আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ট্রাফিক পুলিশ

নগরীর পরিবেশ দূষণে বিভিন্ন ধরণের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ভুগছে ট্রাফিক পুলিশ। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত ১৫ দিনে ২শ ৭৬ জন ট্রাফিক পুলিশ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এদের মধ্যে একশ ৯৩ জন পরিবেশ দূষণের কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছে। ঢাকার বাতাসে দৃশ্যমান ও অদৃশ্য বস্তুকণা, সীসা, সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, হাইড্রো কার্বন, ওজোন গ্যাস, কার্বন মনো-অক্সাইডসহ নানান ধরণের ক্ষতিকারক রাসায়নিক উপাদান মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শব্দ দূষণ।

ফলে ট্রাফিক পুলিশরা অ্যাজমা, ব্রঙ্কাইটিস, ক্যান্সার, রক্তের হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়া, শ্রবণশক্তি হ্রাস পাওয়া, মাথা ব্যাথা, চোখে প্রদাহ, হার্টের সমস্যাসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। কিন্তু এসব রোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ট্রাফিক পুলিশকে কোন উপকরণ সরবরাহ করা হচ্ছে না। তাই নগরীর যান শৃংখলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি মারাত্বক আকার ধারণ করেছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ঢাকার মহাখালীতে সালফার ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ৩৪৯ মাইক্রোগ্রাম, ফার্মগেটে ৪৩৫ মাইক্রোগ্রাম, মগবাজারে ৪৮৯ মাইক্রোগ্রাম, সোনারগাঁওয়ে (কারওয়ান বাজার) ৩৫৭ মাইক্রোগ্রাম এবং সায়েন্সল্যাবে ৪৩৮ মাইক্রোগ্রাম। অথচ আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী বাতাসে সালফার-ডাই-অক্সাইডের বার্ষিক গড় সহনীয় মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ৮০ মাইক্রোগ্রাম।

কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসাপাতালের চিকিৎসক মোহাম্মদ আবুল হুসনাইন বলেছেন, ঢাকার বাতাসে অতিরিক্ত মাত্রায় সালফার ডাই-অক্সাইডের উপস্থিতি ব্রঙ্কাইটিস, অ্যাজমা রোগ সৃষ্টি এবং হৃৎপিন্ড ও ফুসফুসে দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। বাতাসে নাইট্রোজেন অক্সাইডের সহনীয় মাত্রা ১০০ মাইক্রোমিটার। অথচ ঢাকার বাতাসে এর পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ঢাকার মহাখালীতে নাইট্রোজেন অক্সাইডের পরিমাণ ৩৭৬ মাইক্রোগ্রাম, ফার্মগেটে ৭৫২ মাইক্রোগ্রাম, মগবাজারে ৩৩৯ মাইক্রোগ্রাম, সোনারগাঁওয়ে ৭৫ মাইক্রোগ্রাম এবং সায়েন্সল্যাবে ১১৩ মাইক্রোগ্রাম। ডা. আবুল হুসনাইনের মতে, এই গ্যাসের আধিক্যের কারণে ট্রাফিক পুলিশের মাথা ব্যাথা, চোখে প্রদাহ এবং শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দিতে পারে।

একইভাবে বাড়ছে কার্বন মনো-অক্সাইড ও কার্বন ডাই-অক্সাইডের হার। ঢাকায় এ দুটি গ্যাসের সহনীয় মাত্রা যথাμমে হচ্ছে ৫০০০ মাইক্রোগ্রাম ও ২৯০-৩০০ পিপিএম। গবেষণা তথ্যানুযায়ী, ঢাকার মহাখালীতে কার্বন মনো-অক্সাইডের পরিমাণ ৫২১৯ মাইক্রোগ্রাম, ফার্মগেটে ৭৭৩০ মাইক্রোগ্রাম, মগবাজারে ৫৭২৬ মাইক্রোগ্রাম, সোনারগাঁওয়ে ৫৩৪৩ মাইক্রোগ্রাম এবং সায়েন্সল্যাবে ৫৭২৬ মাইক্রোগ্রাম। অতিরিক্ত কার্বন মনো অক্সাইডের ব্যবহার রক্তে অক্সিজেন পরিবহনে বাঁধা সৃষ্টি এবং হৃৎযন্ত্র বিকল করে দিতে পারে বলে মনে করছেন ডা. হুসনাইন। অন্যদিকে মহাখালীতে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ৪৩৫ পিপিএম, ফার্মগেটে ৫৯০ পিপিএম, মগবাজারে ৪৭৫ পিপিএম, সোনারগাঁওয়ে ৫০০ পিপিএম এবং সায়েন্সল্যাবে ৫০০ পিপিএম।

ক্রো পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকার বাতাসে মাত্রাতিরিক্ত ওজোন গ্যাসের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। ভূ-পৃষ্ঠের ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার ওপরে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার স্তরে ওজোন গ্যাসের উপস্থিতি অপরিহার্য। কিন্তু ট্রপোস্ফিয়ার স্তরে (ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে) ওজোনের উপস্থিতি মানুষের জন্য ক্ষতিকর। এর সহনীয় মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ৭৫ মাইক্রোগ্রাম। গবেষণা তথ্যানুযায়ী, ঢাকার মহাখালীতে ওজোন গ্যাসের পরিমাণ ১১৯ মাইক্রোগ্রাম, ফার্মগেটে ১৩০ মাইক্রোগ্রাম, মগবাজারে ১০৬ মাইক্রোগ্রাম, সোনারগাঁওয়ে ১৪৩ মাইক্রোগ্রাম এবং সায়েন্সল্যাবে ৯৬ মাইক্রোগ্রাম।

কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসাপাতালের চিকিৎসক মোহাম্মদ আবুল হুসনাইন বলেছেন, এ গ্যাসের আধিক্য ফুসফুসের μিয়াকলাপ বন্ধ করে দেয়, অ্যাজমা এবং চোখে প্রদাহ সৃষ্টি করে। ক্ষতিকর গ্যাসের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শব্দ দূষণ। ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশ (ডব্লিউবিবি) ট্রাস্টের একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায়, শাহবাগ এলাকায় শব্দের মাত্রা সর্বোচ্চ ১০০ ডেসিবল ও সর্বনি¤ড়ব ৯৬ ডেসিবল। অথচ শব্দের মাত্রা ৭৫ ডেসিবল এর বেশি হলে তা মানুষের কানে নানান রকমের সমস্যা করে বলে জানালেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ডা. সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, অতিরিক্ত শব্দের কারণে শ্রবণশক্তি হ্রাস পায়, মেজাজ খিটখিটে হয়, খাবার ডাইজেস্ট হতে দেরি হয়।

উনড়বত বিশ্বে শব্দ দূষণ থেকে বাচাঁর জন্য ‘কোয়েটপ্রো’ নামের বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি এমন এক প্রযুক্তি যা কানে ব্যবহার করার মতো একটি ডিজিটাল প্লাগ। এটি ১২০ ডেসিবেল মাত্রার বিকট আওয়াজকে ৩০ ডেসিবেলে নামিয়ে শ্রবণ উপযোগী করে কানে পৌছায়। এই প্রযুক্তি চালু করা গেলে ট্রাফিক পুলিশকে শব্দ দূষণ থেকে রক্ষা করা সম্ভব। বর্তমানে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় তিন হাজার দুই শ ৩২ জন ট্রাফিক পুলিশ দায়িত্ব পালন করছেন।

এদের মধ্যে জয়েন্ট কমিশনার একজন, ডেপুটি কমিশনার চারজন, এডিশনাল ডেপুটি কমিশনার চারজন, সিনিয়র এসিস্ট্যান্ট কমিশনার চারজন, এসিস্ট্যান্ট কমিশনার ১৪ জন, ট্রাফিক ইন্সপেক্টর ৭৫ জন, সাব ইন্সপেক্টর ৭জন, সার্জেন্ট ৪শ ৮১ জন, টাউন সাব ইন্সপেক্টর ১৭ জন, এসিস্ট্যান্ট সাব ইন্সপেক্টর একশ ১৮ জন, হেড কন্সটেবল একশ ৫৩ জন, কন্সটেবল দুই হাজার তিনশ ৫৩জন। ট্রাফিক পুলিশরা দুই শিফটে কাজ করেন। সকাল ৭টা থেকে দুপুর ২টা এবং দুপুর ২টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে নগরীর রাস্তাগুলোর যান শৃংখলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করেন ট্রাফিক পুলিশ। আর নগরীর দুষণের ঝাপটা তাদের ওপর দিয়েই বেশি যায়।

আর এসব ক্ষতিকারণ দূষণের সরাসরি শিকার হচ্ছেন ট্রাফিক পুলিশরা। কিন্তু তাদেরকে দূষণ থেকে রক্ষার জন্য কোন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। মগবাজার মোড়ে কর্মরত ট্রাফিক ইন্সপেক্টর ইকবাল ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘সরকার একটা সাধারণ মাস্ক আর চশমা দিতে পারে না আবার প্রতিরোধমুলক ব্যবস্থা!’ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসাপাতালের চিকিৎসক মোহাম্মদ আবুল হুসনাইন বলেছেন, হাসপাতালে যারা চিকিৎসা নিতে আসেন তাদের অধিকাংশই পরিবেশ দূষণের কারণে সৃষ্ট বিভিনড়ব রোগে আμান্ত হচ্ছে। তারা ব্রঙ্কাইটিস, ক্যান্সার, রক্তের হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়া, শ্রবণশক্তি হ্রাস পাওয়া, হার্টের সমস্যা ইত্যাদি রোগেই বেশি রোগী ভর্তি হয়। আর এগুলোর সাথে সরাসরি জড়িত পরিবেশ দূষণ।

ট্রাফিক পুলিশরা বিভিনড়ব ধরণের দূষণগত কারণেই বেশি অসুস্থ হচ্ছেন। তিনি আরো বলেন, এসব রোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ট্রাফিক পুলিশকে ধূলাবালি প্রতিরোধমূলক মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। চোখের সংμমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ডাক্তারের পরামর্শমত চশমা ব্যবহার করতে হবে। বিভিনড়ব গ্যাসের সংμমণ রোধ করার জন্য প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা নেওয়া গেলে ট্রাফিক পুলিশরা এসব অসুখ থেকে মুক্তি পেতে পারেন। কিন্তু ট্রাফিক পুলিশকে দূষণ প্রতিরোধক কোন উপকরণ সরবরাহ করা হচ্ছে না।

ঢাকার সবুজবাগ ট্রাফিক জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার রতড়বা ধর বলেছেন, ট্রাফিক পুলিশকে নিয়মিত এসব উপকরণ সরবরাহ করা হয় না। তিনি বলেন, একটি মেগাসিটিতে ২৫ শতাংশ রাস্তা দরকার। সেখানে ঢাকা শহরে রাস্তা আছে মাত্র ৭ শতাংশ। গাড়ির সংখ্যা প্রতি বছর গড়ে ১০ শতাংশ হারে বেড়ে চলেছে। প্রতিদিন রাস্তায় ১০০টি নতুন প্রাইভেট কার নামছে।

ঢাকার ভেতরে সচল গাড়িগুলোর ৭০ থেকে ৮০ শতাংশই ত্রুটিপূর্ণ ইঞ্জিনের কারণে বিষাক্ত ধোয়াঁ ছড়াচ্ছে। ইদানীং প্রচুর পরিমাণে সিএনজি চালিত গাড়ি চলাচল করছে। সিএনজি চালিত গাড়ি থেকে বের হয় ক্ষতিকারক বেনজিন। আর এই বেনজিনের কারণে ট্রাফিক পুলিশের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ডা. সাইফুল ইসলাম বলেছেন, বায়ু দূষণের ফলে রাজধানীর ৬০ শতাংশ মানুষ চোখের সমস্যায় ভুগছে।

আর ট্রাফিক পুলিশ সারাক্ষণ রাস্তায় থাকাতে তাদের ঝুঁকির পরিমাণ আরো অনেক বেশি। দূষিত বায়ুর প্রভাবে ‘ড্রাই আই’ বা চোখে জলশূণ্যতা দেখা দেয়। ফলে চোখ ফুলে ওঠে, চোখে চুলকানি হয়, চোখের পানি শুকিয়ে যায়। বিষাক্ত গ্যাস পৌস্টিক তন্ত্রে সমস্যার সৃষ্টি করে। অনেকের ত্বকে ক্যান্সার দেখা দিচ্ছে।

রক্তের হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়া, ব্রঙ্কাইটিসসহ নানামুখী রোগ হতে পারে। তিনি বলেন, সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাদের প্রশ্রাবের থলি অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে। এতে করে তাদের বৃক্কে সমস্যা দেখা দিতে পারে। ট্রাফিক পুলিশরা নগরীর দূষণ থেকে সৃষ্ট বিভিনড়ব জটিল রোগ থেকে বাচঁতে প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহের জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান। ## ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।