আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নাট্যকার হিসেবে হুমায়ূন যেমন সেরা, তেমনি দুষ্টুমিতেও ষোলোআনা পটুঃ নওয়াজিশ আলী খান

ঃঃঃঃ চল বহুদূরে...নির্জনে আড়ালে লুকোই...ঃঃঃ নাট্যকার হিসেবে হুমায়ূন যেমন সেরা, তেমনি দুষ্টুমিতেও ষোলোআনা পটু। ময়মনসিংহে আমরা তখন জননী টেলিছবির চিত্রায়ণ করছি। আমাদের ইউনিটে ছিলেন অভিনেতা সালেহ্ আহমেদ। তিনি ময়মনসিংহের বাসিন্দা। সেদিন বেশ আগে শুটিং শেষ হওয়ায় আগেভাগে বাড়ি চলে গেছেন তিনি।

হঠাৎ হুমায়ূনের মনে হলো, সালেহ্ আহমেদকে ভয় দেখাতে হবে। যেই কথা সেই কাজ। গভীর রাতে খালি গায়ে সালেহ্ আহমেদের বাড়িতে গিয়ে গেটের মধ্যে তুমুল শব্দে দুড়ুম-দাড়ুম করলাম আমরা। কী হলো কী হলো—বাড়ির সবাই ভয়ে অস্থির। এর মধ্যে ভেতর থেকে জনা কয়েক লোকসহ সালেহ্ এলেন লাঠিসোঁটা নিয়ে।

এসেই দেখেন আমরা—খালি গায়ে লুঙ্গি পরা অবস্থায় আমি আর হুমায়ূন। এভাবে নানা রকম দুষ্টুমি করে মজা পেতেন হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর মধ্যে বোধ হয় সারাক্ষণই এক উচ্ছল শিশু বাস করত—শিশুটির নাম কাজল। খোয়াবনগর নাটকে শীলা আহমেদ কথাসাহিত্যিক—এটাই তাঁর প্রধান পরিচয়। তবে তিনি ভ্রমণ করেছেন সংস্কৃতির নানা বৈচিত্র্যময় পথে।

নাটক, চলচ্চিত্র, সংগীতের সঙ্গে পাতিয়েছেন সখ্য। তাঁর নন্দিত নরকে ও শঙ্খনীল কারাগার আগেই পড়া ছিল। কিন্তু প্রচণ্ড ভালোলাগা এই বই দুটির লেখক তখনো আমার অচেনা। আশির দশকের প্রথম দিকে আমি বিটিভিতে সাহিত্যনির্ভর ধারাবাহিক রত্নদ্বীপ নির্মাণ করছিলাম। ওই অনুষ্ঠানের জন্য একবার ইব্রাহীম খানের ‘পাখির বিদায়’ গল্পটি নির্বাচন করলাম।

গল্পের নাট্যরূপ চিত্রায়ণের জন্য ধানমন্ডির দখিন হাওয়াতে এসেছি। এই বাড়িতে সে সময় বাস করতেন গুলতেকিনের বাবা হাবিবুর রহমান খান, সম্পর্কে যিনি হুমায়ূন আহমেদের শ্বশুর। এখানেই নন্দিত নরকে উপন্যাসের লেখকের সঙ্গে প্রথম পরিচয়। চকচকে লাল জামা গায়ে, বড় মেয়ে নোভাকে কোলে নিয়ে বসে আছেন তিনি—নিপাট ভদ্রলোক। আলাপ-পরিচয়ের একপর্যায়ে বললাম, ‘আপনার উপন্যাস তো অসাধারণ! এর মধ্যে অনায়াসেই সংলাপ বসিয়ে দেওয়া যায়।

নাটক লেখেন না কেন? টেলিভিশনের জন্য নাটক লিখুন। ’ এবার হুমায়ূন আহমেদের কাটকাট জবাব, ‘নাটক লেখা আমার কাজ নয়। আমি পারব না। ’ এরপর অনেক কষ্টে, দীর্ঘ সময় তাঁর পেছনে লেগে থেকে নাটক লিখতে তাঁকে রাজি করালাম বটে, কিন্তু হুমায়ূনের লেখা প্রথম দুটি নাটক রাজনৈতিক জটিলতা এবং বিটিভির নিজস্ব সীমাবদ্ধতার কারণে নির্মাণ করা যায়নি। সম্ভবত ১৯৮৩ সালে হুমায়ূন আহমেদের লেখা প্রথম টেলিভিশন নাটক প্রথম প্রহর নির্মাণ করি আমি।

তাঁর নাটকের পাণ্ডুলিপি পড়ে আমি তো অবাক—ছোট ছোট দৃশ্য, ছোট সংলাপ, সংলাপে আরোপিত কোনো ব্যাপার নেই, একদম মুখের ভাষায় লেখা! তাঁকে বললাম, ‘অসাধারণ!’ আসলে তাঁর সব লেখাই আমার কাছে অসাধারণ লাগে। তাই রসিকতা করে তিনি বলতেন, ‘নওয়াজিশ আলী খান আমার লেখা পড়েও বলেন অসাধারণ, না পড়েও বলেন অসাধারণ। ’ প্রথম প্রহর নাটকের অভিনেতা আবুল হায়াত, মাসুদ আলী খান, লাকী ইনাম, রিটা আফরিনসহ আরও অনেকে। এর বিষয়বস্তু ছিল মানুষের সততা নিয়ে। প্রচারের পর চারপাশ থেকে অভূতপূর্ব সাড়া পেলাম।

তখন কোনো অনুষ্ঠান প্রচারিত হলে প্রযোজকদের সেভাবে কেউ ফোন করতেন না। কিন্তু প্রথম প্রহর-এর ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটল। বেলাল বেগ আমাকে ফোন করে বললেন, ‘এই নাট্যকারের ভাষাভঙ্গি দারুণ। একে আপনি ছাড়বেন না। যত পারেন এর কাছ থেকে নাটক আদায় করে নেন।

’ এরপর নিয়মিতভাবে তাঁর লেখা নাটক প্রযোজনা করেছি—অসময়, অযাত্রা, বিবাহ, এসো নিপবনে, নিমফুল... কত কত নাম। এর মধ্যে হুমায়ূন আহমেদের প্রথম ধারাবাহিক এইসব দিনরাত্রি প্রচারিত হয়েছে মুস্তাফিজুর রহমানের প্রযোজনায়। এটা এক তেলেসমাতি নাটক, বাংলা নাটকের ব্যাকরণই যেন পাল্টে দিলেন তিনি! বহুব্রীহি তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম ধারাবাহিক। ধারাবাহিক হলেও এই নাটকের প্রতিটি পর্ব ছিল বিষয়ভিত্তিক, স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাংলাদেশের টিভি নাটকের ক্ষেত্রেও ঘটনাটি নতুন।

যেমন: মিথ্যা কথা বলব না, পুষ্টি সংরক্ষণের জন্য সপ্তাহে এক দিন মাছ খাব না—প্রতিটি পর্বে বিষয়গুলো ছিল এ রকম। এই নাটকের মাধ্যমে সে সময় মুক্তিযুদ্ধকে নতুনভাবে জাগিয়ে তুললেন হুমায়ূন। একটি মাত্র সংলাপ ‘তুই রাজাকার’-এর মধ্য দিয়ে স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতি ছড়িয়ে দিলেন তীব্র ঘৃণা। তখনকার বাস্তবতায় ঘটনাটি কিন্তু সহজসাধ্য ছিল না। তখন থেকেই মানুষের মুখে মুখে ফিরছে সংলাপটি।

বহুব্রীহির পর অয়োময়—কত না স্মৃতিময় সে দিনগুলো। অয়োময়-এর চিত্রায়ণ হয়েছিল ময়মনসিংহে। মনে পড়ে, রাতভর শুটিং করতাম আমরা। শুটিং শেষে টিচার্স ট্রেনিং ইনিস্টিটিউটের হলরুমে গণবিছানা করে দল বেঁধে যেতাম ঘুমাতে। আবার শুটিংয়ের অবসরে অনেক মজার মজার কথা বলতেন হুমায়ূন।

তখন এক পর্বের নাটক নির্মাণ করতে সময় লাগত প্রায় ১৪ দিন। এই সময়জুড়ে নাটকের মহড়া, চিত্রায়ণ ও সম্পাদনা—সবকিছুর সঙ্গেই যুক্ত থাকতেন তিনি। পরবর্তী পর্যায়ে সুনির্মাতা হিসেবে তিনি যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, এর পেছনে এগুলোর বড় ভূমিকা রয়েছে। অয়োময় নাটকে হুমায়ূনের মেয়ে শীলাকে অভিনেত্রী হিসেবে আবিষ্কার করি আমি। হুমায়ূনেরও সায় ছিল এতে।

শীলা আহমেদ একজন অসাধারণ অভিনয়শিল্পী। ওর সেই অনন্য অভিব্যক্তিগুলো আজও মনে পড়ে। মুলঃ নওয়াজিশ আলী খান ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.