আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্পটি কি করে যে ডিলিট হলো, তাই আবার...



রাজশাহী মহানগরীর ৫৫/২ উপশহরের ভাড়া বাসায় থাকতাম আমি, আমার স্ত্রী ও শিশুপুত্র ফিমান ফারনাদ। গত ২৩ অক্টোবর, ২০০৭ দিবাগত রাতের ঘটনা। আমরা ঘুমিয়ে ছিলাম। রাত আনুমানিক দেড়টায় কলিংবেল বেজে ওঠে। বিরামহীনভাবে কলিংবেল বাজায় আমাদের ঘুম ভেঙ্গে যায়।

আমি ও আমার স্ত্রী ঘরের দরজা খুলে বেলকুনীতে বেরিয়ে আসি। এসময় আমার কোলেই ছিল শিশুপুত্র ফারনাদ। র‌্যাব সদস্যরা বাড়ি ঘিরে ফেলে। তিনতলা থেকে বাড়ির মালিক জনাব আবুল কাশেম ও তার পুত্র লিখন নীচে নেমে আসেন। সিভিল পোশাকধারী ১০/১২ জন সশস্ত্র লোক আমাদের বাসার বেলকুনীর দরজার কাছে আসেন।

তারা নিজেদেরকে প্রশাসনের লোক পরিচয় দিয়ে আমার বাসা তল্লাশী করবেন বলে দরজা খুলতে বলেন। আমি উনাদের উদ্দেশে বলি, আপনাদের পরিচয় নিশ্চিত না হলে আমি দরজা খুলবো না। তখন তারা বলেন, ‘তাড়াতাড়ি দরজা খুল, নইলে তোর খুব অসুবিধা হবে। ’ তারা আমাকে সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ বলে গালমন্দ করতে থাকেন। আমি বোয়ালিয়া মডেল থানায় মোবাইল করি।

থানার ডিউটি অফিসার আমাকে জানান, ‘থানা থেকে আমাদের কোন লোক যায়নি আপনার বাসায়। কে বা কোন বাহিনী গেছে তা আমাদের জানা নেই। ’ এক পর্যায়ে সশস্ত্র লোকেরা বেলকুনীর গ্রিলের ফাঁক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে আমার কাছ থেকে মোবাইল ফোনটি কেড়ে নেন। তারা নিজেদেরকে র‌্যাবের লোক বলে পরিচয় দেন। বাড়ির মালিকের ছেলে লিখন সশস্ত্র লোকদের পরিচয় জানতে চাইলে তারা তাকে প্রহার করতে থাকেন।

তখন আমি তাদের কাছে হাতজোড় করে অনুনয় করে বলতে থাকি, আপনারা উনাকে মারছেন কেন ? আপনারা কোন অন্যায় আচরণ করবেন না। আমি দরজা খুলে দিচ্ছি। আপনারা বাসা তল্ল¬াশী করুন। কিন্তু আমার প্রতি কোন অবিচার করবেন না। আমার ঘরে আপনাদের হাতের অস্ত্র রেখে আমাকে অস্ত্রসহ ধরে নিয়ে যাবেন না, প্লি¬জ।

এরপর আমার শিশুপুত্র ফিমানকে তার মায়ের কোলে দেই। আমি বেলকুনীর গ্রিলের দরজা খুলি। দরজা খোলামাত্র র‌্যাব সদস্যরা আমাকে টেনে-হিঁচড়ে দরজার বাইরে নেন। তারা আমার দু’ হাতে হ্যান্ডকাপ পরান। আমার দু’ চোখ গামছা দিয়ে বেঁধে দেন।

আমার মাথা থেকে গলা পর্যন্ত কালো কাপড়ের টুপি পরিয়ে দেয়া হয়। আমার শিশুপুত্র, স্ত্রী ও বাড়িওয়ালার সম্মুখে র‌্যাব সদস্যরা আমার শরীরের বিভিন্ন স্থানে এলোপাতাড়ী কিল-ঘুসি ও লাথি মারতে থাকেন। তারা আমাকে একটি মাইক্রোবাসে করে র‌্যাব-৫ রাজশাহীর সদর দপ্তরে নিয়ে যান। পথিমধ্যে গাড়ির ভেতরে আমাকে মারধোর করা হয়। আমাকে অশ্লীল ভাষায় গালমন্দ করেন তারা।

‘তারা আমাকে অস্ত্র মামলায় চালান দেয়া ও ‘ক্রসফায়ার’ করার হুমকি দেন। র‌্যাব কার্যালয়ে নেয়ার পর আমার দু’হাত বেঁধে আমাকে উপরে টাঙ্গিয়ে রাখা হয়। চোখ বাঁধা ও কালো টুপি পরিয়ে এবং আমাকে ঝুলিয়ে রাখা হয় সারারাত। রাতে আমার আশপাশে বুটের খট খট শব্দ করে ৪/৫ জন আসতো। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর আবার একই শব্দ করে হেঁটে চলে যেতেন।

এভাবে সারারাতই আমার ওপর মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। সকাল আনুমানিক আটটার দিকে আমার হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে আমাকে একটি ছোট রুটি পাতলা ডাল দিয়ে খেতে দেন তারা। এরপর আমাকে আবারও উপরে লটকানো হয়। রুটি খাওয়ানোর পর অনেকে আমার কাছে এসে আমাকে ‘সন্ত্রাসী’ ‘চাঁদাবাজ’ ‘সাংঘাতিক’ ইত্যাদি বলে গালমন্দ করেন। সকাল অনুমান ১০ টার দিকে দুইজন এসে আমার নাম জানতে চান।

যাদের কন্ঠস্বর আমার পূর্ব পরিচিত। গ্রেফতারের আগে পেশাগত কারণে এই দু’জনের সঙ্গে আমার পরিচয় এবং উনাদের সঙ্গে আমার একাধিকবার সাক্ষাৎ হয়েছে। এরা হলেন র‌্যাব-৫ এর উপ অধিনায়ক মেজর রাশীদুল হাসান রাশীদ ও ডিএডি হুমায়ুন কবির। নির্যাতনের সুচনাতেই মেজর রাশীদ আমাকে বলেন, ‘এই ফকিরনির বাচ্চা, তোর এতো প্রেসটিজ কিসের? শালা চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসী। তোর পাছার ভেতর ঢুকিয়ে দেবো সাংবাদিকতা।

এই শুয়োরের বাচ্চা তুই আর রিপোর্ট করবি না সিএসবি নিউজ-এ। লিচু বাগানের রিপোর্ট, বেনজিরের বউয়ের কথা, খায়রুজ্জামান লিটন সাহেবের (জনাব লিটন রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য এবং আমার বিরুদ্ধে দায়ের করা চাঁদাবাজি মামলার বাদি জনাব লোটনের ভাইপো) পারিবারিক ওয়াকফ্ এস্টেট নিয়ে রিপোর্ট করবি না ? হারামজাদা তুই র‌্যাব দেখেছিস, কিন্তু র‌্যাবের কাম দেখিসনি। ’ এক পর্যায়ে তিনি আমার বাম গালে থাপ্পড় মারলে আমার ঠোঁট ফেটে রক্ত বেরোতে থাকে। কিছুক্ষণ পর তিনি আমার বাম হিপে ইলেকট্রিক শক দেন। এতে আমার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে অনুমান সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে আমার হাতের বাঁধন খুলে দেয়া হয়।

আমাকে বসানো হয় ইলেকট্রিক চেয়ারে। প্রায় আধাঘন্টা পর ফ্লোরে শুইয়ে আমার শরীরে লাঠি দিয়ে পেটাতে থাকেন মেজর রাশীদ ও হুমায়ুন কবির। একই সঙ্গে বুটের লাথি ও কিল-ঘুসি চলে সমানতালে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আমার জ্ঞান ফিরলে আমি বুঝতে পারি যে একটি পরিত্যক্ত রান্না ঘরে আমি খড়ের ওপর পড়ে আছি।

যেখানে পোকা-মাকড় ঘুরে বেড়াচ্ছিল। দুপুর অনুমান দেড়টার দিকে আমাকে উঠে দাঁড়াতে বলেন র‌্যাবের দুই সদস্য। কিন্তু নির্যাতনের ফলে আমি উঠে দাঁড়াতে পারছিলাম না। এসময় ‘অভিনয় করছে শালা’ এই মন্তব্য করে মেজর রাশীদ আমার দু’পায়ের উপরে তার পায়ের বুট দিয়ে খিচতে থাকেন। তিনি বলেন, ‘ব্যাটার মার হয়নি।

শালা অভিনয় করছে। কুত্তার বাচ্চা উঠে দাঁড়িয়ে নিজে নিজে হাঁট। নইলে আরও মারবো। শালা তোকে ক্রসফায়ার দিলে ঠিক হবি। ’ মেজর রাশীদ আমার পায়ে খিচতে খিচতে আমাকে একটি রুমে নিয়ে যান।

বেলা অনুমান দু’টায় আমার মাথা থেকে কালো কাপড়ের টুপি সরিয়ে চোখ থেকে গামছা খুলে দেয়া হয়। এসময় একটি ফরমে নেয়া হয় আমার দুই হাত ও দুই হাতের সব আঙুলের ছাপ। আমার বুকে আমার নাম লিখে ডিজিটাল ক্যামেরায় ছবি তোলা হয়। এরপর পুনরায় গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে আমার মাথায় কালো কাপড়ের টুপি পরিয়ে দিয়ে আমাকে উঠানো হয় একটি মাইক্রোতে। বেলা আনুমানিক তিনটায় আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় বোয়ালিয়া মডেল থানায়।

থানা থেকে র‌্যাব কার্যালয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। থানায় নেয়ার সময় র‌্যাব সদস্যরা আমাকে হুমকি দিয়ে বলেন, ‘থানায় গিয়ে পুলিশের সামনে সোজা হয়ে হাঁটবি। নইলে তোকে আবার ফিরিয়ে আনবো এবং ক্রসফায়ার-এ মারবো। পুলিশ জিজ্ঞাসা করলে বলবি আমাকে মারধোর করা হয়নি। ’ বিকেল অনুমান পাঁচটার দিকে র‌্যাব আমাকে বোয়ালিয়া মডেল থানায় ৫৪ ধারায় হস্তান্তর করে।

এরপর আমার মাথার টুপি সরিয়ে চোখের বাঁধন খুলে দেয়া হয়। পুলিশ সন্ধ্যায় আমাকে জরুরি ক্ষমতা বিধিমালার ১৬ (২) ধারায় রাজশাহীর মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে চালান দেয়। তখন আদালতে ম্যাজিষ্ট্রেট ছিলেন না। আমাকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কারা কর্তৃপক্ষ আমাকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতালের ইমার্জেন্সী ও সার্জিক্যাল ওয়ার্ড-৪ এ ভর্তি করেন।

কারা হাসপাতালে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত আমি চিকিৎসা গ্রহণ করি। কিন্তু পরিপূর্ণভাবে সুস্থ্য হয়ে ওঠার আগেই আমাকে সিভিল ৬ নম্বর ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়। পুলিশ প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে গত ৮ নভেম্বর আমি জরুরি ক্ষমতা বিধিমালার ১৬ (২) ধারা হতে অব্যাহতি পাই। আমাকে গ্রেফতারের মাত্র চার ঘন্টা আগে দায়ের করা দ্বিতীয় চাঁদাবাজি মামলায় আমি রাজশাহী জেলা ও দায়রা জজ আদালত থেকে জামিন পাই। এরই প্রেক্ষিতে গত ২৪ অক্টোবর, ২০০৭ থেকে ১৯ নভেম্বর, ২০০৭ পর্যন্ত রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি থাকার পর গত ১৯ নভেম্বর, ২০০৭ রাত আটটায় কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি লাভ করি।

২০ নভেম্বর আমি আমার মানসিক ও শারীরিক চিকিৎসার জন্য ঢাকায় চলে আসি। আমাকে গ্রেফতারের সময় আমার ভাড়া বাড়ির মালিকের ছেলে লিখন র‌্যাব সদস্যদের হাতে প্রহৃত হন। এরই প্রেক্ষিতে আমি কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় আমার পতœীকে ভাড়া বাসা ছেড়ে দিতে হয়। কারাগারের অপরিচ্ছন্ন-অন্ধকার জীবন থেকে বেরিয়ে আসার পর আমি পক্স এ আক্রান্ত হই। এখন আবার নতুন করে আমার স্কিন ডিজিজ দেখা দিয়েছে।

নির্যাতনের কারণে আমি আগের তুলনায় এখন আমার চোখে কম দেখতে পাই। আমার হাঁটতে অসুবিধা হয়। রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন, তার চাচা নব্য আওয়ামী লীগার মাহফুজুল আলম লোটন এর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, সন্ত্রাস এবং র‌্যাব-৫ রাজশাহীর কয়েকটি বিতর্কিত অপারেশনের কারণে সৃষ্ট গণবিক্ষোভের ঘটনাগুলো নিয়ে আমি একজন সাংবাদিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করি মাত্র। আর এ কারণে রাজনৈতিক নেতা ও র‌্যাবের মেজর রাশীদের যৌথ ষড়যন্ত্রের কারণে আমার নামে মিথ্যা মামলা চাপিয়ে গ্রেফতার ও নির্যাতন করিয়ে আমার জীবনটাকে বদলে দেয়া হলো কেন? আমি যা বললাম, তার একটি কথাও বাড়তি বা মিথ্যা নয়। আপনারাই বিবেচনা, বিচার, বিশ্লেষণ করুন।

শুনেছি আমাকে ক্রসফায়ারে হত্যা করারও সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু জানি না টো কেন করা হয়নি। হয়ত ওটা করলেই আমি ব্যক্তিগতভাবে খুশি হতাম। কারণ যেখানে ন্যায্য, সত্য, সুন্দর নির্বাচিত, দুর্নীতি-সন্ত্রাস-নির্যাতন আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করায় মিথ্যা মামলা, গ্রেফতার, নির্যাতন, বন্দী জীবন ভোগ করতে হয়, যেখানে নেই কোন সুশাসন, প্রকৃত গণতন্ত্র, মানুষের মৌলিক অধিকার সেখানে অযথা বেঁচে থেকে লাভ কি?


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।