আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ম্যারাডোনার দেশে-২

অলসদের দিয়ে কী আর হয়। আলসেমি ছাড়া! ম্যারাডোনার দেশে-১ এটি একটি ছোট ১৬ সিটের বাস। ওঠার পর দেখলাম আমরাই শুধু। একটু অবাক হলাম কারণ আমাদের সঙ্গে একই বিমানে আসা পাকিস্তান দলকে ওরা বলেছে সিট নাই! তবে, একটু পর বুঝলাম। এয়ারপোর্টটি শহর থেকে দূরে।

রওনা হওয়ার অনেকক্ষণ পরে বাস এসে শহরের টার্মিনালে থামলো। সেখান থেকে দুইটি পরিবার উঠলো আমাদের সঙ্গে। আমরা মোট হলাম ১২ জন। ৪টা সিট ফাঁকা। বাকীরা ঘুমিয়ে কাদা হরেও আমি রাতের আর্জেন্টিনা দেখার চেষ্টা করলাম।

বিশেষ করে হাইওয়ের ব্যাপারটা। অন্যান্য দেশের মতো হাইওয়ে প্রশস্থ এবং আসা যাওয়ার ভিন্ন রাস্তা। মাঝখানে দুই রাস্তা সমান খালি জায়গা। অর্থাৎ আগামী ১০০ বছর পর্যন্ত গাড়ি বাড়লেও রাস্তা বড় করতে কোন সমস্যা হবে না। তবে, থেকে থেকে স্পিডব্রেকারে খাবি খাচ্ছিলাম।

থেমে যাচ্ছিল বাসও। আর প্রতিবারই দেখলাম ড্রাইভার টাকা বের করছে জানালা দিয়ে। টোল প্লাজা। প্রথমবার ভেবেছিলাম ব্রিজ হবে। পরে বুঝলাম ব্রিজ না।

রাস্তাই। (ফেরার সময় সহ গুনে মোট ১১টা ট্রেস করতে পেরেছি। আরো ২/১টা কমবেশি হলেও হতে পারে। ) মিনিবাসের টোল ৭ পেসো করে কয়েকটা খেয়াল করলাম। আর্জেন্টনার মুদ্রা পেসো।

আমাদের দলনেতা ড. মাহবুব মজুমদার আমাকে বলেছিল যেন এয়ারপোর্ট থেকেই ডলার চেঞ্জ করি। করলামও। ওক ডলার = ৩.৬৭ পেসো ওরা কেনে। আর বিক্রি করে ৪.৭৭ পেসোতে। ওদের জন্য এক পেসো, আমার জন্য!!! যাহগে কী আর করা।

রাত আড়াইটার দিকে এক পেট্রোল পাম্প (ওরা বলে GNG) সংলগ্ন ক্যাফেটারিয়ায় বাস থামলো (একটি মাত্র সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতি। আশা করি এই সময়ের মধ্যে... :পি) ড্রাইভার কিছু না বলে নেমে গেল। আমি আর সৌরভ নামনাম ছোট ঘরে যাবো বলে। ক্যাফেটারিয়া বিশাল। তবে, কোন কাস্টোমার নাই।

রাত বিরেতে দলবেধে মনে হয় লোকজন চলাচল করে না। বিক্রেতারা আছে। যাত্রাবিরতি শেষে আমরা উঠে পড়লাম গাড়িতে। এবার আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমভাঙ্গতেই দেখলাম একটা বড় সাইনবোর্ডে বাতি দিয়ে লিখ রেখেছে মার ডেল প্লাটা।

ঘড়ি দেখলাম ৫.২৫ বাজে। বুঝলাম এসে পড়েছি। বাস থেকে নেমে আইএমওর ভলান্টিয়ার বা গাইডের খোজ করলাম। দেখলাম কেহ নাই। একটু বিরক্তও হলাম।

কারণ এখন এখানে যদি খুজে খুজে জোটেল বের করতে হয় তাহলেতো খবর আছে। তা একটু পর দেখলাম আর একটা মিনিবাস আসলো। ড্রাইভার ব্যাটা নামতে এগিয়ে গেলাম। সে আমারে দেখে বললো- হোটেল প্রভিন্সিয়াল? বুজলাম বাহক এসে পড়েছে। প্রভিন্সিয়াল হোটেলের লবিতে আইওমএর লোগো ওয়ালা একজনকে পেয়ে গেলাম।

আমাদের স্বাগত জানিয়ে জানালো আমাদের গাইড আমাদের আনতে বাস স্টপেহে গিয়েছে। এক্ষুনি এসে পড়বে! একটু পর এসে পড়লো আমাদের আমাদের গাইড মাউরো শিলম্যান। হাসিখুশী চমৎকার ছেলে। ও বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত আর কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়ছে। ২০০৭ সালে ভিয়েতনামে আর ২০০৮ সালের স্পেনের আইওমওতে অংশ নেয়া।

ঝুড়িতে একটা ব্রোঞ্জ পদকও আছে। আমাদের রুমে পৌছে দিয়ে ও জানিয়ে গেল সকাল সাড়ে ৯টার সময় আমাদেরকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য রওনা হতে হবে। প্রায় ৪০ ঘন্টা জার্নির পর আমরা রেডি হওয়ার জন্য পেলাম মাত্র ২ ঘন্টা! আমাদের ৬ জনকে ৪টি রুম দেওয়া হয়েছে। একটি রুমে ধনঞ্জয় আর মুগ্ধ, অন্যটিত সৌরভ আর মাহি আর আদিব বেচারা পড়েছে অন্য দেশের একজনের সঙ্গে। আবিদ সবার ছোট আবার এইবারই প্রথম।

আমি বললাম কে যেতে চাও পাশের রুমে। ভেবেছিলাম বড় দুইটার একটা রাগি হবে। তা অবশ্য ওদের কোন আগ্রহ দেখা গেল না। সৌরভই এগিয়ে আসলো। ও চলে গেল হংকং-এর শিক্ষার্থীর সঙ্গে! করিডরের একপাশে ওদের তিনটে রুম আর উল্টোদিকে আমার রুম।

রুমে কাউকে দেখলাম না। ভাবলাম পরে আসবে (পরে আর কেহ আমার রুমমেট হয়নি)। রুমে ফিরে আয়োজকদের দেওয়া ব্যাকপ্যাক খুলে দেখা গেল সেটাতে আছে একটা হাতাকাটা উলের জ্যাকেট আর একটি ছাতা!!! বুঝলাম আর্জেন্টিনার শীতের সঙ্গে বৃষ্টির কোন বৈরিতা নেই। অন্যান্য কাগজপত্রতো আছে। সব আইওমওতে কোন বড় থিয়েটার হলে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়।

সেখানে যেতে হয় পায়ে হেটে নাহয় বাসে করে। তবে, এখানে রেডিও সিটি অডিটরিয়ামটা কাছেই। কাজে আমাদের রওনা হতে হল হেটেই। হাটতে গিয়ে টের পেলাম এটি অন্য আইওমওর থেকে আলাদা। আমাদের শোভাযাত্রার সম্মুখে আর্জেন্টিনার ঐতিহ্যবাহী গায়ক আর বাদকদের একটি দল।

তারা পুরোটা পথ নেচে গেয়ে আমাদের নিয়ে গেছে উদ্বোধনী হলে। সঙ্গে রণপাওয়ালা দুইজনও ছিলেন। একটা হৈ হৈ ভাব নিয়ে আমরা পৌছে যাই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। আইএমওর নিয়মানুসারে নিজ নিজ দলের দলনেতাদের সঙ্গে প্রতিযোগীদের ‘চোখের দেখা’ হয়েছে এই অনুষ্ঠানে। মিলনায়তনে বাংলাদেশ দলের দলনেতা মাহবুব মজুমদার হাত নেড়ে আমাদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।

এই সময় নিজেদের প্ল্যাকার্ড উচু করে আমরা তার দৃষ্টি আকর্ষন করি। এই সময় এক চমৎকার দৃশ্যের জন্ম হয়। আইএমওর প্রথা অনুসারে মাহবুব মজুমদার ৪ জুলাই থেকে অন্য দলনেতাদের সঙ্গে অজ্ঞাতবাসে রয়েছেন। সেখানে তাঁরা অলিম্পিয়াডের প্রশ্ন আর কীভাবে নম্বর দেওয়া হবে সেটি চূড়ান্ত করেছেন। সব উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মতো এখানেও কিছু আনুষ্ঠানিকতা থাকে।

থাকে বক্তৃতা ও উদ্বোধন ঘোষণা। যারা বক্তব্য দিয়েছেন তারা আশা প্রকাশ করেছেন যাতে আজকের খুদে গণিতবিদরা বিশ্বের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে তাদের দক্ষতা কাজে লাগাতে পারে। আইএমওর সভাপতি রাশিয়ার নজর আগাখানভের অবশ্য একটি কষ্ট করতে হয়নি। প্রতিবার সভাপতি ইংরেজিতে বক্তৃতা দেওয়ার পর স্বাগতিকদের ভাষায় তার অংশবিশেষ বলেন। এবার উপস্থাপিকা নজরের বক্তৃতা সঙ্গে সঙ্গে স্প্যানিশ ভাষায় অনুবাদ করে দিয়েছেন! এবারই প্রথম প্রতিযোগীদের, দলনেতা, উপদলনেতাদের শপথ গ্রহণকরানো হয়।

এটি প্রথমবার। আইএমওর নিয়মকানুন মেনে চলার জন্য সবাই দাড়িয়ে শপথ গ্রহণ করে! এরপর শুরু হয়ে যায় অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মার্চপাস্ট। ইংরেজি বর্ণমালা অনুসারে একে এক মঞ্চে ওঠে সব দেশের অংশগ্রহণকারী। শুর হয় আর্জেন্টিনাকে দিয়ে। বাংলাদেশের দুটো পতাকা নিয়ে আমরাও উঠে পড়লাম মঞ্চে।

আর্জেন্টিনার ঐতিহ্যবাহী নাচিয়েরা প্রত্যকেটি দলকে মঞ্চে স্বাগত জানায়। অনেকগুলো দেশের প্রতিযোগীরা মঞ্চে যথেষ্ট লাফালাফি করে। আমাদের ওরা অবশ্য এতো দ্রুত মঞ্চ পার হল যে, যারে ছবি তুলতে দিয়েছিলাম সে একটার বেশি ছবি তুলতেও পারেনি!!! কুচকাওয়াচের শেষ ছিল ছিল ওদের গান আর নাচ। এক ফাঁকে স্প্যানিশ ভাষায় আইএমও এনথেমও শোনানো হল। তবে, শুরুতে খুবই মজার অভিজ্ঞতা হল যখন আর্জেন্টিনার জাতীয় সংগীত বাজানো হল।

গানের মুখটি যথেষ্ট বড়। আবার শুরোতে প্রায় ৩০-৪৫ সেকেন্ডের বাজনা। আবার মুখ গাওয়ার পর একটু পজ এবং যন্ত্রসংগীতও নেমে গেল একেবারে নিচের লাইনে। ফলে আমরা অনেকেই হাততালি দিয়ে বসে পড়তে গেলাম। আর তখনি শুরু হলো প্রথম অন্তরা।

গানের সুরটি খুবই সুন্দর। সব দেশের জাতীয় সংগীতের সময় আবেগে সবাই আপ্লুত হয়। ইংরেজি বর্ণমালার সুবিধা নিয়ে আমি বসেছিলাম দ্বিতীয় সারিতে। প্রথম সারিতে অভ্যাগত অতিথিদের সবাইকে দেখলাম বেশ উচ্চস্বরেই গাইলেন তাদের জাতীয় সংগীত। অনুষ্ঠান শেষে অন্যদের সঙ্গে আমরা হোটেলে ফিরে আসি।

পরের দুইদিন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। আমাদের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় অংশ নেবে। আমি হয়তো এদিক সেদিক যাবো। তবে তার আগে ভ্রমণের ক্লান্তি দূর করার জন্য ঘুমের দরকার। গ্রাসিয়াস (ধন্যবাদ) পরের পর্ব – পরীক্ষার দুইদিন |[ছবি আমার ফেসবুক এলবামে] ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.