এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি
মানব চরিত্র নানা বিষয়বৈচিত্র আর জটিলতার মিশেল। চোখ মেললেই এসব চরিত্রের সাথে আমাদের কারো না কারো যোগাযোগ প্রেম পরিচয় ভালোবাসা ভালোলাগা ঘটে। মানুষের জীবনের সব পরিণতি কি সুখকর না বেদনায় ভরপুর অথচ সুখের সুদৃশ্য মোড়কে আচ্ছাদিত জীবনচক্র। এ অপার বেদনাভার নির্ণয়ে কিংবা কষ্টের তুলিতে মুখের প্রতিচ্ছবি আকঁতে কজন সিদ্ধ। সে অন-র্জালা বুঝবার অন-র্দৃষ্টিই বা কজনের আছে।
তেমনি একজন রোকেয়া ইসলাম। নাট্যঅঙ্গনের এক পরিচিত মুখ। সমপ্রতি বৃষ্টিমুখর এক উষ্ণ সন্ধ্যায় নাটক, নাটকের বর্তমান ও ভবিষ্যত নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন তিনি। এ আড্ডার সারসংক্ষেপ পাঠকদের জন্য পত্রস' করা হল।
লেখালেখির শুরু কখন কিভাবে?
আসলে প্রতিটি মানুষই হল কবি , পড়তে পড়তেই নিজের ভেতর জন্ম নেয় কিছু অধরা বোধ, যা কাউ কেই বলা যায়না।
কাগজে লেখা যায় সে ভাবেই লিখতে শুরু করি নিজের অজানে-ই, ৭২ সালে দেশ সবেমাত্র স্বাধীন হয়েছে। আমাদের পাড়ার ছেলেরা একুশে সংকলন বের করবে একটা কবিতা চাইলো। ছাপাও হল।
তখন কি নিয়মিত লিখতেন ?
অজানে-র লেখা কি নিয়মিত হয়? স্কুলে পড়াকালীন সময়েই আমার বিয়ে হয়ে যায় । বিয়ে হলেও একাডিমীক পড়াশোনাটা ছাড়িনি।
তাহলে কি লেখা-লেখি ছাড়লেন ?
ছাড়লাম ঠিক না। বিরতি দিলাম বলতে পারেন সংসার স্বামী সন-ান ও পড়াশোনা। সব মিলে জীবন যুদ্ধে লড়ছি। এর ফাকে খাতায় লিখছি সময় পেলেই।
আবার শুরু করলেন কিভাবে?
১৯৯৪ সালে ছড়াকার গোলাম রব্বানী রতন আমার একটা পুরানো খাতায় এলোমেলো কিছু লেখা দেখে গল্প লেখতে বলে।
ওর জোড় তাগাদায় শুরু করলাম লেখা। একদিন একটা পত্রিকা এনে দেখায় আমার একটা গল্প ছাপা হয়েছে তাতে। সেই লেখাটা আমার বাবাকে পড়তে দেই, পড়ে উনি কেঁদে ফেলেন, বাবার চোখের সেই অশ্রু বিন্দুই পরে আমাকে লিখতে সাহায্য উৎসাহ যুগিয়েছে।
শুরু করেছিলেন কবিতা দিয়ে কিন' গ্রন' এলো গল্পের । আর এখন আপনি নাট্যকার?
আমি কোন পরিকল্পনামাফিক লিখিনা।
যখন যা ভাবনায় আসে তাই লিখে রাখি। গল্প লিখতেই আমি স্বাছন্দ বোধ করি। তবে এখন নাটক বেশি লিখছি।
আপনার লেখার উপজিব্য কি? বিশেষ করে নাটকে ?
-প্রেম, মানবতা, জীবনের চোখে সময়ের রঙে জীবনকে দেখা।
আপনার কতগুলো নাটক প্রচারিত হয়েছে?
প্রায ১৭/১৮ টি তো হবেই।
বর্তমানে আমাদের দেশে নাটকে দেখা যায় বাংলা ভাষার বিকৃত রূপ। আপনি কী মনে করেন?
অনেকেই এখন নাটকে আঞ্চলিক ভাষা বেশি ব্যবহার হচ্ছে। এটাকে যদি কেই বাংলা ভাষার বিকৃত বলে তাহলে আমি বলব, এটা ভুল।
বর্তমান সময়ে বিদেশী সিরিয়াল এর অনুকরণে বা হুবহুব অনুবাদ করে নাটক প্রচার করছে আমাদের দেশীয় চ্যানেলগুলো। এতে কী আমরা নিজস্ব সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলছি।
আপনি কী ভাবছেন ? আপনি ঠিকি বলেছেন। একসময় বাংলাদেশের নাটকের মাধ্যমে বিভিন্ন পরিবারে তাদের বন্ধন আরো সুদৃঢ করতো। আর এখন ঔসব বিদেশী সিরিয়াল অনুকরণে হচ্ছে তার উল্টা। ফলে আমাদের সংস্কৃতির বিরাট ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। এটা এখনি প্রতিরোধ করতে না পারলে সামনে আরো ভয়াবহ পরিণতি হবে।
এ অবস'া থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী?
হ্যাঁ, আমরা যারা নাট্যআন্দোলনের সঙ্গে জড়িত, আমাদের সবাইকে , সাথে চ্যানেল কর্তৃপক্ষের যথাযথ নজর রাখতে হবে ।
আপনার কয়েকটি জনপ্রিয় নাটকের নাম বলুন।
পায়ের তলে বান ভাসি, চাপা খালা, বসন- তোমারই, মেঘ ভাঙ্গা রোদ, সুন্দর সকালে জন্য, বৈশাখ এল আনন্দ নিয়ে, মধুর আমার মায়ের হাসি, কর্ণেল ভিলা, টুক পলানতি টুকু, রাজা বাদশার কারবার, একজন সৈয়দ ও নাবিকের তোলপাড়, বার বার ফিরে আসে, সংসার সমুদ্রে (ধারাবাহিক)।
প্রথম গ্রন' প্রকাশিত হয় কবে ?
১৯৯৫ সালের বইমেলায় প্রকাশিত হয় গল্প গ্রন' --স্বর্গের কাছাকাছি।
আপনার লেখার মুক্তিযুদ্ধ কিভাবে প্রতিফালিত হয়?
মুক্তিযুদ্ধ শুধু আমার নয় এদেশের এমন লেখক খুঁজে পাওয়া ভার যার কলমে উঠে আসেনি মুক্তিযুদ্ধ।
শুধু মুক্তিযুদ্ধই নয় এদেশের হাজার বছরের শত শত সংগ্রাম আমাদের সাহিত্যকে করেছে সমৃদ্ধ, শিল্পকে অনেক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। আমার প্রথম টিভি নাটক “পায়ের তলে বানভাসি” বাচসাস পুরস্কারের জন্য নমিনেশনে ছিল, সেটা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধের বঞ্চনা নিয়ে লেখা ছিল। আমার লেখা তিন চারটা নাটকের প্রতিপাদ্য বিষয়ই ছিল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে।
আপনিও তো একটা স্কুল পরিচালনা করছেন।
হ্যাঁ, ১৯৯৬ সাল থেকে মীরপুর ডাইনামিক কিন্ডার গার্টেন” নামে একটি স্কুল পরিচালনা করে আসছি।
আমার জানামতে এটাই বাংলাদেশে একমাত্র ফ্রি কিন্ডার গার্টেন। তৃণমূলের জন্য এই স্কুল টা এখানে প্লে গ্রুপ থেকে (ররর) পর্যন- ৬০/৭০টি ছেলে মেয়ে লেখা পড়া করছে বিনা বেতনে।
আপনার সন-ানেরা কি করেছে?
আমার এক ছেলে দুই মেয়ে, ছেলে প্রকৌশলী রুবাইয়াত জামান টিটো এল, জি, ই, ডি তে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। বড় মেয়ে মিলভানা ইশরাত সোমা দাতের ডাক্তার। ছোট মেয়ে উম্মুল ওয়ারা রুম্পা মাত্র এম,বি,এ শেষ করলো।
আপনার স্বামীতো একজন মুক্তিযোদ্ধ। আমার স্বামী আসাদুজ্জামান আরজু কাদেরিয়া বাহিনীর একজন কোম্পানী কমান্ডার মুক্তিযুদ্ধের নিয়মিত খোজখবর করেন। সাহায্যে সহযোগিতা যতটুকু পারেন করেন। আমার স্বামীর প্রসঙ্গে বলতে গেলে বলতে হয় আমার শশুর সম্পর্কে আবদুর রহমান মিয়া ১৯৪৮ সালে টাঙ্গাইল জেলার বলরামপুর গ্রামে বিরাট এক জনসভার আয়োজন করা হয় সেই সভায় উপসি'ত ছিলেন মূখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন নূরুল আমিন, পীরে কামেল মওলানা মোহাম্মদ আবদুল বারী প্রখ্যাত গায়ক আব্বাস উদ্দিন, উক্ত সভায় স'ানীয় বেশ কিছু সমস্যার সাথে দু’টো দাবী জানানো হয় । একটি হল যমুনা নদীতে সেতু তৈরী অন্যটি হল এলাকায় একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করা।
সেই সভায় খাজা নাজিম উদ্দিন উর্দুতে ভাষণ দিতে গেলে আমার শশুর তাকে বিরত রাখে, পরে তিনি ইংরেজীতে ভাষণ দেন আমার শশুর তা বাংলায় তর্জমা করেন।
আপনার শৈশবের কোন স্মৃতি কী মনে পড়ে?
শৈশব থেকেই রাজনৈতিক আলোচনা শুনে শুনে বড় হয়েছি আমার মায়ের বড় মামা রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব আতাউর রহমান খান তৎকালীন মূখ্যমন্ত্রী ছিলেন। আমার বাবা ছিলেন উনার খুব প্রিয় ভাজন। বাবা সরাসরি রাজনৈীতি না করলেও রাজনীতি সচেতন ছিলেন বাংলাদেশের প্রতিটা অঞ্চলের মতোই টাঙ্গাইলও ছিল ১৯৬৯ থেকে আন্দোলনে উত্তাল, অনেক সময় মিছিলেও অংশ গ্রহন করতাম ৭ই মার্চের এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। কি প্রচন্ড ভাবে আলোড়িত করেছিল আমাদের প্রজন্মকে।
৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পরিবার জড়িত ছিল। গভীর রাতে গোপনে আমাদের বাসায় মুক্তিযোদ্ধারা আসতো, আমার বাাবা তাদের নানা ভাবে সহযোগিতা করতেন। মাঝে মাঝে বড় বড় পাতিলে ভাত তরকারি রান্না করাতেন, ব্যাপারটা খুবই গোপনে করতেন কখনও কখনও আমার মাও টের পেতেন না। রান্না্ করা খাবারগুলো আমার ঘরের খাটের নীচে রেখে দিতেন। গভীররাতে বাবার তত্ত্বাবধানে খাবারগুলো চলে যেত যুদ্ধাক্লান- ক্ষধার্ত মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে।
নিম্ন আয়ের হিন্দু সমপ্রদায়ের কিছু মানুষ যারা বর্ডার পার হয়ে কলকাতার যেতে পারেনি, তারা রাতে ঘুমাতো। আমাদের বাড়ীর পেছনে একটা ঘর ছিল সেখানে সারা দেশ জুড়ে যখন মুক্তিযুদ্ধ চলছিল তখন আমার বাবা সার্কিট হাইজের বাউন্ডারী দেযালের কন্ট্রাক্ট পেয়েছিল কাজের তদারকি করতে করতেই আমাদের অনেক খবর সংগ্রহ করতেন, পরে তা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন।
আপনার গ্রনে'র সংখ্যা কত?
আমার মোট গ্রনে'র সংখ্যা ৬টি । চারটি গল্পগ্রন', দু’টো কাব্যগ্রন'।
আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।