আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চিকিৎসকের আত্মপ্রচার ও নৈতিকতা

মানুষ যে দেশে, যে পরিবেশে, যে পরিবারেই জন্ম গ্রহণ করুক না কেন ; প্রথমেই তাকে যে সেবা দেওয়া প্রয়োজন হয় , সেটা হচ্ছে চিকিৎসা সেবা। এর কোন হেরফের হবার সুযোগ নাই। মাতৃগর্ভে যখনই মানব শিশুর আবির্ভাব ঘটে , তখন থেকেই তাকে এই সেবা দিতে হয়। বলা হয় স্বাস্থ্যই সুখের মূল। সুন্দর মন নিয়ে সুখি জীবন যাপন করতে হলে প্রয়োজন সুস্থ ও নিরোগ শরীর।

এর জন্যই প্রতিটি মানুষকে শরণাপন্ন হতে হয় চিকিৎসকের। সকল চিকিৎসক কিন্তু একই রকম মেধা ও দক্ষতা সম্পন্ন নন। রোগ সঠিকভাবে নির্ণয় করে উপযুক্ত ও কার্যকরী ঔষধ প্রয়োগে পারদর্শিতাই একজন চিকিৎসককে সুনাম ও যশের অধিকারী করে দেয়। যশস্বী চিকিৎসকদের কাছে মানুষ সেবা পেতে ভিড় জমায়। অর্থ দূরত্ব বা অন্যকোন প্রতিক’লতা কখনোই এ ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।

সকল প্রতিক’লতা দুপায়ে দলে মানুষ ছুটে যায় যশস্বী চিকিৎসকের কাছে সেবা পেতে। যশস্বী চিকিৎসকেরা কালান্তরেও মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেন। লোকমান হাকিম , ইবনে সিনা প্রমুখ এই পর্যায়ভুক্ত। তাঁদের জীবনকাল শেষ হবার পরেও সহ¯্রাব্দ অতীত হয়ে গেছে বা হতে চলেছে , কিন্তু পৃথিবীর মানুষ তাঁদের ভুলে নাই। চিকিৎসায় পারদর্শীতার কারণে তাঁরা অবহমানকাল ধরে মানুষের হৃদয়ে স্থান লাভ করে বরিত ও নন্দিত হয়ে আসছেন।

দক্ষ ও পারদর্শী চিকিৎসকের চাহিদা সবকালে সবসমাজেই রয়েছে। এই কারণে ব্যবসায়িক দিক বিবেচনায় রেখে কেউ কেউ নিজেকে যশস্বী চিকিৎসক বলে প্রচার করে থাকে । তাদের একটাই উদ্দেশ্য পশারের বিস্তৃতি ঘটানো। রোগাক্রান্ত মানুষ এই সব প্রচারনায় আকৃষ্ট হয়ে প্রলুব্ধ হয় , তারপর হয় প্রতারিত। আরোগ্য লাভের বদলে হয় আর্থিক ক্ষতির শিকার।

জনগণের এই দুর্ভোগের দিক বিবেচনা করে এ বিষয়ে আইনগতভাবে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। ‘বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল কোড অব মেডিকেল ইথিকস’ এই উদ্দেশে প্রনীত হয়েছে। এর ৮ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে রোগীদের নিজের কাছে চিকিৎসা নিতে আকৃষ্ট করা বা পেশাগত স্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোন প্রতিনিধি বা সমিতি বা ব্যক্তি বা সংগঠনের মাধ্যমে কোন চিকিৎসক প্রচার প্রচারনা চালালে তার এই কর্ম ও আচরণ পেশাগত অসদাচরন বলে গণ্য হবে। এইরূপ পেশাগত অসদাচরণকারী চিকিৎসকের বিরুদ্ধে শৃংখলামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা যাবে। পেশাগত স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতা , পেশাগত দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা বিষয়ে কোন নিবন্ধ বা মন্তব্য অনুরূপভাবে প্রকাশ করা হলে তার জন্যও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক শৃংখলামূলক কার্যক্রমের আওতায় পড়বেন।

উক্তরূপভাবে একইরূপ উদ্দেশ্যে উক্তরূপ বই , প্রচারপত্র , খবরের কাগজ , পত্রপত্রিকা , রেডিও বা টেলিভিশনের মাধ্যমে এসব প্রচার করা হলে সেটাও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের ক্ষেত্রে অসদাচরণ বলে গণ্য হবে। প্রথাগত সীমার অতিরিক্ত নোটিশ , লিফলেট , ঘোষণার মাধ্যমে উক্তরূপ প্রচারণাও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের ক্ষেত্রে অসদাচরণ বলে গণ্য হবে। আবার বইপুস্তক , পত্রপত্রিকা, খবরের কাগজে চিকিৎসকের বিজ্ঞাপন প্রচারের উদ্দেশ্যে কোন নিবন্ধ প্রকাশিত হলে সেটাও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের ক্ষেত্রে তার পেশাগত অসদাচরণ বলে গণ্য হবে। রেডিও ও টিভিতে ব্যক্তিগতভাবে হাজির হয়ে এইরূপ বিজ্ঞাপনধর্মী প্রচারে অংশ নিলে সেটাও তার পেশাগত অসদাচরণ বলে গণ্য হবে। যারা ‘প্রাইভেট প্রাকটিস’ করেন তারা রেডিও এবং টেলিভিশনে ব্যক্তিগত ভাবে হাজির হয়ে নিজের পূর্ণ পরিচিতি প্রকাশ করতে পারবেন না , সেই সাথে তাকে নিয়ে এরূপ প্রচারের অনুমতিও দেবেন না।

স্বাস্থ্য সম্পর্কিত শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানে রেডিও এবং টিভিতে চিকিৎসকগণ নিজের পরিচিতি অব্যক্ত রেখে অংশ নিতে পারবেন। খেয়াল রাখতে হবে এরূপ অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণের মাধ্যমে তারা নিজের পশার বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রচারণা চালাবেন না। কোন চিকিৎসক তার নামের সাথে এমন কোন খেতাব ,পদবী , প্রতীক ব্যাবহার করবেন না , যাতে করে তার অতিরিক্ত বা বিশেষ যোগ্যতা সম্পর্কে অসত্য ধারনা জনসমক্ষে প্রকাশ পায়। শুধুমাত্র বাংলাদেশের ভিতরে বা বাইরে আইনসংগতভাবে গঠিত কর্তৃপক্ষের দেওয়া খেতাব , পদবী ও প্রতীক তাঁরা নামের সাথে ব্যবহার করতে পারবেন। সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট বিধি নিষেধ থাকা সত্ত্বেও আরোপিত বিধি নিষেধ উপেক্ষা করে চিকিৎসকের পশার বাড়ানোর লক্ষ্যে বিজ্ঞাপন অহরহ মুদ্রিত , প্রচারিত ও বিতরিত হচ্ছে ।

টেলিভিশনেও মেয়েদের রূপচর্চা ও ত্বকের পরিচর্যার জন্য চিকিৎসা প্রদানের বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়। এখানে অনেক নাম করা হাসপাতালের চিকিৎসকগণ অথবা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের চিকিৎসক-অধ্যাপকগণ পরামর্শ ও ব্যবস্থাপত্র দেন। সেই সাথে তারা নিজেদের ক্লিনিক বা মেডিকের সেন্টারের পরিচিতি প্রকাশ করেন। তাদের কাছে চিকিৎসা নিলে মেয়েরা রূপচর্চায় সফল হবে মর্মে মতামত দেন। এসব অনুষ্ঠানগুলোও প্রাগুক্ত নৈতিকতার বিধিমালার লংঘন করেই প্রচারিত হয়।

চিকিৎসা সংক্রান্ত নৈতিকতার বিষয় জেনেশুনেও এই সব চিকিৎসকগণ নিজেদের পশার বাড়ানোর জন্যই এসব অনুষ্ঠানে অবলীলাক্রমে সাগ্রহে আসেন। এই সব প্রচারণার ডামাডোলে সত্যিকারের নিবেদিত প্রাণ চিকিৎসকেরা হয়ে পড়ছেন কোন ঠাসা। চিকিৎসা প্রার্থী রোগাক্রান্ত ও অসুস্থ জনগণ এবং তাদের স্বজনেরা হচ্ছেন বিভ্রান্ত। এই বিভ্রান্তির কারণে অনেক সময়েই তারা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেন। এরূপ পরিস্থিতিতে রোগীর চিকিৎসা হয় বিলম্বিত , যা তার জন্য ক্ষতিকর পরিণতি ডেকে আনে।

এই পরিস্থিতি প্রমাণ করে আমাদের নৈতিকতা ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতায় ভাটা পড়েছে। বিবেকবোধ ও মানবিক মূল্যবোধ অনৈতিকায় আপ্লুত অর্থলিপ্সু মহলের চেতনা থেকে আজ অপসৃত। তারপরও বুদ্ধিজীবী মহলের বিশাল অংশের মনন ও মানসিকতায় এই কালিমা প্রভাব ফেলতে পারেনি। দেশ ও জনগণের স্বার্থে তাদেরকেই এই সব চিকিৎসার অংগনে অনৈতিক প্রচারণার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে। একবার প্রতিবাদের আওয়াজ উঠলে স্বতঃস্ফ’র্ত গণ-প্রতিরোধ গড়ে উঠবেই।

তার থেকেই সূচিত হবে চিকিৎসা ক্ষেত্রে নৈতিকতার বিজয়। সার্থক হবে ‘বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল কোড অব মেডিকেল ইথিকস’ প্রণয়ন। লেখকঃ সাবেক জেলা ও দায়রা জজ ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.