আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় জাকাত সংগ্রহ ও বিতরণ

বৃটিশ ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় বাংলা ও আসাম প্রদেশের জনগণের গরিষ্ঠ অংশ ছিল ইসলাম ধর্মাবলম্বী , তারা ছিল বৈষম্যপীড়িত। এই কারণেই এই দুইটি প্রদেশ নিয়ে পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবী করা হয়েছিল ১৯৪০ সালের ২৩শে মার্চ তারিখে ‘নিখিল ভারত মুসলীম লীগে’র লাহোর অধিবেশনে। যা ঐতিহাসিক ‘লাহোর প্রস্তাব’ নামে খ্যাত। পরবর্তী ঘটনা প্রবাহের কারণে এই প্রস্তাব ১৯৪৬ সালে ‘নিখিল ভারত মুসলীম লীগে’র দিল্লী অধিবেশনে সংশোধন করা হয়। বৃটিশ ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় এবং পশ্চিমাঞ্চলীয় মুসলীম অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে একটি রাষ্ট্র গঠনের দাবী করা হয়।

সে মোতাবেক বৃটিশ সরকার ভারতবর্ষকে বিভক্ত করে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি রাষ্ট্র গঠন পূর্বক ১৯৪৭ সালের ‘ভারত স্বাধীনতা আইনে’র ভিত্তিতে তাদেরকে স্বাধীনতা প্রদান করে। পাকিস্তান ১৯৫৬ সালের ২৩শে মার্চ তারিখে নতুন শাসনতন্ত্র প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে নিজেকে ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ হিসাবে ঘোষণা করে। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে ঐ শাসনতন্ত্র বাতিল করা হয়। ১৯৬২ সালের ২৩শে মার্চ তারিখে নতুন শাসনতন্ত্র প্রবর্তিত হয় , তাতেও ‘ ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ নাম বহাল রাখা হয়। ১৯৬৯ সালে ব্যাপক গণ-অভ্যত্থানের ফলশ্রুতিতে ঐ শাসনতন্ত্রও বাতিল হয়।

জনপ্রিয় ৬-দফার ভিত্তিতে নতুন শাসনতন্ত্র প্রণয়নের প্রশ্নে তৎকালীন সামরিক সরকার ও জুলফিকার আলী ভূট্টোসহ পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাগণ প্রবল আপত্তি উত্থাপন করলে বাংলার স্বাধীনতার দাবী প্রবল রূপ ধারণ করে। পরিণতিতে পাকিস্তান দ্বিধা বিভক্ত হয় এবং বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। ১৩৭৯ বঙ্গাব্দের ১৮ই কার্তিক মোতাবেক ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর তারিখে গণপরিষদ কর্তৃক রচিত , বিধিবদ্ধকৃত ও গৃহীত সংবিধানে বাংলাদেশ ‘গণপ্রজাতন্ত্র’ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। পরবর্তীতে ২ক অনুচ্ছেদ সংযুক্তির মাধ্যমে ইসলাম ধর্মকে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেই সাথে আরো বলা হয় ‘...তবে হিন্দু, বৌদ্ধ , খ্রীষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন।

’ এতদঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে ইসলাম ধর্মের প্রভাব তাই অপরিসীম। ইসলামী ধর্মাচারণের অন্যতম মূল স্তম্ভ হচ্ছে জাকাত অর্থাৎ বিশিষ্ট দান। ইসলাম ধর্ম অনুসারে নেসাব পরিমাণ সম্পদের অধিকারী প্রত্যেক বালেগ মুসলমানের জন্য জাকাত প্রদান ফরজ। যার কাছে নিজের সাংবাৎসরিক ব্যয় নির্বাহের পরও ঋণমুক্ত সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা সমমূল্যমানের অর্থ বা সম্পদ রয়েছে তাকেই বলা হয় ‘সাহেবে নেসাব’। প্রত্যেক বালেগ মুসলমান নর-নারীর জন্য জাকাত প্রদান বাধ্যতামূলক।

জাকাত কারা পাবে সে সম্পর্কেও সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। পবিত্র কোর-আন মোতাবেক ‘ জাকাত (ছদকা) তো শুধু তাদের হক যারা গরীব , মিসকিন , যারা জাকাত আদায়ের কাজে নিযুক্ত , যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন এবং দাস মুক্তির জন্য ,ঋণগ্রস্থদের জন্য, আল্লাহর পথে এবং মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ হেকমতওয়ালা। ’ (সুরা আত তাওবা , আয়াতঃ ৬০) ।

অভাবগ্রস্থ অসহায় লোকদেরকে মিসকিন বলা হয়। জাকাত প্রাপ্তি বিষয়ে মিসকিনদের সম্পর্কে হজরত মুহম্মদ (সাঃ আঃ) বলেন, ‘...প্রকৃত মিসকিন সেই ব্যক্তি যার এমন সম্বল নেই যা তাকে অভাবমুক্ত রাখে। অথচ তার অবস্থাও কারও জ্ঞাত নয় যে, তাকে কেউ কিছু দান করে এবং সেও লোকের নিকট মুখ খুলে কিছু চায় না। ’ জাকাত প্রদান নিয়ে আমাদের দেশে অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে। প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে জাকাত দেবার প্রবণতা একটা গর্বের বিষয় বলে কেউ কেউ মনে করে।

এভাবে জাকাত দিতে গিয়ে জাকাত প্রার্থী মানুষের ভিড়ে পদদলিত হয়ে মানুষের মৃত্যুর অনেক ঘটনা ঘটেছে। প্রকাশ্যে দান করাকে নিষেধ না করা হলেও , গোপনে দান করাকেই ইসলাম ধর্মে উৎসাহিত করা হয়েছে। মানুষের মাঝে অর্থনৈতিক বৈষমের অবসান ঘটিয়ে , দারিদ্র দূর করে মানুষকে স্বনির্ভর ও স্বচ্ছল করাই জাকাত প্রদানের মূল লক্ষ্য। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের দাবীর সমর্থনে দিনে দিনে প্রবল জনমত গড়ে উঠে। তাই সরকারও এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্যোগ নেয়।

জাকাত সম্পর্কিত বিষয়ে তহবিল গঠনের জন্য ‘জাকাত তহবিল অধ্যাদেশ ,১৯৮২’ (১৯৮২ সনের ৬ নং অধ্যাদেশ) উক্ত সনের ৭ই জুন তারিখে প্রবর্তিত হয়। এই আইন অনুসারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুসলমানদের দেওয়া জাকাত সংগ্রহ করে জাকাত তহবিল গঠন করা হবে। ঐ টাকা তফষিলভুক্ত ব্যাংকে সুদবিহীন হিসাবে রাখবে। শরিয়াহ অর্থাৎ ইসলামী আইন সমূহ অনুসারে এই অর্থ ব্যয় করা হবে। জাকাত তহবিল ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার নীতি নির্ধারণ করার জন্য থাকবে জাকাত বোর্ড।

জাকাত সম্পর্কিত কাজে ব্যয় বরাদ্দ করবে এই বোর্ড । বোর্ডের একটি দাতব্য তহবিল থাকবে। ব্যক্তিগণ স্বেচ্ছায় এই তহবিলে দান করতে পারবে। জাকাত তহবিল ও এই বোর্ডের দাতব্য তহবিলে প্রদত্ত . দানকৃত ও অনুদানকৃত টাকা সম্পূর্ণ আয়কর মুক্ত হবে। একজন চেয়ারম্যান , একজন ভাইস-চেয়ারম্যান ও ১১ জন সদস্যের সমন্বয়ে সরকার জাকাত বোর্ড গঠন করবেন।

প্রখ্যাত মুসলমান বিদ্বান ব্যক্তিদের মধ্য থেকে সরকার চেয়ারম্যান, ভাইস-চেয়ারম্যান ও ৯(নয়) জন সদস্য নিয়োগ করবেন। চেয়ারম্যান ও ভাইস-চেয়ারম্যানের কার্যকালের মেয়াদ হবে তিন বৎসর। সরকার ইচ্ছা করলে কোন কারণ না দর্শিয়ে যে কোন সময়ে চেয়ারম্যান বা ভাইস-চেয়ারম্যানকে অথবা তাদের উভয়কে উক্ত পদ থেকে অপসারণ করতে পারবেন। ধর্ম সম্পর্কিত বিভাগের সচিব ও ইসলামী ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক পদাধিকার বলে এই বোর্ডের সদস্য হবেন। শেষোক্ত জন সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন।

তিন জন সদস্য উপস্থিত হলে সভার কোরাম হবে। বোর্ডের প্রশাসনিক ব্যয় বহন করবে সরকার। জেলা ও থানা পর্যায়ে বোর্ডের কমিটি থাকবে। এই কমিটির দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য হবেন মুসলমান বিদ্বান ব্যক্তি। এই সব কমিটি বোর্ড কর্তৃক আরোপিত দায়িত্ব পালন করবে।

আইনটা মহৎ উদ্যোগ নিয়ে গঠিত হয়েছে বটে কিন্তু জন সম্পৃক্ততার অভাবে এটা হয়ে গেছে আমলা নির্ভর। ফলে জাকাত ও দান সংগ্রহ ও বিতরণের কার্যক্রম আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে উল্লেখযোগ্য কোন প্রভাব ‘জাকাত বোড’ ফেলেনি। দেশে বিভিন্ন মহল্লায় ও মসজিদে স্থানীয় মুসলমান নাগরিকেরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে সামাজিকভাবে মিলিত হয়ে জাকাত সংগ্রহ করছেন এবং বেকার ও দুঃস্থ ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে পর্যায়ক্রমে তাদেরকে জাকাতের অর্থ দিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। এভাবে সাহায্য ও সহায়তাপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ পরবর্তী বৎসরে জাকাত প্রার্থী হচ্ছেনা। কোন কোন ক্ষেত্রে তারা ‘সাহেবে নেসাব’ হয়ে নিজেরাই আবার জাকাত দেবার সামর্থ্য অর্জন করছেন।

এলাকার গরিব ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদেরকেও শিক্ষার খরচ জাকাতের টাকা থেকে দেওয়া হয়ে থাকে। সাহায্যপ্রাপ্ত এই ছাত্রছাত্রীগণ শিক্ষা শেষ করে সম্মানজনক ও জনকল্যাণকর পেশা গ্রহণ করতে সক্ষম হচ্ছেন। এই উদাহরণগুলো পর্যালোচনাপূর্বক অনুসরন করে জাকাত বোর্ড কার্যকরী গণমুখী পদক্ষেপ নিলে দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে এতে কোন সন্দেহ নাই। তা করতে হলে জাকাত বোর্ড গঠন প্রক্রিয়ায় ‘জাতীয় সংসদ’ ও ‘সংসদীয় কমিটি’কে সম্পৃক্ত করতে হবে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় এর কোন বিকল্প নাই।

লেখকঃ সাবেক জেলা ও দায়রা জজ। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.