আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হুমায়ুনের সাথে কিছু সময় অথবা একজন লাজুক মানুষের পঞ্চমীর চাঁদ.....।

এসো ভাই , তোলো হাই , শুয়ে পড়ো চিত, অনিশ্চিত এ সংসারে এ কথা নিশ্চিত - জগতে সকলই মিথ্যা , সব মায়াময়, স্বপ্ন শুধু সত্য আর সত্য কিছু নয়। কাল সারারাত আমার রুমে অবিকল হুমায়ুন জবুথবু হয়ে জানালার বাইরের দিকে তাকিয়ে বসেছিলেন....। গায়ে ধবধবে সাদা পানজাবি। তাঁকে এই প্রথম সাদা পানজাবীতে দেখলাম। সাথে সোনালী ফ্রেমের চশমায় ভালই মানিয়েছে।

মনে মনে তিনি বিড়বিড় করে কি যেন বলে যাচ্ছিলেন......ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দগুলো মাঝে মাঝেই আমার কানে আসছে....."জোস্না"....."চান্নিপসর"...."মেঘের উপর বাড়ি"....."পঞ্চমীর চাঁদ"....আরো কি কি যেন....। হঠাৎ হুমায়ুন নড়ে চড়ে বসলেন...চেহারায় একটু খুশির ঝিলিক। (আওয়াজ একটু চড়া করে) হুমায়ন বলছেন: "তুমি কি করে বুঝলে আমার এখন এক কাপ মরিচ চা খেতে ইচ্ছে করছে?" : হুমম.... না বুঝলে কি আর চলে? এতদিন আপনি আমায় যত্ন করে শিখিয়েছেন কখন কি করতে হয়। আপনার ইচ্ছা-অনিচ্ছা বুঝবো না? এই নিন- কড়া লিকারের সাথে পোড়া মরিচ, সাথে কাঁচা মরিচের খাঁটি রস। একসাথে মিশিয়ে নিন ভাল লাগবে।

চমকে উঠলাম নারী কন্ঠ শুনে। মাথাটা একটু উচু করে দেখি জানালার ওপাশে "মরিচ চা" এর কাপ হাতে অপরূপ সাঁজে দাঁড়িয়ে আছে "রূপা"। রূপাকে আজ একটু বেশী সুন্দরী দেখাচ্ছে। নীল রংয়ের শাড়ীতে যেন ঢেকে আছে একফালি চাঁদ। হুমায়ুনের মৃদু হাসির রেস রূপার চুলের সাথে দোল খাচ্ছে....আমার কেন জানি ভাল লেগে গেল দৃশ্যটা দেখে।

মনে মনে একটু ঈর্ষান্বিত হলাম, ইস.....আমারও যদি এমন একটা রূপা থাকতো......। মাঝে মাঝে রূপা শব্দটাকে উল্টিয়ে তাকে "পারু" বলে ডাকতাম। সে ক্ষেপে যেত, অভিমান করতো...প্রতিশোধ নিতে গিয়ে লুকিয়ে আমার চায়ের কাপে মরিচ মিশিয়ে দিত। ঝালে আমি উহ্- আহ্ করতাম। আড়াল থেকে সে দাঁতে দাঁত লাগিয়ে বিজয়ীর বেশে বলত : "ঠিকই আছে....এবার বোঝ ঠেলা....আমার সাথে দুষ্টুমি না?" হঠাৎ উদাস গলায় হুমায়ুন গান ধরলেন.... "ও কারিগর, দয়ার সাগর, ওগো দয়াময়...." ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে দেখি রূপা নেই, নেই তার নীল শাড়ীর স্নিগ্ধতা।

শুধু হুমায়ুনের দু আঙুলের মাঝখানে নিভে যাওয়া আধখানা সিগারেট তন্ময় হয়ে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। যেন হুমায়ুন মস্তবড় একজন গায়ক, সিগারেট তার একমাত্র ভক্ত আশেকান...। সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস না থাকলেও আমার ওই নিভে যাওয়া সিগারেটে দুটো টান দিতে ইচ্ছে করল খুউব করে...। কেন জানি তাঁকে বলতে গিয়েও পরক্ষণে থেমে গেলাম। হুমায়ুনের সিগারেটে টান দেয়া হলনা আমার।

মাথার ভেতর সিগারেট শব্দটা ঢুকে গেছে ভালভাবে বুঝতে পারলাম। দূর থেকে দুটো মানুষের ঝগড়ার শব্দে আমি সিগারেটের ঘোর থেকে বের হয়ে চুপি চুপি হুমায়ুনের পেছনে গিয়ে দেখি একটু দূরে রাস্তায় হলুদ পানজাবী পরা হিমু মিসির আলীর জামার কলার চেপে ধরে শাসাচ্ছে। হিমুকে মধ্যরাতের টহলদার পুলিশের গালে চড় না মেরে আচমকা মিসির আলীর গালে চড় মারতে দেখে একটু অবাক হলাম। কি বিচিত্র মিসির আলীকে চড় মেরে অবাক করতে গিয়ে উল্টো হিমু আমাকেই অবাক করে দিল। দুজন কাছে আসতেই জানা গেল রূপার দেয়া সব টাকা নাকি হিমু পকেটের অভাবে মিসির আলীর কাছে জমা রেখেছে মাজেদা খালার ননদের চাচাতো দেবরের মামাতো শালীর ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য।

সেই টাকা নাকি মিসির আলী খেয়ে খেয়ে আয়তন বাড়িয়েছে তার ভুঁড়ির। মিসির আলী আজীবন যুক্তিতে বিশ্বাসী। সে বারবার যুক্তি দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করছে যে টাকাগুলো সে নেয় নাই। সে শুধু হিমুর জলতত্ব আয়ত্বে আনার চেষ্টা করছিল গলা পর্যন্ত পানির নিচে রেখে জোসনা দেখার মজা দেখতে গিয়ে। সেই সময় নাকি তার কক্ষে শুভ্র এসেছিল, কাঁঠাল গাছে করলা ধরেনা কেন এই বিষয়ক একটি যৌক্তিক সমাধানের জন্য।

সম্ভবত শুভ্র ই ওই সময় টাকাগুলো সরিয়েছে। মিসির আলীকে যুক্তি বাদ দিয়ে ধারণা প্রসুত কথা বলতে দেখে হুমায়ুন একটু আহত হলেন। : আহ তোমরা থামবে? কেন খামোখা একে অপরের দোষ দিচ্ছ। টাকাগুলো আমিই সরিয়েছিলাম। (হুমায়ুনের কিছুটা রাগত স্বর) : আ-আপনিই সরিয়েছেন? কিন্তু কেন? (জানালার ওপাশ থেকে হিমু মিসির আলীর সমস্বরে প্রশ্ন) : হ্যা, আমিই সরিয়েছিলাম।

আজ ছিল মীরার জন্মদিন। তার খুব ইচ্ছে ছিল চুরি করা টাকা দিয়ে কেউ তার জন্মদিনে কেক গিফট করুক। : কিন্তু, তাই বলে আমার টাকা চুরি করে ? (হিমুর বিস্ময়!) : আর তাও আবার আমার যুক্তি তর্কের বইয়ের ভেতর থেকে? (মিসির আলীর অবাক দৃস্টি) : হুমমম। কারণ মীরার ইচ্ছে ছিল চুরি করা টাকাগুলো হবে একজন পকেটহীন লোকের আর সেটা অবশ্যই কোন বইয়ের ভেতর থেকে চুরি করতে হবে। বইয়ের ভেতরে রাখা টাকারা নাকি একটু শিক্ষিত শ্রেণীর হয়।

তাই সকালে শুভ্রের জামা পরে আমাকে এই মহৎ কাজটি করতে হয়েছে। : মহৎ কাজ ?? (হিমু-মিসির আলী লজিক-এন্টি লজিকে দুজন দুজনকেই প্রশ্ন করছে) ....ঠিক এই মুহূর্তে তাদের কথাগুলো আর শুনতে ইচ্ছে করছিল না আমার। ইচ্ছে হচ্ছিল চুরি করা টাকায় গিফট করা মীরার জন্মদিনের কেক এর একটি বিশাল অংশ গপাগপ অন্দরমহলে প্রবেশ করিয়ে দেই। কিন্তু তাদের এই ঝগড়া ঝাটি আর সহজ স্বীকারোক্তির মাঝখানে মীরার বাসার ঠিকানা চেয়ে বসা কতটুকু যৌক্তিক হবে সেটা ভেবে চুপসে গেলাম। ঠিকানা পেলেও দাওয়াত ছাড়া কি আমাকে বাসার ভেতরে ঢুকতে দেবে? আচ্ছা মীরাদের বাসার গেইটে কি দারোয়ান থাকে নাকি বদরাগি একটি কালো রংয়ের বিদেশী কুকুর থাকে? আমি হঠাৎ মীরাদের বাসার আশে পাশে কল্পনায় ঘুরে বেড়াই।

মীরার মা নির্ঘাত আজ তার মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষ্যে চিংড়ী মাছের ঝোল রান্না করেছে। মীরার নিশ্চয় চিংড়ী মাছের ঝোল খুব একটা পছন্দ না। : আমার কিন্তু এটা একদম পছন্দ না। বস্ শুধু আপনি নিয়েছেন তাই এই বেটা মিসির আলীকে কিছু বললাম না নইলে আমার খালুজান রফিকুজ্জামান এর ২৮৮ ধারায় তার সোজা যাবজ্জীবন হয়ে যেত। (হিমুর ক্ষোভ মিসির আলীর প্রতি) : (মিসির আলী অন্যমনস্ক) আচ্ছা আজ মীরার জন্মদিন।

আপনি তার জন্য চুরি করা টাকা দিয়ে কেক কিনেছেন। অথচ তার জন্মদিনে উইশ করতে না গিয়ে আলো আঁধারীতে এই ভাঙ্গা জানালায় বসে আছেন কেন? : অপেক্ষায় আছি। (হুমায়ুনের মৃদু হাসি) আজ রাতে মৃ্ন্ময়ী আসবে জরীকে সাথে নিয়ে। তাদের সাথে কথা হবে আড্ডা হবে। টুকটাক কথা হতে হতে মায়া লেগে যাবে।

মায়া লাগানোর জন্য কথা চালাচালি করা খু্বই জরুরী। জানোতো, রূপবতীদের মধ্যে নার্সিসাস কমপ্লেক্স খুব প্রকট। তারা নিজের রূপের প্রেমে পড়ে, অন্য কারো প্রেমে পড়তে পারে না। আজ রাতে আঁধারের বুক চিরে তাদের পাশে বসে আমি রূপবতীদের প্রশংসায় নিজেকে বিলিয়ে দেব। অন্ধকারে ডুবে যাবে পঞ্চমীর চাঁদ।

আমার মুখ দিয়ে হুট করে বেরিয়ে গেল "আমিও আজ নিজেকে....." ভুত দেখার মত চমকে উঠে সবাই আমার দিকে তাকল। আমি যথারীতি লাজুক হাসি দিয়ে মাথা নিচু করে রইলাম। কথাটা শেষ করতে পারলাম না। সবকিছু কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গেল.....হুমায়ুন, হিমু, মিসির আলী......কোথাও কেউ নেই....। জানালাটি আমার কাছে অ-নে-ক দূরে মনে হল যেখানে এতক্ষণ বসেছিলেন অবিকল হুমায়ুন আহমেদ।

মা বাবা যাকে আদর করে ডাকতেন কাজল বলে। লজ্জায় আমার আর সেই জানালার কাছে যাওয়া হলনা। কিছুটা ভয়ে, কিছুটা আত্মবিশ্বাসের অভাবেই হয়ত। ....লাজুক মানুষের আত্মবিশ্বাস কম থাকে.....। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.