আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্পটি মণির (গল্প)

মুহাম্মাদ রিয়াজ উদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হওয়ার পর মণি আজ ওর মাকে নিয়ে ভর্তি হতে এসেছে। মোধাক্রম অনুযায়ী পছন্দের বিষয় নির্ধারণ হয়ে থাকে। মেধা তালিকায় নিচের দিকে থাকলে আসন খালি থাকা সাপেক্ষে কখনো কখনো নিজের পছন্দের বিষয়ে ভর্তি হওয়া যায়। ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরই মণি এসব কথা অনেকের কাছে শুনেছে। এ বিষয় কৌতূহল থাকার কারণ মণির নামটা তালিকার শেষ পর্যায়ে ছিল।

অনুষদের ডিনের রুমে সাক্ষাতকার হবে। মাকে নিয়ে অফিসের সামনেই অপেক্ষা করছে। কেউ কেউ ডিনের অফিসে সাক্ষাতকার দিয়ে পছন্দের বিষয় পেয়ে হাসিমুখে বেরিয়ে যাচ্ছে। এসব যতই দেখছে মণির হৃতপিণ্ডের গতি ততই বাড়ছে। সময়মত মণিকেও সাক্ষাতকারের জন্য ডাকা হলো।

টান টান উত্তেজনা ওর মাঝে। কি জানি কী হয়। পছন্দের বিষয়ে অনার্স করতে পারবে কিনা-নানা ভাবনা। ‌‌‌'তোমার পছন্দ দেখছি অর্থনীতি?' জিজ্ঞেস করলেন বোর্ডের একজন। 'জি স্যার।

' মণির উত্তর। 'তুমি অনেক ভাগ্যবতী। একটি আসনই খালি ছিল। ' কথাটি শোনার পর মণির মনে কত আনন্দের ঝরণা ধারা বইছে শুধু ও নিজেই অনুভব করল। ধন্যবাদ জানাবে কি জানাবে না এ দ্বিধাদ্বন্দ্বে কিছুই বলতে পারেনি।

রুম থেকে বেরোতেই অফিসের দরজার মুখে একটি ছেলের সামনে পড়ল। মণি ওর বাম দিকে সরে যেতে চাইল, ছেলেটিও তার ডান দিকে সরে মণিকে যাওয়ার পথ দিতে চেয়েছিল। এবার দুজনার চোখে চোখ পড়ল। দুজনই লজ্জা পেল। ‌'সরি'।

ছেলেটি এরকম পরিস্থিতির জন্য সরি বললেও মণি কিছুই বলেনি। মায়ের কাছে এসে পছন্দের বিষয় পাবার কথা জানালে ওর মাও অনেক খুশি হলো। ব্যাংকে টাকা জমাসহ ভর্তি প্রক্রিয়া সব শেষ করে বাসায় ফিরতে রাত হলো। বাসায় ফেরার পুরো পথেই মণির চোখে অফিসের সামনের সেই ঘটনার দৃশ্য মনে করেছে। কলেজ জীবনে মণি ছেলেদের বরাবরই এড়িয়ে চলেছে।

নিজে সুন্দরী হওয়ায় ছেলরা নানাভাবে মিশতে চেষ্টা করতো। কিন্তু আজ কেন এ ছেলেটিকে দেখে সব কিছু পাল্টে গেল? নিজের কাছে প্রশ্ন করে মণি। গভীর রাতে মণির চোখে ঘুম আসে। তবে সে ঘুমের প্রায়ই সময়টা জুড়ে ছিল স্বপ্ন। জীভনের এতগুলো বছরে এমন স্বপ্ন কখনোই দেখেনি ও।

বেশ ভালোই লেগেছে মণির কাছে। কবে ক্লাস শুরু হবে বিভাগের অফিস থেকে নির্দিষ্টভাবে জানায়নি। বলেছে নিয়মিত খোঁজ রাখার জন্য। পুরনো ব্যাচের পরীক্ষা না হলে নতুন ব্যাচের ক্লাস শুরু না করার রেওয়াজ কমবেশি সব বিশ্ববিদ্যালয়েরই আছে। মণির বিশ্ববিদ্যালয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় এখানে সেশনজট রয়েছে।

কিছুটা বিলম্ব করেই ক্লাস শুরু হলো। নতুন ক্লাসে মণি একাই এসেছে। ক্লাস রুটিন আগে হাতে পাওয়ায় কোন রুমে ক্লাস তা জানতে কষ্ট হল না। ক্লাসে ঢুকে মণি অবাক না হয়ে পারল না। ভর্তির সময় যে ছেলেটির সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিল সেই ছেলেটি ওর বেঞ্চেই বসা।

কী অবাক ব্যাপার! মণি ক্লাসের পুরো সময়টাই মাথা নিচু করে ছিল। কয়েকবার ছেলেটির দিকে তাকিয়েছিল কিন্তু ছেলেটি যে ওর দিকে তাকায়নি এটা বুঝতে পেরেছে মণি। নিয়মিত ক্লাসও হচ্ছে। ক্লাসের সবার সাথেই কমবেশি পরিচিত হয়েছে মণি। সেই ছেলেটির সাথেও কথা হয়েছে।

দুজন এখন পরিচিত। অনেক পরিচিত। মুঠোফোনের নম্বরও অদল বদল হয়েছে। ছেলেটির নাম মামুন। এ বিভাগেই গত বছর ভর্তি হয়েছিল।

তারপর কিছুদিন ক্লাসও করেছে। নতুন করে মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ায় নিয়মিত ক্লাস করা হয়নি। মেডিকেলে চান্স না পাওয়ায় অবশেষে এ বিভাগেই পুন: ভর্তি হয়েছে। নিয়মানুসারে পুরনো ব্যাচের কেউ থাকলে তার রোল শেষে হয়ে থাকে। নতুন ব্যাচের শেষ রোল মণির তারপর মামুনের।

কী অদ্ভুত ব্যাপার! মণি এ বিভাগে ভর্তি হয়েছে একবছর পেরিয়ে গেছে। কয়েকজনের সাথে ঘনিষ্টতা হয়েছে। এদের মধ্যে মামুন অন্যতম। মণি ছেলেদের সাথে মিশতে অস্বস্তিবোধ করলেও কেন যেন মামুনের সাথে খুব মিশতে ইচ্ছে হয়। মামুন কেন মণিকে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করে সেটাও মণি বুঝতে পারে।

আর বুঝতে পারায় দুজনের মধ্যে সম্পর্ক আগের মত। প্রয়োজনে কথা হয়, দেখা হয় ক্লাসের ভেতরই। মামুনকে মণির ভালো লাগার বিষয়টি আর কেউ না জানলেও মণির মা তাহরিমা বেগম জানেন। আর জানবেই না কেন। একমাত্র মেয়ের সব খবরই তাকে রাখতে হয়।

মণির বাবা রহমান মোস্তাফিজ একটি এনজিও'র উর্ধ্বতন কর্মকর্তা হওয়ায় অফিস নিয়েই ব্যস্ততা তার। মণি ওর সব কথায়ই মায়ের সাথে শেয়ার করে। ভালো মন্দ উভয়ের দিকের কথাই মা ওকে শোনায়। মা মেয়ে দুজনই এসব বিষয়ের কথা বলতে আনন্দ পায়। মামুনের বিষয়েও নিয়ে বাসায় অনেক বার আলোচনা হয়েছে।

প্রথম বর্ষের পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। মণি মামুনকে নতুনরূপে আবিষ্কার করল। সেরা রেজাল্ট করে মামুন সবাইকে চমকে দিয়েছে। পেছনের বেঞ্চে বসা কোন ছাত্র এমন ভালো রেজাল্ট করতে পারে এমনটি ছিল সবার কল্পনাতীত। মণিও ভাবত মামুন মধ্যম সারির ছাত্র।

রেজাল্টের পর শুধু বিভাগেই নয় পুরো অনুষদের ভেতর পরিচিত হয়ে উঠেছে মামুন। ক্লাসের কেউ কেউ মামুনের তৈরা করা হ্যান্ডনোটও চেয়েছে। মণিও ব্যতিক্রম নয়। অন্যদের ক্ষেত্রৈ ফটোকপি করে নিতে হয় আর মণিকে মামুন নিজেই ফটোকপি করে দেয়। মামুনের এমন পরিবর্তন মণিকে অবাক না করে পারে না।

মণির সাথে মামুনের একটু সখ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে এমটাই প্রমাণ করে। আজ বিভাগে কোন ক্লাস না থাকায় বিভাগের করিডোরে বসে কেউ কেউ গল্প করছে। বিভাগে এসে মামুন যখন জেনেছে আজকের নির্ধারিত কোন ক্লাসেই হবে না তখন বাসায় ফেরার মনস্থির করল। 'মামুন ভাই?' ডাক শুনে মামুন পেছনে ফিরে তাকায়। 'কী কিছু বলবে মণি?' 'কিছু বলার জন্য তো ডাক দিলাম।

' 'জলদি বলো আমি বাসায় ফিরবো। ' 'কেন? বাসায় কাউকে রেখে এসেছেন বুঝি?' মণির এমন কথা শুনে মামুন লজ্জা পায়। লজ্জা পেলে অন্য দশজন ছেলের অবস্থা যা হয় মামুনের বেলায় তাই হল। মামুনের এমন অবস্থা দেখে মণির কাছে ভালো লাগে। এর পূর্বে কয়েকবার মণি এমনটি দেখেছে।

'মামুন ভাই চলুন না ওই সামনের গাছের ছায়ায় বসি। ' বিভাগের সামনের বড় আমা গাছের ছায়ায় অনেকেই বসে গল্প করে। সময় কাটায়। কখনওবা ক্লাস শেষে অন্য ক্লাসের জন্য অপেক্ষা করে। মামুনের অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মণির কথা ফেলতে পারেনি।

অবশেষে দুজন বসল। কিছুক্ষণ নীরবতা ভেঙে মণি বলল- 'মামুন ভঅই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির সময়কার সাক্ষাতের কথা মনে আছে?' 'থাকবে না কেন? স্মৃতিশক্তি এতোই কম?' পাল্টা প্রশ্ন মামুনের। 'না। তা বলছি না। সেদিনের কথা মনে পড়লে অনেক ভালো লাগে।

' 'জীবনের মধুর স্মৃতিগুলো সবার কাছে ভালো লাগে। ' মামুনের মুখে এমন কথা শুনে মণির ভেতর নতুন আশা জাগে। কারণ মামুনকে মণি সত্যিই অনেক ভালোবাসে। 'আচ্ছা মামুন ভাই আপনার আর আমার মধ্যে কী মিল?' 'শুধু একটি মিল আমি খুঁজে পাই আর সবগুলো অমিল। ' 'মিল কী আর অমিলই কী মামুন ভাই?' 'তোমার আমার নামের অদ্যাক্ষর শুরু 'ম' দিয়ে এটাই মিল।

আর অমিল তোমার আমার জীবনের গতি। ' অনেকক্ষণ বসে গল্প করে দুজন। গল্পে উঠে আসে মামুনের জীবনের নানা কাহিনি। অবসরপ্রাপ্ত বাবার টাকায় চলছে নিজেদের সংসার। ছোট বোন আর মামুন দুজনই লেখাপড়া করছে।

শহরের সংসারের সব খরচ মিটিয়ে ওদের টানাপোড়েনের সংসারের কথা অকপটে বলে মামুন। মামুন নিজ্ই সব খুলে বলেছে যাতে মণি ওর প্রতি আকর্ষণবোধ না করে। কিন্তু সবকিছুই জেনে মণির ভেতর মামুনের প্রতি ভালোবাসার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। মামুনের আচার-আচরণ, সততা সবকিছুই ভালো লাগে মণির। মামুনের ভাষায় মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেদের কাছে ভালোবাসার চেয়ে লেখাপড়া করে ভালো চাকুরি পাওয়ায়াই মূখ্য।

মামুনের এমন কথা শুনে মণির ভেতর আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়। মামুন একদিন বড় হবে এমন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে মণি। এরপর কেটে গেছে কয়েকটি বছর। স্নাতক শেষ করে অনেকেই চাকরি নিয়েছে। মামুন স্নাতকোত্তর শেষ করেই সরকারি চাকরেতে যোগ দিয়েছে।

এ কয়েক বছরে মামুন হারিয়েছে অনেক কিছু। চাকরি পাবার কয়েক মাস আগে ওর বাবা মারা যায়। প্রায় দুবছরের মতো মামুনের সাথে মণির কোন যোগাযোগ ছিল না। মণি ইচ্ছে করেই মাস্টার্সে ভর্তি হয়নি। মামুনও ইচ্ছে করে মণির খোঁজ নেয়নি।

মামুনের চাকরি পাবার কয়েকমাস পর হঠাত একদিন মামুনের মা রিজয়িা পারভীন মণিদের বাসায় আসে। মণি যখন মামুনের মায়ের বিয়ের প্রস্তাবের খবর শুনল তখন নিজের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়। মামুন কী সত্যিই আমাকে ভালোবাসত? নিজরে কাছে প্রশ্ন করে মৃদুস্বরে হেসে ওঠে। মামুন বলেছিল ভালো চাকরি পেলে আবার দেখা হবে। মামুন কথা রেখেছে।

অনেক আনন্দ আয়োজনের মধ্য দিয়ে দুজনার বিয়ো হলো। মণি মামুনকে পেলো নিজের মতো করে। মণি মামুনের পাশে বসে বলে-'আপনি সত্যিই আমাকে ভালোবাসতেন?' 'আপনি নয় স্বামীকে তুমি করেই বলতে হয়। ' দুজন উচ্বস্বরে হেসে ওঠে। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।