানাট্য আমি বীরাঙ্গনা বলছি (২য় খ- ১৯৯৬-৯৭); অনুবাদ এলিনর রুজভেল্ট (১৯৫৫), কথাশিল্পী জেমস ফেনিমোর কুপার (১৯৬৮), বস্টনের পথে (১৯৬৯); ভ্রমণকাহিনী শাহী এলাকার পথে পথে (১৯৬৩); আত্মজীবনী বিন্দু-বিসর্গ (১৯৯১) ইত্যাদি।
সাক্ষাৎকার ভিত্তিতে প্রয়াত ডঃ নীলিমা ইব্রাহিম পরম মমতায় একাত্তরের নির্যাতিতা নারীদের নিয়ে লিখেছেন তাঁর জীবনের অন্যতম কালজয়ী প্রমান্য গ্রন্থ 'আমি বীরাঙ্গনা বলছি৷' যেখানে ফুটে উঠেছে স্বাধীনতা যুদ্ধের বীরঙ্গনাদের উপর ঘটেচ যাওয়া নারকীয় বর্বরতার বাস্তব কাহিনী।
বইটির ভূমিকাতে তিনি লিখেছিলেন "চরিত্রগুলি ও তাঁদের মন-মানসিকতা, নিপীড়ন, নির্যাতন সবই বস্তুনিষ্ঠ"। এই বইতে তিনি প্রকাশ করেছেন কীভাবে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী স্বাধীন বাঙলাদেশের সমাজ একাত্তরের অমর আর অজেয় বীরাঙ্গনাদের অবদান অস্বীকার করেছে। শুধু সমাজ নয়, বীরাঙ্গনাদের পরিবারও তাঁদের গ্রহণ করতে রাজি হয়নি। অস্বীকার করেছে বাবা, অস্বীকার করেছে স্বামী।
পাঠকের জন্য "আমি বীরঙ্গনা বলছি" বইটির একটা ছোট অংশ তুলে দিলাম নিচে"
....“যে চেয়ারম্যান সাহেব আমাকে পাকিস্তানি সেনার হাতে তুলে দিয়েছিলেন, একদিন তিনি এলেন।
সব কিছু জেনেও আমি তার পা জড়িয়ে ধরলাম। বললাম, ‘কাকাবাবু, আমাকে বাবার কাছে রেখে আসুন। ছোট্টবেলা থেকে আপনি আমাকে চেনেন। আপনার মেয়ে সুলতানার সঙ্গে আমি একসঙ্গে খেলাধুলা করেছি, স্কুলে পড়েছি। আমাকে দয়া করুন'।
উনি পা ঝাড়া দিয়ে আমাকে দূরে সরিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন।
...প্রথমে আমার উপর পাশবিক অত্যাচার করে একজন বাঙালি। আমি বিস্ময়ে বোবা হয়ে গিয়েছিলাম।
...আমাদের শাড়ি পরতে বা দোপাট্টা ব্যবহার করতে দেয়া হত না। কোন ক্যাম্পে নাকি কোন একটা মেয়ে গলায় শাড়ির ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে।
...প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন যে সব রমণী মাতৃভূমির জন্য তাদের সতীত্ব, নারীত্ব হারিয়েছে তিনি তাদের বীরাঙ্গনা আখ্যায় ভূষিত করেছেন। অন্তরের শ্রদ্ধা জানালাম সেই মহানায়কের উদ্দেশ্যে। আমি বীরাঙ্গনা, এতোবড় সম্মান আমি পেয়েছি। আমি ধন্য কিন্তু চোখের জল কেনো জানি না বাঁধা মানতে চায় না।
....বাবাকে দেখবার জন্য, তাদের খবর নেবার জন্য অস্থির হয়ে গেছি।
কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য এমন কাউকে দেখি না যাঁকে অনুরোধ করা যায়। শেষে পুনর্বাসন কেন্দ্রের কার্যনির্বাহি অফিসার মোসফেকা মাহমুদকে বাবার ঠিকানা দিলাম। পথের দিকে তাকিয়ে থাকি, যেনো খবর পেয়েই বাবা ছুটে আসবেন। কিন্তু না দিন গড়িয়ে সপ্তাহ গেল। খবর পেলাম বাড়িঘর ভেঙ্গে গেছে সে সব মেরামত করা নিয়ে বাবা ব্যস্ত, আসবেন কয়েক দিনের মধ্যে।
শুধু উচ্চারণ করলাম,‘বাবা তুমিও’!
ইত্যবসরে আমার গর্ভপাত করানো হলো, কারণ এতদিনে বাস্তবতা বুঝে গেছি।
..... ''হঠাৎ অনেক লোকের আনাগোনা,চেঁচামেচি কানে এলো। একজন বাংকারের মুখে উঁকি দিয়ে চিৎকার করলো, কই হ্যায়: ইধার আও। মনে হলো আমরা সব এক সঙ্গে কেঁদে উঠলাম। ঐ ভাষাটা আমাদের নতুন করে আতঙ্কগ্রস্ত করলো।
কয়েকজনের মিলিত কন্ঠ এবারে, মা, আপনারা বাইরে আসুন । বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। আমরা আপনাদের নিতে এসেছি। চিরকালের সাহসী আমি উঠলাম। কিন্তু এতো লোকের সামনে আমি সম্পূর্ণ বিবস্ত্র, উলঙ্গ।
দৌড়ে আবার বাংকারে ঢুকতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু যে বলিষ্ঠ কন্ঠ প্রথম আওয়াজ দিয়েছিলো, কোই হ্যায়, সেই বিশাল পুরুষ আমাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে নিজের মাথার পাগড়িটা খুলে আমাকে যতটুকু সম্ভব আবৃত করলেন। . . . . . . . . . আমি ওই অধিনায়ককে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। ''
নীলিমা ইব্রাহিম সমাজকর্ম ও সাহিত্যে অনন্যসাধারণ অবদানের জন্য বহু পুরস্কার ও পদকে ভূষিত হয়েছেন। যদিও সবই ছিলো তাঁর অবদানের দৃষ্টিতে নগন্য।
তাঁর প্রাপ্ত পুরস্কারসমূহঃ বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৯), জয়বাংলা পুরস্কার (১৯৭৩), মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার (১৯৮৭), লেখিকা সংঘ পুরস্কার (১৯৮৯), বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী স্মৃতিপদক (১৯৯০), অনন্য সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৬), বেগম রোকেয়া পদক (১৯৯৬), বঙ্গবন্ধু পুরস্কার (১৯৯৭), শেরেবাংলা পুরস্কার (১৯৯৭), থিয়েটার সম্মাননা পদক (১৯৯৮) ও একুশে পদক (২০০০)।
এই মহীয়সী নারী ২০০২ সালের ১৮ জুন ঢাকায় নিজ বাস-ভবনে মৃত্যু বরণ করেন। মৃত্যুর পর তাঁকে শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে সমাহিত করা হয়। নীলিমা ইব্রাহিম আজীবন মানুষের শুভ ও কল্যাণ চেতনায় আস্থাশীল ছিলেন। মুক্তবুদ্ধি, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও উদার মানবিকতা ছিল তাঁর জীবনদর্শন।
মহীয়সী এই বিদূষী নারী আমাদের দিয়ে গেছেন জ্ঞানের এক অফুরন্ত ভান্ডার, যে জ্ঞান ভান্ডারে প্রবেশ করলে আমরা দেখতে পাই তিনি আমাদের মাঝে থেকে সাহস দিয়ে যাচ্ছেন অবিরত। আজ তাঁর ১১৩ম মৃত্যুদিনে তাঁকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধাও ভালোবাসায় ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।