আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ম্যারাডোনার দেশে-১

অলসদের দিয়ে কী আর হয়। আলসেমি ছাড়া! এমিরেটস-এর বড়ো ডানার বিমানটি গোত্তা খেয়ে নিচের দিকে নামতে শুরু করলো। আমাদের চোখের সামনে ফুটে উঠলো বুয়েনার্স আয়ার্স শহর। আর্জেন্টিনার রাজধানী। ফুটবলের বরপুত্র ডিয়াগো মারাডোনার শহর।

সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বলে অন্ধকার থাকার কথা। তবে, ওপর থেকে আমি দেখলাম খালি বাতি আর বাতি। আমাদের ঢাকা শহরেও এরকম নামার সময় বাতি দেখা যায় তবে সেখানে মাঝে মাঝে কালো ছোপ ছোপ থাকে। সেগুলো লোডশেডিং এলাকা! বুঝলাম বুয়েনার্স আয়ার্সে লোডশেডিং নাই!!! আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পয়াড (আইএমও – http://www.imo-official.org) –এর ৫৩ তম আসরে যোগ দেওয়ার জন্য আমরা ম্যারডোনার দেশে এসেছি। রওনা দিয়েছি ৭ জুলাই রাতে বাংলাদেশ সময়।

এখানে আসতে আসতে বাংলাদেশে ৯ তারিখে সূর্য উঠে পড়েছে। দুবাই থেকে প্রায় ২০ ঘন্টার বিমান যাত্রা। অবশ্য ফাঁকতালে আমরা পেলের দেশের এয়ারপোর্টও দেখে ফেলেছি! আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আসতে হয় বলে, হয়তো, বিমানটি থামে ব্রাজিলের রাজধানী রিও ডি জেনিরোতে। সেখানে প্লেনের ভেতরটা পরিস্কার করার জন্য আমরা যারা বুয়েনার্স আয়ার্সের যাত্রী তাদেরকে বিমানবন্দরের লাউঞ্জে নামিয়ে দেওয়া হয়। ঘন্টা দেড়েক সেখানে অপেক্ষা করে আবার বিমানে উঠে পড়া।

আমি ভাবলাম আবার কবে ব্রাজিলে পা পড়বে, স্মৃতি হিসাবে একটি স্যুভেনির নিয়ে যাই! আমার সঙ্গে বাংলাদেশ গণিত দলের পাঁচ সদস্য। ধনঞ্জয় বিশ্বাস, তানজীম শরীফ মুগ্ধ, সৌরভ দাশ, নূর মোহাম্মদ সফিউল্লাহ এবং আদিব হাসান। তোমরা অনেকেই হয়তো জানো গত প্রায় এক দশক ধরে বাংলাদেশে গণিতের একটি উৎসব হয়। দেশের শিক্ষার্থীদের গণিতভীতি কাটিয়ে ওঠার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে এই ডাচ বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো গণিত উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই উৎসবের মূল পর্ব হচ্ছে গণিত অলিম্পিয়াড!!! অলিম্পিয়াড শুনে অবাক হচ্ছো? ভাবছো, অলিম্পিক তো খেলাধুলার।

দৌড়, ঝাপ, সাঁতার আর অন্যান্য ক্রীড়ার। এখানে গণিত আসলো কোথা থেকে। ঠিক শুনেছো। এটি গণিতেরই অলিম্পিয়াড। ১৯৫৯ সালে রুমানিয়ায় প্রথম একটি আন্তর্জাতিক মেধার লড়াই-এর আযোজন করা হয়।

নানান দেশ থেকে সেখানে হাই স্কুলের শিক্ষার্থীরা গড়ো হয় অঙ্ক করবে বলে। আযোজকরা এর ব্যাপ্তি আর লড়াই-এর ধরণ দেখে এর সঙ্গে অলিম্পিকের মিল খোজে পান। অলিম্পিকে যেমন নানান দেশের ক্রীড়াবিদরা ক্রীড়ার শ্রেষ্ঠত্বের জন্য লড়ে তেমনি এখানে বিশ্বের খুদে গণিতবিদরা তাদের মেধার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে। কাজে এটিও অলিম্পিয়াড। (এখন অবশ্য গণিত ছাড়াও অন্যান্য বিষয় যেমন পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, ইনফরমেটিক্স ইত্যাদি বিষয়েরও অলিম্পিয়াড হয়ে থাকে)।

১৯৫৯ সাল থেকে শুরু হলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা এই অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করছে এইতো সেদিন ২০০৫ সাল থেকে। ২০০৩ সালে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি গঠন হওয়ার পর থেকে আমাদের এই অংশগ্রহণ। আমি যেহেতু এই কমিটির সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশের পক্ষে সমন্বয়কারী তাই প্রতিবছরই আমি বাংলাদেশ গণিত দলের সঙ্গে আইএমওতে যাই, উপ-দলনেতা হিসাবে। আইএমওর নিয়মানুসারে প্রত্যেক অংশগ্রহণকারী দেশ ৬ জন পর্যন্ত প্রতিযোগী পাঠাতে পারে। এই প্রতিযোগীদের নির্বাচন করা হয় একটি কঠিন প্রক্রিয়ায়।

এই ধরো আমাদের এই পাঁচজন। ওরা কেমন করে আর্জেন্টিনার জন্য নির্বাচিত হলো শুনবে? ২০১২ সালের জন্য সারাদেশের ১৭টি জেলা শহরে আঞ্চলিক গণিত উৎসব হয়েছে। এইগুলোতে অংশ নিয়েছে প্রায় ২২ হাজার শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে যারা বিজয়ী হয়েছে, অর্থাৎ প্রায় ৮০০ ছেলমেয়ে ঢাকার জাতীয় উৎসবে অংশ নিয়েছে। সেন্ট যোসেফ স্কুলে ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার ও শনিবার অনুষ্ঠিত হয়েছে এবারের জাতীয় উৎসব।

সেখানে ওদের যে সব গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে হয়েছে তার কোনটি বাংলাদেশের কোন স্কুল বা কলেজের পরীক্ষায় কোনদিন আসে নি। কাজে সম্পূর্ণ নতুন সমস্যার সমাধান করে সেখানে বিজয়ী হতে হয়েছে। বিজয়ীদের মধ্য থেকে ৪০ জনকে নির্বাচন করা হয় বাংলাদেশ জাতীয় গণিত ক্যাম্পের জন্য। গণিত ক্যাম্প এক মজার জায়গা। এখানে ক্যাম্পাররা সকালে অঙ্ক করে, দুপুরে অঙ্ক করে, বিকেলে অঙ্ক করে এমনকী রাতে যখন ঘুমোতে যায় তখনো স্বপ্নে অঙ্ক করে।

তবে শুধু যে অঙ্ক করে তা নয়। ওখানে অনেক নতুন বন্ধু হয়, অনেক নতুন বিষয় শেখা যায় আর সবচেয়ে বড় কথা সবার সঙ্গে মিলেমিশে থেকে দেশের জন্য, আমাদের দেশের জন্য এক গভীর ভালবাসার জন্ম হয়। সেখানে পরীক্ষাও হয় আর তা থেকে ১৫ জনকে বাছাই করা হয় আর একটি ক্যাম্পের জন্য। এই ক্যাম্পটির কোন আলাদা নাম নেই। তবে এটিকে আইএমও দল নির্বাচনের ক্যাম্প বলা যায়।

এই ক্যাম্পে সবাই খালি পরীক্ষা দেয়। সকালে, দুপুরে রাতে। আর মাঝে মধ্্যে বড়রা এসে সেখানে কিছু ক্লাস নেয়। সব মিলিয়ে মানে বাংরাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড, জাতীয় গনিত ক্যাম্প দল নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে আইওমওর জন্য দল নর্বাচন করা হয়। তবে, শুধু অঙ্ক করার দক্ষতা দেখা হয় না।

দেখা হয় তাদের শৃংখলা, পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা আর অন্যকে সাহায্য করার প্রচেষ্ঠা। এবার তাহরে বুঝেছো যে কতো চড়াই-উৎরাই পার হযে ধনঞ্জয় আর অন্যরা আর্জেন্টিনার জন্য নির্বাচিত হয়েছে। তো, আমরা এয়ারপোর্টে নেমে গরম জামাকাপর পরে নিলাম। জুলাই মাসে? হ্যা। কারণ আর্জেন্টিনা দক্ষিণ গোলার্ধের দেশ।

আমাদের যখন গরমকাল ওখানে তখন অনেক শীত। নিজেদের বাক্সপেটরা নিয়ে আমরা যখন এরাইভাল লাউঞ্জে আসলাম দেখা হল আইওমও ভলান্টিয়ারদের সঙ্গে। আমাদেরকে যেতে হবে বুয়েনার্স আয়ার্স থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে মারডেল প্লাটা শহরে। সেখানে এবারকার অলিম্পিয়াড হবে। আমরা ঢাকা থেকেই এই যাত্রার টিকেট করে গিয়েছিলাম।

সেটি ভলান্টিয়ারকে দেখাতে আমাদেরকে বাস কাউন্টারে যোগাযোগ করিয়ে দিল। আমরা আমাদের টিকেট হাতে পেলাম। আমাদের যাত্রা শুরু হবে রাত সাড়ে এগারোটায়। এখন বাজে মাত্র ৯টা! কী করি। এরাইভাল লাউঞ্জে আমরা পেয়ে গেলাম ম্যাকডোনালডের দোকান।

ব্যাস। আলুভাজি, বার্গার আর চিকেন নাগেট দিয়ে হয়ে গের আমাদের রাতের খাবার। রাত সাড়ে এগারোটায় আমাদের মিনিবাস যাত্রা শুরু করলো বুয়েনার্স আয়ার্স থেকে। আমার সঙ্গীরা প্রায় সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি মাঝে মধ্যে দেখছিলাম রাতের আকাশ।

সবার সেকেন্ড ডিফারেন্সিয়াল নেগেটিভ হোক। পরের পর্ব- উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.