সাপের শরীর হয়ে আঁধারের গাছ/ কুয়াশার বন্যায় ডুবো দেবী মাছ!
১.
মুড়ির টিনটা সামনে টেনে নিয়ে বসলো আনাম। সামনে পরীক্ষা। টার্ম ফাইনাল । অথচ মাথার ভেতর প্রেমের গল্প ঘুর ঘুর করছেতো করছেই। মুড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে না খেলে শান্তি নেই।
এই গভীর রাতে মুড়ি ছাড়া কিছু নাই। ঘরে রাখারও উপায় নাই। পটলের যন্ত্রনা। বিস্কুট খেতে ওস্তাদের উপরে ওস্তাদ। বাড়ি থেকে আসার সময় আব্বা এক টিন ভর্তি করে নোনতা বিস্কুট দিয়ে দিয়েছিল।
দু একটা খেয়েছে কিনা। সব শালা পটলের পেটে গেছে। একটা ক্ষুদ্র রুমে ঠিক সেরকমই ক্ষুদ্রাতি সাইজের খাট।
হাত পা ছড়িয়ে ঘুমানোর অভ্যাস ছাড়তে হয়েছে মেসে ওঠার পরই। প্রথম প্রথম মেঝেতে নিজেকে আবিষ্কার করতো প্রায়।
এখন ঠিক হয়ে গেছে। গভীর রাত ছাড়া লেখা আসেনা।
মশার কামড় আরশোলা টিকটিকির যন্ত্রনা আর ইঁদুরের ছুকছুক করে দৌড়ানোর ভেতর দিয়েই সমস্ত গল্প সে প্রসব করেছে। গল্পের ভেতর মেয়েটি আসে। সেই মেয়েটি! দু হাত ভরে হলুদ কাঁচের চুড়ি থাকে।
আর অকারনেই যে খুব হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে গল্প করে।
২.
কদিন ধরেই কোন একটা সমস্যা হয়েছে। লিখতে বসলেই মাথার কাছে কেমন নিঃশ্বাস টের পায় আনাম। যেন কেউ খুব ধীরে সন্তর্পনে শ্বাস নিচ্ছে। নিজেকে আলগোছে সরিয়ে রাখার মত মনে হয়।
একটা প্রেমের গল্প লিখতে চাওয়া অপরাধ হতে পারেনা। আনাম মুড়ি খায় আর ভাবে এবার লিখে ফেলতেই হবে। যে করেই হোক। পেছনে মেয়েটিই থাকে এব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। হয়ত মুখ ঘোরালেই দেখতে পাওয়া যাবে।
কিন্তু বুঝতে দেয়া যাবেনা মেয়েটার উপস্থিতি টের পেয়ে গেছে আনাম। এটা একটা খেলা। বেশ মজার একটা খেলা। আনামের প্রচন্ড ইচ্ছে করে মুখ ঘুরিয়ে দেখতে। মেয়েটি কি হলুদ কাঁচের চুড়ি পরে এসেছে আজো?
৩.
লেখার সময় মেয়েটি খিলখিল করে হেসে ওঠে।
কি যন্ত্রনা। শুনশান রাত আর পাশে পানির বোতল ঠোঁটে সিগারেট এ সব ছাড়া আনাম লিখতে পারেনা। কিন্তু মেয়েটি ইদানীং খুব যন্ত্রনা দিচ্ছে। পা উঠিয়ে লেখার টেবিলে বসে থাকে।
অচেতন ভাবেই কদিন আনাম টেবিলের একপাশটা রোজ গুছিয়ে রাখতে শুরু করেছে।
ওখানে বই পত্র আর নোটস গুলো এলোমেলো পড়ে থাকলে মেয়েটি নাও বসতে পারে। গতকাল হাত ভর্তি হলুদ কাঁচের চুড়ি পরে এলো আর হাতটাকে সাবধানে লেখার খাতার উপর রেখে বসে রইলো।
আনামের যা বিরক্তি লাগছিলো বলার মত না।
আচ্ছা বাবা তুই দেখছিস একটা মানুষ লিখছে। অগা বগা যা হোক কিছুতো লিখছে।
জমির দলিল লিখলেও তো তার একটা মূল্য থাকে নাকি? এরকম যদি লেখার খাতার উপর হাত ফেলে রাখিস তো পাতা উল্টাবো কিভাবে!
অবশ্য পাতা উল্টানোর মত লিখতেই পারছেনা আনাম। মনে হচ্ছে মাথার ভেতর একটা ডোরাকাটা টিকটিকি ঢুকে পড়েছে। কানের উপরটায় টিকটিক করে লাফাচ্ছে। অসহ্য!
৪.
শোন তুমি একটা গল্প লিখবে আমাকে নিয়ে?
জানালার সাথে বাড়ানো ছোট্ট জায়গা টাতেই কেমন অদ্ভুত করে মেয়েটি বসে আছে। হাতের আঙ্গুলে শাড়ির আঁচল টা নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সুতলি বানাচ্ছে এক আধবার।
জানালা দিয়ে আসা বাতাসে মেয়েটার চুল হালকা উড়ছে। মুখ ঢেকে গেলে মাথা ঝাঁকিয়ে পেছনে ফেলে দিচ্ছে সাপের শরীরের মত ঠান্ডা চুল গুলিকে। কি অদ্ভুত ই না লাগছ আনামের!
লেখার টেবিলটা থেকে জানালাটা অল্প দূরে। টেবিলে একটা ছোট বাতি। শুধু লেখার পাতাটার উপর আলো এসে পড়ে।
মেয়েটিকে আলো আঁধারীর মধ্যে দেখতে ভালই লাগে। হাতের হলুদ চুড়িতে হালকা আলো পড়ছে। টুং টাং কেমন বিচিত্র একটা শব্দ!
৫.
আনামের মন খারাপ। পুরুষ মানুষের মন খারাপ প্রকাশের অযোগ্য একটা অপরাধ। মন খারাপ মেয়েলি অসুখ।
আনাম মন খারাপ করে বসে থাকে চেয়ারটাতে। এই রাতে পটল কে ডেকে উঠালে হয়। রাস্তার ও পাশের চায়ের দোকানটা সারা রাত খোলা থাকে। চা খেয়ে এলে কি মন খারাপ কমবে!
বাইরে থেকে জোছনা এসে পড়ছে। আনাম তার দু হাত দিয়ে চোখ ঢেকে বসে থাকে।
এসব জোছনা দেখার বিলাসিতা দিয়ে সে তার মন খারাপ ভাবটাকে উড়িয়ে দিতে চায়না।
মেয়েটা আসতো। বসতো। খিল খিল করো হাসতো। যন্ত্রনা দিত।
আবদার করতো।
গল্পটা লিখে ফেলার পর বেশ উত্তেজিত ছিল আনাম। প্রথম শ্রোতা হিসেবে হলুদ চুড়ি পরা মেয়েটাকে ভাবতেই তার দারুন আনন্দ হচ্ছিল।
রাত প্রায় শেষ। মেয়েটি এখনো আসেনি।
একবার টেবিলটা পরিষ্কার করেছে রাতে। এখন ফাঁকা জায়গাটার দিকে তাকাতেই কান্না এসে যায়। লিখে ফেলা পাতাটার উপর সব রাগ এসে পড়ে। পাতাটা ছিঁড়ে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেললে ওটা চারতলা বেয়ে বেয়ে নিচের সরু নর্দমাটায় পড়বে।
গল্প টা ছিঁড়ে ফেললে কি মেয়েটি আসবে আরেকবার? কোলের উপর গল্পটা নিয়ে বসে থাকে আনাম।
রাগ ক্ষোভ দুঃখ একসাথে খেলতে থাকে বুকের ভেতর। একসময় পরম মমতায় খাতাটাকে উঠিয়ে রাখে টেবিলে। তারপর ক্লান্ত হয়ে ঘুমুতে যায়।
মেয়েটি আনামকে আচ্ছন্ন করেছিলো সুখে। এখন লিখে ফেলা গল্পটার প্রতিও তার অন্য রকম মমতা!
৬.
একজন গল্পকারের কাছে তার সৃষ্টি প্রিয় সন্দেহ নেই।
ঈশ্বর একজন শ্রেষ্ঠ গল্পকার। একদিন আনাম নিজেকে ঈশ্বর ভাবতে শুরু করবে। কি ভয়ংকর!
চাইলেই যে কাউকে জীবন দেয়া যায়। আর মৃত্যুও কত সহজ এখানে। আনন্দময় ভুবনে আমন্ত্রন জানাতে পারে আনাম এখন ! আরেকটি গল্প শুরু করার আগে তার তৃষ্ণা পায়।
আর তখন ই চোখের সামনে খুলে যেতে থাকে শীতল ঝরনাধারা...। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।